'কারেন্টটার এই এখনই যাওয়ার ছিল? ঘন্টায় ঘন্টায় যেরকম কারেন্ট যায়, তাতে কারেন্ট নেওয়ার প্রয়োজনটাই ছিল না। বরং আমার প্রদীপটাই ভাল।'
'যা বলেছো দিদি, প্রদীপ ব্যবহারের কত সুবিধা.....'
লোডশেডিং হওয়াতে সারাদিনের খাটুনিরত গৃহিণীদের সন্ধ্যাকালীন আলাপচারীতা। বাড়িতে আজ এক রকমের উৎসবই চলছে। বাড়ির বড় মেয়ে মাস ছয়েক বাদে শহর থেকে বাড়ি ফিরছে। তাই তাকে নিয়ে সবার একটু মাতামাতি। কয়েকজন ঘনিষ্ঠ নিকটাত্মীয়ও এসেছে।
বারান্দায় প্রদীপটা রেখে খোলা উঠোনে গোল করে পাতা বেঞ্চিতে গিয়ে বসল পরমাদেবী। বিদ্যুতের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধারের জন্য কয়েকটা কটু কথা বললেন। তারই জের ধরে বড়রা, ছোটরা নানারকম মন্তব্য, কটুক্তি আর মাঝে মাঝে দু'একটা গালিও দিচ্ছিল।
এরই মাঝে বিদ্যুৎ চলে এলো। বৈদ্যুতিক বাতির উজ্জ্বল আলোয় তারা তাদের মধ্যে আবিষ্কার করল একজন নতুন মানুষকে। যার পঢ়নে সাদার ওপর লাল সুতোয় নকশা করা শাড়ি, ম্যাচিং ব্লাউজ, কপালে লাল টিপ। হাতের সাথে পেঁচানো বড় ফিতে ওয়ালা ছোট ব্যাগ আর পাশে ট্রলি ব্যাগ।
একমুহূর্তকাল সবাই নিশ্চুপ। এইকি তাদের দীপা? ছ'মাস আগের দীপার সাথে মিল কোথায়? সামান্য একটু সাজে রাতের বেলাতেও কেমন সতেজ, প্রাণচ্ছল আর বুদ্ধিদীপ্ত দেখাচ্ছে।
'আরে! একা এলি যে বড়? তোর দাদাকে যে পাঠালাম স্টেশনে, দেখা হয় নি ওর সাথে?'
'না বৌদিমণি, ট্রেন থেকে নেমে সোজা চলে এসেছি।'
'কী দস্যি মেয়ে হয়েছিস রে বাবা! ভয় করল না?'
'ভয় কেন করবে?'
'কত রকম বাজে লোক রাস্তায় ঘোরে, আর এই রাতে? ভূতের ভয়ও করল না বুঝি?'
'ভূত আবার কী? ভূত তো মানুষই। আচ্ছা, তোমরা কি নিয়ে কথা বলছিলে?'
'কই, কি কথা বলব?'
'আমি এখানে দাঁড়িয়ে তোমাদের কথা অনেকক্ষণ শুনছি।'
এবার সবাই একটু সংযত হল। মনে করতে লাগল অন্যজনের চেয়ে নিজে কম বলেছে কিনা। মনে মনে বলতে লাগল, ছিঃ ছিঃ! কি বিশ্রী ব্যাপার! কেন যে বেমালুম মুখ দিয়ে ওইসব ছাইপাঁশ বের করতে গেলাম। সবাই দীপার কাছে এক বিব্রতিকর অবস্থায় পড়লো।
পরদিন সূর্যের রঙিন আভার সাথে বের হল দীপা। পাখির মত উড়ে উড়ে দেখল নিজের চেনা পরিচিত গ্রামটি। একটু অন্যরকম লাগছে, হয়ত পার্থিক্যটা তার, গ্রামের নয়।
সন্ধ্যায় আবার আগের দিনের মত মজলিশ বসল। মজলিশ বলতে তেমন কিছু নয়। রাতের খাওয়ার আগে টুকিটাকি দু'চারিটি কথা।
সারাদিন ঘুরে ঘুরে গ্রাম, গ্রামের মানুষ, প্রকৃতি সমন্ধ্যে অনেক ধারণা পেয়েছে।
মহিলাকেন্দ্রিক এই গল্পের আসরে আবার উঠে এলো অপরের দোষ, গুন কীর্তনের কাহিনী। খুব অস্বাভাবিক লাগছিল এসব শুনে, অবশেষে সে বলেই ফেলল, 'সামান্য কারণে তোমরা এমন সব কথা বল না। যদি সব ঘটনারই পেছনের কারণ জানতে তাহলে হয়ত এমন কেউ বলতে পারত না। কিন্তু তোমরা কোনো বিষয় জানতেও চাও না, বুঝতেও চাও না।
আবার তোমরা ধর্মভীরু কিন্তু ধার্মিক না। তোমরা চাও সকালে চুলোর ছাই তুলতে, সারাদিন খেটে মরতে আর স্বামীর বকাঝকা আর নির্যাতন সহ্য করতে। প্রতিদিন এই একই রুটিন, ক্লান্তিতে নিস্তেজ হয়ে পরো না?
আচ্ছা, তোমাদের নতুন কিছু করতে ইচ্ছা হয় না? ইচ্ছা হয় না জীবনটাকে রাঙাতে?'
কেউ দীপার কথা বুঝল, কেউ বুঝল না, কেউ অবজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মুখটা বাকাল। আমাদের স্কুল পড়ুয়া বিপাশা কিন্তু ঠিক বুঝে নিয়েছে বড়দিদির সার কথা।
অনেক দিন থেকেই গ্রামীণ মহিলাদের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করছিল দীপা। সফল হবে কিনা সে বিষয়েও সন্দিহান, তবে হঠাৎ করেই উদ্যোগ নিয়ে নিয়েছে দীপা।
পরদিন থেকেই চলল দীপার পরিকল্পনা। নির্যাতিত, অক্ষরজ্ঞানহীন, দরিদ্র মহিলাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য ছোট্ট প্রচেষ্টা।
বাড়ির পুরুষগুলো কাজে বেরিয়ে পড়লে মহিলারা সংসারের কাজ সাঙ্গ করে চলে আসে রিনা মহলে। গ্রামের মহিলারা অনেক নিপূণতার সাথে নকশী কাঁথা, ঝুড়ি, শিকা, টুপি বানাতে পারে। রিনা মহলের বড় উঠোনজুড়ে সবাই গোল হয়ে বসে দীপার কাছ থেকে হাতের কাজগুলো শহরতলীতে পাঠানোর উপযোগী করে তৈরি করা শিখে নিচ্ছে। মায়েদের সাথে মেয়েগুলাও এসেছে। স্কুল পড়ুয়া মেয়েগুলো দীপার কাছ থেকে এটা ওটা জেনে নিচ্ছে। কিশোরীরা মুড়ায় বসে গল্প-উপন্যাস পড়ছে। ছোট ছেলে মেয়েগুলো করছে ছুটোছুটি।
এক সপ্তাহের মধ্যে দীপা এ ছাড়াও আরো অনেক পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। জাগাচ্ছে স্বাবলম্বী হওয়ার ইচ্ছা। ঘুম পারাচ্ছে ভয়-ভীতির বোধকে।
এক সপ্তাহের মধ্যে অনেক মাল উৎপন্ন হয়েছে। শহরের একটা বড় হস্তশিল্পের দোকানের সাথে তাদের উৎপন্ন মালগুলো লেনদেনের ব্যবস্থা হয়েছে। গ্রামের মহিলারা বুঝতে পারল তাদের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। পরিবারে তাদের কর্তৃত্ব এখন অনেকটাই বেড়েছে।
এরই মাঝে কিছু লোকের গায়ে জ্বালা ধরল, বিশেষ করে পুরুষগুলোর। আবার তাদের জ্বালাকে উষ্কে দেয়ার জন্যও তৈরি ছিল একদল মহিলা, যারা অত্যন্ত গোয়ার ও ধর্মভীরু।
পুরুষগুলোর মনে হতে থাকে তারা তাদের কর্তৃত্ব হারাচ্ছে। তখন তারা নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল। কারণে অকারণে গালাগালি করা তাদের মুদ্রাদোষে পরিণত হল।
গ্রামে নেটওয়ার্ক কখনোই ভাল থাকে না। বাড়ির পেছন দিকটায় গেলে ভাল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।
'আচ্ছা দীপা, তুমি কবে আসবে বল তো?'
'এইতো, এদিকে আমার কাজ প্রায় শেষ। ৪-৫ দিনের মধ্যেই শহরে পৌছে যাবো।'
'৪-৫ দিন? তোমাকে না দেখে তো আমার একদম ভাল লাগছে না।'
'মাত্র তো কয়েকটা দিন, তারপরেই.....'
'রাখো তো। তুমি কালই চলে আসবা। তোমার কলেজও তো মিস হচ্ছে, দীপা প্লিজ চলে এসো।'
অল্পকিছু দিনের মধ্যে হয়ে যাওয়া প্রিয় এই মানুষটির সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে বড় পুকুরটার ওধারে চলে এসেছে সে বুঝতেই পারে নি। কেমন গা ছমছমে পরিবেশ। একঝাঁড় বাঁশ, বিভিন্ন রকম আগাছা আর উলুতে ভরা। একটু নড়ে উঠতেই নারকেল গাছটার পেছন দিক থেকে টিমটিমে আলো এসে মুখে লাগল।
উকি দিয়ে দেখল, জনাকয়েক লোক জুয়ো খেলছে। তাদের ঘিরে আরো দুই তিন জন। ভূতের চেয়েও কুৎসিত তাদের দেখতে।
ভয় পাচ্ছে দীপা। ইচ্ছা হচ্ছে এক দৌড়ে বাড়ি ফিরে যায়। চুপি চুপি বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে যাবে, অমনি বাশের কঞ্চিতে বাধা লেগে সাই করে একটা শব্দ হল। ততক্ষণে জুয়াড়িরা সব উটে দাঁড়িয়েছে। দীপা তখনও সেখানে স্থানুর মত দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।
কিম্ভুত গোছের একটা লোকের সাথে চোখাচোখি হল দীপার। শিরদাঁড়া ঠান্ডা পরশ বেয়ে গেল, গলগল করে ঘামতে শুরু করেছে। হৃদপিণ্ডের আওয়াজকে ঢাকের আওয়াজের মত মনে হচ্ছে। কিঞ্চিৎক্ষণ সবকিছু নিশ্চুপ, তারপরেই হুটোপুটি।
ঘন জঙ্গলের মধ্যে ১০ সেকেন্ডের বেশি দৌড়াতে পারল না দীপা, লতায় পা জড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেল। হিংস্র প্রাণীগুলোর দাঁত চোরা হাসিতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। খুব ইচ্ছা করল প্রাণপণে কয়েকটা চিৎকার দ্যায়, কিন্তু চিৎকারগুলো দৈত্যের মত হাতের মাঝে নিঃশেষ হয়ে গেল। সেই সাথে নিভে গেল এক দেদীপ্যমান শিখা।
২৮ জানুয়ারী - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪