কালো বেড়াল

রাত (মে ২০১৪)

জোহরা উম্মে হাসান
মোট ভোট ১৮ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.৫৪
  • ২০
  • ৯১
এক
রাত বাড়তে থাকলেই কোত্থকে থেকে যেন গহীন আঁধার রাতের মতোই মিশমিশে কালো সেই বেড়ালটা উঁড়ে এসে জুড়ে বসে । কুচকুচে কালো তাঁর গায়ের রঙ। খাঁড়া দু্ কান আর খোঁচা দেয়া নূয়ে পড়া জোড়া গোঁফ । বাঁকানো পশমঘন ভারী লেজ । চকচকে ভীতিকর চোখ দুটো হিংস্র বাঘের চোখের মতো কেবলি জ্বলে আর নেভে । নেভে আর জ্বলে !
ভয়ঙ্কর সেই কালো বেড়ালটা আজও কেন যে এল ! এবার এসে সে ফুল্লরা খাতুনের মুখের কাছে মুখটি রেখে হাসতে হাসতে বললে, কেমন মেয়ে পছন্দ করলে গো নতুন বউ তোমার ছেলের জন্য ?
ফুল্লরা খাতুন উত্তর দেয় না । দিতে ইচ্ছা করে না তাঁর । আগাম কথা কি আর বলা যায় ? কালো বেড়ালটার আদিখ্যেতা দেখে ভয়ানক রাগ হয় তাঁর । নাদান । সে জানে সব কথা । কিন্তু ভাব দেখাচ্ছে যেন কিছুই জানে না সে । তাঁকে কি আহান্মক ভেবেছে বেড়ালটা ?
ফুল্লরা খাতুনের আজ একটা সুখের দিন । একমাত্র ছেলের বিয়ের জন্য অনেক দিন বাদে মনের মতো একটা মেয়ে খুঁজে পেয়েছে সে । আজকে আবার কেন সেই আন্ধার কালো বেড়াল ? যা যা চোখের সামনে থেকে পালা ! দূর হ ! দূর হ ! কালো আন্ধার গহীন যে বন , সে বনে ফিরে যা তুই। জন্মের মতো যা । ফুল্লরা বিড়বিড় করে !
তবুও যাই যাই কোরেও যায় না যেন কালো সেই বেড়াল !
দুই
গ্রাম জুড়ে ফুল্লরা খাতুনকে ঘিরে ভালো মন্দ ম্যালা রকম কথাই চালু আছে । ভালো কথা বললে , সবাই তাঁর অপরূপ রুপ লাবন্যের কথাই কইবে। পূর্ণিমা চাঁদের আলো ছড়ানো গায়ের রঙ । টিকালো নাক । পদ্গ ভাসা দু চোখ । রাতের আকাশের মতো কালো মিসমিশে একতাল চুল কোমর অব্দি ছড়ানো । ভাটার টা্নে বয়স যদিও তার পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে অনেকদিন । কিন্ত কে বলবে বয়স এতো ? কিভাবে যে সে তার বয়স এতকাল ধরে লুকিয়ে রেখেছে তাও যেন এক রহস্য !
ফুল্লরার প্রথম বিয়ে বেশ সচ্ছল ঘরেই হয়েছিল । গরীব বাপকে মেয়ের বিয়ের জন্য হন্নে হোয়ে পাত্র খুঁজতে হয় নাই । সুন্দরী মেয়ের জন্য ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসার কমতি ছিল না । কিন্তু আরেকটু দেখি দেখি করে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় যা হোক যেন একটু বেশী সময়ই নিয়ে ফেলেছিল নুরু মিয়া , ফুল্লরার দিনমজুর বাপ । শেষমেস গায়ের লোকজন যখন বলাবলি শুরু করলো ; ফুল্লরার বাপ, তুমি কি তোমার মাইয়াকে লাউয়ের বস বানাইয়া চাতালের আগায় ঝুলিয়ে রাখবা , তখনই টনক নড়লো তাঁর। একটু বেশীই দেরী হয়ে গেল বলে সোমত্ত মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে গভীর আক্ষেপে মাথার কাঁচা পাকা চুল ছিড়ে ফেলার উপক্রম করলো সে ।
যার সাথে বিয়ে ঠিক হলো ফুল্লরা খাতুনের , সেই ছেলের বাপের অবস্থাদি মন্দ না । কিন্তু ছেলেটাই একটু যেন কেমন , কেমন । তার স্বভাব চরিত্রে কোন কালো দাগ নাই বটে কিন্তু বড়ই আলাভোলা আর হাবাগোবা সে। এবং বিয়ের পরেই তা ধীরে ধীরে টের পেতে শুরু করলো ফুল্লরা । একবার বাপের বাড়ীতে নাইয়র এসে কি ভেবে বাপ তাকে আচমকা একদিন জিঞ্জেস করেছিলো জামাই বাবাজির কাজকামের কথা! আর তাতেই ভালমতো হুঁশ হয়েছিল ফুল্লরার ! স্বামীকে নিয়ে নতুন কোরে ভাবতে বসল যেন সে । তাইতো কি কাজ করে স্বামী তাঁর ? কেবল তার নিজের চোখে নয় , বাপের চোখেও স্বামীর ফাঁকটা ধরা পড়ছে বটে । রুস্তমের বাপ তি্ন ছেলের জন্য যা সহায়সম্পতি রেখে গেছে তা একেবারেই ফেলে দেয়ার মতো নয় । কিন্তু বাপের অবর্তমানে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণের মালিক যে তার বড় দু ভাই , তা এক্ষণে বেশ বুঝে গেছে ফুল্লরা । ভাইদের সবারই গঞ্জের বুকে বড় বড় দোকান । কিন্তু রুস্তমের নামে কি আছে ? কিছুই নাই ।
বলি না বলি করে একদিন বুড়ো শাশুড়িকে স্বামীর ভবিষ্যতের কথা জিজ্ঞেস করলে , শাশুড়ি নতুন বউকে শান্তনা দিয়ে বলে ; হোবো রে মা হোবো । একটু ধৈয্য ধর , বড় ভাইয়েরা কি তাক ফ্যালায় দিবো ?
ভাইয়েরা কি তাক ফ্যালায় দিবো ? শাশুড়ির এই কথাটার মানে সহজেই যেন বুঝে ফেলে ফুল্লরা । এর মানে , তাঁর স্বামীর ভাগ্যের পুরোটাই এখন ঝুলছে তাঁর বড় দু ভাইয়ের হাতে !
কিছুই ভাল লাগে না ফুল্লরার । সংসারে আর আগের মতো মন বসে না ! স্বামীর সাথে এসব বিষয় নিয়ে প্রায়শঃ মন কষাকষি হয় ! তবে কিছুদিন বাদে ক্ষান্ত দেয় সে । তাঁর মনে হয়, কাজকামের ব্যাপারে ভাইদের যতনা দোষ , তাঁর স্বামীর দোষ তাঁর চেয়ে কোন অংশে কম না !
ঘরকুনো রুস্তম দিনরাত সুন্দরী বউয়ের আঁচল ধরে পড়ে থাকতেই ভালবাসে । আর এ নিয়ে তার বড় ভাইয়ের বউরা আড়ালে আবডালে এটা ওটা নানা ধরণের কটুক্তি করে। যেন খুব একটা মজার আলোচনার বিষয় এদ্দিন বাদে পেয়ে গেছে তারা । বুড়ো শাশুড়ির যত মাথা ব্যথা ছোট ছেলেকে নিয়ে , তা ভালমতেই জানে তারা । তাই সুযোগ পেলেই তাকেঁ খোঁচা দিয়ে বলে এ কথা ও কথা বলে ব্যঙ্গ করতে ছাড়ে না তারা!
কদিন পরে ফুল্লরার কানে আসে , তার স্বামীর যাত্রাপালা্র আসক্তির কথা । বিয়ের আগে এ বাড়ীর কেউই ঘুনাক্ষরে মেয়েপক্ষকে জানায়নি সেসব কথা । তাই কদিন বাদে বউয়ের আঁচল ছেঁড়ে রুস্তম আলী আবার যাত্রাপালায় মন দিল ! ফুল্লরা দাঁতে দাঁত চেপে থাকে । মনে মনে ভাবে ; যাক , ঘর ছেড়ে সে যে এবার বাড়ীর বাহিরে পা দিল , এই মন্দের ভালো ।
রুস্তমের ভারী সখ ছোট বউকে সে একবার যাত্রা পালা দেখায় । তাঁর স্থির বিশ্বাস, বউ একবার তার পার্ট দেখলে কিছুতেই আর তার উপর রাগ করে বসে থাকতে পারবে না । তাই অনেকদিন ধরে সেধে সেধে একদিন সত্যি সত্যি বউকে সে যাত্রা পালা দেখাতে রাজী করালো । রুস্তমের সারা বিকাল আর সন্ধ্যা যেন কিছুতেই কাটতেই চায় না । তবে আজ একটু রাত করেই পালামঞ্চে যাবে সে। বউয়ের হাত ধরে একবারে বারো ভুঁইয়ার ঈসা খার মত। বড় সখ রুস্তমের ঈসা খার পালায় ঈসা খা সাজে , কিন্তু পালার মালিক কেবলি তাঁকে সখিনা সাজায় । বলে রুস্তমকে নাকি মেয়ের রোলই ভাল মানায় ! কিন্তু সে তো বিয়ে করার আগে । বিয়ে করার পর মেয়ে সাজতে ইদানীং যে তাঁর আর ভালো লাগে না , তা সে বেশ বুঝতে পারে ।
যা হোক রাত একটু গভীর হতে না হতেই রুস্তম আলী তাঁর সুন্দরী বউটাকে সাজিয়ে গুজিয়ে যাত্রা প্যান্ডেলের দিকে পা বাড়ায় । এর আগে এত রাতে ঘরের বাহিরে বের হওয়ার অভ্যাস ছিল না ফুল্লরার । বাপের কড়া হুকুম , ঘরের মেয়ে বউদের রাতবিরেতে বাড়ী যাওয়া চলেবে না , তা যত কাজকাম থাকুক ।
গায়ের পায়ে হাঁটা পথ । একটু এগোলেই মনে হয় যেন কতো পথ হাঁটা হোল ! চারিদিকে ঘোর ঘুট্টি অন্ধকার । আর তা একটু একটু কোরে যেন বাড়তেই থাকে । গায়ের ঠিক মধ্যিখানটায় সারি সারি বাড়ী । ঘরবাড়ীগুলোর গা ঘেশে অসংখ্য ঝোপঝাড়। আর তার মাঝখান থেকে হঠাৎ হঠাৎ কোরে কোন ফাঁকে বেড়িয়ে আসে জোনাই পোকার দল । টিপ টিপ আলোর মালা জ্বালে আবার রাগ করে এক ফুঁয়ে যেন দেয় নিবিয়ে। ফুল্লরা যেন ফিরে গেছে তাঁর কিশোরীকালে । সে জোনাই হাতে পাবার জন্য ঝোপ বরাবর দৌড় দেয় । রুস্তম ব্যাকুল হাসি হেসে বউয়ের হাতটা আরও শক্ত কোরে চেপে ধরে। কি মনে কোরে বলে, বউ, জোনাইকে ব্যথা দেওয়া ভালো না । ওরা কষ্ট পায় । ফুল্লরা জোরে জোরে হাসতে থাকে আর মনে মনে বলে ; বাহ , লোকটা জোনাই এর কষ্ট বোঝে কেবল বউয়ের দুঃখ বোঝে না । রুস্তম আলীর কানে বউয়ের পাগল করা হাসির শব্দ ভাসতে থাকে । সে ফিসফিসিয়ে বউ এর কানে কানে বলে , তুই সত্যি একবারে পাগলীরে বউ ।
রাত বাড়তে থাকে । জোনাই পোকারাও ক্ষান্ত দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে একটু বিশ্রাম নেয় । ওরা দুজন হাঁটতেই থাকে । পথের ধারে বড় বড় তাল আর নারকেল গাছগুলোকে এক্ষণে আঁধারে আর চেনা যায় না । দেখে মনে হয় যেন এক একটা দৈত্য দানব । ফুল্লরা ভয়ে ভয়ে তাঁর স্বামীর হাত চেপে ধরে ! রুস্তম তাকে সাহস যোগায় বলে , এই চাঁদ উঠলো বলে ।
অনেক অনেকটা পথ পেড়োনোর পর , একসময় যাত্রাপালার প্যান্ডলের কাছে এসে দাঁড়ায় তাঁরা । ফুল্লরা দেখে , মস্ত একটা খোলা মাঠ । মাঠের ঠিক মধ্যেখানে বাঁশের খুঁটি দিয়ে উঁচু চালা করা। চালার মাথায় পুরু চড়াট আর শতরঞ্চি বিছিয়ে নিপাট মঞ্চ বানানো ।মঞ্চের চারদিকটাই খোলা । তিন দিকেই ভরা মানুষ ।কেবল মানুষ আর মানুষ । এত রাতে একসঙ্গে এতো মানুষ কোনদিনও দেখেনি ফুল্লরা । মঞ্চের একদিকে কয়েকজন লোক হারমোনী আর তবলা ডুগী নিয়ে বসে আছে। তাঁদের সবার গায়ে রঙিন রঙিন সার্ট । ঝলমলে ! পরনে ফুল আঁকা লাল নীল লুঙ্গি । প্রায় সবার মুখই পান পাতা আর জর্দায় ভরা । পানের রস ঠোঁট বেয়ে বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নীচে পড়ছে , গায়ে আর সার্টের বুকে । কিন্তু কারোই সেদিকে সামান্য খেয়ালও যেন নাই ।
যাত্রা পালা আরম্ভ হতে তখনও ঢের দেরী । নট নটীরা যার যার মতো করে সাজ সাজন দিচ্ছে । সাজঘরে মেকআপম্যানরা গোল আয়না হাতে এর ওর মুখের সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আনছে , পছন্দ হোল কি না ।বাহিরে একতাল মানুষ । এত রাতেও যেন চারদিকটা জুড়ে দিনের মতো সাজ সজ্জা, রব । কেবলই হুড়োহুড়ী , হাসাহাসি আর টানাটানি । কে যেন দ্রুত যাত্রা শুরু করতে হুকুম দিয়ে চলে গেল!যাত্রা পার্টির ম্যানেজার হয়তো বা !
চার পাশের পরিবেশটা বড়ই আনন্দঘন , মন্দ লাগছে না ফুল্লরার। খোলা মঞ্চটার চারদিক জুড়ে কেবলি আলোর বন্যা । লাল নীল হলুদ বাতি কেবলি জ্বলছে আর নিবছে । বাতির আলো ডিঙ্গিয়ে সুদূর আকাশের চুড়ায় বসে থাকা চাঁদ আর হাজারো তারা সখী্রা কোন ফাঁকে আলোর বন্যা বইয়ে দিচ্ছে মাটির বুকের আঁচলে । গোটা এলাকাটাকে যেন গ্রাস করে ফেলেছে শঙ্খীনি চন্দ্রাবতীর সেই রূপোলী আলো। আর সে আলোর ছটা বারে বারে এসে গড়িয়ে পড়েছে ঠায় বসা অসংখ্য নর-নারীর গায়ে। আলোর সাথে মিতালি কোরতে উচাটন বাতাস মাঝে মধ্যেই ঘুরে ফিরে এসে আছড়ে পড়ছে চার ধারটাতে । দুয়ে মিলে পলে পলে বুনে চলে যেন নকশী কাঁথার বাহারী আঁচল ।
যা হোক , সে রাতে যাত্রা পালার রুপভানকে একটুকুও মনে ধরলো না ফুল্লরার! বেটা মানুষ মেয়ে সাজে কি করে ? ছি , লাজ লজ্জা যেন কিছুই নাই তার !মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো সে , না , না। আর কিছুতেই স্বামীকে যাত্রা কোরতে দেবে না সে । অন্তত মেয়ে সেজে যাত্রা পালা করা তো নয়ই । কি লজ্জা ! কিন্তু হা হতোগ্মি ! স্বামীকে ঘরে আগলে রাখার কোন বারণ কান্দন কিছুই তেমন কাজে লাগলো না । শাশুড়ি পরামর্শ দিলো , কাচ্চাবাচ্চা নিতে । তাতে যদি ছেলে তার ঘর মুখী হয় ।
সন্তান পেটে আসার কিছুদিন রুস্তম যাত্রাপালা ছেড়ে বউয়ের শরীরের দিকে মন দিলো । কিন্তু ছেলে হতে না হতেই আবার সে তাঁর পূর্বাবস্থায় ফিরে গেল । ছেলে কোলে নিয়ে গভীর রাতে একাকী ফুল্লরা স্বামীর পথ গুণে। রাত গড়িয়ে শেষ রাতের ফিকে আলো নেতিয়ে পড়ে তাল আর নারকোল পাতার গায় । দূর বন থেকে খেক শিয়াল শিয়ালী হুক্কা হুয়া , হুক্কা হুয়া করে শেষ প্রহরের ডাক ডাকে । পাখীরা ঘুম ঘুম ভাঙ্গা চোখে গানের বাঁশী বাজায় । কিন্তু যার জন্য এত প্রতীক্ষা তাঁর ফেরার নাম গন্ধটি পর্যন্ত নাই। হয়তো বা যাত্রার পোশাক খুলে সেই সাজ ঘরের এক কোনে পড়েছে নেতিয়ে পড়েছে সে ।
আর সেই সময়টাতেই কোত্থকে যেন একদিন সেই কুচকুচে কালো বেড়ালটা তাঁর সামনে এসে হাজির হোল! কি ভয়ঙ্কর কালো তাঁর গায়ের রঙ । অমাবশ্যা রাতের আন্ধারের মতো কুটকুটে কালো । শাশুড়ির কানে সেই কালো বেড়ালের কথা গেল , গেল বাড়ীর আর সবার কানে । শাশুড়ি বউকে শান্তনা দিয়ে বললো , তোমার মনের ভুল গো বউ। মনের ভুল । তয় রাত বিরেতে আর দাদুভাইকে নিয়ে দাওয়ায় হাটাহাটি কোর না ! ওদিক নানান গাছা অগাছা আছে ।
ফুল্লরা গলায় যেন অসুরের শক্তি । সে জোড় গলায় শাশুড়িকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে , ভুল নয় মা। কালো বেড়ালটা যে প্রতিরাতে আমার সন্মুখে আসে । দূর হ , দূর হ বলে কোন কোন দিন সে চেঁচিয়ে পাড়া মাত করে । কালো বেড়ালটাকে তাড়াতে কবরেজ , বৈদ্য , হাকিম ডাকা হোল । কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। কোথা থেকে যেন উড়ে এসে জুড়ে বসে সে রাতের বেলায় । আর আশে পাশে কেউ না থাকলে তার যেন পোয়াবাড়ো !
কালো সেই বেড়ালটাকে তাড়াতে না তাড়াতেই একদিন ফুল্লরার যাত্রা করা স্বামীটা ধপাস করে গেল মরে ! দূর গ্রামে যাত্রাপালা কোরতে গিয়েছিল তাঁর দলবল আর সে। আষাঢ় মাসের রাত। মাঝ গাঙ ভরা উতাল পাতাল জল । ঢেউ আর ঢেউ । দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন জলের সমুদ্দুর । এর মধ্যে মাঝ রাত্রিরে গাঙ্গে উঠে জোর তুফান । আকাশের তারার আলোগুলো সহসা কে যেন এক ফুঁয়ে দেয় নিবিয়ে । আর সেই গহীন রাত্রিরের আঁধারে ঝড় তুফানের মধ্যেখানে পরে যাত্রাপালার নৌকাটা গেল ফস কোরে তলিয়ে ।
ফুল্লরার কালো রাত আরও কালো হোল। গহীন কালো । পাহাড়ের মত ভারী সে রাত । এতিম ছেলে বুকে ধরে তাঁর দু চোখে কেবলই আন্ধার ।রাত গভীর হলেই তাঁর ঘর থেকে কেবলি তীক্ষ্ণ কান্নার শব্দ ভেসে আসে । আর সে সময়টাতে কালো বেড়ালটাই কেবল তাঁর নিত্য সহচর !
সব শুনেটুনে রুস্তম আলীর ভাই আর তাঁদের বউরা রটিয়ে দিল নানা কথা । আর তার সহজ মানে করলে এই দাঁড়ায় যে ; নির্ঘাত জীন আছে ফুল্লরার সাথে ! কালো বেড়াল ! আর কালো বেড়াল করতে করতেই জোয়ান স্বামীটাকে অকালে খেয়ে ফেলেছে সে । বড় ভয়ানক সে ! তাই ফুল্লরা এ বাড়ীতে থাকলে , তাঁরা কিছুতেই হেথায় থাকবে না ।
এরপর ছেলেসহ একদিন ফুল্লরাকে জোড় করে এক কাপড়ে বাপের বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়া হোল !

তিন
ফুল্লরা খাতুনকে ঘিরে মন্দ কথা বলা শুরু করলে অনেক কথাই আসবে ঘুরে ফিরে । আপন ভাই আর বউরা আর স্বামীর বাড়ীর লোকগুলো অনেককাল ধরে তাঁর সন্মন্ধে যা বলে এসছে তাইই ।
ফুল্লরার সাথে যে কালো বেড়াল! তাই তাঁর সাথে মানুষ থাকে কি করে ? স্বামী মরার কদিন যেতে না যেতেই নিজের ভাইবউরা চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে পাড়া মাত করলো । ফুল্লরাকে নিয়ে বুড়ো বাপ মায়েরই যেন কেবল মাথা ব্যথা । বাপ তাই এবার না দেখে শুনেই মেয়ের জন্য দ্বিতীয় বিয়ে ঠিক করে ফেললো । পাত্র অঢেল টাকা পয়সার মালিক । কেবল বয়সটা একটু বেশী । এই সত্তর বাহাত্তরের কাছাকাছি । পাত্রের আগের তিন তিনটে বউ গত হয়েছে । এই শেষ বয়সে আর নতুন করে বিয়ে সাদীর সখ ছিল না তার।কিন্তু ছেলে বউরা আর দেখাশুনা করতে চায়না তাকে । পান থেকে চুন খসলেই শ্বশুর নাকি ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করে । এখন এসব আর ভালো লাগে না ডানা গজিয়ে উঠা বউদের! শেষমেশ ছেলেরাই একরকম জোড় করে বাপের আবার বিয়ে দিয়ে দিল । কিন্তু লাল ঘোমটা টানা নতুন বৌ এর মুখ দেখে তাদের দুশ্চিন্তা গেল বেড়ে । দিন কি গ্যালো ? বুড়া বাপকে নির্ঘাত এবার এই মেয়েলোকটাই চরকার মত ঘুরাবে ।
হোলও তাই । বুড়ো কসিম ব্যাপারী তাঁর নতুন যুবতী বউ ছাড়া কিছুই যেন বোঝে না । দিনে রাতে কেবল বউ আর বউ । সুন্দরী বউ এর ভবিষ্যতের কথা ভেবে তলে তলে তাঁর নামে ম্যালা জমি জমা লিখে দিলো সে । দিন দিন এসব কথা তার জোয়ান ছেলেদের কানে আসে । তাঁদের চিল্লাচিল্লি বুড়ো বাপ একবারেই গায়ে মাখে না ! ফুল্লরাও না!
কালো সেই বেড়ালটা তারপরও আসে ফুল্লরা খাতুনের কাছে রাত বিরেতে ।মাঝে মধ্যেই বুড়ো আধ বাতিল লোকটাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ভেংচি কাটে ।
কয়েক বছর বাদে , কসিম ব্যাপারীর মৃত্যুকে ঘিরে গ্রামে নানান রটনা শোনা গেল । নিন্দুকেরা বলে বেড়ালো কসিম ব্যাপারীর নতুন বউ ফুল্লরা খাতুনের সেই কালো বেড়াল রুপী জীনটাই নাকি তাঁকে নিশিরাতে ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলেছে !
চার
একমাত্র ছেলে সোরহাব আলীর প্রথম বিয়েতে ধুম ধামের কোন কমতি রাখে নাই ফুল্লরা খাতুন । তবে সেবার মেয়ে খুঁজতে খুঁজতেই ভারী পেরেশান হয়ে গিয়েছিল সে । খুব সুন্দরী মেয়ে চাই তাঁর । যেন গাঁয়ের আর দশজন লোক দেখে বলে , বউ এনেছে বটে সোহরাব আলীর মা তাঁর ছেলের জন্য । চাঁদের রুপকেও হার মানায় যেন সে রুপ । সত্যি সত্যি অনেক গাঁ খুঁজে খুঁজে শেষমেস দূরের অচেনা এক গাঁ থেকে মনের মতো বউ নিয়ে আসলো ফুল্লরা । গাঁয়ের দু চারটা সুন্দরী মেয়ে ছিল বটে , কিন্তু নিজের গায়ের মানুষজন কেন জানি ফুল্লরার সাথে আত্নীয়তা করতে চায় না । এটা ওটা নানা মন্দ কথা বলে তাঁর নামে।
ছেলের বউয়ের নাম আলপনা । দেখতে শুনতে ভারী রুপসী। মেয়ের বাপ এত দূরে মেয়েকে বিয়ে দিতে কিছুতেই রাজি হোচ্ছিল না । তারপরও অনেক দিয়ে থুয়ে বলে কয়ে তাঁকে রাজী করানো গেছে।
রুপের অহঙ্কারে বউয়ের মাটিতে যেন পা পড়ে না । ফুল্লরা খাতুন বউয়ের ভাবসাব দেখে আর মনে মনে হাসে । নিজের কথা মনে কোরে ভাবে সুন্দরী মেয়েদের রুপের এক আধটু দেমাগ থাকবেই । এ তেমন দোষের কথা নয় । ছেলের খুব মনে ধরেছে বউ , তাতেই খুশী সে । কিন্তু দিনকে দিন ছেলের বউ বউ কোরে পাগলামি দেখে , তাঁর বাপের কথাই মনে পড়ে ফুল্লরার । নাহ , আর বাড়তে দেয়া যাবে না । এই যে বিশাল সম্পতি , ব্যবসাপাতি সে তিল তিল কোরে গড়ে তুলেছে , তার সবই তো ছেলের মুখের দিকে চেয়েই । তাই ছেলে মায়ের হুকুমমতো অনিচ্ছাস্বতেও গঞ্জের দিকে পা বাড়ায় ।
কিন্তু বউ এর নিত্য নতুন রঙ ঢং দেখে মাথা ধরে যায় ফুল্লরার । ইদানীং আবার নতুন এক বেশ ধরেছে সে । রাতের বেলায় ঘর থেকে বের হতে নাকি বড় ভয় লাগে তাঁর। এত ভয় যে রাতের খাবারও তার ঘরে দিয়ে আসতে হয় । দিনকে দিন সে ভয় যেন বেড়েই চলেছে তাঁর । কিন্তু কারণটা কি ? না , তা বলা নাকি হুজুরের বারণ । কেবল স্বামীকেই সে চুপি চুপি বলেছে সে , এ বাড়ীতে একটা প্রকাণ্ড কালো বেড়ালের ছায়া ঘুরে বেড়ায় ! আর তা রাতের বেলায় মায়ের ঘরে !
সোরহাব আলীর মনে একটা গভীর দুশ্চিন্তা্র ছায়া ভর করে ।বউয়ের কথা বিশ্বাস কোরতেও ইচ্ছে হয় না তার । আবার না করলে সে অভিমান করে বসে থাকে । এ ব্যাপারে মাকে কিছু বলতেও সাহস হয় না তাঁর। একদিকে মা আর অন্যদিকে বউ , কাউকেও মনে কষ্ট দিতে পারে না যেন সে ।
সোরহাব আলী তবুও ভাবে ; আচ্ছা, বউ তাঁর কালো বেড়ালের কথা শুনলো কি করে ? তারপর অনেকটা নিশ্চিত হোয়েই মনে মনে বলে , নিশ্চয়ই বাড়ীর কোন কাজের মেয়ে মার সেই কালো বেড়ালের গপ্পো শুনিয়েছে আলপনাকে। মায়ের কালো বেড়ালের কাহিনী যদিও সে নিজে একটুকুও বিশ্বাস করে না । কিন্তু তাঁর বউ কেন যেন কালো বেড়ালের গপ্পোটা একেবারেই ভুলতে পারছে না , কেন ? কালো বেড়ালটা নিয়ে এদ্দিনবাদে যেন একটা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ালো সোরহাব আলী ! তা থেকে যেন তাঁর মুক্তি নাই ! তবুও বউকে সামলে রাখার নানা চেষ্টা চালাতে ত্রুটি রাখে না সে !
এত কিছুর পর তবুও যেন শেষ রক্ষে হোল না ! একদিন ছেলে হতে গিয়ে হুট কোরে সোরহাব আলীর সুন্দরী বউটা গেল মরে। মা আর সন্তান এক সাথে । সন্তান ভুমিস্ট হওয়ার আগে দুইদিন সে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় পড়েছিল । গ্রামে তখন তখনই রটে গেল সোরহাব আলীর অচেতন বউ নাকি মরে যাবার আগ মুহূর্তে তাঁর স্বামীর কানে কানে বলে গেছে , শাশুড়িকে সে নাকি কালো বেড়াল হয়ে যেতে দেখেছে । আর তাতেই সে ভয় পেয়ে --------!
বউ এর আচমকা মৃত্যুর পর অনেকদিন গোঁ ধরে ঘরে বসে থাকলো সোরহাব আলী । কাজে কামে তাঁর আর আগের মতো মন বসে না । মার সাথেও কথা বলতে ইচ্ছা করে না ! ফুল্লরাও সাহস করে ছেলেকে কিছু বলে না !


পাঁচ
একদিন দ্বিতীয় বিয়ের কথা উঠতেই সোরহাব আলী মাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিলো , এতো শীঘ্রই আবার বিয়ে করার মতো মনের অবস্থা তাঁর নাই । একেবারের নাই ।
ফুল্লরা খাতুন ছেলের এহেন আচমকা পরিবর্তনে খুব অবাকই হয় । মনটাও বেশ খারাপ হয় যায় তাঁর । বউকি কারও মরে যায় না নাকি ? তাই বলে ঘর সংসার বাদছাদ দিয়ে একেবারে বৈরাগী সাজা !ছেলেকে নিয়ে যেন নতুন কোরে ভাবতে বসে সে । তাইতো, যে ছেলে তাঁর মায়ের মুখের সামনে কোনদিন একটা ক্থাও মুখ ফুটে বলে নাই , সে আজ তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কথা বলতে শিখেছে । বলুক । পরক্ষণেই নিজের মনকে শান্তনা দেয় ফুল্লরা । বলুক, আহা বলুক। সদ্য সদ্য বউ হারিয়ে বেচারার মাথা ঠিক নাই । বলতেই পারে । সে মা হয়ে তো আর ছেলেকে ফেলে দিতে পারে না । পেরেছে কি সে কোনদিন ? ছেলেকে হাতে ধরে সে সব বিষময় দিনের কথা ভোলে কি কোরে ফুল্লরা।একটা কথাও ভুলতে পারে নাই সে । দিনের বেলা কাজকামের মধ্যে সব ভুলে টুলে এভাবে ওভাবে কাটানো যায় বটে ! কিন্তু রাত হলেই চারদিকের সেই ঘনঘোর অন্ধকার ! সেই নিদারুন যন্ত্রণা !
ছেলের জোর অনিচ্ছা থাকা সত্তেও তা্ঁর দ্বিতীয় বিয়ের জন্য জোর মে্যে খোঁজা শুরু করে ফুল্লরা খাতুন ।রাতের বেলায় মেয়ে দেখা একেবারেই পচ্ছন্দ নয় তাঁর। এতে নাকি মেয়ের খুঁতটুত বোঝা দায় । তারপরও অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিজের গরজেই এ মেয়েটিকে রাতের বেলায়ই দেখতে গেল সে । মেয়ের বাপের অবস্থা তেমন ভালো নয় । ছিটা ফোঁটা জমি আছে , এছাড়া অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করে সে । তবে কুলসুম নামের এ মেয়েটিকে বেশ পছন্দ হোল ফুল্লরার । সে দেখতে শুনতে আগের বউ আলপনার মতো চাঁদপানা সুন্দরী নয় । বরং বেশ একটু শ্যামল ঘেঁষা তাঁর গায়ের রঙ্ । সেই ভালো । বেশী সুন্দরী বউদের বাড়তি ডানা গজায় পিঠের উপরে । বড় বউকে নিয়ে তো কম ঝক্কি সামলাতে হোল না । অতো চাঁদপানা সুন্দরী মেয়ের আর দরকার নাই , ফুল্লরা আপন মনে বলে ।
ছেলের মতি গতির কথা ভেবে তাঁর বিয়ের ব্যাপারে আর কোন সময় নিতে চাইল না ফুল্লরা । তাই সে রাতেই বিয়ের তারিখ , দেনা পাওনা এসব সব ঠিকঠাক করে ফেলে সে । ছেলেকে কিছুই দিতে হবে না মেয়ের বাপকে । বরং ফুল্লরা খাতুন নিজেই সোনাদানায় ভরে দেবে মেয়েকে । রাজরানী সাজিয়ে ঘরে তুলবে তাঁকে।
আগামী শুক্রবার জুম্মার নামাজের পরে বিয়ে !
কুলসুমের ভাইরা গাইগুই করে দিনের বেলায় বিয়ের আয়োজনের কথা শুনে । এত বড়লোকের ঘরে বোনের বিয়ে হোচ্ছে ! গ্রামসুদ্ধ লোকজন না জানলে কিসের আবার বিয়ে । বাড়ীঘর সাজানো , গেট বানানো আর তার মাথায় লাল নীল হলুদ আলোর ফোয়ারা না ছুটালে আবার বিয়ে কিসের ? এসব হলে , তবেই তো গায়ের সবাই বলবে , বিয়ে একটা হোচ্ছে বটে বসির মিয়ার বেটি কুলসুমের !
কিন্তু ফুল্লরা খাতুন সব ইচ্ছেয় বাদ সেধে সবাইকে অবাক কোরে দিয়ে জোর গলায় বলে উঠে ; না , কিছুতেই না ! বিয়ে দিনের বেলাতেই হবে !
ছেলের মা বাড়ী ফিরে গেলে কুলসুমের মা তার স্বামীকে ফিস ফিস কোরে বললো , ঐ ঘরে আমার মেয়ের বিয়া কিছুতেই দিমুনা আমি । দ্যাখো পাড়ার লোকের কথাই সত্য । রাতের বেলায় সে যে নিজেই কালো বিলাই হয় , তাই রাতে ছেলের বিয়ে দিতে এতো আপিত্তি !
বসির মিয়া বউয়ের কথায় কান দেয় না ! মেয়ে মানুষের কথায় অতো গুরুত্ব দিলে কি আর এই পৃথিবীটা চলে !
ছয়
এবার প্রথম থেকেই ছেলের বউয়ের উপর নজর রাখে ফুল্লরা । আগের বউয়ের মতো তাঁর যখন যা ইচ্ছে করার ক্ষমতা যেভাবে পারে ছেটে কুটে রাখে । কুলসুম বেশ ভয়ই পায় জবরদস্ত শাশুড়িকে । সে যত তাকে ভয় করে , মুখ বুঁজে নমনীয় আর চুপচাপ থাকে , ততই মনে মনে খুশী হয় ফুল্লরা । মুখে অবশ্য কিছু বলে না । কিন্তু ধীরে ধীরে বউয়ের আসল চেহারা ফুটে উঠে তাঁর কাছে । ফুল্লরা বেশ বুঝতে পারে এতদিন তাঁর ছেলের বউ কেবল ভাল সাজার ভান করেছে। না হলে পুচকে ঐ একরত্তি মেয়ের সাহস হয় কি করে তাঁর মুখে মুখে উত্তর কাটা। ইদানীং শাশুড়ির কোন কথাই যেন সহ্য হয় না তার । কিছু বললে দৌড়ে গিয়ে ঘরের দুয়ার দেয় । এ যে প্রথম বউকেও ছাড়িয়ে গেল ! ফুল্লরা উদাস সুরে মনে মনে বলে !
ছেলে বউয়ের উপর রাগ করে শরীর খারাপের অছিলায় ফুল্লরাও দরজায় খিল দেয়। ছেলে বাড়ীতে ফিরে এলে মাকে ভাত খাওয়ার জন্য সাধাসাধি করে । ইচ্ছে হোলে দোর খুলে ফুল্লরা । আবার কোনদিন জেদ করে চুপ করে থাকে । বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিজের ভাগ্যকে কেবল দোষারোপ করে সে । সবই তাঁর কপাল । দু চোক্ষের পানি ছাড়া আর বোধহয় কিছুই ভাগ্যে লেখা নাই তাঁর । আর সেই ফাঁকে কোথা থেকে যেন সেই ভয়ঙ্কর কালো বেড়ালটা লেজ গুটিয়ে তার পাশে এসে বসে । বলে ; কাঁদ ফুল্লরা , কাঁদ , আরও জোরে জোরে কাঁদ । মন খুলে কাঁদ । কেঁদে কেঁদে ভাসিয়ে দে চারদিক । রাত যত গহীন হয় , বেড়ালটার উৎপাত ততই বাড়তে থাকে । আঁধার ঘন কালো রাত , নিঝুম আর নিথর । তার সাথে মিল রেখে কালো বেড়ালের কান্নার শব্দ !
একদিন রাতদুপুরে কুলসুম শাশুড়িকে শুনিয়ে শুনিয়ে স্বামীকে জোর গলায় বলে , আমি হেথায় আর থাকতে পারবনি ।
ক্যান ? সোরহাব মিয়া অবাক হয়ে জানতে চায় ।
জান না না তুমি ? পাড়ার ছেলে বুড়া সবাই জানে তোমার মায়ের কথা , আর তুমি না জানার ভাব করো , পিচ্চি মেয়েটা যেন অগ্নি মূর্তি ধারণ করে ।
কি , কি জানো তুমি ? কলহ ভারী অপচ্ছন্দের সোরহাব মিয়ার ।তারপরও সে যেন জানতে চা্য় তাঁর মায়ের বিরুদ্ধে কি কি অভিযোগ আছে নতুন বউয়ের ।
কুলসুম কিছু বলে না। আর কিছু বলতে চায় না সে । সে যেন বুঝে গেছে তাঁর স্বামী সব জেনেও না জানার ভান করছে । আসলে মায়ের বিরুদ্ধে কোন দিন কিছুই বলেনি সে আর বলবেও না ।
তারপরও কি ভেবে সাহস কোরে হঠাৎ সে বলে উঠে , জানোনা তুমি না ? তোমার মা যে ডাইন , কালো বিলাই ! বলতে বলতে উচ্চস্বরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সে । আগে জানলে কি আর এই ঘরে আসি !
ফুল্লরার কানে ছেলের বউয়ের সব কথা যায় । নিজের কানকে যেন নিজেই বিশ্বাস কোরতে পারে না সে। এত বড় কথা তাঁর মুখের উপর কোনদিন যে কেউ বলতে পারবে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারে নাই সে। কিন্তু এখন কি হবে ? কি হবে ? ছেলের কানে তো বুদ্ধীহীন মেয়েটার সব কথা এতক্ষণে ঢুকে পড়েছে নিশ্চয়ই ।এখন কি হবে? এখন কি হবে তা যেন ভুলেও ভাবতে পারছে না ফুল্লরা । মায়ের নামে কূট কথা , মাকে অবজ্ঞা আর গালাগালি । বিশ্রী রটনা ! ছেলে নিশ্চয়ই এবারে আর কিছুতেই ক্ষমা করবে না তাঁর বউকে । ফুল্লরা কান খাড়া করে রাখে । তাঁর বুকের স্পন্দন বেড়ে যায় দ্রুতগতিতে । ধক ধক ! ধক ধক ! আহা বুদ্ধীহীন মেয়েটি কি সাধ করে মৃত্যুর পরোয়ানা গলায় পড়ল ?
অনেক অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে থাকে সোরহাব মিয়া । একেবারে নিস্তব্ধ । বড়ই নিঃশ্চুপ যেন সে। কুলসুমকে বোবা করে দেবার কোন ভাষা যেন জানা নাই তাঁর । কিন্তু তাঁকে বিশ্বাস না করেই বা থাকে কি কোরে সে । এমন একটা কথা আলপনাও তো মরে যাবার আগ মুহূর্তে তাঁর কানে কানে বলে গিয়েছিল। দুজনার কথা এক হয় কি করে ! ভাবতে থাকে সোরহাব মিয়া । ভেবে ভেবে তাঁর মন উতাল পাতাল মাতাল ঢেউয়ের মতো আকুলি বিকুলি করে !
বউকে আর কিছু বলতে পারে না সোরহাব মিয়া, বলার কোন ভাষা যেন জানা নেই তার! কেবল মায়ের ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত , হতভম্ব , বিপর্যস্ত সোরহাব মিয়া ব্যাকুল কণ্ঠে এক সময় ফস কোরে বলে ফেলে ; মা , মাগো , তোমার ছেলের বউদের সাথে তোমার এত কি শত্রুতা ? আমাকে কি তুমি একটু শান্তিতে ঘরসংসার কোরতে দিবে না ?
সাত
ফুল্লরা খাতুন এক্ষণে যেন বুঝে গেছে মস্ত এ পৃথিবীটাতে সে বড় একা ! বড়ই একা । তাঁর আকাশ নাই। বাতাস নাই । তাঁর জমিন নাই । আসমান নাই । তারঁ রাত নাই । দিন নাই । তাঁর আপন নাই , পর নাই। তাঁর নাই , কিচ্ছু নাই । থাকলে কি আর নিজের বুকের রক্ত পানি করা যক্ষের ধন , নয়নের মনি তাঁর সোরহাব , সোরহাব মিয়া , তাঁর বাবলু তাঁর মুখের উপর এত বড় কথা কইতে পারে ?
ফুল্লরা আর কি কোরতে পারে? ঘরের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালে দেখা যায় দূরের আকাশ। গাঢ় অন্ধকার সে আকাশ। আকাশে কোন চাঁদ নাই । নাই তারা । তারার বাতি জ্বালিয়ে সুতো কাটে না আর গুড়িসুড়ি চরকা বুড়ি । চাঁদের আলোর সাথে হেলেদুলে বাতাস যে পাতাবাহারী ঢেউ তোলে নদীর বুকে , বট পাকুরের মাথায় আর অলিন্দে , সে আলো আজ যেন চিরতরে করে হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে !
ফুল্লরার প্রাণ নাই । আত্মা নাই । দয়া নাই , মায়া নাই । নাই আর কারো জন্য দুশ্চিন্তা। নেই ভালবাসা ।
কালো বেড়ালটা আগের মতোই আজোও হুট বেড়িয়ে এলো , কোত্থকে কে জানে । কি ভয়ঙ্কর কালো তাঁর গায়ের রং , অমাবশ্যার আকাশের মতো মিসমিশে কালো আর ভয়ঙ্কর । কি সুতীব্র তাঁর চাহুনি । তা হার মানায় রা্তের বিজলী হায়েনাকে!
কালো বেড়ালটা ফুল্লরা খাতুনের কানে ফিসফিসিয়ে বলে , আর ক্যানো ফুল্লরা ! আর ক্যানো অনেক তো হোল ! এবারে ক্ষমা দে ! ক্ষমা দে !
ফুল্লরা খাতুনের দেহটা ঝুলছে ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে! বড় করুণ আর বীভৎস সে দৃশ্য । পাড়া প্রতিবেশীরা তাঁর নিস্পান দেহখানা দেখে অনেক্ষণ ধরে কানাঘুষা করে । ফিসফিসিয়ে বলে ; উহ , কি ভয়ঙ্কর কালো বেড়ালের মতো হয়ে গেছে মুখটা !
হতবিহ্বল , ম্লান আর বেদনাক্লিষ্ট সোরহাব মিয়া তাকাতে পারে না , কিছুতেই তাকাতে পারে না , মায়ের অভিমানী সেই মুখের দিকে! ভয় পায় । বড় ভয় পায় সে। পাছে আর পাঁচজনের মতো সেও কালো বেড়াল খুঁজে পায় মার সেই অনিন্দ্র সুন্দর মুখে !
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া নিঝুম রাতে গল্পটি পড়লাম... ভালো লাগল... ধন্যবাদ
Fahmida Bari Bipu গল্পটা পড়ে অভিভূত হলাম। আপনার চিন্তার গভীরতা স্পর্শ করল আমাকে।
ভৌতিক পিয়াস গল্পটা অনেক ভাল। আমি গল্পের চিন্তার গভীরতা, লেখিকার মনোদ্দেশ বুঝতে পেরেছি। হয়ত বুঝাতে পারবনা কি বুঝেছি, তবুও এক কথায় বললে বলতে হয়, মা সবসময়ই মা, ডাইনি বা অন্ন কিছু নয়।
খুব সুন্দর মন্তব্য । দারুন প্রীত হলেম । আসলে তাইই বলতে চেয়েছি - ,মা সব সময়য়ই মা !
ভালো লাগেনি ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৪
সাদিয়া সুলতানা অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানবেন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ সাদিয়া ! ভালথেক !
ওয়াহিদ মামুন লাভলু অনেক অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানবেন।
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ , ভাল থাকবেন !
সকাল রয় অনেক ভালোলাগলো।।
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ দুর্দান্ত নামকরণ আর অসাধারন গল্প ----- !!
ঝরা পাতা রহস্য রয়ে গেল...শেষ হইয়াও হইলনা শেষ। অসাধারণ একটা গল্প...
Gazi Nishad অসাধারণ গল্প। খুব খুব ভালোলাগা রেখে গেলাম। আমার কবিতায় আমন্ত্রণ রইলো।
রোদের ছায়া গল্পের নামকরণ থেকে শুরু করে বর্ণনাভঙ্গি কাহিনী খুব ভালো লাগলো। সামাজিক প্রেক্ষাপটটিও বেশ যত্নের সাথে তুলে ধরেছেন। শুভকামনা রইলো ।

১০ ফেব্রুয়ারী - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ১৬ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.৫৪

বিচারক স্কোরঃ ৩.৩৮ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.১৬ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪