'এই যে ভাই শুনছেন, ফরাশপুর কোথায় বলতে পারেন?
'চাঁদপুর, গোপালপুর, মেদিনীপুর কোথায় তা বলতে পারি। ফরাশপুরটা কোথায় ভাই?'
যাব্বাবাহ! এ যে আমাকেই উল্টো প্রশ্ন করে! গ্রাম গঞ্জের মানুষজন আজকাল অনেক স্মার্ট হয়ে গেছে। আগে শহর থেকে কেউ এলে গ্রামের লোকজন দল বেঁধে দেখতে আসতো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতেই থাকতো।
শহরের লোকদের সবকিছুতেই তাদের বিস্ময় জাগতো। তাদের পোশাক, চালচলন, কথা বলা...মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখতো সবাই। ছোট বেলায় যখন দাদাবাড়িতে বেড়াতে যেতাম, নিজেদের কেমন যেন রাজা বাদশা বলে মনে হতো। আমার বয়সী ছেলেদের একটা দল অল্প সময়ের ভেতরেই আমাকে ঘিরে ফেলে দিতো। ভাতের গ্রাস তোলা থেকে শুরু করে জামা কাপড় পাল্টানোর সময়ও এদের হাত থেকে মুক্তি মিলতো না। আমি যেন চিড়িয়াখানার এক নতুন প্রজাতি। আমার সবকিছুই দেখার মতো।
সেই দিন অনেক আগেই শেষ। এখন গ্রামে ডিশ এ্যান্টেনা এসেছে। গ্রামের হাটে-বাজারেও হিন্দি গান বাজে। গ্রামের মেয়েরা সিরিয়াল দেখে দেখে সিরিয়ালের নায়িকার মত জামা বানায়, সাজগোজ করে। সুতরাং শহর থেকে কেউ এলে এখন আর চোখ উল্টিয়ে দেখার কিছু নাই।
তারপরও আমি একটু বিশেষ মনোযোগ আশা করেছিলাম। আমার হাতে অনেক কায়দা করে একটা লেটেস্ট মডেলের জুম করা বিশেষ ক্যামেরা ধরে রেখেছি। মাঝে মাঝে সুবিধামত জুম করে এদিক ওদিকের ছবিও তুলে চলেছি।
কয়েকটা স্কুলগামী মেয়েকে দলবেঁধে স্কুলে যেতে দেখে অনুমতির তোয়াক্কা না করে ক্যামেরা তাক করলাম। মেয়েগুলো এমন একটা চাহনী দিল যে, আরেকটু হলে ক্যামেরাটাই পড়ে গিয়েছিল হাত থেকে। বুঝলাম আমার এই ক্যামেরার ফুটানি দেখিয়ে বিশেষ সুবিধা করতে পারবো না। অতএব আসল কাজে মন দিলাম। যে জায়গার উদ্দেশ্যে এসেছি সেটাই বরং খোঁজা যাক।
আমাকে তো এই ঠিকানাই দেওয়া হয়েছে!
বলা হয়েছে, সদরের বাসস্ট্যাণ্ডে নেমে লোকাল যেকোন বাসে উঠে পড়লেই হবে। বলতে হবে হালি'র মোড়ে নামবো। সদর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটারের মতো দূর হবে। বাসে উঠলে বড়জোর চল্লিশ মিনিটের মতো লাগবে। রাস্তাঘাট একেবারেই নির্জন। যানজটের প্রশ্নই নাই। এ পর্যন্ত ঠিকঠাক মিলে গেছে। পুরো রাস্তা আশ্চর্য রকম ফাঁকা। হঠাৎ সঠাৎ একটা দুটো বাস কিংবা ভ্যানের দেখা পাওয়া গেছে মাত্র।
বাস থেকে নেমে অবধি একে ওকে জিজ্ঞাসা করে চলেছি। কিন্তু কেউ আমাকে ফরাশপুরের খোঁজ দিতে পারলো না। শেষমেষ যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিতে যাচ্ছি, এক মাঝবয়সী সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। বয়স আনুমানিক সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ হবে। খুব সাধারণ কিন্তু পরিপাটি বেশবাস। পায়ে চটি স্যান্ডেল। হাতে একটা খবরের কাগজ। কৌতুহলী মুখে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। মুখে মৃদু হাসি।
‘জনাব বুঝি ঢাকা থেকে এসেছেন?’
‘জি, ভাই। এক জায়গার খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছি। ঠিকানা তো এটাই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেউ তো ফরাশপুরের নামটাও শোনেনি।’
‘আপনি সঠিক জায়গাতেই এসেছেন। যাদের জিজ্ঞেস করছেন, আসলে এই নামটি তাদের অবগতিতে নেই। নামটি কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। নদীর গর্ভে যেমন পুরনো এলাকা বিলীন হয়ে নতুন চর গজিয়ে ওঠে, অনেকটা তেমনই।’
আমি ভদ্রলোকের বাচনভঙ্গিতে অবাক হলাম। পাড়াগাঁয়ের লোকের কথা বলে মনে হয় না। বেশ আকর্ষণীয় একটা ভঙ্গিতে ভদ্রলোক বলতে থাকেন,
‘এখানকার লোকজনের কাছে এই জায়গার নাম কাদিরগঞ্জ। তা, আপনি কার কাছে এসেছেন?’
‘ভাই, আমি পত্রিকা অফিসে চাকরি করি। একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নিউজ কাভার করতে এসেছি। সামনে একুশে ফেব্রুয়ারী।
আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনে এদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান আছে। এই বছর সরকার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা এসব ভাষা সৈনিকদের আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার একটা মহতী উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন। একই সাথে তাদের পুরষ্কৃতও করা হবে। পুরষ্কার বাবদ একটা মোটা অংকের অর্থ প্রদান করা হবে। তাদের অথবা তাদের কোনো উত্তরাধিকারির হাতে এই পুরষ্কার তুলে দেওয়া হবে।
আমাদের কাছে খবর আছে, এই অঞ্চলের জনাব ফরাশউদ্দীন একজন ভাষাসৈনিক ছিলেন। তার নামেই এই অঞ্চলের নাম রাখা হয়েছে ফরাশপুর।’
ভদ্রলোক মৃদু হাসলেন।
‘কোথা থেকে যে কী খবর পান ভাই! তবু এতো কষ্ট করে এসেছেন যখন, আসুন আপনাকে এলাকাটি ঘুরিয়ে দেখাই।’
আমার মেজাজ তখন সপ্তমে। এতো ঝামেলা করে, সহকর্মী আবীরের সাথে একরকম গ্যাঞ্জাম করে এসাইনমেন্টটা হাতে নিলাম। এখন কিসের কী! ঘুরে ঘুরে এই অজ পাড়া গাঁ দেখবো!
বেশি মেজাজ খারাপ হলো প্রতিবেদক মিথুনদা’র ওপর। ঠিক মতো খোঁজ খবর না নিয়েই আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিলেন!
ফিরতি বাস ধরবো কিনা ভাবছি। ভদ্রলোক আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেই যেন বললেন,
‘এত দূর থেকে এসেছেন। তাছাড়া আপনি আমাদের গ্রামের অতিথি। অন্ততঃ দুপুরের খানাটা আমার বাসায় খেয়ে যান। আর...যে ফরাশউদ্দীনকে আপনি খুঁজছেন, তিনি এই গ্রামেই জন্মেছিলেন। আজ বেশ অনেক বছর হলো তিনি জীবিত নেই।’
আমি ভদ্রলোকের হেঁয়ালিতে আরো বিরক্ত হলাম। একবার বলছেন এটা, আরেকবার ওটা। কোনটা বিশ্বাস করবো?
তবে তার প্রস্তাবটা ভেবে দেখার মতো। সেই সাত সকালে বেরিয়েছি। খিদের চোটে পেটে ইঁদুরের বুকডন টের পাচ্ছি। এই অজ পাড়া গাঁয়ে কোন হোটেল টোটেল তো আর পাবো না। অগত্যা বিরসমুখে ভদ্রলোকের পিছু নিলাম। তাছাড়া ভদ্রলোককে বেশ ইণ্টারেস্টিং ক্যারেক্টার মনে হচ্ছে। যেতে যেতে একটা কিশোরকে ডেকে বাসায় গিয়ে রান্না বসানোর কথা বলে আসতে বললেন। আরো বললেন, মাকে গিয়ে যেন বলে যে সাথে মেহমান আছে। বুঝলাম তার ছেলে।
‘আপনি যদি খুব ক্লান্ত না হয়ে থাকেন, আমার ছোট স্কুলটা আপনাকে দেখাতাম। আমার ছাত্ররা আপনার কাছে থেকে অনেক কিছু শিখতে পারতো।’
‘বেশ তো, চলুন দেখা যাক।’
এসব নতুন অভিজ্ঞতা নয়। পত্রিকা অফিসে চাকরি করি শুনলেই মানুষজন আলগা তোয়াজ শুরু করে দেয়। এটা ওটা দেখিয়ে শেষে আসল কথা পাড়ে।
পত্রিকাতে যেন বিষয়টা নিয়ে লিখি। সবার একটা ধারণা আছে যে, একবার পত্রিকাতে খবর প্রকাশিত হলেই আর দেখতে হবে না। হুড়হুড় করে সাহায্য আসা শুরু হবে। বিষয়টা যে মোটেও তা নয় এটা পাবলিককে বুঝিয়ে লাভ হবে না। অতএব আমিও ‘নাই কাজ তো খই ভাজ’ এমন একটা ভাব নিয়ে স্কুল দেখতে রওয়ানা হলাম।
বেশ অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে, বাঁশের সাকো পার হয়ে পৌঁছলাম ভদ্রলোকের স্কুলে। উনার নামটাও এখনো জানা হয়নি। আমি খানিকটা লজ্জিত হলাম।
‘ভাই, আপনার নামটাই তো জানা হলো না। আমার নাম সায়েম।’
ভদ্রলোক লাজুক বিনয়ী হাসি দিলেন।
‘আমার নাম পরিচয় জেনে কী করবেন? ছোটখাট মানুষ আমি। পরিচয় দেবার মতো তেমন কিছুই নাই। এখানকার স্কুলে ছাত্রদের পড়াই। লোকে আমাকে ফরাজ মাষ্টার নামে চেনে।’
‘স্কুলটা কি সরকারি?’
‘জি না, সরকারি না। স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা জনাব ফরাশউদ্দীন। তারই উদ্যোগে প্রায় চল্লিশ বছর পূর্বে স্কুলটার জন্ম হয়। শুরুতে মাত্র পাঁচজন ছাত্র ছিল। আমি নিজেও সেই পাঁচজন ছাত্রের একজন।’
আমি উৎসাহ বোধ করতে শুরু করলাম। যে উদ্দেশ্যে এসেছি তা একেবারে বৃথা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। ফরাজ মাষ্টার বলেন,
‘ফরাশউদ্দীন এই গ্রামের প্রথম গ্র্যাজুয়েট।
সেই সময়ের গ্র্যাজুয়েট মানে বুঝতে পারছেন? বিশাল ব্যাপার! শিক্ষার প্রতি, মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগ তার রক্তে বাহিত ছিল। ভাষা আন্দোলনের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন।
সেই সময় তার বয়স ছিল একেবারেই অল্প। সবে কলেজে ভর্তি হয়েছেন। গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়েছেন পড়তে। সেখানে গিয়েই ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হন। আমাদের গ্রামে ভালো মানের স্কুল তো দূরের কথা, তেমন কিছুই ছিল না পাঠগ্রহণের মতো। ফরাশউদ্দীনের মতো দু’একজন যারা লেখাপড়ার সাথে নিজেকে জড়িত করতে পেরেছিলেন তারা পাশের গ্রামের স্কুলে যেতেন। এখান থেকে প্রায় ছ’সাত ক্রোশ দূরের পথ। প্রতিদিন এতটা পথ পায়ে হেঁটে তারা শিক্ষার অন্বেষণে যেতেন।
এই স্কুলটি ফরাশউদ্দীনের অনেক স্বপ্নের ফসল।’
আমি ভদ্রলোকের কথা যত শুনছি ততই অবাক হচ্ছি। গ্রামের একজন স্কুলশিক্ষকের চেয়ে অনেক বেশি পরিশীলিত আর মার্জিত তার কথা বলার ধরন।
‘এই জায়গার নাম সংক্রান্ত বিবাদটা তো ঠিক বুঝলাম না। আমি তো জানতাম এই জায়গার নাম ফরাশপুর। আপনি বলছেন কাদিরগঞ্জ।’
ফরাজ মাষ্টার মৃদু হাসলেন।
‘এসেছেন যখন চক্ষু কর্ণের বিবাদ খুব শীঘ্রই ভঞ্জন হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না। আসুন আপনাকে স্কুলটা দেখাই। আমরা গ্রামের লোক। শহরের লোকজন দেখলে ভালো লাগে।’
আমি ঘুরে ঘুরে স্কুলটি দেখতে লাগলাম। জুম ক্যামেরা দেখিয়ে গ্রামবাসীকে বিস্মিত করতে চেয়েছিলাম। এবার আসল বিস্ময়ের পালা আমার। এরকম একটা পাড়া গাঁয়ে এমন একটা স্কুল দেখবো এ আমার কল্পনাতেই ছিল না।
স্কুলটা পুরোটাই মাটির। উপরে টিনের চালা দেওয়া। যা দেখে আমি মোহিত হয়েছি তা হচ্ছে স্কুলটার সামগ্রিক সাজসজ্জা।
আমাদের দেশের ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ গুলো ছবির মাধ্যমে বেশ যত্নের সাথে পুরো স্কুলের ক্লাস রুমের দেওয়াল গুলোতে এঁটে দেওয়া। ছবিগুলো যাতে কোনো কারণে নষ্ট না হয়ে যেতে পারে সেজন্য প্লাস্টিক দিয়ে মুড়িয়ে বিশেষপদ্ধতিতে ঝুলিয়ে রাখার ব্যাবস্থা করা হয়েছে দেওয়ালের সাথে। গ্রামাঞ্চলে যতোটুকু টেকনিক্যাল জ্ঞান প্রয়োগ করা সম্ভব পুরোটাই করা হয়েছে আর কী!
প্রতিটি ছবির নীচে ছোট আকারে ছবির ঘটনাপ্রবাহ বর্ণণা করা হয়েছে। ভদ্রলোক আমাকে গোড়া থেকে দেখিয়ে চললেন।
প্রথম ছবিটি ১৯৪০ সালের ‘লাহোর প্রস্তাব’। ছবির নীচে লেখা, ‘এই প্রস্তাবে ঠিক করা হয়েছিল ভারতবর্ষের যে অঞ্চলগুলোতে মুসলমান বেশি, সেরকম দুটি অঞ্চলকে নিয়ে দুটি দেশ এবং বাকি অঞ্চলটিকে নিয়ে আর একটি দেশ তৈরি করা হবে।’
তার পাশের ছবিটি ‘১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ’। নীচে লেখা, ‘১৪ই আগস্ট যে এলাকা দুটিতে মুসলমানরা বেশি সেই এলাকা দুটি নিয়ে দুটি ভিন্ন দেশ না হয়ে পাকিস্তান নামে একটি দেশ এবং ১৫ই আগস্ট বাকি অঞ্চলটিকে ভারত নামে অন্য একটি দেশে ভাগ করে দেয়া হলো। পাকিস্তান নামে পৃথিবীতে তখন অত্যন্ত বিচিত্র একটি দেশের জন্ম হলো, যে দেশের দুটি অংশ দুই জায়গায়।’
তারপরে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু বিচ্ছিন্ন ছবি তুলে ধরা হয়েছে। তাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, ‘বিভেদ, বৈষম্য, শোষণ আর ষড়যন্ত্র’ নামে। নীচে লেখা, ‘পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে শুধু যে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব ছিল তাই নয়, মানুষগুলোর ভেতরেও ছিল এক সুবিশাল দূরত্ব। তাদের চেহারা, ভাষা, খাবার, পোশাক, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সবকিছুই ছিল ভিন্ন, শুধু একটি বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষগুলোর মাঝে মিল ছিল। আর তা হচ্ছে ধর্ম।’
এরপরের অনেকটা দেওয়াল জুড়ে বড় করে দেওয়া হয়েছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ছবি, ‘১৯৫২’র ভাষা সংগ্রাম’ নামে। সুবিস্তারে লেখা হয়েছে, ‘অর্থনৈতিক নিপীড়নের চেয়েও অনেক বড় নিপীড়ন হচ্ছে একটি জাতির ভাষা, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের ওপর নিপীড়ন আর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ঠিক সেটিই শুরু করেছিল। পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৭ সালে আর ঠিক ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা এসে ঘোষণা করলেন উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সাথে সাথে পাকিস্তানের বাঙালিরা তার প্রতিবাদ করে বিক্ষোভ শুরু করে দিল। আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল।’
এরপরে আরো আছে ১৯৫৬ সালে বাংলাকে স্বীকৃতি প্রদান, ১৯৫৮ সালের আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম। ছবি এবং বিস্তারিত তথ্য দিয়ে দেশের ইতিহাস কে এমন চমৎকার করে সাজিয়ে ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন সত্যিই প্রশংসার দাবীদার।
আমার হাত আপনা থেকেই চলে এলো ক্যামেরার শাটার বাটনে। একনাগাড়ে কতোক্ষণ ধরে যে ছবি তুললাম নিজেও জানি না। ছবির নীচে কাগজের লেখাগুলো হলদেটে বিবর্ণ হয়ে গেছে। ফরাজ সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘আচ্ছা, এই ছবিগুলোর নীচের লেখাগুলো কি জনাব ফরাসউদ্দীনের নিজের হাতে লেখা?’
‘জি, জনাব। এই স্কুলটি ছিল উনার প্রাণ। নিজে যত্ন করে এর প্রতিটি দেওয়াল তিনি সাজিয়ে তুলেছেন। আসুন, আপনাকে স্কুলের লাইব্রেরিটা দেখাই।’
‘এই স্কুলের লাইব্রেরিও আছে নাকি?’ আমি সবিস্ময়ে জানতে চাইলাম।
‘ঐ আছে আর কী একটা! না থাকার মতোই।
ফরাশউদ্দীন যেখান থেকে যতোরকম বইপুস্তক পেতেন সব সংগ্রহ করতেন। নানারকম পত্র-পত্রিকার কপি। হাতে লেখা কাগজ, ব্যানার। আসুন, এলেই বুঝতে পারবেন।’
আমি ফরাশউদ্দীনের সংগ্রহ দেখে বিস্ময়ে একেবারে বোবা হয়ে গেলাম। এটাকে লাইব্রেরি না বলে জাদুঘর বা গবেষণাগার বললেও কিছু কম বলা হবে না। ছোট একটা কক্ষ। তাতে দুটো বড় পুরনো জং ধরা স্টিলের বুকশেলফে ঠাসাঠাসি করে রাখা নানা আকৃতির বই, পত্রিকা। বহু ব্যবহারে সেগুলো জরাজীর্ণ। সবচেয়ে দামী সংগ্রহ হচ্ছে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের সময়কার কিছু পত্রিকার কপি। সেগুলো প্লাস্টিকের মোড়ক দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। এমনকি ভাষা আন্দোলনের সময় ব্যবহৃত কিছু হাতে লেখা কাগজের ব্যানার, প্ল্যাকার্ড পর্যন্ত রাখা আছে।
বলাই বাহুল্য, অত্যন্ত দামী সংগ্রহ। এরকম সংগ্রহের খবর প্রচারিত হলে এই স্কুল এমনকি এই গ্রামের যে কী পরিমাণ ঐতিহাসিক মূল্য নির্ধারিত হবে তা সহজেই অনুমেয়। আমি দেখা শেষ হলে বললাম,
‘এ তো দারুণ ব্যাপার! এই সংগ্রহের খবর কোথাও প্রকাশিত হয়নি? জাতীয় ভাবেও এই সমস্ত জিনিস সংগ্রহ করার কথা। এগুলো কী না এভাবে প্রচারের আড়ালে অন্ধকারে পরে আছে! আর তাছাড়া স্কুলটি পাকা করার জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি?’
ফরাজ মাস্টার মৃদু হাসলেন।
‘এই যেমন আজ আপনি ফরাশউদ্দীনের খোঁজ করতে করতে আমাদের গ্রামে চলে এলেন, তেমনি আরো অনেকেই অনেক সময় এসেছে। সকলেই স্কুলটি দেখে আকৃষ্ট হয়েছে। শুনেছি কিছু আর্থিক বরাদ্দও নাকি স্কুলটার নামে করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো এই স্কুল পর্যন্ত আসতে পারেনি।’
আমি অবাক হলাম। সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কেন? স্কুল পর্যন্ত আসতে বাধা কোথায়?’
‘সব কেন’র কী উত্তর হয় জনাব? এখন এসব কথা থাক। অনেকক্ষণ যাবত এসেছেন। চলুন, এই গরীবের বাড়িতে একটু আহার গ্রহণ করবেন।’
ফরাজ মাস্টারের কথা শেষ হতে না হতেই স্কুলের বাইরে একটা আলোড়ন শোনা গেল।
দেখলাম, এক বিরাট লটবহর। জনা বিশেক লোক সমেত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেব উপস্থিত হলেন। তার মাথায় দুজন ছাতা ধরে আছে। তিন চারজন আশেপাশে একরকম হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। যাকে বলে, একেবারে এলাহি কারবার! চেয়ারম্যান সাহেব নিজের পরিচয় দিয়ে ফরাজ মাস্টারকে একরকম ধমকের সুরে বললেন,
‘কী হে মাস্টার মশাই! উনাকে কি আদর আপ্যায়ন কিছু করেছেন নাকি শুকনো মুখে স্কুল দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন?’
তারপর আমাকে বা ফরাজ মাস্টারকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমাকে একরকম জোর করেই নিয়ে চললেন তার সাথে। তার সাথে ‘ডাল ভাত’ আহার করার আমন্ত্রণ জানিয়ে। আমি মৃদু আপত্তি জানানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তা ধোপে টিকলো না।
মনটা একটু খারাপ হলো। সেই সকাল থেকে যিনি এতক্ষণ ধরে আমাকে সঙ্গ দিয়ে চললেন এবং নিজের বাসায় রান্নারও আয়োজন করালেন তাকেই আপ্যায়ন করার সুযোগ দেওয়া হলো না।
চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,
‘আপনার আসার উদ্দেশ্য জানতে পেরেছি। অতি আনন্দের খবর। আমাদের কাদিরগঞ্জ গ্রামের জন্য এ তো বিপুল আনন্দের সংবাদ! আমরা আমাদের গ্রামে ফরাশউদ্দীনের একটা আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করার চিন্তাভাবনা করছি। এই জন্য অনেক অর্থেরও প্রয়োজন। এই পুরষ্কার বাবদ প্রাপ্ত অর্থ এই কাজেই ব্যয় করা হবে। মূর্তি নির্মাণ অতি আবশ্যক। গ্রামের সম্মান তিনি। তার মূর্তি স্থাপন করেই তাকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা সম্ভব।’
তারপর গলাটা একটু নামিয়ে বললেন
‘আপনাকে কি ফরাজ মাস্টার কিছু বলেছে নাকি? এই যেমন পুরষ্কারের টাকা কী করা হবে এই ব্যাপারে?’
‘কই, না তো! উনি তো আমাকে কিছুই বলেননি!’
‘তাহলে ঠিক আছে। বাইরে থেকে কেউ আসলে তাকে স্কুল দেখানোর কী মানে আছে? জনাব ফরাশউদ্দীন এই গ্রামের গর্ব। গ্রামের প্রয়োজনে তিনি একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, সেখানে ছেলেপেলে শিক্ষা গ্রহণ করবে... সেটা ঠিক আছে। কিন্তু একটা স্কুলকে জাদুঘরের মতো করে দেখানোর কী আছে বলুন দেখি! মাথামোটা লোকজনের কারবার সব!’
আমি কিছু বললাম না। নীরব থাকাই যুক্তিযুক্ত মনে হলো। তাছাড়া সব চিকন মাথায় সবকিছু ঢুকবেও না।
দুপুরে রাজকীয় খাওয়া দাওয়া সারলাম। আমার আসার খবর জেনে ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেব দরাজ গলায় বললেন,
‘ভাষার জন্য আমাদের এই গ্রাম বিখ্যাত! আমার বাবা জনাব কাদির আলী ফরাশউদ্দীনকে বিশেষ সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। তার সাহায্য ছাড়া এই গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো না। যে জমিতে তিনি স্কুল স্থাপন করেছিলেন সেটি আমার বাবারই দেওয়া। কাজেই সেই হিসেবে এই স্কুলের কৃতিত্ব আমার বাবা জনাব কাদির আলীর উপরও বর্তায়। আমাদের এই গ্রামের নামকরণও তার নামেই করা হয়েছে।’
বিকেল হয়ে আসছে। আমার কাজ মোটামোটি শেষ। জিজ্ঞেস করলাম,
‘পুরষ্কার আনতে কে যাবে?’
চেয়ারম্যান সাহেব তেল চকচকে মুখে বললেন,
‘গ্রামের চেয়ারম্যান হিসেবে তো আমারই যাওয়া উচিত, কী বলেন?’
আমি ফেরার অনুমতি চাইলাম। বেশি দেরি করলে বাস পেতে সমস্যা হয়ে যাবে। চেয়ারম্যান সাহেব তার দুজন বিশ্বস্ত লোককে আমার সাথে পাঠালেন বাসে তুলে দেওয়ার জন্য।
বাসে ওঠার আগমুহূর্তে মনে হলো, ফরাশউদ্দীনের একটা ছবি নিয়ে আসতে হতো। চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে আবার ফিরে যাবো কীনা ভাবছি, এমন সময় একটা ছোট ছেলে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসে একটা চিঠি ধরিয়ে দিলো হাতে।
ফরাজ মাস্টারের লেখা।
‘জনাব,
কিছু মনে করবেন না। আপনাকে আপ্যায়ন করতে পারলাম না। খালি মুখেই স্কুল দেখালাম। পারলে অধমকে ক্ষমা করে দেবেন।
আপনি একটি কথা জিজ্ঞেস করছিলেন, বরাদ্দ কৃত অর্থ স্কুল পর্যন্ত আসে না কেন?
জনাব, আপনি বিজ্ঞ মানুষ। সব কথা কী বুঝিয়ে বলতে হয়? এই পর্যন্ত যখনই কোনো অর্থ সাহায্য বা এই জাতীয় কিছু এসেছে তা জনাব ফরাশউদ্দীনের আবক্ষ মূর্তি স্থাপনে ব্যয় করা হয়েছে। যদিও সেই মূর্তিটা কোথায় নির্মিত হচ্ছে তা আজ অবধি গ্রামের লোক জানতে পারে নাই। সে যাক, মূর্তি হয়ে স্মৃত হবার জন্য তো সব মানুষের জন্ম হয় না। কিছু মানুষ জন্ম নেয় আরেক প্রজন্মের কাছে নিজের ইতিহাসকে তুলে ধরার জন্য। পৃথিবীর আগামীর পথকে সুগম করার জন্য অতীতের স্বপ্নগুলোকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। তারা স্বপ্নচারী মানুষ। স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখাই তাদের আমরণ সংগ্রাম।
আপনার পত্রিকার জন্য যদি প্রয়োজন হয়, তাই ফরাশউদ্দীনের একটা ছবি দিলাম। ছবিটা ফটোকপি করা। খুব বেশি ছবি তো নাই যে অরিজিনালটা দিবো। আমার বাবা বেশি ছবি তুলতেন না।
জি হ্যাঁ, জনাব ফরাশউদ্দীন আমার বাবা। পরিচয়টা আগেও দিতে পারতাম, কিন্তু তাতে জটিলতা হতে পারে ভেবে আর দেইনি।
আমি তার অযোগ্য পুত্র। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, একদিন ভাষার জন্য মানুষের এই অবদানের কথা গ্রামের প্রতিটি শিশু-কিশোর আগ্রহ নিয়ে জানবে। ভাষার প্রতি এই ত্যাগটাকে তারা অনুধাবন করবে এবং তা থেকে জন্ম নেবে ভাষার প্রতি ভালোবাসা।
আমি তার রেখে যাওয়া স্কুলটাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছি মাত্র। কারণ এই স্কুলটি না বাঁচলে ফরাশউদ্দীনের স্বপ্নের মৃত্যু হবে, এবং সেই সাথে মৃত্যু হবে ভাষার জন্য পরিচিত একটি গ্রামের। যে গ্রামটিতে প্রতি বছর একবারের জন্য হলেও কেউ না কেউ এসে ঘুরে যান।
তবু তো আসেন! আমাদের সামান্য গ্রামটির কিছু অসামান্য উদ্যোগের গল্প আমরা গর্বভরে তাদের কাছে বলতে পারি। ভাষার জন্য আমাদের কাছে সঞ্চিত কিছু টুকরো ভালোবাসা তাদের দেখাতে পারি। আমরা প্রতি বছর তাদের আগমনের অপেক্ষায় থাকি।
সামনের বছর আবার আসবেন। অপেক্ষায় থাকবে ফরাশউদ্দীনের গ্রাম।
ইতি
ফরাজ মাস্টার’
আমি বাসে উঠে অপেক্ষা করতে লাগলাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার জন্য।
ফরাজ মাস্টার আমাকে বেশ গুরু দায়িত্ব দিয়েছেন। ভাষার জন্য পরিচিত একটি গ্রামকে সবার সামনে তুলে নিয়ে আসার দায়িত্ব। বছরে একবারের জন্যই পালন করা।
...তবু তা যেন যথাযোগ্যভাবে হয়।