ইউনুস খবরটা বাদলের মুখেই শোনে। বাদলের ছোট পোলাটা প্রায় কোলকাতা যায় ব্যবসার কাজে। সেখানেই মুকেশের সাথে দেখা হয়ে যায়, একথা সেকথা জানতে পারে যে ও এখন মস্তবড় সরকারি অফিসার। হিঁদুর মেয়েকে বিয়েসাদি করে বেশ সুখেই আছে।
গুঞ্জাবাড়ীতে রথের মেলায় ইউনুস আজকাল বেলুন বিক্রি করে। যবে
থেকে জমি জায়গা চলে গেছে তবে থেকেই চাষের কাজে আর মন লাগে না ওর। বয়সটাও কম হয় নি। নানান রোগ ব্যামোয় ব্যতিব্যস্ত।
সামিমা উঠোনে ধানগুলো পায়ে করে নেড়ে শুকনো করছিল। ছিট মহলের অনেকের বাড়ী থেকেই ধান এনে সেদ্ধ শুকনো করে। বিনিময়ে চাল, টাকা পায়। এছাড়াও ছাগল, মুরগী পালে। সময়ে অসময়ে দুটো পয়সা যা আসে দু'টো প্রাণীর পেট ভাতে চলে যায়।
অসময়ে ইউনুসকে ঘরে ফিরতে দেখে সামিমা একটু অবাকই হয়। ইউনুস দাওয়ায় বসে পড়ে। সামিমা চট জলদি কলসি থেকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল সামনে রেখে হাত পাখা দিয়ে হাওয়া করে।
- শরীলটা কি খারাপ লাগছে? সামিমার গলায় উৎকণ্ঠা।
- না, শরীর ঠিকই আছে। বাদলের কাছে রাজুর খবর পাইল্যাম তাই...।
ইউনুস প্রায় পুরো ঘটনাটাই সামিমাকে সবিস্তারে জানায়।
- কবে আইস্বে কিছু কইলো সে?
ইউনুস জবাব দেয় না। একটা শ্বাস ছেড়ে বলে,
- জিগাই নাই।
সামিমা একটু নিভে যায়। ইউনুস-এর পাশে বসে পড়ে, প্রায় দু'টো বছর ঘুরতে চললো পোলাটাকে একবার দেখার জন্য প্রাণটা কেমন হাঁসফাঁস করে। গ্রামে ভ্যান-রিকসা এলেই সামিমা ছুটে যায় দেখতে। এই বুঝি রাজু এলো। সর্বক্ষণ একটা দুঃশ্চিন্তা মাথার মধ্যে পাক খায়। অতদুর শহরে পোলাটা কি খায়, কোথায় শোয়, কেমন থাকে কে জানে।
জন্ম থেকেই রাজুর গড়নটা ওর আব্বার মতো পেয়েছিল। বছর পাঁচেকের হতেই বেশ লম্বা চওড়া হয়ে যায়। সামিমার জিদে ওকে কলমা পরানোর ব্যবস্থা হয়। নাজির হাটের বড় মসজিদের ইমামের দেহান্ত হয়েছে, তারই ছেলে নতুন মৌলানা। ছোট রাজুকে সেই কলমা পরায়। সামিমার আব্দারেই ইউনুস ধারধোর করেও আশেপাশের দশটা গাঁয়ের লোক কে দাওয়াত দেয়।
পুরনো সব ঘটনাগুলো সামিমার পরিষ্কার মনে পড়ে যায়। কাঠফাটা নির্জন দুপুরে একা একা দাওয়ায় বসে পুরনো সব স্মৃতিগুলো মনে করার চেষ্টা করে। উঠোনের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা পলাশ গাছ থেকে টকটকে ফুলগুলো মাটিতে ঝরে পড়ে।
রাজু তখন পেটে, ভরাভরতি চার মাসের। রাত গভীরে মেয়ে দুটো ঘুমিয়ে গেলে চুপি সাড়ে সামিদা মেঝেতে নেমে এসে ইউনুস'এর পাশে শুয়ে পড়তো।
- এবার দেখস্ তোর ঠিক পোলা হবে। আলো আঁধারির মধ্যেই ইউনুস হাঁতড়ে হাঁতড়ে সামিদার পেটটায় হাত বুলিয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করে।
সামিদা জবাব দেয় না, অন্ধকারে মুচকি হাঁসে। ওরও মনের কথা তাই। পেটটাও খুব বেঢপ হয়েছে। একটুতেই হাঁপিয়ে ওঠে।
ইউনুসের বরাবরই ছেলের চাহিদা। সালমা হওয়ার পরে ভেবে ছিলো যে এবার আল্লাহ নিশ্চয় পোলা দেবে। শিকারপুরের সরকারি হাসপাতাল সিমুলডাঙা থেকে প্রায় তিন ক্রোশ মেঠো রাস্তা। ইউনুস ভ্যান-রিক্সায় শুইয়ে সামিদাকে ভর্তি করে। রাতভোর জেগে বসে থাকে। ভোররাতে কান্না শুনে দৌড়ে যায়, নার্স দিদিরা বলে মেয়ে হয়েছে।
- আল্লাহ মর্জি, মেনে নেওয়া লাগে। চোখের কস বেয়ে জলটা মুছিয়ে ইউনুস সামিদাকে সান্ত্বনা দেয়।
নবজাতকের দেখে ইউনুসও ততক্ষণে খুব খুশি। সালমার থেকে গায়ের রং আরো ফর্সা। চোখ, নাক, মুখে একটা পাঠানি আভিজাত্য, মুখেচোখের গড়ন অনেকটা ইউনুস এর খালার মতোই। সামিদাই ওর নাম রাখেন আনোয়ারা।
ছিটমহলের মধ্যে এই এলাকার যে কয়েকটা গ্রাম পড়ে তান মধ্যে একটা হল সিমুলডাঙা। ইউনুসের পাঁচ ভাই, বাপ ঠাকুরদার আমর থেকেই এই গ্রামের বাসিন্দা ছিল। দেশভাগের আগে এই গোটা তল্লাটটাই ভারতে ছিল। ইউনুস এর বাবা ইরাজুল ছিলো নামী হাকিম। তিস্তার এপার ওপার দুপার থেকেই মানুষ চিকিৎসার জন্যে ছুটে আসতো তার কাছে। সবচেয়ে ছোট ছিলো ইউনুস। সিমুলডাঙার বেশিরভাগ অংশেই ওদের পৈত্রিক ভিটে আর জমিজায়গা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ইরাজুল চোখ বুজতে না বুঝতেই ভাইয়েদের মধ্যে বনিবনা হয় না। সালিসি ডেকে যে যার ভাগ নিয়ে আলাদা হয়। ইউনুস তখন যুবক। মা রাসিনা বিবিকে নিয়ে পৈত্রিক ভিটের এক অংশ দু কামরার ঘর সমেত দুই ডেসিমাল জমি আর চাষের জমি বরাবরের এক অংশ পায়। সামিদাদের বাড়ী ছিলো জলপাইগুড়ির দক্ষিণ খড়িবাড়িতে। নাজিরহাটের বড় মসজিদের ইমাম ছিলো হাজি জুলফিকার সাহেব। ইউনুসের বাবা ইরাজুল মিয়ার খাস দোস্ত। ইরাজুল বেঁচে থাকতে বহুবার এ বাড়ীতে এসেছে। সামিদার সঙ্গে ইরাজুলের বিয়ের প্রস্তাব রাসিনা বিবির কাছে তারই মারফৎ আসে।
বিয়ের আগে পর্যন্ত সামিদা বা ওর বাড়ীর লোকজন একদমই জানতো না যে সিমুলডাঙা গ্রাম বাংলাদেশী ছিটমহলের মধ্যে পড়ে।
- দ্যাসে থাইক্যাও আমাগো পরদেশী হইয়া থাইকতে হয়।
বিয়ের পর সামিদা ইউনুসের খালার মুখ থেকে শুনেছিলো। রসিনা বিবির থেকে দু বছরের বড় হলেও খালাতে ছোট বলেই মনে হতো। সত্তর পার করেও গড়নে পিঠনে ধরা যেত না। রাসিনা বিবি দিদির কথা এলেই বলতো, - ওই মাইয়্যা এক্কেবারে পাঠানি রূপ পাইসে। যৌবনে কতো যে মনিষ্যিকে ঘায়েল করসে তার ইয়াত্যা নাই।
সিমুলডাঙা এলে নাতি নাতবৌদের সঙ্গে বিশেষ বনতো না বুড়ির। সামিদার আদর যত্ন বেশী পেতো, তাই তাকে মন খুলে মনের কথা বলতো।
- আসলে আমাগো কুচবিহার আর রংপুরের নবাব সাহেবদের একটা নেশা দাবা খেলা। যখন তখন ঘুঁটি সাজাইয়া বইস্যা পড়তো। তহন আর তাদের জ্ঞান গম্মি থাইকতো না। গ্রাম কে গ্রাম তহষিল কে তহষিল দাবায় বাজি ধইরতো। যে বাজিতে জিতে য্যাতো ওই গাঁ, ওই তহষিল তারই সলতানতে খারিজ হাইয়্যা য়াইতো। এমন সময় দ্যাস স্বাধীন হাইলো। রংপুরের নবাবের বাজিতে জেতা গাঁ, তহষিল এই দেশের সিটমহল আর কুচবিহারের নবাবের জেতা গাঁ তহষিল সব বাংলা দ্যাসের সিটমহল হইয়্যা গ্যালো। এই সমস্ত সিটমহলের বাসিন্দারাই দ্যাসে থাইক্যা পরদেশি হইয়া গেলো।
সামিদা খালার সব কথাগুলো খুব মন দিয়েই শুনছিলো।
- অ্যাই সমস্ত সিটমহলের কোন পরিবারের লোক মাইয়া বিয়েসাদি দেয় না। পোলা পানরা ইস্কুলে গেলে এ দ্যাসের কাইকে বাপ বইল্যা মাইনতে হয়। বেফাঁস কিছু কইরালেই পুলিস ধইর্যা জেলে প্যুইরবে।
খালার কথা শুনতে সামিদার বুকের ভেতর কেমন যেন ছ্যাঁত করে ওঠে। তারও পেটে তখন প্রথম সন্তান। তার ভাগ্যে কি লেখা কে জানে। এমনটা আগে জানলে তার বাড়ীর লোকেরাও বোধহয় এ বিয়েতে রাজি হতো না, সামিদার বিয়ের বছর না ঘুরতেই শাশুড়ি আর খালা কয়েক মাসের ব্যবধানেই চোখ বুজলো। প্রথম প্রথম সামিদার নিজের একা একা মনে হতো। সারাটা বাড়ীটা খাঁ খাঁ করতো।
এরপরে সালমা এলো, তারপরে আনোয়ারা, দুজনের জন্মই দিনহাটায়। সরকারী হাসপাতালের বাবুর ওদের জন্মপতি দিতে রাজী হয় না। পরেশ সরকারের বাড়ীটা খাগরাবাড়ী গ্রামে, সিমুলডাঙার লাগেয়া বলা চলে। ওদের গ্রামটা ছিটমহলের মধ্যে পড়ে না। ওরই বড় ছেলে বাদল সরকার একটু মুরুব্বি গোছের। ছিটমহলের বাসিন্দাদের একপ্রকার ত্রাতা। এতটু গায়ে পড়েই উপকার করে লোকের। এরা সাত ভাই, একান্নবর্ত্তী। সবভাইদের মধ্যে বাদলই একটা বাস্তুঘুঘু নামে বেনামে সরকারবাড়ীর অনেক সম্পত্তি। শহরেও অনেকগুলো ব্যবসা। পরেশ সরকারের আদি ব্যবসা হলো বন্ধকি কারবার আর সুদখোরি। ছিটমহলের আনেক পরিবারই সময় অসময়ে জমি জমা বন্ধক রেখে ওর থেকে চড়া সুদে টাকা ধার করেছে, পরে আসল ফেরত দিলেও সুদের ভারে নিঃশর্ত্তে জমিজমা ছেড়ে দিনমজুর হয়ে গেছে। এসবের পিছনেই নাটের গুরু বাদল। আসলে ছিটমহলের বাসিন্দাদের চাষের জমির বেশীরভাগটাই বাংলাদেশের, যারা সঠিক নথাপত্রের কোন হদিশই এদের হাতে নেই। এর সবটাই বাদলেই নখদর্পনে। এই সমস্ত অসহায় অশিক্ষিত চাষিরা জানে বাদল চাইলে যখনতখন তাদের জমিজায়গা সরকারি রেকর্ড হয়ে যেতে পারে। কারাঘুষোয় এটাও শোনা যায় যে বাদল আর সঙ্গি সাথিরা রাতবিরাতে সীমান্তে চোরা কারবারও করে। বে আইনি ঐষধপত্র, নেশার জিনিষ, সোনাদানা এমনকি মেয়েছেলেও অবাধে পারাপার চলে, এই কাজে বিএসএফ'-এর সাথে বাদলের একটা গোপন বোঝাপড়া থাকেই।
বেশ কিছুদিন ধরেই শহরের বাজারগুলোয় পুলিশের হানা বেড়ে গেছে। সুযোগ পেলেই ছিটমহলের চাষিদের ধরে ধমকে মোটা টাকা আদায় করে, ইদানিং বাদল আর ওর সঙ্গিসাথিরা ছিটমহলের চাষের যাবতীয় জিনিষপত্র নগদেই কিনে নিচ্ছে। জলেরদর হলেও সকলেই একটু স্বস্তি পাচ্ছে।
সালমা এ বছর বারোয় পা দিলো। আনোয়ারা ওর থেকে দুবছরের ছোট। গৃহস্থালী কাজে দুবোনেই সামিদাকে অনেকটাই সাহায্য করে। ইউনুস জমিজমার কাজ নিজের হাতেই করে। দরকারে মুনিস মজুর ডাকলেও কাটা, ঝাড়া, সেদ্ধ শুকনো ও আর সামিদাই করে নেয়। রান্নবান্নার বেশীর ভাগটাই সালমা সামলে নেয় বলে সামিদা ইউনুসকে বেশী সাহায্য করতে পারে।
দুই মেয়েকে নিয়ে সামিদা বেশি খুশিই ছিলো। আর ছেলে-মেয়ে নেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। ইউনুস জিদ করলেও সামিদা সময়বুঝেই শোয়াবসা করতো। তবু কেমন করে যে কি হলো কিছু বোঝা গেল না। যখন বোঝা গেলো তখন ভরা তিন মাস।
সামিদার দুই মেয়েই দুই স্বভাবের, সালমা একটু চাপা, সাত চড়ে রা করে না। সকাল থেকেই চুপচাপ কাজ করে যায়, সময় পেলে মা’য়ের সাথে দু এক দান লুডো খেলে। আনোয়ারা একদমই বিপোরীত। একটু একগুঁয়ে প্রকৃতির। এখন থেকেই সময় পেলেই আয়নার সামনে দাঁড়ায়। ইদানিং একটা বায়না, -- স্কুলে ভর্ত্তি হবো। পড়াশোনা করবো। ছিটমহলের ছেলেমেয়েরা খুব কমই স্কুলে পড়ে। হাসপাতালের জন্মপত্রি না থাকায় স্কুলে ভর্তি নেয় না।
এই কাজটাও বাদল অনায়াসে করতে পারে। ওর সাঙ্গপাঙ্গরা সকলেই ভারতীয়, তাই ওর কেউ বাবা সেজে হাসপাতালের কাগজে সই দিলেই অনায়াসে স্কুলে ভর্তি করা যায়।
মেয়ে জীদে ব্যস্ত হয়ে সামিদা ইউনুস’এর সামনে কথা পাড়ে।
- আমন ভাড়ায় বাপ যোগাড় কইর্যান মেয়েকে বিদ্যান করায়ে কি লাভ? মেয়েছেলে, দুদিন পর বিয়াসাদি কইর্যা্ সংসার করুম। পড়াশোনা শিখে কি চাকরি করুম?
ইউনুস সামিদার কথা গুরুত্ব দেয় না, - তাছাড়া একাজে আমারে বাদলকে ত্যাল লাগান লাগে। পোলাটা সুবিধের নয়। এর জন্যে অনেকগুলান টাকা চ্যায়ে বসবে।
সামিমাও জানে বাদল এই সব কাজে মোটা টাকা দাবী করে। তারপরেও যখন তখন এটা ওটা চায়। তাছাড়া ওর নজরটা সামিদার সুবিধের মনে হয় না। রাস্তা ঘাটে পাশ দিলে এক দৃষ্টিতে গিলে খেতে আসে।
সামিদার এখন ভারভর্ত্তি মাস চলছে। বেঢপ পেটটা নিয়ে চলাফেরা, কাজ করতে খুবই অসুবিধে। বাচ্ছাটাও খুব নড়াচড়া করে। রাতে তক্তোপোষে একাই শোয়। মেয়েদুটো বাপের সাথে মেঝেতে ঢালা বিছানায় ঘুমোয়। বেশীরাতে ইউনুস সামিদার পাশে চলে আসে।
- এবার পোলা হলে কি নাম রাখবা? সামিমা ইউনুসের একটু অন্তরঙ্গ হয়ে বলে।
- রাজু, কেমন হইবো?
- বেশ, সামিমা সায় দেয়, সালমা আর আনোয়ারার আকিদায় তেখন জাঁকজমক হয়নি এবার কিন্তু পোলার কলমা পরানোয় আমি সব্বাইকে ড্যাকে আনবো। বেশী খরচ বইল্যা পার পাবে নাই।
- আগো তো পোলা হোক, ত্যাখন দেখা যাবেখন। ইউনুস সামিদা কে আশ্বস্ত করে।
একটু আগেই সন্ধ্যে হয়েছে। সামিদা সাঁজবাতিরগুলো জ্বালিয়ে ঘরে নামাজের ঢুকেছে। ইউনুসের উঠতে ইচ্ছে করে না। শেষবার রাজু সিমুলডাঙাতে এসেছিল টাকা নিতে। এমনিতেই ও একটু লম্বাচওড়া গোছের, পেটা শরীর। তার ওপর শহরের জল হাওয়া বেশ চিকন লাগছিল। জামা প্যান্ট পরে সাহেব মনে হচ্ছিল ইউনুসের। ইতিমধ্যেই সালমা আর আনোয়ারার সাদিতে বেশীর ভাগ ক্ষেতই ইউনুসকে জলের দরে বেচতে হয়েছিল। যেটুকু বেঁচে ছিলো তাতেই চাষ আবাদ করে দুজনের চলে যাচ্ছিল।
অতগুলো টাকা যোগাড় করার মতো মানষিক জোর ছিলো না ইউনুসের। রাজু জানতো আব্বা তার কথার গুরুত্ব দেবে না। অতএব সামিদাকে সে নানা ভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে, ভবিষ্যতে বড় চাকরি পেয়ে মা আর আব্বাকে শহরে নিয়ে যাবে, তাদের সংসারে আর দুঃখ কষ্ট থাকবে না।
- পোলা যখন কয় টেকাকার বেবস্থা করা লাগে গো। আমাগো একটাই তো পোলা, যা কিছু ওরই ভালোর জন্যে।
ইউনুস জমিবেচায় কিছুতেই রাজি হতে চায় না।
- যেটুকু জমি বেঁচেবর্ত্তে আছে বেচাকেনা করে খাব কি? আমাগো নবাবপুত্তর তো ট্যাকা ছাড়া কিছুই বোঝে না।
ইউনুস সামিদাকে নানান অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা করে।
- তুমি আব্বা হইয়া এ কথা কইলে আমাগো দুধের শিশু ক্যামনে যায়, একবার ভেবে দেহো।
অবেশেষে পরের দিনই ইউনুস বাদল সরকারের কাছে বাকি ক্ষেতটুকু বেচে টাকাটা রাজুর হাতে তুলে দেয়। সেই শেষবার রাজুর আসা। আজকাল ইউনুসকে দেখে সামিদার ভীষণ কষ্ট হয়। সেই আগের মতো দত্তিপনা নেই, শরীলটাও ভেঙে গেছে। কাকভোরে বেরিয়ে হাটে, বাজারে, রাস্তায় রাস্তায় বেলুন ফেরি করে। সন্ধ্যায় ফিরে দোয়ারে চুপ করে শুয়ে থাকে, আজকাল কাশিটাও বেড়েছে। সারারাত ঘুমোতে পারেন আ। হাজার বলেও ডাক্তার বদ্দি দেখায় না। সর্বস্ব খুইয়ে মনিষ্যিটা আজ ফেরিওয়ালা, সামিদা জানে যে এসব কিছুর জন্যে পরোক্ষে সেই দায়ী। তার জিদ পূরন করতেই ওর এমন দশা।
পড়াশোনার ওপর ঝোঁক রাজুর বারবারের ছিলো। আব্দারে আব্দারে অতিষ্ট করে আম্মিকে। স্কুলে ভর্ত্তি হবে। সামিদা ইউনুসকে অনেক কষ্টে রাজী করায়। নগদ পাঁচ হাজার আর দশ বস্তা ধানে বাদল সরকার রাজী হয় রাজুর নকল বাপ হতে। ইস্কুলে ভর্ত্তির সব কাগজ পত্রে বিনা ওজরে সই করে সা। রাজু সরকার নামেই ভর্ত্তি হয়।
সামিদার মমনে আছে, সব কাজ সমাধা করে ইউনুস যখন বাড়ী ফেরে তখন সে সম্পূর্ণ বিদ্ধস্ত। রাতে খাওয়া দাওয়া করে না, চুপচাপ বিছানা শুয়ে পড়ে।ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে গেলে সামিদা ইউনুসকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করে। মাথায়, পীঠে হাত বুলিয়ে ঘটনা ভোলাবার চেষ্টা করে।
- পোলাটারে নিজের পরিচয়টুকু দ্যাতে পারলুম ন্যাই। আমাগো একটাই পোলা আজ পর হয়ি গ্যালো রে সামিদা।
অমন সাজোয়ান মনিষ্যিতা হঠাৎই ভেঙে পড়ে। সামিমার বুকে মুখ গুঁজে ফোঁপাতে থাকে সে। সামিমাকে আসল কথাটা বলতে ভয় পেয়েছিল ইউনুস। ইউনুস জানতো যে, বাদলের ছেলের শেষ কথাগুলো শুনলে সামিদা সহ্য করতে পারবে না, তাই সে কেটে ছেঁটেই বলেছিলো। বাইরে অন্ধকারটা আজ খুব গাড় মনে হয় ইউনুসের। দাওয়ায় বসে নিজের হাতটাও ঠাওর হয় না তার।
- চাচা, রাজু আর তোমাগো সাথে কোন সম্পর্ক্য রাখুম না। এখন সেতো ইউনুস মিঁয়ার পোলা নয়। এখন, রাজু সরকার, পোল্লায় চাকুরে। হিঁন্দুর মাইয়ারে বে করছে। মুসলমান মা বাপের পরিচয় ক্যামনে দেয়?
ইউনুস বুঝতে পারে, সামিদা এসে তার পাশটিতেই বসেছে। অন্ধকারে ভালো করে কিছুই ঠাওর করতে না পারলেও সামিদার খোলা দৃষ্টিটা পরিষ্কার দেখতে পায়। যেখানে শুধুই তার প্রিয় সন্তানের ফিরে আসার প্রতিক্ষা।
[এই গল্পের চরিত্র, স্থান, কাল, পরিবেশ সকল কিছুই কল্পনাপ্রসূত। কেউ কোন প্রকার মিল পেলে তা অনিচ্ছাকৃত। এই গল্পের মাধ্যমে আমার একটাই উদ্দেশ্য হলো, দুই প্রতিবেশী দেশের এতটা অতি প্রচীন সমস্যার প্রতি আলোকপাত করা এবং ছিটমহলের বাসিন্দাদের অমানবিক অসহায়তার কিছুটা তুলে ধরে।]