( ১ )
১৯৭১ সাল । বাবার কর্মস্থল কলারোয়া থানা শহর , ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি । । ছোট্ট শহর । পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সরু একটা নদী । পাকিস্তানী সেনাদের সরব উপস্থিতি শহরে । আমাদের প্রাইমারী স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে । স্কুলের মাঠে সৈনিকদের অস্থায়ী ব্যারাক । চারিদিকে চাঁপা উত্তেজনা , উঠতি বয়সের ছেলেদের চোখে কি যেন এক চঞ্চলতা !
রোজ সন্ধ্যার মত আজও বাবা রেডিওর নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খবর শোনার চেষ্টা করছেন । রুটিন মত পাশে বসে আছেন সাদেক কাকা । তারা বি বি সির পরে ভয়েস অব অ্যামেরিকা শুনবেন । মাঝখানে ছোট্ট বিরতি । এ সময়ে বাবা ভেতরের দরজার পর্দার দিকে তাকিয়ে গলা উঁচিয়ে বলবেন , চা কোথায় ? আমি খুব সাবধানে ট্রেতে করে দু কাপ চা আর এক পিরিচ সল্টেড(নাবিস্কো ) বিস্কিট নিয়ে যাব । সাদেক কাকা আমাকে বিস্কিট সাধবেন । মায়ের বারন আছে , আমি না নিয়ে চলে আসবো । খবর শোনার পর প্রতিদিনই তারা দুজনে খবরগুলো বিশ্লেষণ করে থাকেন । তখন তাদেরকে দুই জন উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন মন্ত্রী জাতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মনে হয় । আজ বি বি সির পরেই বাবা নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আরেকটি রেডিও ষ্টেশন ধরালেন বাবা । খবর শোনা শেষে সাদেক কাকা আর বসলেন না । শুধু বললেন , স্বাধীন বাংলা রেডিও সার্ভিস শুরু করেছে , বুঝলেন স্যার , দেশ স্বাধীনের আর বেশী বাকি নাই । তার কথায় বাবা গম্ভীর ভাবে সায় দেন । অল্প কদিন আগে ইলেকশন নামের যে একটা উৎসব মত কিছু একটা হয়ে গেল , আমি কিন্তু তখন থেকেই বুঝতে পেরেছি দেশে বিশাল কিছু একটা হতে যাচ্ছে , যা আগে কখনো হয়নি ।
পরদিন সকালে বাবা কোন পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই আমাদের গ্রামের বাড়ীতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত শোনালেন । আমাদের আনন্দের মাত্রা হঠাৎ আকাশ স্পর্শ করলো । আমাদের মানে আমার আর শিমুলের । আমার এক বছরেরে বড় বোন । দুজনে একসাথে আমরা ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছি এ বছর । আমাদের আরেকটা ছোট ভাই আছে বিপ্লব । সে কেবল হামাগুড়ি দিতে শিখেছে । পানি খেতে চাইলে সে বলে , ওবো । মা তাকে ধরে ধরে পানি খাওয়ান । আনন্দের বিষয় তাকে এখনো স্পর্শ করতে পারে না । তবে তাকে আমি আরও স্মার্ট বানানোর জন্য প্রানপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি । শিমুল তার পুতুলের কিছু পুরনো শাড়ী দয়া করে আমাকে দিয়ে দিয়েছে । মায়ের সেলাই মেশিন থেকে গোপনে সিজার সরিয়ে আমি ওগুলো কেটে পতাকা বানিয়েছি । লাল নীল পতাকাগুলো কাঠির ডগায় উঁচু করে আমি যখন বলি পদ্মা মেঘনা যমুনা , তোমার আমার ঠিকানা , আমার ছোট ভাই বিপ্লব তখন মুখের লালা ভেজা তর্জনীটা খাড়া রেখে মুঠো হাত উঁচু করে শেখ মুজিবের মত নাচাতে থাকে । এটার নাম পতাকা পতাকা খেলা ।
শেখ মুজিব কে তা আমি অবশ্য জানি না । তবে আমি একটা মজার ছড়া শিখেছি কিছুদিন আগে ইলেকশনের সময় ।
দারিপাল্লায় সেন্ট নাই ,
ভোট দিয়ে কাম নাই,
ভোট দেব কাকে ?
মুজিবরের টাকে ।
বাসায় বাইরের কেউ আসলেই বাবা আমাকে ডাকেন ছড়াটা শোনাবার জন্য । ছড়া শুনে অতিথি আনন্দিত হয়ে আমাকে চেপে ধরেন , ‘শেখ মুজিব কে তা জানো ?’ আমার অজ্ঞতা তাদের বিনোদনে আরও একটি মাত্রা যোগ করে ।
মা যখন আমার কাছে বিপ্লবকে রেখে সাংসারিক কাজকর্ম সারেন তখন আমরা দুভাই পতাকা পতাকা খেলি । খেলতে খেলতে সে দাঁতবিহীন লাল মাড়ি বের করে হাসতে থাকে । আমি তখন তার পেটে আর বগলে কাতুকুতু দিতে থাকি । হাসতে হাসতে সে জমাট বাঁধা দুধ বমি করে ফেলে । মা তেড়ে আসেন , আমি পতাকাটা পকেটে নিয়ে পালিয়ে যাই ।
( ২ )
আমাদের দেশে যাওয়া মোটেও সহজ হোল না । পরদিন খুলনা থেকে মেঝ মামা এলেন আমাদেরকে সাতক্ষীরা হয়ে খুলনা মামাবাড়িতে নিয়ে আসবেন । কথা ছিল খুলনা দুই তিন দিন থাকার পর আমাদেরকে গোপালগঞ্জে গ্রামের বাড়ীতে রেখে আসবেন ছোট মামা । তিনি অবিবাহিত , ছাত্র । আমরা আসার রাত্রে ছোট মামা পালিয়ে ভারতে চলে গেলেন । তার রুমে টেবিলের ড্রয়ারে একটি চিঠি পাওয়া গেল । সম্বোধন বিহীন সে চিঠিতে লেখা , যুদ্ধে যোগ দিতে এ ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলনা ! নানাজানের বয়স নাকি আশির কাছাকাছি , ইতিমধ্যে দুইবার স্ট্রোক করে তিনি প্রায় শয্যাশায়ী । রোজ সকালে মামাতো ভাই শিপলু তাঁকে পাশের ওয়াপদার রাস্তায় ধরে ধরে হাঁটান । ছোট মামার যুদ্ধযাত্রায় নানাজানের মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল । যুদ্ধে যাবার অপরাধে তিনি ছোট মামাকে ত্যাজ্য পুত্র ঘোষণা করবেন , সাফ জানিয়ে দিলেন । আমি অবশ্য ত্যাজ্য পুত্রের মর্মার্থ বুঝতে পারি নাই । আমার খালাতো ভাই সোহেলের কিছুটা ইঁচড়ে পাকা বদনাম ছিল । সে আমার মাথায় গাট্টা মারে বলল , প্রেম করে বিয়ে করলে এই কঠোর শাস্তি দেয়া হয়। প্রেম সম্পর্কেও আমার কোন জ্ঞান নেই । গাট্টার ভয়ে আমি প্রেম বিষয়ক জ্ঞানার্জন থেকে নিজেকে সংযত করলাম । নানাজান অবশ্য বলছেন , সব দোষ নাকি আমার নানীজানের । ছোট মামা জন্মের সময় তিনি মারা না গেলে আজ মামার এই দুর্দশা হতো না , এ ব্যাপারে নানাজান নিশ্চিত । সারা দিন তিনি পুত্রশোকে বিরতিহীন ভাবে চিৎকার করতে লাগলেন । এশার পর তার গলার স্বর বুজে এলো । চোখে জল বইতে লাগলো । তিনি আয়েশা , আয়েশা বলে বিশ বছর আগে জান্নাতবাসীনী নানীজান কে ডাকতে লাগলেন ।
আমাদের সময় অবশ্য কাটছে ভালই । পাঁচ মামার বিশাল একান্নবর্তী পরিবার । মামাতো ভাইবোনের সংখ্যা অগণিত । ঘটনাক্রমে একমাত্র খালার ছেলে মেয়েরাও এখানে । পাশেই বিখ্যাত প্রেমকানন । সেখানে ঝোপঝাড় কেটে মাষ্টার – ছাত্র , সওয়ারী সমেত ঘোড়া , বাঘ , ভালুক ইত্যাদি বানানো হয়েছে । শহরের মাঝে বিশাল এক ফুলের বাগান । নয়নাভিরাম রকমারী ফুল । আমাদের কাজ সারাদিন প্রেমকাননে ফুল ছেঁড়া আর দুপুরে গোসলের নামে পুকুরে ঝাপাঝাপি করা । সন্ধ্যায় প্রেমকাননের হিন্দুস্থানী মালির নালিশ আসে । বিচারসভায় বড়মামার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি আমরা জনা বিশেক মামাতো-ফুফাতো-খালাতো ভাইবোন । বড়মামা নিজে নিঃসন্তান । কি জলদগম্ভীর তাঁর কণ্ঠস্বর ! হাতে লম্বা বেতের লাঠি , কিন্তু তিনি আমাদের গায়ে হাত তুলেন না । সব অপরাধের একই শাস্তি তার কাছে । নাকে খত দেয়া । সবাই মিলে শাস্তি খাবার মজাই আলাদা । আমরা কালো মুখ করে পরমানন্দে শাস্তি ভোগ করি এবং পরদিন একই অপরাধের পুনরাবৃতি ঘটাই ।
কলারোয়া ছাড়ার সাতদিনের মাথায় সেখানে বাড়ী বাড়ী তল্লাশী শুরু হোল । আর্মির লোকেরা শহরের বাড়ীতে বাড়ীতে এসে যুবক ছেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে । যে বাড়ীতে উঠতি বয়সের কোন ছেলে নেই সে বাড়িগুলো তাদের টার্গেট হয়ে যায় , অর্থাৎ তারা ধরে নেয় যে ওই বাড়ীটার ছেলেটি মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিয়েছে । আমাদের পাশের বাড়ীটি ছিল এক ইমাম সাহেবের । সৈন্যরা এক সকালে এসে বাড়ীতে তাঁকে ছাড়া কোন পুরুষ নাপেয়ে মহাখ্যাপা । তিনি যতই বোঝান তাঁর সাত মেয়ে , কোন ছেলে নেই , অফিসার বিশ্বাস করেননা । মিথ্যাকথা বলার জন্য তাঁকে তাঁরই বৈঠকখানায় কান ধরে ওঠ বস করানোর আয়োজন হোল । বড় মেয়েটি বাবাকে বাঁচাতে পর্দার বাইরে এসে ‘বেগানা আওরাত’ গালি খেল । শাস্তি স্থগিত করে তাঁকে ছেলে হাজির করতে একবেলা সময় বেঁধে দিয়ে অফিসার সদলবলে চলে গেলেন । ভদ্রলোক একঘণ্টার মধ্যে বাড়ী ছেড়ে গ্রামে শ্বশুরালয়ের উদ্দেশ্যে সপরিবারে চলে গেলেন । সেদিন আমার বাবা একটি কঠিন সিন্ধান্ত নিলেন । পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিন না ভেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পরদিন পালিয়ে ভারত চলে গেলেন । যাবার আগের রাত্রে তিনি অফিসের পিয়ন কালীপদকে ডেকে আমদের গ্রামের বাড়ীতে আম্মার যা কিছু সোনাদানা ছিল , পৌঁছে দিতে দিলেন । কালীদার বাড়ী গোপালগঞ্জে , আমাদের পাশের গ্রামে । তিনি খুলনায় মামাবাড়িতে আগেও এসেছেন । মা দাদার কাছে সব শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন ।
ইদানিং আমাদের আনন্দ মারাত্মক ভাবে হ্রাস পেয়েছ । অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মালীরা প্রেমকাননের লোহার গেটে বড় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে । তাই আমাদের থাকতে হচ্ছে পিকনিক পার্টির আগমনের অপেক্ষায় । বর্ষাকাল শুরু হয়েছে । চারিদিকে অজানা আশঙ্কা । আমরা তবুও অপেক্ষা করি । কোন পিকনিক পার্টি এলে আমরা সদলবলে তাদের সাথে মিশে ভেতরে ঢুকে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে ফেলি । অবশ্য আমাদের আনন্দ দেয়ার জন্য সোহেল ভাই আরও নতুন নতুন খেলা আবিষ্কার করছেন । তার একটা হোল চড়ুইভাতি । আমরা বাড়ীর ভেন্টিলেটরে বাসা বাঁধা চড়ুইগুলোর ঘর-সংসার তছনছ করি । ডিম পেলে আনন্দের সীমা থাকে না । আর চড়ুই পেলে তো রাজ্যই পেয়ে গেছি এমন একটা ভাব । তক্ষুনি কিছু চাল সরিয়ে ছোট্ট পাতিলে ভাত রাঁধা হবে । চড়ুইয়ের অবস্থা ততক্ষনে মরো মরো । দুই জন সাহসী ভলান্টিয়ার চড়ুইয়ের পুরোপুরি মৃত্যু ঘটিয়ে ফেলবে । এ সময়ে আমাদের মধ্যে যাদের মন অপেক্ষাকৃত নরম তারা দূরে দূরে থাকে ।
(৩)
বরষায় ফুলে ফেঁপে নদী সুবিশাল হয়ে উঠেছে । লঞ্চের ডেকের উপরে আপার কেবিন । আমি আর শিমূল পাল্লা দিয়ে বানান করে পড়ে চলি দেয়ালে লেখা বিভিন্ন তথ্যাদি , ‘আপার ক্লাসের ভাড়া দ্বিগুণ , সময়ের চেয়ে জীবনের মুল্য বেশী , ভদ্রতা বজায় রাখুন’ । কেবিনের ভেতরে আমাদের বসার ব্যাবস্থা করা হয়েছে । কিন্তু আমরা এ জটলা থেকে সে জটলা ঘুরে বেড়াচ্ছি । ছোট্ট লঞ্চ । যাত্রীদের মনে অজানা আশঙ্কা । এ লাইনে প্রায়শই লঞ্চ ডুবি হচ্ছে । অনেক চেষ্টায় ও আমাকে সাঁতার শেখানো সম্ভব হয়নি । আমি আর সাঁতার শিখতে পারব বলে শিমুল মনে করে না । একমাত্র বুদ্ধি হোল ‘পিঁপড়া ঔষধ’ । আমাকে দশটা জ্যান্ত পিঁপড়া ধরে খেতে হবে । বিষয়টা অবশ্যই গোপনে করতে হবে , কাক পক্ষীটিও যেন জানতে না পারে । এতে একটা আশা আছে । বড় বড় ঢেউয়ে লঞ্চ দুলছে । আমি বড়ো একটা ঢোক গিলে রাজি হয়ে গেলাম । শিমুল বলল , দেখিস , কাউকে বলা যাবে না কিন্তু । কাউকে মানে মাকে । আশু মৃত্যু দর্শন করে আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে দিলাম ।
লঞ্চ থেকে নেমে আমাদের নদী পার হতে হোল । তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে । দূরে কৃষ্ণকায় একটি ছেলে এই বর্ষায় হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে গরুর জন্য ঘাস কাটছিল । আমাদের দেখে সে ছুটে এসে আমাকে কাঁধে তূলে নীল । জিগ্যেস করলো , হোয়াট ইজ ইয়োর নেম ? আমি নাম বলতেই ফের জিগ্যেস করলো কেমন আছি , তাও ইংরেজিতে । এই হোল আমার বড় দাদার নাতি , প্রিয় সাজু ভাই । প্রতিবারই তিনি ইংরেজীতে এসব প্রশ্ন করেন । বাড়ীতে এঁরা দুই ভাই বাবার সাথে ইংরেজিতে ঝগড়া করার কারনে এর মধ্যেই আশেপাশের কয়েকগ্রামের মধ্যে বিখ্যাত হয়ে গেছেন । পথ সামান্য । তবে পানির প্লাবনে পথ অপথ একাকার । অন্যদের নিতে নৌকা এলো । আমাকে সাজু ভাই বুক পানি ঝাঁপিয়ে পাঁচ মিনিটেই বাড়ীতে নিয়ে এলো । অন্দরমহল থেকে রাঙা কাকী এসে মুহূর্তেই বুকে জড়িয়ে নিয়ে সোজা পুকুর পাড়ে চলে এলেন । গোসল সেরে দাদা-দাদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম । ততক্ষণে নৌকার যাত্রীরাও এসে পড়েছে । দাদাজান বয়সের ভারে শয্যাশায়ী । অস্পষ্ট শব্দে তিনি বৃষ্টির ধারার মত অবিরাম গালি দিতে লাগলেন আমার আব্বা আর রাঙা কাকাকে । তখনি জানলাম রাঙা কাকাও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন ।
রাঙা কাকা হলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর মানুষ । গান গাওয়া , ফুটবল খেলা , অভিনয় করা থেকে শুরু করে দুনিয়ার সব কাজই তার খুব ভাল জানা । গল্প বলায় তার প্রতিভা অতুলনীয় । যখনি বাড়ীতে আসি , সারাক্ষণ তার পেছনে আমরা ঘ্যানর ঘ্যানর করতে থাকি , গল্প বল , গল্প বল । বরষায় গ্রাম ডুবি ডুবি । এক বাড়ী থেকে অন্য বাড়ীতে যেতে হচ্ছে নৌকায় চড়ে । দূরে যত দূর চোখ যায় মাঠ জুড়ে সবুজ আমন ধান ।কাছে পিঠের দুয়েকটা অল্প পানির জমিতে পাট চাষ করা হয়েছে । বাড়ীতে পাঁচটা বসত ঘর । সবচেয়ে প্রথম দাদা দাদির ঘর , আমরা বলি ওটা পশ্চিমের ঘর । তারপর রাঙা কাকার ঘর , পাশেই বিশাল ঘরটা কুটি কাকার । আমাদের জন্য পুবের ঘরটা প্রস্তুত করা হচ্ছে । ঘরটা অব্যবহৃত থাকায় সাপ কোপের আড্ডাখানায় পরিনত হয়েছিল ।
বাইরের কাছারীতে অভ্যাগত পুরুষদের আড্ডা তরুন , যুবক , বয়স্ক । দুটো হুক্কা পর্যায়ক্রমে এ হাত ও হাত ঘুরছে ।
( ৪ )
বাবার অবর্তমানে জীবনের রঙ যেন সাদা কালোতে সীমিত হয়ে গেছে । এরই মধ্যে আমার ভেতরে জেগে উঠেছে অন্য এক আমি । যা করি ভেবে করি । যা বলি তা না বুঝে বলি না । সমবয়সী চাচাতো ভাই বোনদের সাথে আনন্দ করি , দুষ্টুমিতে মিলে যাই । কিন্তু সীমা আর শালীনতা বুঝতা পারি । তিন মাস পর বাবার দেখা মিলল । রাতের আঁধারে । একটা ঝটিকা অভিযানে এসেছিলেন চার মাইল দূরের এক রাজাকার ক্যাম্পে । অপারেশন শেষে কমান্ডারসহ দলের সবাইকে নিয়ে চলে এসেছেন । দলনেতা অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য , খুবই কঠোর , সময় বরাদ্দ মাত্র চার ঘণ্টা । ঘুম থেকে উঠিয়ে বাবার কোলে দেয়া হোল আমাকে । বিস্মিত হয়ে বাবা বললেন , বেটা রোমেল , তুই তো মাশাআল্লাহ অনেক বড় হয়ে গিয়েছিস বাপ । আসলেও আমি বেশ বেড়ে উঠেছি , অনেকেই নয় দশ বছরের ছেলে বলে মনে করে আজকাল । বাবা দেখছি দাঁড়ি , গোঁফ সব ছেড়ে দিয়েছেন , চুল কাঁধ ছেড়ে পিঠ ছুঁয়েছে । গল্পের বইয়ের কিংবদন্তীর যোদ্ধাদের মত লাগছে তাঁকে । আমি স্বপ্নাবিষ্ট চোখে চেয়ে রইলাম । উঠোনময় লোক গিজগিজ করছে । মধ্যরাতের আনন্দজজ্ঞ । এরই মধ্যে খাসী জবাই করা হয়েছে । পোলাওয়ের গন্ধে সারা বাড়ী ম ম । মায়ের পরনে একটা আনকোরা শাড়ী , চোখে কাজল । সবচেয়ে বড় জটলাটা দাদার ঘরে । দাদাকে ধরে বালিশে হেলান দিয়ে শুইয়ে দিয়েছে । তাঁর পায়ের কাছে ষোল জন মানুষ দুই সারিতে বসা , ওরা মুক্তিযোদ্ধা । আমি আসতেই ওদের একজন অন্য একজনকে ফিসফিস করে কিছু বলল । চৌকস ঢঙ্গে একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলল , আপনিই ফিল্ড মার্শাল রোমেল ! হাবিলদার কেরামত অ্যাট ইয়োর সার্ভিস স্যার । বলেই লোকটি আর্মি কায়দায় পা ঠুকে একটা স্যালুট দিল । আমি হকচকিয়ে গেলাম । সবাই হো হো করে হেসে উঠলো । বাবা ওঁদের সাথে আমাদের পরিবারের অনেক গল্প করেছেন বুঝতে পারি । আমার আর্মি অফিসার হবার স্বপ্নটিও ওঁরা জানেন । মধ্যরাতের আলো আঁধারিতে ওঁদের মনে হয় খুবই চেনা , অনেক আপন ।
দেখতে দেখতে সময় শেষ । ভোর হতেও বেশী বাকি নেই । একটা বড়সড় টাবুরে নৌকা বাড়ীর সামনের ঘাটে বাঁধা ছিল । গোটা কয়েক গামছা , চার জেরিকেন মুড়ি , বেশ কিছু খেজুরের রসের পাটালী গুড় আর কয়েক সের চিড়া নিয়ে দলটি উঠে বসলো । আমরা বিষণ্ণ মনে বাবাকে বিদায় দিলাম । হঠাৎ পুবালি হাওয়ার তোড়ে মায়ের চোখ জলে ভরে গেল । সারা মুখে কাজল লেপে একাকার , নৌকার দিকে নির্বিকার চেয়ে রইলেন তিনি । ছয়টি দাঁড় ততক্ষণে ছন্দ তুলে পানি কাটতে শুরু করেছে । সতেরো জন সংসারত্যাগী সন্যাসী , তাঁদের বুকের ভেতর দুর্বাসার ক্ষোভ , চোখে জ্বলজ্বলে সুদিনের স্বপ্ন । ঐ তো দূর থেকে ভেসে আসছে তাঁদের কণ্ঠের গান , মুজিব বাইয়া যাওরে , নীল বাদাম উড়াইয়ারে মুজিব , আমার ভাঙা নাওরে মুজিব , বাইয়া যাওরে............।
(৫)
জুলাই মাসের শেষভাগে মধুমতীর পাড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাবাদের ক্যাম্পেটি আক্রমণ করে । মুক্তিবাহীনির মনোবল ভেঙ্গে দিতে এটি ছিল তাদের একটি আত্মঘাতী রেইড , শত্রু বাহিনীর দুঃসাহসী এক মরন কামড় । সাংকেতিক নাম দিয়েছিল ওরা ‘ অপারেশন রেড হার্ট ’ । ঐদিন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল দূরে একটি অপারেশনে যাওয়ায় ক্যাম্পে জনবল ছিল অপ্রতুল । সব খবর আগে রেকি করে নিশ্চিত হয়েই তারা এসেছিল । মুক্তিযোদ্ধারা হার মানে নি । স্বল্প সংখ্যক যোদ্ধা দৃঢ় মনোবল নিয়ে প্রবল বিক্রমে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন । সারারাত গুলি বিনিময় হোল । রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খান খান করে দিচ্ছিল দুপক্ষের মুহুর্মুহু গুলির শব্দ আর মৃত্যুর আর্তনাদ । চারিদিকে বারুদ আর পোড়া মাংসের গন্ধ । শেষ পর্যন্ত তারাই বিজয়ী হয়েছিল যারা বেঁচে ছিল । একটি শত্রু সেনাও সশরীরে ফিরে যেতে পারেনি । মাত্র তিন জন মুক্তিযোদ্ধা মাত্র বেঁচে ছিলেন । তাদেরই একজন আমাদের গ্রামের সেলিম কাকা । এসব পরে তার কাছ থেকে শোনা । সন্ধ্যায় কাকা আমাদের বাড়ীতে এলেন , সাথে কয়েকজন অচেনা লোক । তাদের কাঁধে একটি খাটিয়া । এতদিন কত প্রতীক্ষা ছিল বাবার জন্য ! তুমুল বৃষ্টিতে নাইতে নাইতে হঠাৎ মনে হতো , রাইফেল কাঁধে বাবা এসে এই বুঝি পেছন থেকে আমাকে শুন্যে উঁচিয়ে ধরবেন । পাটখড়ির ডগায় জিয়লের আঠা মাখিয়ে সঙ্গীদের সাথে ফড়িঙ শিকারে যেয়ে মনে হতো বাবা বুঝি আমাকে ফাঁকি দিয়ে বাসায় এসে গেছেন । ফড়িঙ ফেলে ছুটে এসেছি আমি । আমার প্রতীক্ষা আজ শেষ হয়েছে আমার । ফিরে এসেছেন বাবা । অন্যের কাঁধে শায়িত , নিথর । কপালে শত্রুর গুলির দাগ , রক্ত শুকিয়ে গেছে । রাইফেল হাতে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তেই বাবা শহীদ হয়েছেন । সবাই কাঁদছে । আমার কান্না পাচ্ছে না , শুধু শুন্য শুন্য লাগছে ......... মনে হচ্ছে খারাপ স্বপ্ন দেখছি । আমি প্রানভরে দোয়া করতে থাকি , হে আল্লাহ এটা যেন একটা দুঃস্বপ্ন হয় , শুধুই যেন দুঃস্বপ্ন হয় । সহসা বুঝতে পারি কেউ একজন আমার গলাটি চেপে ধরেছে , একটি শব্দও বেরুচ্ছে না ।
তিন দিন পর খুলনা থেকে মেঝ মামা এলেন , আমাদের নিয়ে যেতে । আমরা এখন থেকে মামাবাড়িতে থাকব । কয়েকদিন আগেও মামা বাড়ী যাবার বিষয়টা ছিল বিশাল আনন্দের । ওখানে আমাদের গ্রুপটাকে নিয়ে নতুন কিছু আইডিয়া সাজানো ছিল মাথায় , আজ সেগুলো পানসে লাগছে । মায়ের চোখমুখ ফোলা । সকালে শিমূল আমাকে এক কোনে ডেকে বলল , জানিস কিছু , আমাদের বেওয়ারিশ করা হবে । তার দিকে শুন্য দৃষ্টি দিয়ে আমার অজ্ঞতা বুঝিয়ে দিলাম আমি । শিমূল চেহারাটি শোকাতুর করে বলল , মুসলমানদের মধ্যে দাদা বেঁচে থাকতে বাবা মারা গেলে বাবার সন্তানেরা বেওয়ারিশ হয়ে যায় । মানে আমরা এ বাড়ীর কিছুই আর পাব না । আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল । দাঁত খিঁচিয়ে বললাম ,
-দাদাজান তোকে বলেছে ?
-তুই তোকারি করছিস কেন , আমি তোর বড় !
আমি বিরক্ত হয়ে কাছারি ঘরে চলে গেলাম । বারান্দায় ছোট চাচা হুঁকো টানছেন । মেঝ মামা তার পাশে চুপচাপ বসে আছেন । পরিবেশের গাম্ভীর্য দেখে বারান্দায় না যেয়ে পশ্চিমের কামরায় জানালা দিয়ে দুকুল প্লাবিত নদীটিকে দেখতে লাগলাম । উত্তাল বয়ে যাচ্ছে মধুমতী । এমন সময় আমার কানে এলো মামার কণ্ঠ ,
-দেখেন ভাইজান , তিন তিনটা সন্তান নিয়ে আজ আমার বোন বিধবা । তার স্বামীর টাকায় রাখা সম্পত্তিটুকু থেকে অন্তত বাচ্চাগুলোকে বেওয়ারিশ করবেন না ।
-বাবজান বাইচে আছে । সব জমি জিরাতই তার নামে । আইনে আপনার ভাগ্নে ভাগ্নীরা কিছুই পায় না । রাঙা যুদ্ধে গেছে । তয় করাচীতে আমি বড় ভাইজানরে চিঠি দিয়ে সব জানাব । ভাইজানের মতামত নিতে হবে ।
একটু থেমে আবার চাচা বললেন , ওদের নিয়ে যাচ্ছেন কখন ? বৃষ্টি বাদলার দিন । এক কাজ করেন , আজ দুপুরেই একটা ষ্টীমার আছে । লঞ্চ ডুবি হয় শুনছি , ষ্টীমার ডোবে না ।
আমার বড় চাচা শুনেছি করাচী থাকেন । তাঁকে কখনো দেখিনি । দেখবো কিভাবে তিনি তো সাত বছর দেশেই আসেন নি । বাইরে ঘন মেঘে আকাশ আঁধার হয়ে উঠেছে । দরোজা গলে মামাকে দেখা যাচ্ছে , তাঁর মুখটিও অন্ধকার ।
বাবা মারা যাবার দিন থেকে আমাদেরকে দাদা দাদীর ঘরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না ছোট কাকার নির্দেশে দুই দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে দুইজন কাজের মেয়ে । আমরা ভেতরে যেতে চাইলে এটা সেটা বলে সরিয়ে আনে তারা । । বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাদার গোঙ্গানি আর দাদীর বিলাপ শুনি । আমরা রওনা হবার আগেই রাঙা কাকী এক কাপড়ে বাড়ী ছাড়লেন । গতকাল থেকে দানা পানি মুখে দেন নি । সকালে একবার জ্ঞান হারিয়েছেন । তিন গ্রাম পরেই তাঁর বাপের বাড়ী । তাঁকে নিতে ভাইয়ের ছেলে এসেছে । যাবার আগে কাকী মায়ের পা ছুয়ে সালাম করতে এসে পায়ের উপর আঁচড়ে পড়লেন । তাঁর মুখে ভাষা নেই , শুধু এটুকুই বলতে পারলেন , রাঙা মিয়া আজ বাড়ীতে থাকলে এটা হতে পারতো না । দাদীকে দাদার সাথে আটকে রেখে দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছে কেউ । আসার আগে মা শ্বশুর শ্বাশুড়ীকে সালাম করে বিদায় নিতে চাইলেন । কিন্তু চাবিটা পাওয়া গেল না । দরজার ওপাশে আমার দাদী বুক চাপড়ে উচ্চস্বরে বিলাপ করছেন ।
( ৬ )
মামা বাড়ীর মুল বিল্ডিঙের সামনে রাস্তার সাথে লাগোয়া একটা ছোট্ট টিনের ঘরটি ছিল । সেখানে আমাদের আশ্রয় হোল । ঘরটার একপাশে একটা নতুন বাথরুম তৈরি হয়েছে আমাদের সুবিধার্থে । ছোট্ট ঘরটির সাথে করুগেটেড টিনের একটা ছাপড়া মত করা হয়েছে , আমাদের রান্নাঘর । সারাদিন মা কান্নাকাটি করেন , শিমূল মুখ ভার করে কাটায় । সবাই আগের মত আর খেলতে ডাকে না । যতক্ষণ জেগে থাকি আমার কাছে বন্দী জীবন মনে হয় ।
আমাদের আগে এই ঘরটা রিক্সা মিস্ত্রীর জন্য নির্দিষ্ট ছিল । মেঝমামার ছিল একশোর ও বেশী রিক্সা । এখানেই সেগুলোর মেরামতির কাজ চলত । সম্প্রতি রিক্সাগুলো বিক্রি করে বিশাল চালের আড়ত কিনেছেন মামা । সেখানে একপাশে শত শত বস্তা চাল মওজুদ রাখা হয় , অন্যপাশে ধান , গম আর ডাল ভাঙ্গানো হয় । জনা বিশেক নারী পুরুষ গায়ে-মুখে আটা মেখে সকাল সন্ধ্যা কাজ করেন । কি বিশাল হৈ চৈ ! নানাভাইয়ের শরীর কিন্তু ভাল নেই । আমরা দেশে যাবার পরপরই তিনি আরেক বার স্ট্রোক করে বাকশক্তি , চলনশক্তি দুইই হারিয়েছেন । ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে । তাঁর সবকিছুই এখন বিছানাতে । সবচেয়ে বেশী ক্ষয়িষ্ণু বড়মামা । তার তোয়াক্কা বড় বেশী করছে না কেউ । ইদানিং তার সামনে শিপলু , টিপলু , সাচ্চু , বাচচুরা দুষ্টুমি করলে তিনি না দেখে অন্যদিকে চলে যান । চতুর্থজন তোতা মামা , ভালই আছেন তিনি । দুই মাস হল সপরিবারে কুমিল্লায় কর্মস্থলে থাকছেন । সবচেয়ে ফর্মে আছেন সেজমামা । চার মাস আগে যখন আমরা এসেছিলাম তখন পরিবারের সবাইকে এখানে রেখে উনি স্পেশাল ট্রেনিঙে রাজশাহীর সারদা গিয়েছিলেন । পুলিশ ইনেসপেক্টরের দাপট আর পয়সার বিষয়ে আমার আগে কোন জ্ঞান ছিলনা । মুহুরি বড়ভাইয়ের সামনে ছোট ভাই ইনেসপেক্টর সাহেবকে তর্জনী উঁচিয়ে গর্জন করতে শুনছি একাধিকবার । বড়মামার নীরবতার ব্যাখ্যা পেতে আমাকে আর ভাবতে হয়নি ।
আগে এবাড়ীতে সবাই আমাদের দেখে যেভাবে উচ্ছ্বসিত হতো , তাতে যথেষ্ট ভাঁটা পড়েছে । খাবার সময়ে আমাদের মুল বাড়ীতে যেতে হয় । আগে বৈঠকখানায় মাদুর পেতে সারি বেঁধে খেতে বসার রীতি ছিল । মাদুরটি দ্রুত ছিঁড়ে যাচ্ছে । পাল্লা দিয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে পুরনো রীতিনীতি । ছেঁড়া মাদুরে সবার জায়গা হয়না । সেজমামার সন্তান সাচ্চু বাচ্ছুরা চার ভাইবোন ঘরেই নাস্তা সেরে নিচ্ছে । তাদের জন্য সকালে পরোটার সাথে জনপ্রতি একটি করে ডিম ভাঁজি করা হয় । ভাঁজা ডিমের বাটি আমাদের সামনে দিয়ে সাচ্চুদের ঘরে নিয়ে চলে যায় ওদের নির্দিষ্ট চাকরানী , জায়নাব । যেতে যেতে সতেজ গন্ধটা বিলায় অকাতরে । সেদিকে ভুলে তাকালে মেয়েটি একটি ভেঙচি কাটে । সে যেন জেনে গেছে কাকে ভেঙচি কাটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না । কখনো কখনো চাকর বাকরের শ্রেণী জ্ঞান অত্যন্ত প্রখর হয় । আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে কিছু না বোঝার ভান করি । মাদুরটি আরও ছিঁড়তে ছিঁড়তে একটি ক্ষুদ্র দ্বীপের আকার নেয় । স্থানাভাবে পাশ থেকে উঠে যেতে থাকে শিপলু , টিপলুরা পাঁচ ভাইবোন । শিপলুদের ঘরে এখন দুধ , চিনি , হালুয়া-রুটি আর গাড় লিকারের চা নিয়ে যায় তাদের চাকরানি , মোমেনা । বানভাসি মানুষের মত ক্ষুদ্র দ্বীপে বন্দী আমরা তবু রুটি ডালের প্রতীক্ষায় বসে থাকি । কি আশ্চর্য এতো কিছুতেও আমাদের জন্য বরাদ্দ ডাল রুটিতে স্বাদের কমতি হয় না ।
কাজের লোকেরা খেতে বসে রান্না ঘরে । আমার মা আমাদের জন্য এক বাটি ডাল আর তিনটে রুটি সামনে রেখে ওদের সাথে ভাঁড়ারে বসে যান । একদিন রান্নাঘরে উঁকি দিলাম । কাজের মেয়েরা খাচ্ছে যে যার মত , আমার মায়ের সামনে একটা পোড়া কাল রুটি । বিরক্তি আর আস্বস্তি নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো জায়নাব । আর কোনদিন দেখার সুযোগ হয়নি । এতদিনে মাদুরটির দশা আবর্জনার বাড়া । কেউ একজন একদিন সেটা তুলে ফেলে দিল ।
( ৭ )
আমরা গ্রাম থেকে আসার দুই সপ্তাহের মাথায় নানাভাই ইন্তেকাল করলেন । শোক পালন আর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন হোল দোয়া আর দান খয়রাতের মধ্য দিয়ে । বাইরের খবর খুব বেশী পাইনা । একদিন শুনতে পেলাম দেশ স্বধীন হলে আমরা শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে আবেদন করলে দেশের আনুকূল্য পাব । কথাটা মায়ের কানে দিলে তিনি কিছুক্ষন আমার দিকে চেয়ে রইলেন , তারপর ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলেন গালে । প্রস্তুতি ছিল না । খুব জোরে না মারলেও ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলাম । চোখের জল মুছতে মুছতে মা বললেন , কারো দয়া নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরণ ভাল । ঐ একবারই মায়ের হাতে মার খেয়েছি ।
শীত জেঁকে বসেছে । শীতবস্ত্রের অভাবে আমরা বেশ দমে গেলাম । ঘরের বেড়া বাঁশের বাতির , হাওয়া-পানি কোনটাই কার্যকরভাবে ঠেকাতে পারেনা । শিপলু টিপলুদের কিছু পুরনো পোশাক নিয়ে এলেন মা । আমি আর বিপ্লব পরমানন্দে পরে নিলাম । মা ও পেয়ে গেলেন মেঝ মামীর পুরনো পোশাক । বেচারী শিমুলের জন্য কিছুই মিলল না । কদিন ধরে মাকে দেখছি খুব ভোরে উঠে চুপি চুপি প্রতিবেশী কাজী সাহেবদের বাড়ীতে চলে যান , ফিরতে ফিরতে সকাল নয়টা বেজে যায় । দুপুরে মামাদের ঘরে অনেক কাজ নিজ হাতে সামলান মা , বিশেষ করে শিপলুদের পাশে । বিকেলে আবার কয়েক ঘণ্টার জন্য আমাদের ছেঁড়ে যান , রাত নটার আগে ফেরেন না । তিনদিন পর মা শিমূলের জন্য একটা কারডিগান নিয়ে এলেন । হাতের কাছে সামান্য ছেঁড়া । বোঝাই যায় না পুরনো । আমার খটকা লাগলো , কোথায় যেন এটি দেখেছি । হঠাৎ মনে পড়লো , সোমা আপু ! কাজী সাহেবের ছোটমেয়ে সোমা আপুকে পরতে দেখেছি ওটা । মাকে জিজ্ঞেস করে কোন উত্তর পেলাম না । শিমূলের একটা অহংকার ছিল , পরবে কিনা সন্দেহ । সন্ধ্যায় দেখি শিমূল ওটা পরে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে । আমাকে দেখে বলল , বেশ গরমরে দাদু , হাত দিয়ে দেখ । আমি ওর কলারের নীচে হাত রাখলাম । সত্ত্যি তাই । আমার চোখে পানি এলো । এভাবেই চিরতরে হারিয়ে গেল প্রিয় বোনটির পোষা ছোট্ট আভিজাত্যটি ।
এবছর স্কুলে ভর্তি হওয়া হল না । তবু সন্ধ্যায় দুই ভাইবোন বই মেলে বসে যাই । মা রাত্রে শুতে শুতে এটা সেটা গল্প বলেন । সবই শিক্ষণীয় , দৃষ্টান্তমূলক । একদিন গল্পে গল্পে বললেন , বাবার পরেই সংসারের কর্তা হোল বড়ভাই । কথাটার ভেবে ভেবে অনেকটা সময় কেটে গেল । পরদিন সকালে আমার মাথায় একটা আইডিয়া খেলে গেল । গায়ে পুরনো সোয়েটার চাপিয়ে , ছেঁড়া জুতো পায়ে গলিয়ে আমি চলে গেলাম স্থানীয় বাজারে । ট্রাক থেকে এই সকালে আনাজপাতি নামাচ্ছে বেশ কিছু শিশু কিশোর । ওদের পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম কিছু একটা । ট্রাকের ভেতর থেকে হঠাৎ একটা কণ্ঠ ডেকে উঠলো , এই ছোকরা , হাত লাগা না , হাত লাগা , হাত লাগা । আমি কাজে নেমে পড়লাম । নটায় কাজ শেষে নগদ চার আনা পেয়ে গেলাম । কাউকে কিছু জানতে দিলাম না । সিকিটা এনে বিছানার নীচে লুকিয়ে রাখলাম । ডিসেম্বরের কনকনে শীতে শহর নয়টা দশটা অব্দী কুয়াসা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকে । মা কাজীদের বাড়ী চলে গেলে ভাই বোন দুটোও ঘুমের ভিতর স্বপ্নের দেশে বুঁদ হয়ে ঘুরে বেড়ায় । আমি কিন্তু রোজ বেরিয়ে পড়ছি । ছেলেগুলো প্রথমে আমাকে মেনে নেয় নি । হাত থেকে বোঝা কেঁড়ে নিয়ে ভাগিয়ে দিতে চাইত । দুচারটে ধাক্কাও খেয়েছি । একটু বলিষ্ঠ ছিলাম বলেই হয়তো বড়রা আমাকে ডেকে নিত । দারিদ্রের সাথে লড়তে লড়তে ওদের সবার সাথে বেশ একটা সমঝোতা হয়ে গেল । একেকটা চকচকে সকালের বিনিময়ে একেকটা ঝকঝকে সিকি । সিকিগুলোয় মুঠো ভরে গেলে আমার ভেতরে প্রত্যয় জেগে উঠছে , আমি পারব ইনশাআল্লাহ । সেদিন বিকেলে মা একটি মাটির ব্যাংক নিয়ে এসে বললেন , নে , এটা তোর জন্য , এখন থেকে তোষকের নীচে সিকি রাখতে হবে না । ভয়ে ভয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি তাঁর ঠোঁটে হাসি , চোখে জল । আমি মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়লাম । জটিল পৃথিবীতে আমি ছয় বছরেই শক্ত পায়ে চড়াই পার হতে শিখে গেছি । শিকারির সহস্র তীক্ষ্ণ তীর যেন আমার দিকে তাক করা । মায়ের বুকের এই অভয়ারন্যে আমি এক শিশু মৃগ , কেউ আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না । অনেকদিন পর আমি প্রানভরে কাঁদলাম ।
সংগ্রামী মানুষদের কাছে দিনের কোন নাম থাকে না , প্রতিদিনই যুদ্ধের প্রতিটি সকালই রুটি খুজে আনার । তবু আজকের দিনটা একটু ভিন্ন । সকাল থেকে আকাশে একেরপর এক প্লেন উড়ছে । মুদী দোকানগুলোর সামনে উৎসুক জনতার ভিড় । রেডিওতে কি যেন শুনতে চেষ্টা করছে ওরা । বিকেলে আমিও ওদের পাশে দাঁড়িয়ে কান পাতি । দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে ওঠে কেউ ! এই দেশ , এই মাটি , গাছ-পালা , এই মানুষ আমরা সবাই স্বাধীন ! সহসা আমার হাত পা নিয়ন্ত্রন হারিয়ে কাঁপতে থাকে , মুখের ভাষা হারিয়ে যায় আর বুকের ভেতর কে যেন একসাথে একশত পায়রা উড়িয়ে দেয় । পায়রাগুলোর শুন্যে ডিগবাজী খাচ্ছে , আমিও , সবুজ ঘাসে । শুন্যে লাফিয়ে উঠে চারিদিকে কয়েকটা চক্কর কেটে অহেতুক পেরেশান হলাম । তারপর ভাবলাম , অহেতুক নয়তো ! এ দেশ আমার বাবার রক্তে স্বাধীন । এ দেশ আমার । এ আনন্দ দেশের সবার , এ আনন্দ আমাদের ছোট্ট পরিবারের খুব নিজস্ব । ছুটে এসে ভাইবোনদের জড়িয়ে ধরি । মা এরই মধ্যে জেনে এসেছেন । কারো মুখে কথা নেই , চোখভরা জল । একে অন্যের চোখ মুছে দিচ্ছি । মা ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে ফ্রেমে বাঁধানো একটি ছবি বের করে টানিয়ে দিলেন , আমার বাবার ছবি ।
প্রেমকাননের হিন্দুস্থানী মালী বাসব খুব অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে আমাকে । হিসাবটা মিলছে না তার । এতদিন ফুল চুরিসহ নানান দুষ্কর্মের নায়ক এই আমি কি না তার কাছে নগদ পয়সায় মালা কিনতে এসেছি ! এবার তাড়া দিতেই হাতে সুঁইয়ের খোঁচা খেয়ে বেচারা সম্বিৎ ফিরে পেল । আবক্ষ ছবিটিতে নিজের উপার্জনে কেনা মালাটি পরিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আমরা । আমার বাবা দূর মেঘের পারে আসমানের বাগানে ফেরেস্তাদের সাথে বসে হাসছেন , কি অনাবিল সেই হাসি , কি প্রশান্তি দুটি চোখে !