বিষ

ঈর্ষা (জানুয়ারী ২০১৩)

রনীল
  • ২৬
  • ৬২

ইনিও একজন রাজা, তবে ধরনটা একটু ভিন্ন। ধড়াচুড়ো, মুক্তোর মালা কিংবা পাগড়ী- কিছুই নেই। তার বদলে আছে ক্রিম কালারের স্যুট, অত্যাধুনিক বাসভবন- গাড়ী। জুতো মসমসিয়ে রাজা সুশোভিত ড্রইং রুমের মাঝখানটায় এসে দাঁড়ান। লাইলি আস্ত মরিচে কামড় দিয়ে ফেলেছিল- ঝালের চোটে ওর চোখে জল চলে আসে।
রাজা এমনিতেই প্রচণ্ড রকমের সুপুরুষ, তবে রাগলে তাঁর মুখের দিকে আর তাকানো যায়না। রোষকষায়িত চোখে রাজা ড্রইং রুমটা একবার জরিপ করে নেন। তারপর প্রচণ্ড জোরে একটা হাঁক দেন। লাইলির দুই বছরের ছেলেটা কেঁদে উঠে। চারদিক সুনসান... রাজার ডাকে কেউ সাড়া দেয়না, শুধু লাইলির ছেলেটা একঘেয়ে স্বরে অনবরত কাঁদতে থাকে। রাজা কিছুটা ক্রুদ্ধ, কিছুটা বিস্মিত। লাইলি হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করে বাচ্চাটাকে অভয় দেবার চেষ্টা করে। বাচ্চাটা একসময় চুপ মেরে যায়।
রাজপ্রাসাদ প্রায় পুরোটাই খালি হয়ে গেছে। প্রাসাদের লোকজন সবাই লুকিয়ে লুকিয়ে থাকে, ক্রুদ্ধ রাজার সামনে কেউ পড়তে চায়না। রাজা বিরক্তভাবে দ্বিতীয়বার হাঁক দিতেই ভয়ে ভয়ে কক্ষে একজন মধ্যবয়সী লোক প্রবেশ করলেন।
বেঁটে, ছোটখাটো চেহারা- চোখদুটো বুদ্ধিদীপ্ত।দৃশ্যপটটি যদি অতীতের হত- তবে এই লোকটিকে অনায়াসে একজন মন্ত্রী বলে সম্বোধন করা যেত... উল্লেখিত পরিস্থিতিতে একে বরং ম্যানেজার বলে সম্বোধন করাটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত হবে।
ম্যানেজার সাহেবকে দেখে রাজা যেন ক্রোধে ফেটে পড়লেন। এমনিতেই বহিরাগত বনিকের দল ক্রমশ রাজ্যের ভেতর ঢুকে পড়ছে। এস্টেটের আয় রোজগার দিন দিন কমে যাচ্ছে, তার সাথে যুক্ত হয়েছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। রাজ্যে রানীর সংখ্যা দুজন। বড় রানীর কোন ছেলেপুলে হয়নি, তবে দুই দুইটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে ছোট রানী ইতিমধ্যেই বেশ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
সম্পদলোভী অকর্মা দুই রাজকুমার আর কুটকাচালিতে দক্ষ ভাইদের সাথে নিয়ে ছোটরানী ইতিমধ্যে সন্তানহীনা বড়রানীকে রাজার চোখে মহা অপরাধী প্রমাণিত করে ফেলেছেন।
ক্রুদ্ধ রাজা আর কোনরূপেই বড়রানীর মুখদর্শন করতে রাজি নন। নতজানু ম্যানাজারকে তিনি নির্দেশ দিলেন বড়রানীকে প্রাসাদ থেকে বের করে দেবার জন্য।
ম্যানেজার লোকটি বুদ্ধিমান কিন্তু হৃদয়হীন নন। রাজার এমন নির্দেশ শুনে তিনি কিছুটা কেঁপে ওঠেন, সেই সাথে লাইলিও। সময় যেন হঠাৎ থেমে গেছে। লাইলির ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। অনেক দূর থেকে ক্লান্ত পায়ের শব্দ ভেসে আসে। লাইলি দুহাতে নিজের মুখ চেপে ধরে।
আলোআঁধারিতে তাঁর মুখটা স্পষ্ট দেখা যায়না, শুধু অস্পষ্টভাবে মৃদু শ্বাসের শব্দ শোনা যায়। ক্লান্ত, খুব গভীর থেকে উঠে আসা সে শ্বাস প্রাসাদের দেয়াল- পাথরের খাঁজে আলতো ভাবে সেঁটে যেতে থাকে। ছ্যাঁচড়ে ছ্যাঁচড়ে বড়রানী একসময় পৌঁছে যান- প্রাসাদের সিংহ দরজায়। লাইলি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।


দুপুরের মত ফাউল ব্যাপার পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারেনা। সকাল কিংবা রাতগুলোকে তাও কোনরকমে সামাল দেয়া যায়। কিন্তু গোমড়ামুখো হলুদ রঙের দুপুরগুলো এসে হাজির হলেই মিজান অনুভব করে- সবকিছু একেবারে সুনসান হয়ে যাচ্ছে। টিনের চালে কাকের ঠ্যাঙের শব্দ নেই, গাছের পাতাগুলো নিস্তেজ... এমনকি মিজানের যে বউটা রাতের বেলা ঘুমের মাঝেও ঝগড়া করে- সেও পর্যন্ত ছবির মত শব্দহীন।
চিটচিটে গরমে ঘামতে ঘামতে মিজান একসময় অনুভব করে- মাথার ভেতরটা ক্রমশ দখল হয়ে যাচ্ছে। নিরামিষ আর হলুদ-মরিচের মাখামাখি গন্ধে তার পেটের ভেতরটা পাক দিয়ে ওঠে। হাতে বেশি সময় নেই। এভাবে চলতে থাকলে খুব দ্রুতই সবকিছু হাওয়ায় উড়ে যাবে।
মুখরা বউটাও তার দুপুরবেলার এই ভূতুড়ে ব্যারামের কথাটা জানে। এই সময়টায় সে আর মিজানের কাছাকাছি ঘেঁষার চেষ্টা করেনা।
খুব আকস্মিকভাবেই মিজান হঠাৎ উঠে দাড়ায়। যেন খুব জরুরি কাজ আছে- এমন ভঙ্গীতে শার্টটা গায়ে জড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। জুয়ার আড্ডা কিংবা গাঁজার আসরে সে যায়না- অনেকদিন হল। বন্ধুবান্ধবরা ও সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে, তাতে অবশ্য তার খুব বেশি দুঃখবোধ নেই।
মিজান জানে- তার এই সমস্যা থেকে তাকে উদ্ধার করতে পারে একমাত্র তার বোন লাইলি। লাইলির বাসা এখান থেকে খুব বেশি দূর নয়। টেম্পুতে গেলে পাঁচ টাকা ভাড়া। স্ট্যান্ডে কোন টেম্পু দেখা যাচ্ছেনা, মিজান আর দাঁড়ালোনা। হনহন করে সে কাঁচারাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে।
লাইলির জামাই আমজাদ ইদানীং বেশ ভালো টাকাপয়সা কামাচ্ছে। আগে ট্যাক্সিক্যাব চালাতো। দেশের বাড়ির জায়গা জমি সব বেঁচে একটা মাইক্রো বাস কিনেছিল। এখন বাবু বাজারে রেন্ট এ কারের বিশাল অফিস নিয়েছে। শোনা যাচ্ছে চৈতি গার্মেন্টসের পেছনের পাঁচ কাঠা জমিটাও খুব শীঘ্রই কিনে ফেলবে।
ছোটবোনের স্বামীর এরকম আর্থিক সফলতায় মিজান কি খুশী হবে নাকি বেজার- বুঝতে পারেনা। লোকটা দুইহাতে টাকা কামাচ্ছে, সেই ধাক্কায় যদি মিজানের ও একটা গতি না হয়- তবে পুরো ব্যাপারটাতে খুশী হয়ে তার ফায়দাটা কি!
লাইলির বাসার সামনে মিজান যখন এসে দাঁড়ালো- সূর্য তখন কিছুটা হেলে গেছে। এদিকটায় এখনো খুব বেশি বাড়িঘর ওঠেনি। চারপাশ একেবারেই চুপচাপ। শুধু লাইলির ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসে বিজাতীয় ভাষার টানটান সব ডায়লগ। মিজানের হঠাৎ হাসি পেয়ে যায়, বোকা লাইলিটা দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা টিভিতে এসব ছাইপাঁশ দেখে আর কেঁদেকেটে বুক ভাসায়।
মাথার ভেতরের ফাঁকা অনুভূতিটুকু কেটে গেছে, দরজার সামনে দাড়িয়ে মিজান আবার অনুভব করে- হাতে আর খুব বেশি সময় নেই।


প্রাসাদ থেকে বের হয়ে বড়রানীর যাবার কোন জায়গা ছিলনা। উদ্ভ্রান্তের মত তিনি এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তাঁর এমন দুর্দশায় এগিয়ে এলেন প্রাসাদের ম্যানেজার সাহেব। বড়রানীকে তিনি মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা করে দিলেন।
থাকার কোনরকম একটা ব্যবস্থা হলেও বড়রানীর মনে স্বস্তি নেই। সম্পদের লোভে কাতর ছোটরানী, রাজকুমার আর তাদের মামারা মিলে দিনরাত ষড়যন্ত্র করে এখানেও তাঁর জীবন অতিষ্ঠ করে দিচ্ছে।
দুপুরের রান্না হয়ে গেছে অনেকক্ষণ হল। ছোট ছেলেটা ক্ষুধায় কাতর হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেদিকে লাইলির কোন খেয়াল নেই। সুদর্শন রাজার প্রতি তীব্র অভিমান দীর্ঘক্ষণ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।
দরজায় টোকার শব্দ শুনে লাইলি বুঝতে পারে মিজান এসেছে। টোকার ধরনটি ছন্দহীন, দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভরা। এর আগে একবার মিজান এরকম দুপুরবেলাতে এসে আমজাদের মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিলো। স্বল্পভাষী আমজাদ মুখে কিছু বলেনি, রক্তচক্ষু মেলে অপলক একবার তাকিয়েছিল মাত্র।
মিজান ঘরে ঢুকে চকিতে চারপাশটা একবার দেখে নেয় তারপর অসচ্ছন্দভাবে একবার হাসে।
লাইলি জানে মিজান আবার টাকা চাইতে এসেছে। সিরিয়াল শেষ হয়ে গেছে, রিমোট চেপে সে টিভিটা বন্ধ করে দেয়।
সতীনের ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরে বাথরুমে ঢুকে বসে আছে। লাইলি বুঝতে পারে ছেলেটা আবার বাথরুম নোংরা করে ফেলেছে।
বাথরুমে ঢুকে লাইলির কপালে ভাঁজ পড়ে। বোকা বাবুল পুরো বাথরুম জুড়ে হেগেছে। আজকাল পানির অনেক কষ্ট। লাইলি বড় গামলাটা ভর্তি করে পানি জমিয়েছিল সকালবেলা। সেটা পর্যন্ত নোংরা হয়ে গেছে।
বসার ঘরে মিজান বসে আছে, লাইলি কোন শব্দ করলোনা। ছেলেটাকে পরিষ্কার করিয়ে দিয়ে পুরো বাথরুম ধুল। পুরো এক গামলা পানি ফেলে দিতে হল।


বড়রানীর তুলনায় লাইলির কষ্ট কি কম! এই যে সে সারাক্ষণ সতীনের অপ্রকৃতস্থ ছেলেটাকে সামলে সুমলে রাখছে, তাতেও আমজাদ খুশি নয়- সারাক্ষণই খুঁতখুঁত করছে। গতকাল অফিস থেকে আসার সময় আমজাদ বিশাল একথোকা লিচু এনেছিল। পেটুক ছেলেটা তা দেখে হামলে পড়েছিল। লাইলি শুধু একবার বলেছিল,
- এভাবে খাইসনা, পেট খারাপ হইবো।
পুত্রঅন্তপ্রান আমজাদ তাতেই বাঘের মতো করে তাকিয়েছিল। লাইলি আর কথা বাড়ায়নি। বিশাল থোকার অর্ধেকটা সাবড়ে দিয়ে ছেলেটার পেট ছেড়ে দিল। সকাল থেকে সমানে ঘরদোর নোংরা করে যাচ্ছে। আমজাদ তো মনের সুখে অফিস আদালত করে বেড়াচ্ছে। পেটুক ছেলেটার হাগামুতা তো সব লাইলিকেই পরিষ্কার করতে হচ্ছে।
বসার ঘরে গিয়ে দেখে মিজান টিভি দেখছে। লাইলির বিপর্যস্তভাবটি মিজানের নজর এড়ায়না।
- খাওয়া দাওয়া করসো ভাইজান?
- রাখ তোর খাওয়া, আগে বল- আমজাদের সাথে কথা হইসে?
- তোমাকে তো আগেই বলসি, কোন লাভ নাই, ও তোমাকে কখনোই টাকা দিবোনা।
- আরে বেকুব- ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা কর। বাবুবাজারে একদম ঢোকার মুখেই দোকান, কস্মেটিক্সের... দুই লাখ দিলেই পজেশন। দরকার হইলে আমজাদরে আমি পার্টনার বানামু, ইন্টারেস্ট দিমু!
মিজান নানাভাবে লাইলিকে বোঝানোর চেষ্টা করে। লাইলির ঘাড়ের ভঙ্গিটি নমনীয় হয়না। শুরুর দিকে মিজানকে আমজাদ তার অফিসের ম্যানেজারের চেয়ারে বসিয়েছিল। এক সপ্তাহের মাথায় হিশেব নিকেশে গোলমাল পাকিয়ে মিজান সেখান থেকে চলে আসে।
আমজাদ লোকটি নিরাসক্ত ধরনের। চল্লিশের ওপারে বয়স, শক্তপোক্ত গড়ন। এমনিতেই ভালো মানুষ, তবে মাঝে মাঝে মদ খেয়ে এসে লাইলির গায়ে হাত তুলতো। লাইলি প্রথম ক’দিন সহ্য করেছিল, এরপর একদিন মাথায় রক্ত চড়ে গেল। রান্নাঘর থেকে মাছ কাটার বড় বটিটি নিয়ে তেড়ে গিয়েছিল আমজাদের দিকে। সেদিন হয়ত খুনোখুনিই হয়ে যেত, যদিনা পাশের বাড়ির খালা সময়মত মাঝখানে এসে দাঁড়াতেন।
বিচক্ষণ আমজাদ সেদিনই লাইলির মনের গঠনটি সম্পর্কে ধারনা পেয়ে যায়। এরপর থেকে সে লাইলির দিকে মনোযোগ দেয়া শুরু করলো। লাইলির টুকটাক সব কথাই সে মনোযোগ দিয়ে শোনে। কেবলমাত্র সতীনের ছেলেটা আর ব্যবসা- এ দুটো প্রসঙ্গ আসলেই আমজাদ শক্ত হয়ে যায়।
আমজাদের সাথে লাইলির যখন বিয়ে হয়, তখন বাবুলের বয়স ছিল তিন। বাবুলকে প্রথমবার থেকেই লাইলি বুঝছিল ছেলেটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। এরপর অনেকদিন কেটে গেছে, লাইলির নিজের ও একটি ছেলে হয়েছে... কিন্তু বাবুলের অস্বাভাবিকতা আর কমেনি। লাইলি ও বুঝে নিয়েছে বাকি জীবন তাকে এই বোঝা টেনে নিয়ে যেতে হবে।
মূল সমস্যাটা সৃষ্টি হয়েছে এখানটায়। প্রতিবন্ধী ছেলের প্রতি আমজাদের টানটা এতোই তীব্র আর অন্ধ যে আর কোন দিকেই তার নজর নেই। লাইলির দুই বছরের ছেলেটাকে সে শেষ কবে কোলে নিয়েছিল- সে সম্পর্কে লাইলির কোন ধারনাই নেই।
সামনে বসে থাকা মিজান যেন অন্তর্যামীর মত করে লাইলির মনের ভাবটি বুঝে নেয়।
- দ্যাখ বইন, তোর ভালর জন্যই বলতেছি, সময় থাকতে থাকতে নিজেরটা গুছায়া নে। আমজাদের কাজকারবার সুবিধার ঠ্যাকতাছেনা। কোনদিন দেখবি- লাথি মাইরা তোরে ঘর থেকে বাইর করে দিছে।
শেষের কথাটায় লাইলি চমকে ওঠে। মিজান ব্যাপারটা খুব উপভোগ করলো।
- আমজাদের ব্যবসা যেই হারে বাড়তাছে, তাতে কয়দিন পর তোর মত হাজারটা লাইলি সে হাতের ইশারায় কেনা বেচা করবো। এখন ই তো দেখতাছি- তোর কি অবস্থা। আমার কথা শোন- এই দামড়াডারে আমার কাছে দে। ওরে আমি এমন জায়গায় রাইখা আসমু যে কেউ আর ওর কোন খোঁজ পাইবনা। দামড়াডা চোখের আড়াল হলেই দেখবি আমজাদ আবার তোর দিকে মনোযোগ দিতাছে।
বাবুল দরজার পেছনটায় নিঃস্পন্দন দাড়িয়ে ছিল। মিজানের কথাগুলো সে বুঝতে পেরেছে কিনা কে জানে! লাইলির বসার ভঙ্গিতে তেজী ভাবটা আর নেই।
- বুঝবি, বুঝবি!! সব গেলে তারপর বুঝবি। এই যে তোর ছোট ছেলেটা- লাস্ট টাইম আমজাদ কখন এরে কোলে নিছে! এইডার কথা না হয় বাদ দিলাম, তোর পেটে যে আরেকটা বড় হইতাছে- সেটার কি তার কোন খবর আছে!
লাইলি যে হাজার ভোল্টের ইলেকট্রিক শক খেল। এখনো দেড় মাস ও হয়নি। বাইরে থেকে দেখে এখনই বোঝার কথা না। মিজান ব্যাপারটা কিভাবে বুঝলো!
গত কয়দিন সে সময়ে অসময়ে বমি করেছে, নতুন কাঁথা সেলাই করেছে... সব আমজাদের সামনে, কিন্তু সে তো কিছুই বুঝলনা!


খাওয়া দাওয়া শেষে আরো কিছুক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে মিজান বিদায় নেয়। টিভিতে এখন খুব ভালো একটা প্রোগ্রাম হবার কথা। কিন্তু মিজানের কথাগুলো আজ লাইলিকে বড় বেশি কাহিল করে দিয়েছে। বালিশে মাথা ছোঁয়াতেই সে ঘুমিয়ে পড়লো। খুব গভীর, ক্লান্ত এবং অসহায়ের মত সে ঘুম।
শেষ বিকেলের দিকে সে স্বপ্নে রাজাকে দেখতে পেল। রাজার মেজাজ এখন বেশ ভালো। বিকেল বেলার অদ্ভুত আলোয় রাজা বসে বসে চা খাচ্ছেন। রাজার পাশে যে সুন্দরী মেয়েটি বসে আছে, তাকে লাইলি চেনেনা।


কোথায় যেন ক্রমাগত কচকচ একটা শব্দ হচ্ছে। মিজান হতাশ ভাবে মাথা নাড়ে,
- আরে বোদাই! মাইডারে চিনতে পারলিনা! এইডা আমজাদের নতুন বউ। তোমার সোয়ামী আবার বিয়া করছে... এইবার তাইলে বুঝো ঠ্যালা!
কচকচ শব্দটা ক্রমশ বেড়ে চলছে। বাবুল বাথরুমে ঢুকেছে অনেকক্ষণ হল। আবার নিশ্চয়ই সব নোংরা করেছে।
ম্যানেজার সাহেব দুঃখী দুঃখী মুখ করে সামনে এসে দাঁড়ান। বিশাল ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিয়ে ম্লানভাবে বলেন,
- চলেন মা জননী। এখন থেকে আপনি আমার বাসায় থাকবেন।
কচকচ শব্দটা বোধহয় বাথরুম থেকেই আসছে। বাথরুমের দরজা ফাঁক করতেই দেখা গেল বাবুল ভেজা মেঝেতে বসে আছে, হাতে একটা ধারালো কেঁচি। সামনে একটা সদ্যভুমিষ্ঠ বাচ্চা সমানে হাতপা নেড়ে যাচ্ছে।
যেন পুতুল খেলছে এমন ভঙ্গিতে বাবুল বাচ্চাটার একটা আঙ্গুল তুলে কেঁচি দিয়ে কেটে ফেলল। কচ করে একটা শব্দ হয়। লাইলি ধড়মড় করে উঠে বসে। আশ্চর্যজনকভাবে কচকচ শব্দটা তখন ও হচ্ছিল।
লাইলি বাঁ হাতে চোখটা কচলে দেখে নিচে মেঝেতে বসে আছে বাবুল। সিলভারের বড় কেঁচিটা দিয়ে মনের সুখে তার নতুন বানানো কাঁথাগুলো কেটে কুচিকুচি করছে।
লাইলির মাথাটা একটু টাল খেয়ে যায়। পেছন থেকে মিজান এলোমেলো সব ডায়লগ প্রম্পট করতে থাকে। এলোকেশী লাইলি হাত বাড়িয়ে বাবুলের হাত থেকে কেঁচিটা ছিনিয়ে নেয়। কানদুটো শোঁশোঁ করছে, চোখদুটো উলটে যাচ্ছে প্রেত্নীসুলভ ক্রূরতায়।
বাবুলের বোধহীন চোখদুটোতে ভয়ের ছাপ পড়ে। কুলকিনারাহিন, অমানুষিক ধরনের সে ভয়ে শরীরের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রক্ত কনিকারা কেঁপে উঠে... হৃৎপিণ্ড ও ক্ষণিকের জন্য কাজ থামিয়ে দেয়।
হাতের মুঠিতে কেঁচিটা শক্ত করে ধরে লাইলি একটু একটু কাঁপতে থাকে। বাবুলের হতভম্ব চেহারাটা এখন আর সে দেখতে পাচ্ছেনা। তার বদলে দেখা যায়- অবিরল রক্তে চারপাশ ভেসে যাচ্ছে... ছোপছোপ সে রক্তের মাঝে শুয়ে সদ্যভুমিষ্ঠ সেই শিশুটি এখনও হাতপা ছুড়ে যাচ্ছে।



চৈতি গার্মেন্টসের পেছনের জমিটা শেষমেশ কিনেই ফেলল আমজাদ। বেশ সস্তাতেই পাওয়া গেছে জমিটা। বিশাল এক থোকা লিচু ব্যাগে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে আমজাদ ঘরে ফিরছিল। মনের মাঝে খুশির হাওয়ারা পাক খাচ্ছে। ছেলেটা লিচু খেতে এত পছন্দ করে!
এদিকটায় ইদানীং খুব বেশি চুরি ছিনতাই হচ্ছে। ন’টা বাজতেই রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা হয়ে যায়। বাসার সামনে আস্তেই আমজাদের হঠাৎ মনে হল- একটা কিছু ঘটেছে... গতানুগতিকতার বাইরে, অস্বাভাবিক একটা কিছু।
ঘরে ঢুকে দেখে বসার ঘরে লাইলি চুপচাপ বসে আছে। বসার ভঙ্গিটি অস্বাভাবিক, চুল এলোমেলো। আমজাদ মনে মনে একটু হাঁসে। পেটে বাচ্চা এসেছে, এ সময়টাতে মেয়েরা একটু এলোমেলো থাকবেই। আর লাইলি তো একটা আস্ত পাগল।
পায়ের শব্দ শুনে লাইলি মুখ তুলে তাকায়। আমজাদ লিচুর ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে ভেতরের ঘরে ঢুকতেই অস্বাভাবিক ব্যাপারটা ধরতে পারল।
বাচ্চাদুটো নির্নিমেষে ঘুমোচ্ছে। রাত একটা দুটোর আগে এরা কখনো ঘুমায়না, আজ ঘুমাচ্ছে কারণ- বসার ঘরে টিভিটা বন্ধ। একারণেই সবকিছুই এত শুনশান লেগেছে।
ন’টার খবর দেখার দরকার। টিভি চালাতে গিয়ে আমজাদ টের পেল টিভির পেছনের ক্যাবল কানেকশনটা কেউ একজন ক্রুদ্ধভাবে কেঁচি দিয়ে কেটে ফেলেছে।
আমজাদ অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই লাইলি একটু লজ্জা পেল।
- এই বাড়িতে আর কখনো অইসব সিরিয়াল চলবেনা, দুনিয়ার যত ফালতু কূটকচালই আর প্যাঁচঘোঁচ! এইসব দেখলে ভালো মানুষ ও পাগল হয়ে যাবে।
আমজাদ স্নেহের ভঙ্গিতে লাইলির মাথায় হাত রাখে।
- আর শোনেন, ভাইজান দুপুরের দিকে এসে বড় বিরক্ত করেন। ওনারে বলবেন- উনি যাতে এখানে আর না আসেন।
আকাশে যে কখন মেঘ জমেছিল- তারা কেউই টের পায়নি। অনেক অনেক আলোকবর্ষ দূর থেকে কেউ একজন আগ্রহভরে নাটকের শেষ অংশ দেখছিলেন। টিনের চালে রিমঝিম বৃষ্টির মাধ্যমে তিনি আবিষ্ট দম্পতিটির জন্য বিনোদনের বিকল্প সংস্থান করে দেন। দিগন্ত জোড়া উথাল পাথাল বৃষ্টিতে ওরা দুজন স্বপ্নোত্থিত হয়ে বসে থাকে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তানি হক প্রথম দিকে তাল সামলাতে একটু হিমসিম খেয়েছি ..রাজা ..ছোট রানী ..বড় রানী ...পরে লাইলি ..মিজান..আমজাদ ..একটু প্যাচ খেয়ে যাচ্ছিলাম ...কিন্তু কিছুদুর এগুতেই ..খুব সুন্দর ভাবে সব পরিস্কার বুঝেছি ..আর শেষে এসে তো সব প্যাচের জোট খুলল ..খুব খুব ভালো লেগেছে যে ..লাইলি ক্যাবল কানেকশনটা যে নিজের হাতে ..কেটেছে ..পরিস্থিতি অনুজয়ী উচিত কাজ .. আর আমজাদ সাহেবের ..(আমজাদ স্নেহের ভঙ্গিতে লাইলির মাথায় হাত রাখে) এই লাইনটি খুব প্রশংসনিয় ও অনুপ্রেরণা মূলক ..সব মিলিয়ে ..ভাইয়ার গল্পটি দারুন দারুন উপভোগ করলাম ...ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা ভাইয়াকে //
ভালো লাগেনি ২৮ জানুয়ারী, ২০১৩
সেলিনা ইসলাম দুপুরের মত ফাউল ব্যাপার পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারেনা। সকাল কিংবা রাতগুলোকে তাও কোনরকমে সামাল দেয়া যায়। ব্যাপারটা কিন্তু আমিও অনুভব করেছি এবং মিজানের মতই আমাকেও সময়টা ভাবিয়েছে! গল্পটা বেশ ভাল লাগল একটু ভিন্নতা আছে গল্পে। শুভকামনা
ভালো লাগেনি ২৬ জানুয়ারী, ২০১৩
Lutful Bari Panna এইরকম দুর্দান্ত একটা গল্পে ভোট বন্ধ কেন সেটাই মাথায় ঢুকল না। যাই হোক গল্পকার রনীলের বইয়ের অপেক্ষায় আছি। আগামী বছর হলে আমি নিজেও সামিল হয়ে যেতে পারি একটা বইসহ।
ভালো লাগেনি ২৫ জানুয়ারী, ২০১৩
এই গল্পটা এর আগে একটা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, যে কারণে এটিকে আবার প্রতিযোগিতার জন্য জমা দেওয়াটা কে ন্যায়সঙ্গত মনে হয়নি... আর বই! ওরে বাপরে বাপ... :P
ভালো লাগেনি ২৬ জানুয়ারী, ২০১৩
তাপসকিরণ রায় গল্পটি কোথাও মনে হোল সাধারণ,কোথাও কাব্যিক,আবার কোথাও সংযোগের অভাব,এতা আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত।
ভালো লাগেনি ২৩ জানুয়ারী, ২০১৩
সূর্য একবার হলো কি পাঙ্খোরি নামের এক মেয়ে চরিত্রের বাপ দাদা চৌদ্দগুষ্ঠির সবাইকে সমানে তার শশুর বাড়ীর কে কে যেন অপমান করছে। রিমোটটা তোমার ভাবির হাতে। কিছুক্ষন দেখার পর মেজাজ এমন খারাপ হলো মন চাইলো টিভিটাকে মাথায় তুলে আছড়ে ফেলি, মানুষ কতটুকু অপমান সহ্য করতে পারে? পাঙ্খোরী চরিত্রটাকে একটা থাপ্পর মেরে বলতে ইচ্ছে করছিল "তুই কি মানুষ!" টিভি সিরিয়ালগুলো এমন ভাবে আমাদের বাড়ীর মহিলাদের জড়িয়ে নিয়েছে কখন যে তারা সিরিয়াল দেখে দু:খী হয় আর কখন যে বাস্তবেই দু:খী বোঝা বড় মুশকিল। এ গল্প পড়ে মনে মনে ভাবছি ইস বাড়িতে গেলে যদি এমন কথা শুনতে পেতাম "এই বাড়িতে আর কখনো অইসব সিরিয়াল চলবেনা, দুনিয়ার যত ফালতু কূটকচালই আর প্যাঁচঘোঁচ! এইসব দেখলে ভালো মানুষ ও পাগল হয়ে যাবে।" জীবনের অেনকটা সময় আটকে গেছে ওখানে। তোমার এক্সপেরিমেন্টগুলো দারুন উপভোগ করছি রনীল।
ভালো লাগেনি ১৮ জানুয়ারী, ২০১৩
বিন আরফান. পড়লাম. ভালো লাগলো. অসাধারণও বটে
ভালো লাগেনি ১৬ জানুয়ারী, ২০১৩
মামুন ম. আজিজ ব্যতিক্রম এঙ্গেলে লেখার চেষ্টায়ম তার বারবারই সফল হচ্ছ। ...বাস্তব, কল্পনা এবং সম্ভবত টিভির পোগ্রাম মিলে মিশে এক কেমোফ্লেজে দশর্ককে আটকে থাকতে বাধ্য করলে......এটা অভাবনীয়, তোমার গল্প মনোযোগ দিয়ে পাঠক পড়তে বাধ্য....চোখের নিমিষে পড়ে গেলে মূল সুরটাই খেই হারাবে পাঠকে কাছৈ.....আমি যে বক্তব্য পেলাম তার মূল সুর মনে হচ্ছে হিন্দী সিরিয়ালের প্রতি একটু নাক সিটকানো...ঠিক আছেতো
ভালো লাগেনি ১৬ জানুয়ারী, ২০১৩
মোঃ আক্তারুজ্জামান লেখাটিকে স্বপ্ন, বাস্তব, অবাস্তবের মেলবন্ধন করতে লেখকে ভাবনার কতটা গভীরে যেতে হয়েছে তাই ভাবছি| চিন্তা, দক্ষতার কঠিন প্রমান রেখেছ ভাই রনীল| খুব ভালো লাগলো|
ভালো লাগেনি ১৫ জানুয়ারী, ২০১৩
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন ....................চমতকার কাহিনী, আগাগোড়া মনো যোগ ধরে রাখতে পেরেছে। প্রথম দিকে মনে হল সাধু-চলিত জট পাকাচ্ছে, পরে একেবারে সাবলীল। ভাল লেগেছে। শুভেচ্ছা রইল।
ভালো লাগেনি ১৪ জানুয়ারী, ২০১৩
মিলন বনিক আপনার গল্প পড়ার সময় মনে হয় কবিতা পড়ছি...এত প্রানবন্ত আর ঝরঝরে কথার গাঁথুনি..রনীল ভাই অসীম ভালো লাগা তবে ৩-এ ম্যানাজার ভুমিকাটা রাজা রানীর সাথে কেমন বেমানান মনে হলো....অনেক শুভ কামনা....
ভালো লাগেনি ১৩ জানুয়ারী, ২০১৩

০৪ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪