এক
সেই ছোট্টবেলা থেকেই অন্ধকারকে ভীষণ ভয় পেতাম আমি।
আমার নিজস্ব এক ভীতিময় সম্পর্ক জুড়ে ছিল অন্ধকারের সাথে। এর কারণ অথবা উৎপত্তি যে কী থেকে হয়েছিল, তা কেউ জানতো না।
ছোটবেলায় আমার মা, আমার এই আঁধার ভীতি দূর করার অনেক চেষ্টা করেছিল। মা যখনই সময় পেত, আমাকে নানারকম সাহসী হওয়ার গল্প শোনাতো। আমার ভেতরের এই ভয়টাকে চিরতরে মুছে দিতে চাইতো।
অনেকসময় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বাগে আনতে কেউ কেউ অন্ধকার ঘরে আটকে রাখে, অথবা আঁধার কালো রাতের বিভীষিকাময় গল্প শোনায়। আমার কাছে কেউ যাতে এমন কোনো গল্প বলতে না পারে, সেদিকে মার ছিল সজাগ দৃষ্টি। আর অন্ধকার কোন জায়গায় আমাকে আটকে রাখার তো প্রশ্নই আসে না। মা’র আমাকে নিয়ে ভালোই হ্যাপা পোহাতে হতো। আমি যাতে রাতে কখনো ঘরে একা না থাকি, সেদিকে মা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতো।
হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে অথবা কোন কারণে ঘর অন্ধকার হয়ে গেলে আমি হিস্টিরিয়া রোগীর মতো অসাড় হয়ে যেতাম। গলা দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ বের হতো। মা যেখানেই থাকুক না কেন, ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরতো। বাড়ির অন্যরাও আমার এই বাড়াবাড়ি রকমের অন্ধকার ভীতিতে ভীষণ উদ্বেগে থাকতো সবসময়।
অথচ এই আমার, এমন তীব্র অন্ধকার ভীতিটা একদিন চিরতরে দূর হয়ে গিয়েছিল। সে গল্পই আজ বলতে যাচ্ছি।
আমার দাদার বাবা অর্থাৎ আমার প্রপিতামহ ছিলেন জমিদার। আমাদের বাড়িটা ছিল ছোট এক জেলার প্রায় অখ্যাত এক অঞ্চলে। অবশ্য একেবারে অখ্যাত বলা যাবে না। আমার প্রপিতামহের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আমাদের বিশাল বাড়িটির কারণেই এই অঞ্চলটি আশেপাশে বেশ পরিচিত ছিল। সেই সাথে তার দৌর্দণ্ড প্রতাপের নানারকম খ্যাতি অখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।
বিশাল প্রাচীর ঘেরা আমাদের এই জমিদার বাড়িটি ছিল দেখার মতো। চারপাশে পরিখার মতো ঘিরে ছিল বড় বড় দীঘি। সেগুলোর বেশিরভাগই অবশ্য পানা জমে অচল হয়ে পড়েছিল। এত দেখাশোনার লোক কোথায় যে পুকুরের পানা পরিষ্কার করবে? গাছ-গাছালীর অন্ত ছিল না। ফল-ফলাদি থেকে শুরু করে ছিল নানাজাতের কাঠের গাছ। সেসব গাছের ফল কখনো আমরা একা খেয়ে ফুরোতে পারতাম না। পাড়া প্রতিবেশিরা দেদারসে ভাগ পেতেন।
বাড়িটার স্থাপত্যনকশা দেখে কারো চোখ যেন সরতে চাইতো না। বিশাল সিংহ দুয়ারে একসময় নাকি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাইক পেয়াদা দাঁড়িয়ে থাকতো। এখন লাঠি হাতে দিনুচাচাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়।
আমাদের বিশাল বাড়িটি দেখতে প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসতো। বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে দিনু চাচা বলতো,
‘আর কী দেখবে বাপু, পুরনো বাড়িঘর? আর কী দেখবার বাকী আছে? সবকিছুই তো এখন প্রায় খসে পড়েছে। যেটুকু টিকে আছে, খোকাবাবুরা তাতে কোনোরকমে দিনাতিপাত করছেন। তোমরা কেন বাপু রোজ রোজ তাদের এমন বিরক্ত করতে আসো?’
কেউ কেউ বুঝতো। ঘাড় নেড়ে সায় দিতো,
‘হুম, তা তো বটেই! আসলেই তো! আর কী ই বা আছে এখন দেখবার? সেই জমিদারই বা কই আর তার জমিদারীই বা কোথায়?’
কেউ কেউ মোটেই বুঝতে চাইতো না। ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকতো। ঘন ঘন মাথা নেড়ে অনুনয়ের সুরে বলতো,
‘বেশি না, একটিবার দেখেই চলে যাবো। এত বড় জমিদার ছিলেন একসময়। কত নামডাক শুনেছি!’
দিনু চাচা পুরনো মানুষ। আমার বাবাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন। বাবা তাকে ‘চাচা’ ডাকতো। ছোট থেকে শুনে শুনে আমিও তাকে চাচা বলেই ডাকতাম। সম্বোধনটা আমার কাছে এসে আর ‘দাদু’ হয়ে যায়নি।
দিনু চাচার মুখে আমি রোজ ভরদুপুরে এই বিশাল জমিদার বাড়িটার গল্প গাঁথা শুনতাম। দিনুচাচা প্রথমেই আমাকে মন্ত্র পড়িয়ে নিত,
‘আগে বল তো দাদাভাই, ভয় পাবে না তো! তাইলে কিন্তু বউমা আমাকে বকেঝকে কিছু রাখবে না বলে দিচ্ছি!’
সে কথার কথা! মা দিনুচাচাকে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করতো। মা আর বাবার শ্রদ্ধা ভক্তিতে আমার কখনো মনেই হয়নি, দিনুচাচা এ’বাড়ির একজন সামান্য কাজের মানুষ। আমার দাদা তাকে পাশের গ্রাম থেকে জোগাড় করে নিয়ে এসেছিলেন। সে গল্পও দিনুচাচার মুখে অনেক শুনেছি।
‘সে বছর গাঁয়ে মড়ক লাগলো গো দাদাভাই। সে কী ভয়ানক মড়ক! গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যায় এমন মড়ক। আমার বাবা গেল, মা গেল...ছোট ভাইটাও গেল। শুধু হাড় জিরজিরে শরীর নিয়ে আমি কোনমতে টিকে রইলাম।
তোমার দাদা, আমি উনারে দাদাবাবু বলতাম...আমার দিকে তাকিয়ে লোকজনরে বললেন,
-এরে এইখানে ফেলায়া গেলে শিয়াল কুকুরে টেনে নিয়ে যাবে। বাড়ি নিয়ে চল।
ব্যস! সেই থেকে আমি এই বাড়িতে ঢুইকে গেলাম। আর আমারে কেউ খেদায়বারই পারলো না!’
আমি একই গল্প বারবার শুনতাম। টেপ রেকর্ডার বাজানোর মতো করে একই টেপ বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শুনতাম। দিনুচাচারও মনে হয় এটা খুব প্রিয় গল্প ছিল। বার বার বলাতেও ক্লান্ত হতো না কখনো।
আমার বাবার এক অতি বৃদ্ধা ফুফু থাকতেন আমাদের সাথে। একশো বছরের ওপরে ছিল তার বয়স। আমি তাকে দাদু বলে ডাকতাম।
দাদু চোখে দেখতে পেতেন না। হাঁটতে পারতেন না। একটু দাঁড়াতে গেলেই থরথর করে আবার বসে পড়তেন। তাকে খাইয়ে দিতে হতো। সবকিছু করে দেওয়ার জন্য বাসায় সার্বক্ষনিক কাজের লোক ছিল।
দাদুর চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। তবু তার চোখজোড়া কেমন জানি জ্বলজ্বল করে জ্বলতো। যেন সেই চোখ দিয়ে ঠিকরে আসা আগুনের হল্কা এসে ভস্ম করে দেবে সবকিছু।
আমাকে দিনুচাচার কাছে গল্প শোনার আবদার জানাতে দেখলেই দাদু হাত নেড়ে কাছে ডাকতেন। দিনু চাচার আশেপাশে এত ঘুরঘুর করা দাদু মোটেও পছন্দ করতেন না। কাঁপা কাঁপা গলায় বলতেন,
‘ও দিনু কী জানে রে? ও তো এ’বাড়ির চাকর। আমার কাছে শোন কী শুনবি।’
তিনি আমাকে এককালীন জমিদারীর ঠাঁটবাটের গল্প বলতেন। তার বাবার সেই ভীষণ প্রতাপের দম্ভভরা কাহিনি শোনাতেন। তার গলার স্বরেও দম্ভ ফুটে বেরুতো।
সেই গল্পগুলো দিনুচাচার গল্পের মতো সরল সোজা ছিল না। কেমন যেন অন্যরকম। গা ছমছমে। আমার খুব বেশি ভালো লাগতো না। তবু চুপ করে বসে থাকতাম।
দাদু যখন আমাকে গল্প বলতেন, মা আশেপাশে ঘুরঘুর করতো। কিছু একটা ছুতোয় আমাকে সরিয়ে দিত। আমি বুঝতে পারতাম না, মা কেন এরকম করতো।
পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছি।
দুই
আমাদের সেই বাড়িটা ছিল আসলেই ভয়ানক রকমের বিশাল। বাড়িটাতে যে মোট কতগুলো ঘর ছিল, আমি কখনো তা গুনেই শেষ করতে পারতাম না। সেগুলোর বেশির ভাগই তখনো অক্ষতই ছিল।
দর্শনার্থীর ভীড় ঠেকাতে দিনুচাচা এই বাড়ির ভগ্নদশার গল্প বানিয়ে বানিয়ে বলতো।
বেশিরভাগ ঘর অবশ্য তখন তালাবন্ধ করেই রাখা হতো। বাড়িতে মানুষ মোটে আমরা ক’জন। আমি, বাবা-মা, দাদু, দিনুচাচা আর বাড়ির গোটা চারেক কাজের লোক। এই ক’জন মোটে লোকের জন্য এত বড় বাড়ি কোন কাজে আসবে? আর তাছাড়া সেগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখাও তো ভারী এক ঝক্কির কাজ।
আমাদের বাড়ির সামনের অংশটাতে বেশ আলো আসতো সবসময়। আমরা এই সামনের অংশটাতেই থাকতাম। পেছনের দিকের ঘরগুলো ছিল স্যাঁতস্যাঁতে, অন্ধকার। সেদিকে দিনের বেলাতেও তেমন একটা আলো আসতো না।
আমি ভুলেও কখনো সেদিকটাতে যেতাম না। মা’র কড়া নিষেধ ছিল। অন্ধকারের কুঠুরি ছিল একেকটা ঘর। মা জানতো, ওদিকটাতে গেলেই আমি ভয় পাবো।
আর তাছাড়া...দিনু চাচা আর বাবারও বারণ ছিল সেদিকটাতে যাওয়ার ব্যাপারে। বাবা প্রায়ই দিনুচাচার কাছে বলতো,
‘চাচা, এবার ভালো দেখে একটা অফিস টফিস দেখে ভাড়া দিয়ে দিই এই পেছনের অংশ। আমরা আর এগুলো আগলে রেখে কী করবো? তুমি দেখতো, কেউ অফিস ঘর হিসেবে ভাড়া নেবে কী না!’
দিনুচাচা ক্লান্ত সুরে উত্তর দিত,
‘ভাড়া দিয়ে দেবে খোকাবাবু? ঐদিক কেউ ভাড়া নেবে? যে গল্প আছে সেখানে...’
এটুকু বলেই দিনুচাচা থেমে যেত। বাবাও আর কথা বাড়াতো না।
রাতে শোবার ঘরে মা আর বাবা এই নিয়ে অনেক রাত অব্দি ফিসফাস করতো। একেবারে পাশের ঘরেই থাকতো বাবা-মা। অনেক কথা না চাইলেও আমার কানে চলে আসতো। দাদু আর আমি এক ঘরে ঘুমাতাম। আমি থাকতাম একটা বিছানায়। আর তার পাশের বিছানায় দাদু ঘুমাতো।
বুড়ো হলে নাকি মানুষের ঘুম কমে যায়। দাদুর বেলাতে মোটেও তা সত্যি ছিল না। বিছানায় পড়ামাত্রই দাদু ভোঁস ভোঁস করে নাক ডাকতো। আমি ভয়ে ভয়ে চোখ বন্ধ করে থাকতাম। একহাতে সবলে জড়িয়ে ধরতাম কোলবালিশটাকে। একসময় মা পাশের ঘর থেকে এসে আমার মাথায় হাতে বুলিয়ে দিলেই আমার ঘুম চলে আসতো।
আমাদের এই বিশাল জমিদার বাড়িটা নিয়ে অনেক গল্প গাঁথা চালু ছিল। সেসব গল্প গাঁথার অনেককিছুই হয়ত সত্যিও ছিল। সেই বয়সে আমাকে কেউ খোলাসা করে কিছু বলতো না ঠিকই, কিন্তু আমি ঠিক বুঝে যেতাম।
স্কুলে আমার বন্ধুরাও আমাকে মাঝে মাঝে কিছুটা ইঙ্গিত দিয়ে বলেছে,
‘হ্যাঁরে পুলক, তোর দাদার বাবা নাকি খুব খারাপ লোক ছিলেন!
উনি নাকি অনেক লোককে একটা ঘরে আটকে রেখে দিতেন?
দিনের পরে দিন তাদের খাবার দাবার দিতেন না! সেই ঘরগুলো নাকি মাসের পরে মাস বন্ধ করে রাখা হতো?
কেউ সেগুলো কখনো খুলতো না...আর সেই লোকগুলো নাকি না খেয়ে মরে পড়ে থাকতো সেই ঘরের মধ্যেই?’
ভয়াবহ সব গল্প! প্রথমদিন এই গল্প শুনেই আমি দিনুচাচাকে বলেছি,
‘চাচা ঐঘরগুলোতে নাকি অনেক মানুষ আটকে থাকতো আর খেতে না পেয়ে মরে পড়ে থাকতো? সত্যি নাকি গো?’
কথাগুলো বলতে বলতে আমার গলার স্বর কাঁদো কাঁদো হয়ে যেত। আমার বাবা-মা কত ভালো মানুষ! আমাদের বাড়িতে কখনো কোনো ভিক্ষুক খালি হাতে ফিরে যেত না। ঘরে এতটুকু খাবার থাকলেও মা তাদেরকে উঠোনে বসিয়ে যত্ন করে খেতে দিত। মা’র কাছে থেকেই শুনেছি, ক্ষুধার্তকে অন্ন দেওয়া সবচেয়ে বড় পূণ্যের কাজ।
সেই আমাদের বাড়িতে না খেয়ে মানুষ মারা যেত...!
আমার প্রশ্ন শুনে দিনুচাচা শশব্যস্ত হয়ে বলতো,
‘এসব কথা তোমাকে কে বলেছে দাদাভাই?’
আমি অস্থির হয়ে বলতাম,
‘তুমি বল না, সত্যি নাকি এসব? আসলেই আমার দাদুর বাবা এমন পচা লোক ছিল?’
দিনুচাচা কিছু বলতো, কিছু গোপন করতো। তার এই লুকোচুরিতেই সেই শিশুবয়সেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম, খুব বেশি আলোকিত ছিল না এই জমিদার বাড়ির ইতিহাস। একটা নিকষ কালো অন্ধকারের ছায়া চুপিসারে ঘিরে ছিল, আমাদের সেই অতিকায় বাড়িটাকে।
বাতাসে গন্ধ শুঁকে বেড়াতো রক্তচোষা শকুনির দল...
তিন
সেদিনও অন্যদিনের মতোই দিনুচাচা বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে অতিথি সৎকার করছে। বেশ একটা হৈ চৈ চলছে সেখানে। রোজকার ব্যাপার। আমি ছাদে দাঁড়িয়ে মজা দেখছি। দিনুচাচা’র লাঠি নিয়ে এই অতিথি সৎকার আসলেই এক দেখার মতো ব্যাপার ছিল।
হঠাৎ দেখতে পেলাম, ষন্ডামতন কয়েকজন লোক দিনুচাচাকে পাত্তা না দিয়েই পাশ কাটিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। যতদূর মনে আছে, সংখ্যায় তারা ছ’সাত জনের মতো হবে। দিনুচাচা তাদের ঢুকে পড়তে দেখে আপত্তি জানিয়ে বললো,
‘ও কী! বিনা অনুমতিতে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লে কেন?’
সবক’টি লোকের মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে রাখা। তাদের এক হাত পেছনে রাখা। সেই হাত সামনে নিয়ে আসতেই দেখলাম, সবার হাতে একটা করে রামদা ধরা আছে। আমি এক নজর তাকিয়ে দেখলাম, দিনুচাচার চোখে হতবিহবল দৃষ্টি। তারপরেই লোকগুলো ধাক্কা দিয়ে দিনুচাচাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লো।
আমি সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে দেখছি। আমার যেন কিছুই করার নেই। পা’দুটো আটকে গেছে। বাড়ির ভেতরে মা-বাবা, দাদু...সবাই আছে। লোকগুলো কী করবে তাদের?
হঠাৎ মাটিতে শোয়া অবস্থাতেই দিনুচাচার চোখ পড়লো আমার দিকে। আমাকে হাত ইশারায় কিছু একটা বলেই পড়িমড়ি করে তাকে ছুটে আসতে দেখলাম।
কতক্ষণ পরে জানি না...দিনু চাচা ছাদে এসে হাঁপাতে লাগলো। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘দাদাভাই চল!’
‘কোথায় যাবো? আমি বাবা-মা’র কাছে যাবো। ঐ লোকগুলো...’
‘শসসস! তুমি আমার সাথে চল দাদাভাই। এখন ঘরে গেলে কেউ বাঁচবো না। তুমি আর কথা বলো না...চল আমার সাথে...শিগগির!’
আমার মাথার মধ্যে ঝিম মেরে আছে। লোকগুলো কারা? কেন তারা এভাবে ঘরে ঢুকে পড়েছে? কী চায় ওরা? বাবা-মা আর দাদু’র কোনো ক্ষতি করবে না তো লোকগুলো!
দিনুচাচার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, এখন প্রশ্ন করার সময় নয়। এখন টুঁ শব্দটিও করার সময় নয়। আমি শুধু নিঃশব্দে তার পিছু পিছু চলতে লাগলাম।
দিনুচাচা খুব সাবধানে অতি সুনিপুণ চতুরতায় এক বাড়ির ছাদ থেকে আরেক বাড়ির ছাদে লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে লাগলো। সেই সাথে আমাকেও প্রতিটি বাড়ির ছাদ অতি সযত্নে পার করিয়ে দিতে লাগলো। কখনো আমাকে কোলে তুলে নেয়, কখনো কোল থেকে নামিয়ে নিজের হাতে উঠিয়ে দেয়। তার বুড়ো শরীরে যেন কয়েকজন জোয়ানের শক্তি আর সাহস এসে ভর করেছে তখন।
আমরা পেছনের দিকের বাড়ির ছাদে এসে নামলাম একসময়। ধুলো ধুসরিত এই দিকটাতে কেউ আসতো না। আমার একসময়ের গা ছমছমে সেই পেছন দিকটাতে পা দিয়েও আমার কেন জানি তেমন ভয় ভয় করলো না। আমি তখন অনুভূতিশূণ্য...অসাড় কোনো এক মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়েছি।
দিনুচাচা আমাকে নিয়ে হাঁচড়ে পাঁচড়ে ছাদ থেকে নেমে এলো। কোঁচড়ে বাঁধা চাবির গোছাটা বের করে পেছনের দিকের একটা ঘরের দরজা খুলে ফেললো। তারপরে খুব সাবধানে ইতিউতি তাকিয়ে আমাকে নিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ করে দিল।
ঘরের ভেতরে নিকষ কালো অন্ধকার। ভ্যাপসা তীব্র একটা জমাট গন্ধ আমাকে কেমন যেন বিহ্বল করে দিল। দিনুচাচা ফিসফিসিয়ে আমাকে বললো,
‘একটাও কথা বল না, দাদাভাই। আল্লাহকে ডাকো...প্রাণ দিয়ে আল্লাহকে ডাকো...’
দিনুচাচা সেই ঘরের মধ্যে ছটফট করে বেড়াতে লাগলো। দেওয়ালের ফাঁকফোঁকড় খুঁজে বেড়াতে লাগলো, যদি বাইরের কিছু দেখতে পাওয়া যায়।
আমি কাঠপুত্তুলীর মতো চুপ করে বসে রইলাম...সেই ভয়ানক তীব্র জমাট অন্ধকারে।
অন্ধকার আমাকে গিলে খাওয়ার জন্য দু’হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি দাঁতে দাঁত চেপে তার শেষ ছোবল হানার প্রহর গুনছি।
হঠাৎ বাইরে থেকে আর্তচিৎকার ভেসে এলো। বাবা-মা-দাদু...প্রত্যেকের চিৎকার শুনতে পেলাম আমি। হৈ চৈ আর আওয়াজে এটুকু বোঝা গেল, কেউ যেন বলছে...
‘সেই বুড়ো কই? আর ছেলেটা? সবক’টাকে নিপাত করতে হবে। জ্বালিয়ে দিব এই শয়তানের বাড়ি!’
আমরা সারাদিন সারারাত সেই অন্ধকার ঘরে সিঁটিয়ে বসে রইলাম। দিনুচাচা আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব সঙ্গোপনে কাঁদছিল। তার চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছিলো আমার কপাল।
যখন সব শব্দ পুরোপুরি থেমে গিয়ে চারপাশ নিঝুম হয়ে গেল...আমরা খুব চুপিসারে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
বাইরে তখন ঘোর অমনিশা। আমাদের বিশাল বাড়িটা তখন আঁধারের চাদর দিয়ে মুড়ে রাখা...এক বিন্দুও আলো নেই কোথাও!
শুধু একাকী জ্বলতে থাকা শুকতারার একটুখানি আলো এসে যেন চিনিয়ে দিয়ে গেল আমাদের অতি পরিচিত ঘরদোর।
চার
রক্তাক্ত লাশগুলো উঠোনেই পড়ে ছিল।
মা-বাবা-দাদু...বাড়ির কাজের লোকগুলো...কাউকে ছাড়েনি ওরা। যেন প্রতিহিংসার আগুনে কুপিয়ে শেষ করেছে, এই রক্তাক্ত জমিদার বাড়ির শেষ চিহ্নটুকুও।
আমি অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। দিনুচাচা বাবার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আমি নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলাম আমার মা’র মুখটার দিকে।
কী সুন্দর মুখ আমার মা’র! এত সুন্দর মুখে কেউ এভাবে আঁচড় মারতে পারে?
বাবা’র দিকে তাকিয়ে দেখি, তার চোখদুটো তখনো মেলে রাখা। বাবা কতদিন আমাকে বলেছে,
‘আমি হলাম তোর ছায়া...ছায়ার মতো আগলে রাখবো তোকে!’
বাবা কি এখনো ছায়া হয়েই তাকিয়ে আছে আমার দিকে?
হঠাৎ দিনুচাচা যেন সম্বিত ফিরে পেল। আমাকে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো,
‘ওঠ ওঠ দাদাভাই ওঠ। চল এখান থেকে। এক্ষুনি চল।’
আমি তখনও ঠায় বসে আছি মাটিতে। দিনুচাচা আমাকে টানতে টানতে নিয়ে চললো সেখান থেকে।
সে রাতেই আমরা পালিয়ে পাশের গাঁয়ে চলে গেলাম। দিনুচাচার এক দূর আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম।
দূরে বসেই জানতে পেরেছি, আমাদের বাড়িতে পুলিশ গিয়েছে। খুনিরা পুলিশের জোর তৎপরতায় ধরাও পড়েছে।
আদালতে তারা জবানবন্দি দিয়েছে, তাদের পূর্বপুরুষেরা অত্যাচারিত ছিল জমিদারের কাছে। বহুদিনের পুষে রাখা সেই ক্ষোভের তারা অবসান ঘটিয়েছে। জমিদার বাড়ির রক্তের ছাপ তারা রক্ত দিয়েই চিরতরে মুছে দিয়েছে।
আদালত তাদের প্রত্যেককে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে।
আমি আবার সবকিছু ফিরে পেয়েছি। বিশাল জমিদার বাড়ি...একগুচ্ছ সম্পত্তি। কিন্তু সেই বাড়ির প্রাণ হয়ে ছিল যে মানুষগুলো, তাদের কাউকেই আর ফিরে পাইনি। তাই আমিও আর উঠতে চাইনি সেই অভিশপ্ত বাড়িতে।
দিনুচাচার বয়স হয়েছিল। তিনিও আর ক’দিন আমাকে আগলে রাখবেন? গ্রামের মুরুব্বিদের তদারকি আর পরামর্শে এই জমিদার বাড়ি সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে আমি শহরের আবাসিক স্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়েছি। সেখানে হোস্টেলে থেকেই পড়াশুনা করি আমি। আমার সম্পত্তির বিষয়টা আমাদের পারিবারিক উকিল দেখাশুনা করেন। দিনুচাচার ভরণপোষণের টাকাটাও সেখান থেকেই আসে।
গ্রামে মাঝে মাঝে যাই। দিনুচাচা তার সেই আত্মীয়ের বাড়িতে কোনরকমে বেঁচে আছেন। আমাকে দেখেই হু হু করে কাঁদেন। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন,
‘সেখানে একা একা কেমনে থাকো গো দাদাভাই? অন্ধকারে ভয় পাও না তুমি? কে দেখে রাখে তোমাকে এখন?’
আমি হাসি দিনুচাচার কথায়। হাসতে হাসতে বলি,
‘তুমি কী বোকা দিনুচাচা! অন্ধকারকে ভয় পাবো কেন? তাকে তো আমি সেই কবেই জয় করেছি! সে এখন আমার কত আপন!’
মানুষের জমিয়ে রাখা অন্ধকার কেড়ে নিয়েছে আমার সবকিছু। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া এই আলোকিত অন্ধকার আজ তাই আমার জন্য আশীর্বাদ!