বৃষ্টি,আমি এবং তারা

বৃষ্টি (আগষ্ট ২০১২)

তান্নি
  • ২৩
  • ৬৭
মেঘ মেদূর ঘন বর্ষার মাঝামাঝি সময় চলছে। অথচ এতোদিন বৃষ্টির দেখা মেলেনি। স্নিগ্ধ বারিধারার ছোয়ায় কদমের যৌবনে উপনীত হবার সময় পেরিয়ে যাবার দিন ছুঁই ছুঁই করছিলো। কিন্তু আজ! অনেকদিন পর আকাশ মেঘের ঘোমটা পরেছে। সারা অঙ্গে কালো মেঘের চাদর জড়িয়েছে। উৎসবের আতশবাজির শব্দ মেঘের ঘর্ষনে। মৃত্তিকার কাছে বারিধারার শুভ যাত্রায় আকাশের বুকে এই মহাউৎসব। মেঘের বাজনা বেজে চলেছে বজ্রপাত হয়ে। অল্পক্ষণ পরেই সে কী বর্ষণ! মৃত্তিকার গন্ধে সুদীপ্ত পৃথিবী। সে বুঝি নতুন প্রাণ ফিরে পেল। তার বুকে লুটিয়ে পড়ে নদীর মোহনায় ছুটেছে অঝোর ধারার স্রোত। দোতলার বেলকনিতে রাখা টবের গোলাপগুলো বৃষ্টির ছোয়ায় লজ্জায় আরো রক্তিম হয়ে উঠেছে। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে চলে এলাম বেলকনিতে। দুচোখ বুজে শরীরটা এলিয়ে দিলাম বেতের চেয়ারটায়। বৃষ্টি চুম্বন আঁকছে আমার সারা অবয়বে। আমার ভালোলাগার আদুরে বৃষ্টি, কতদিন পর সান্নিধ্যে পেয়েছি তাকে! বৃষ্টির সাথে সখ্যতা আমার কচি বয়স থেকে। ! কতোবার ঝুম বৃষ্টিতে বাবার কোলে করে পুকুরে স্নান করতে গিয়েছি। সেদিন পেরিয়ে গেছে বহুদিন আগে। এখন বৃষ্টির ছন্দে পরিণত প্রেমের ভাষা শুনতে পাই। যৌবনের গান শিস দেয় কর্ণকুহরে। অচেনা স্পর্শের শিহরন জাগে বৃষ্টির ছোঁয়ায়। শৈশবের ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দিব মেপে’ ছড়ার পরিবর্তে প্রেমময় কাব্য মনে দোলা দেয়। কী বিচিত্র জগৎ সংসারের পাল্টে যাবার নিয়মগুলো! কদমফুল হাতে হাস্যরত বাচ্চা মেয়ের ছবি এঁকেছি কতোবার। কদম গুচ্ছ হাতে হাসি মুখে আয়নায় নিজের ছবি দেখে সেটা সযত্নে আর্টপেপারে তুলি চালিয়ে নিখুঁত ভাবে তুলে ধরতাম। অথচ এখনো মাঝে মাঝে জলরং মেশাই সেই কচি বয়সের ছবিটা আঁকবো বলে। স্মৃতির পাতা ঝকঝকে স্পষ্ট হলে ও হাত চলেনা আগের মতো। আগ্রহটা ও ক্রমাগত গুটিয়ে আসে। কখনো বৃষ্টি নামে। আগোছালো হাতে তুলি চালাই আর্টপেপারে। উৎসুখ মন আনচান করে, এই বুঝি ছবিটা আঁকা হলো। ছবি আঁকা হয় ঠিকই। কিন্তু এ যে অন্য ছবি? সেদিনের কচি মেয়েটি যৌবনের পসরা সাজিয়ে বসেছে। দীঘল চুলের খোঁপায় কদমের সারি। ঘন কালে চোখের পাপড়ি জুড়ে অন্যরকম স্বপ্ন। আর তার পাশে? ঝাপসা কারো জলছাপ। অস্পষ্ট চোখ দুটো গেঁথে যায় মনের ক্যানভাসে। এ ছবিটাই ক্রমাগত আপন হয়ে ওঠে আমার কাছে। দুরে কোথাও বাজ পড়ে, আমার অন্তহীন ভাবনায় বিচ্ছেদ ঘটে। লাগামহীন তেড়ে আসা বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি। সোজা হয়ে বেলকনির গ্রীলের ফাঁকে নীচে তাকালাম। এরই মধ্যে পায়ের পাতা ডুবে যাবার মতো থৈ থৈ করছে পানি। সেখানে কোন ফ্ল্যাট নেই। চারপাশে বিলের মতো উন্মুক্ত এলোমেলো জায়গা। আর একপাশে কিছুটা দূরত্ব রেখে অনেকগুলো টিনের খুপরি গড়ে উঠেছে। বস্তিবাসীরা সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর একটু মাথা গোঁজার ঠাই করে নেয় এই খুপরির ভেতর। আর কিছুকক্ষণ এভাবে বর্ষন হতে থাকলে ঘরগুলো পানিতে ভাসবে। মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল। যাই হোক, এ বর্ষন যেন শত জনমের চাওয়া। কতোদিন ভেজা হয়নি এ বৃষ্টিতে! এ অন্যরকম অনুভূতি।

কারো ছুটোছুটির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল, তাছাড়া ঘাড়ের নিচে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। বোকার মতো খাট ছেড়ে শক্ত কাঠের ডাইনিং টেবিলে শুয়েছিলাম। কারণ খাটে শুয়ে বৃষ্টি দেখা যাচ্ছিলনা। বৃষ্টি দেখতে গিয়েই এ পন্থা অবলম্বন। এভাবে কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানা নেই। ভিজে জুবুথুবু হয়ে ছুটোছুটি করছে মা। ব্যপার কী জানতে চাইলে মা অবাক হয়ে বলেন, ব্যপার কী মানে? নীচ তলায় পানি উছেছে। হাটু পর্যন্ত পানি। সব আসবাবপত্র ভিজে সর্বনাশ। আজ আর রান্নাবান্না করা ও হবেনা মনে হয়। এবার ভীষন অবাক হলাম। মামনি কী বলছে এসব! বলা বাহল্য, আমাদের বাসাটা ডুপ্লেক্স হাউস। যদিও বাসাটা আমাদের নিজস্ব নয়। থাক এসব কথা। নীচতলায় আমাদের স্থায়ী থাকার ঘর। দোতলায় মুটামুটি ফাঁকা। গেস্টরুম হিসেবে ব্যবহার হয় দোতলার রূমগুলো। নীচে নেমেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। পনিতে ডুবে গেছে মেঝে। ভাইয়া, আম্মু, আববু সবাই ছুটোছুটি করছে। মায়ের নির্দেশে আবার দোতলায় চলে এলাম। তখনো বিরামহীন বৃষ্টি ঝরছে। বিকেল পাঁচটা প্রায়। বেলকনির গ্রীল দিয়ে নীচে তাকাতেই বুকটা কেঁপে উঠল। বস্তির খুপরিগুলো সব প্রায় ডুবে গেছে। অথৈ পানির মধ্যে জীর্ন টিন গুলো আর কিছু গাছ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছেনা। অসহায় মানুষগুলোর দুর্দশার কথা কল্পনাই করা যাচ্ছেনা। কীভাবে তারা রাত্রি যাপন করবে? এই পানি বন্দী সময়ের মাঝে একমুঠো খাবার যোগাড় করা ও অসম্ভব। আমরা নিজে ও পানি বন্দী। সত্যিই ভালো লাগছেনা। মনে মনে বৃষ্টি চলে যাবার জন্য কামনা করছি। অথচ হৃদয় ভরে এই বৃষ্টির আগমনকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছি। কিন্তু এ ভালোলাগার বৃষ্টি হঠাৎ করেই যেন সবার জন্য দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। অসহায় মানুষ গুলোর চেচামেচি আর ভালোলাগছেনা। অপেক্ষার প্রহর গুনছি কবে এ বর্ষন থামবে।

সারারাত বৃষ্টি ঝরেছে। ভোর পাঁচটার দিকে একটু ক্ষান্ত হলো। সকাল সাতটা। কিছু খাওয়া হয়নি। শুয়ে আছি বিছানায়। পাশের বাসার নেহা, শিমুল, মৌ এর গলা শোনা যাচ্ছে। একটু পরেই সবাই হৈ হুল্লোড় করতে করতে আমার রুমে ঢুকে পড়ল। সাথে মৌ এর যমজ ভাই দুটো। গুড মর্নিং বলেই দুজনই আমাকে জড়িয়ে চুমু খায়। এবার নেহা জোর করে শোয়া থেকে তুলে দেয় আমাকে। মৌ আর শিমুল চেচিয়ে বলে উঠে এই তাড়তাড়ী আয়। দেখ, বিলের গলা পানিতে বস্তির ছেলেগুলো মশারি দিয়ে মাছ ধরছে। সবাই চলে এলাম বেলকনিতে। অনেকগুলো ছেলে মহা আনন্দে মাছ ধরছে । এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখিনি। সত্যিই ভীষন মজা লাগছে। ‘এই চল সবাই মজা করি, এই বলে, নেহার হাত ধরে নেচে উঠে মৌ। সেই সাথে শিমুল ও মৌ এর জমজ দুভাই সোহান সিয়াম সহ আমরা সবাই একসাথে আনন্দে মেতে উঠি। অসম্ভব ভারী মিষ্টি গলায় গান ধরেছে শিমুল। মন মোর মেঘের সঙ্গী, উড়ে চলে দিগদিগন্তের পানে, নিঃসীম শুন্যে, শ্রাবন বর্ষন সঙ্গীতে...................... । আনন্দের তুফান উঠেছে আমাদের মনে। বাঁধ ভাঙ্গা এ উচ্ছাসে কতোদিন মেতে উঠা হয়নি! হঠাৎ গান থামিয়ে দেয় শিমুল। তারপর নরম কন্ঠে বলে ‘দেখ একটি বৃদ্ধা ঘরে চালার উপর বসে আছে। আর আমাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মূহুর্তেই আনন্দে ভাটা পড়ে আমার মনে। পলকহীন দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে বৃদ্ধাটি। দৃষ্টি জুড়ে তাচ্ছিল্যের ছায়া। হয়তো ভাবছে তাদের দুর্দশা দেখে আমরা কী নিষ্ঠুর আনন্দ করছি। সত্যিই তো তাই, ধিক্কার দিই নিজেকে। কতো মানুয়ের ঘর ভেসে গেল এই বৃষ্টি জোয়ারে। একটুখানি মাথা গোঁজার ঠাই তো দূরের কথা। সারাদিন- রাত্রি মিলে একমুঠো আহার জুটেনি। অথচ আমরা দিব্যি উপর তলায় বাস করে আয়েশের ঢেকুর তুলছি। বৃদ্ধার চোখে জল টলমল করছে। আমরা এমন কিছু লোক শহরে বাস করি যাদের সত্যিকার অর্থে শুধু চাকচিক্যটাই আছে। ভেতরটা বেলুনের মতো ফাঁকা। কেইবা বুঝে এই সহজ সত্যটুকু। বিবেকের দংশনে ক্রমশ কেঁপে কেঁপে উঠছে মন। পিনপতন নীরবতা নেমে এসেছে আমাদের মাঝে। একটু পর আমার কাধে হাত রেখে প্রশ্ন করে নেহা। ‘বৃদ্ধাটা মনে হয় কিছু খায়নি সারারাত তাইনারে! ‘শুধু বুদ্ধাটা নয়, হয়তো ওদের কারো মুখে গতকাল থেকে একমুঠো অন্ন জুটেনি নেহা...’ কথাটা বলতে গিয়ে ও বলতে পারলামনা। শুধু চেপে রাখা কান্নাটা লুকিয়ে রেখে ধরা গলায় বললাম, ‘হয়তো তাই।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
প্রিয়ম অনেক অনেক দুঃখবোধ হলো , ভালো লাগলো লেখা |
ভালো লাগেনি ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সালেহ মাহমুদ অনেক ভালো একটি গল্প। বেশ মানবতাবাদী চেতনা ছড়িয়ে আছে গল্পে, ভালো লাগলো। ধন্যবাদ তান্নি।
মোঃ আক্তারুজ্জামান আমরা এমন কিছু লোক শহরে বাস করি যাদের সত্যিকার অর্থে শুধু চাকচিক্যটাই আছে। ভেতরটা বেলুনের মতো ফাঁকা- এমন সব সত্য তুলে ধরাই লেখার মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত| খুব ভালো লাগলো|
মাহবুব খান অনেক ভালো লিখেছেন বৃষ্টির কথা /ভালো লাগলো
Lutful Bari Panna তান্নি চমৎকার লিখেছ। বর্ণনা মাধুর্যে ছোট্ট কাহিনীটুকুই দুর্দান্ত হয়ে উঠেছে।
দুরন্ত পাঠক খুব সুন্দর হৃদয় ছোঁয়া গল্প, ভালো লাগলো।
Sisir kumar gain সুন্দর কথামালা।ধন্যবাদ।
Jontitu বৃষ্টির দিনের মনের সুন্দর ভাব প্রকাশ। ভালো লাগলো।
বিদিতা রানি বৃষ্টিতে মনের ভাব এবং সুবিধা অসুবিধা সুন্দর তুলেছেন। আবেগ দিয়ে লেখা। ভালো হয়েছে।
আহমেদ সাবের খুব সুন্দর গল্প। জীবনটা এমনিই, সুখ-দুঃখ এক সূত্রে গাঁথা। দুঃখী জনের প্রতি আপনার সহমর্মিতা হৃদয়কে ছুঁয়ে গেল। শুভেচ্ছা রইল।

০৪ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪