এক 
রাত বাড়তে থাকলেই কোত্থকে থেকে যেন গহীন আঁধার রাতের মতোই মিশমিশে কালো সেই বেড়ালটা উঁড়ে এসে জুড়ে বসে । কুচকুচে কালো তাঁর গায়ের রঙ। খাঁড়া দু্ কান আর খোঁচা দেয়া নূয়ে পড়া জোড়া গোঁফ । বাঁকানো পশমঘন ভারী লেজ ।  চকচকে ভীতিকর  চোখ দুটো হিংস্র বাঘের চোখের মতো কেবলি জ্বলে আর নেভে । নেভে আর জ্বলে !
ভয়ঙ্কর সেই কালো বেড়ালটা আজও কেন যে এল ! এবার এসে সে ফুল্লরা খাতুনের  মুখের কাছে মুখটি রেখে হাসতে হাসতে বললে, কেমন মেয়ে পছন্দ করলে গো নতুন বউ তোমার ছেলের জন্য ? 
ফুল্লরা খাতুন উত্তর দেয় না । দিতে ইচ্ছা করে না তাঁর । আগাম কথা কি আর বলা যায় ?  কালো বেড়ালটার আদিখ্যেতা দেখে ভয়ানক রাগ হয় তাঁর । নাদান । সে জানে সব কথা । কিন্তু ভাব দেখাচ্ছে যেন কিছুই জানে না সে । তাঁকে  কি আহান্মক ভেবেছে বেড়ালটা ?
ফুল্লরা খাতুনের আজ একটা সুখের দিন । একমাত্র ছেলের বিয়ের  জন্য অনেক দিন বাদে মনের মতো  একটা মেয়ে খুঁজে পেয়েছে সে । আজকে আবার কেন সেই আন্ধার কালো বেড়াল ? যা যা চোখের সামনে থেকে পালা ! দূর হ ! দূর হ !  কালো আন্ধার গহীন  যে বন , সে বনে ফিরে যা  তুই। জন্মের মতো  যা । ফুল্লরা বিড়বিড় করে !
তবুও যাই যাই কোরেও যায় না যেন কালো সেই বেড়াল !
দুই 
গ্রাম জুড়ে ফুল্লরা খাতুনকে ঘিরে ভালো মন্দ ম্যালা রকম কথাই চালু আছে । ভালো কথা বললে ,  সবাই তাঁর অপরূপ রুপ লাবন্যের কথাই কইবে। পূর্ণিমা চাঁদের আলো ছড়ানো গায়ের রঙ । টিকালো নাক । পদ্গ ভাসা দু চোখ । রাতের আকাশের মতো কালো মিসমিশে একতাল চুল কোমর অব্দি ছড়ানো । ভাটার টা্নে বয়স যদিও তার পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে অনেকদিন ।  কিন্ত কে বলবে বয়স এতো ? কিভাবে যে সে তার বয়স এতকাল ধরে লুকিয়ে রেখেছে তাও যেন এক রহস্য !   
ফুল্লরার প্রথম বিয়ে বেশ সচ্ছল ঘরেই হয়েছিল । গরীব বাপকে মেয়ের বিয়ের জন্য হন্নে হোয়ে পাত্র খুঁজতে হয় নাই । সুন্দরী মেয়ের জন্য ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসার কমতি ছিল না ।  কিন্তু  আরেকটু দেখি দেখি করে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় যা হোক যেন একটু বেশী  সময়ই নিয়ে ফেলেছিল নুরু মিয়া , ফুল্লরার দিনমজুর বাপ । শেষমেস গায়ের লোকজন যখন বলাবলি শুরু করলো ;  ফুল্লরার বাপ,  তুমি কি তোমার মাইয়াকে লাউয়ের বস বানাইয়া চাতালের আগায় ঝুলিয়ে রাখবা , তখনই টনক নড়লো তাঁর। একটু বেশীই দেরী হয়ে গেল বলে সোমত্ত মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে  গভীর আক্ষেপে মাথার কাঁচা পাকা চুল ছিড়ে ফেলার উপক্রম করলো সে ।  
যার সাথে বিয়ে  ঠিক হলো ফুল্লরা খাতুনের ,  সেই ছেলের বাপের অবস্থাদি মন্দ না । কিন্তু ছেলেটাই একটু যেন কেমন , কেমন । তার স্বভাব চরিত্রে কোন কালো দাগ নাই বটে কিন্তু বড়ই আলাভোলা আর হাবাগোবা সে। এবং বিয়ের পরেই তা ধীরে ধীরে টের পেতে শুরু করলো ফুল্লরা ।  একবার বাপের বাড়ীতে নাইয়র এসে কি ভেবে বাপ তাকে  আচমকা একদিন জিঞ্জেস করেছিলো জামাই বাবাজির কাজকামের কথা! আর তাতেই ভালমতো হুঁশ হয়েছিল ফুল্লরার ! স্বামীকে নিয়ে  নতুন কোরে ভাবতে বসল যেন সে । তাইতো  কি কাজ করে স্বামী তাঁর ? কেবল  তার নিজের চোখে নয় , বাপের চোখেও স্বামীর ফাঁকটা  ধরা পড়ছে  বটে । রুস্তমের বাপ তি্ন ছেলের জন্য যা  সহায়সম্পতি রেখে  গেছে তা একেবারেই ফেলে দেয়ার  মতো নয় । কিন্তু  বাপের  অবর্তমানে  সব  কিছুর নিয়ন্ত্রণের মালিক যে তার বড় দু ভাই , তা  এক্ষণে বেশ বুঝে গেছে ফুল্লরা । ভাইদের সবারই গঞ্জের বুকে বড় বড় দোকান । কিন্তু  রুস্তমের  নামে কি আছে ? কিছুই নাই । 
বলি  না বলি করে একদিন বুড়ো শাশুড়িকে স্বামীর ভবিষ্যতের কথা জিজ্ঞেস করলে , শাশুড়ি নতুন বউকে শান্তনা দিয়ে বলে ;  হোবো রে মা হোবো । একটু ধৈয্য ধর , বড় ভাইয়েরা কি তাক ফ্যালায় দিবো ? 
ভাইয়েরা কি তাক ফ্যালায় দিবো ? শাশুড়ির  এই কথাটার মানে সহজেই যেন বুঝে ফেলে ফুল্লরা । এর  মানে  , তাঁর স্বামীর ভাগ্যের পুরোটাই এখন ঝুলছে তাঁর বড় দু ভাইয়ের হাতে !
কিছুই ভাল লাগে না ফুল্লরার । সংসারে আর  আগের মতো মন বসে না ! স্বামীর সাথে  এসব বিষয় নিয়ে প্রায়শঃ মন কষাকষি হয় ! তবে কিছুদিন বাদে ক্ষান্ত দেয় সে । তাঁর মনে হয়, কাজকামের ব্যাপারে ভাইদের  যতনা  দোষ , তাঁর স্বামীর দোষ তাঁর চেয়ে কোন অংশে কম না !
ঘরকুনো রুস্তম দিনরাত সুন্দরী বউয়ের আঁচল ধরে পড়ে থাকতেই ভালবাসে । আর এ  নিয়ে তার বড় ভাইয়ের বউরা আড়ালে আবডালে  এটা ওটা নানা ধরণের কটুক্তি করে। যেন  খুব একটা মজার আলোচনার বিষয় এদ্দিন বাদে পেয়ে গেছে তারা । বুড়ো শাশুড়ির যত মাথা ব্যথা ছোট ছেলেকে নিয়ে , তা ভালমতেই জানে তারা । তাই  সুযোগ পেলেই তাকেঁ খোঁচা দিয়ে বলে  এ কথা ও কথা বলে ব্যঙ্গ করতে ছাড়ে না তারা!
কদিন পরে ফুল্লরার কানে আসে , তার স্বামীর যাত্রাপালা্র আসক্তির কথা । বিয়ের আগে এ বাড়ীর  কেউই ঘুনাক্ষরে মেয়েপক্ষকে জানায়নি সেসব কথা । তাই কদিন বাদে বউয়ের আঁচল ছেঁড়ে রুস্তম আলী আবার যাত্রাপালায় মন দিল ! ফুল্লরা দাঁতে দাঁত চেপে থাকে । মনে মনে ভাবে ; যাক , ঘর ছেড়ে সে যে এবার বাড়ীর বাহিরে পা দিল , এই মন্দের ভালো ।
রুস্তমের ভারী সখ  ছোট বউকে সে একবার যাত্রা পালা দেখায় । তাঁর স্থির  বিশ্বাস,  বউ  একবার তার পার্ট দেখলে কিছুতেই আর তার উপর রাগ করে বসে থাকতে পারবে না ।  তাই অনেকদিন  ধরে সেধে সেধে একদিন সত্যি সত্যি বউকে সে যাত্রা পালা দেখাতে রাজী করালো । রুস্তমের  সারা বিকাল আর সন্ধ্যা যেন কিছুতেই কাটতেই  চায় না । তবে  আজ একটু রাত করেই পালামঞ্চে যাবে সে। বউয়ের  হাত ধরে একবারে বারো ভুঁইয়ার ঈসা খার মত। বড় সখ  রুস্তমের ঈসা খার পালায় ঈসা খা সাজে , কিন্তু পালার মালিক কেবলি তাঁকে সখিনা সাজায় । বলে রুস্তমকে নাকি মেয়ের রোলই ভাল মানায় ! কিন্তু সে তো বিয়ে করার আগে ।  বিয়ে করার পর মেয়ে সাজতে ইদানীং যে তাঁর আর ভালো লাগে না , তা সে বেশ বুঝতে পারে ।
যা হোক রাত  একটু গভীর হতে না হতেই রুস্তম আলী তাঁর সুন্দরী বউটাকে সাজিয়ে গুজিয়ে যাত্রা প্যান্ডেলের দিকে পা বাড়ায় । এর আগে এত রাতে ঘরের বাহিরে বের হওয়ার অভ্যাস ছিল না ফুল্লরার । বাপের কড়া হুকুম , ঘরের মেয়ে বউদের রাতবিরেতে  বাড়ী যাওয়া চলেবে না , তা  যত কাজকাম থাকুক । 
গায়ের পায়ে হাঁটা পথ । একটু  এগোলেই মনে হয় যেন কতো পথ  হাঁটা হোল ! চারিদিকে ঘোর ঘুট্টি অন্ধকার । আর তা একটু  একটু কোরে যেন বাড়তেই থাকে । গায়ের ঠিক মধ্যিখানটায়  সারি সারি বাড়ী ।  ঘরবাড়ীগুলোর গা ঘেশে অসংখ্য ঝোপঝাড়। আর তার মাঝখান থেকে হঠাৎ হঠাৎ  কোরে কোন ফাঁকে বেড়িয়ে আসে জোনাই পোকার দল । টিপ টিপ  আলোর মালা জ্বালে আবার রাগ করে এক ফুঁয়ে যেন দেয়  নিবিয়ে। ফুল্লরা যেন ফিরে গেছে তাঁর  কিশোরীকালে । সে জোনাই হাতে পাবার জন্য ঝোপ বরাবর দৌড় দেয় । রুস্তম ব্যাকুল হাসি হেসে বউয়ের হাতটা আরও শক্ত কোরে চেপে ধরে। কি মনে কোরে বলে, বউ, জোনাইকে ব্যথা দেওয়া ভালো না । ওরা কষ্ট পায় । ফুল্লরা জোরে জোরে হাসতে থাকে আর মনে মনে বলে ;  বাহ , লোকটা জোনাই এর  কষ্ট বোঝে কেবল বউয়ের দুঃখ বোঝে না । রুস্তম আলীর কানে বউয়ের  পাগল করা হাসির শব্দ ভাসতে থাকে । সে ফিসফিসিয়ে বউ এর কানে কানে বলে  ,  তুই সত্যি একবারে পাগলীরে বউ । 
রাত বাড়তে থাকে । জোনাই পোকারাও ক্ষান্ত দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে একটু বিশ্রাম নেয় । ওরা দুজন  হাঁটতেই থাকে ।  পথের ধারে বড় বড় তাল আর নারকেল গাছগুলোকে  এক্ষণে আঁধারে আর চেনা যায় না । দেখে মনে হয় যেন এক একটা দৈত্য দানব । ফুল্লরা ভয়ে ভয়ে তাঁর স্বামীর হাত চেপে ধরে ! রুস্তম  তাকে সাহস যোগায় বলে  , এই চাঁদ উঠলো বলে । 
অনেক অনেকটা পথ পেড়োনোর পর , একসময় যাত্রাপালার প্যান্ডলের কাছে এসে দাঁড়ায়  তাঁরা । ফুল্লরা দেখে , মস্ত  একটা খোলা মাঠ । মাঠের ঠিক মধ্যেখানে বাঁশের খুঁটি দিয়ে উঁচু চালা করা। চালার মাথায় পুরু চড়াট আর শতরঞ্চি বিছিয়ে নিপাট মঞ্চ বানানো ।মঞ্চের চারদিকটাই  খোলা ।  তিন দিকেই ভরা মানুষ ।কেবল মানুষ আর মানুষ । এত রাতে  একসঙ্গে এতো মানুষ কোনদিনও দেখেনি ফুল্লরা । মঞ্চের একদিকে কয়েকজন লোক হারমোনী আর তবলা ডুগী  নিয়ে বসে আছে। তাঁদের  সবার গায়ে  রঙিন রঙিন সার্ট । ঝলমলে !  পরনে ফুল আঁকা লাল নীল লুঙ্গি । প্রায় সবার মুখই পান পাতা আর জর্দায় ভরা । পানের রস ঠোঁট বেয়ে বেয়ে  গড়িয়ে গড়িয়ে নীচে পড়ছে , গায়ে আর সার্টের বুকে । কিন্তু কারোই সেদিকে সামান্য খেয়ালও যেন নাই ।
যাত্রা পালা আরম্ভ হতে তখনও  ঢের দেরী । নট নটীরা যার যার মতো করে সাজ সাজন দিচ্ছে । সাজঘরে মেকআপম্যানরা গোল আয়না হাতে এর ওর মুখের সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আনছে  , পছন্দ হোল কি না ।বাহিরে একতাল মানুষ । এত রাতেও যেন চারদিকটা জুড়ে দিনের মতো সাজ সজ্জা, রব ।  কেবলই হুড়োহুড়ী , হাসাহাসি আর টানাটানি । কে যেন দ্রুত যাত্রা শুরু করতে হুকুম দিয়ে  চলে গেল!যাত্রা পার্টির ম্যানেজার হয়তো বা !
চার পাশের পরিবেশটা বড়ই আনন্দঘন , মন্দ লাগছে না ফুল্লরার। খোলা মঞ্চটার  চারদিক জুড়ে   কেবলি আলোর বন্যা । লাল নীল হলুদ বাতি কেবলি জ্বলছে আর নিবছে  । বাতির আলো ডিঙ্গিয়ে  সুদূর আকাশের চুড়ায়  বসে থাকা  চাঁদ আর হাজারো তারা সখী্রা কোন ফাঁকে আলোর  বন্যা বইয়ে দিচ্ছে মাটির বুকের আঁচলে । গোটা এলাকাটাকে  যেন গ্রাস করে ফেলেছে শঙ্খীনি চন্দ্রাবতীর সেই রূপোলী আলো। আর সে আলোর ছটা বারে বারে এসে গড়িয়ে পড়েছে ঠায় বসা অসংখ্য নর-নারীর গায়ে।  আলোর সাথে মিতালি কোরতে উচাটন বাতাস মাঝে মধ্যেই  ঘুরে ফিরে এসে আছড়ে পড়ছে  চার ধারটাতে । দুয়ে মিলে পলে পলে বুনে চলে যেন নকশী কাঁথার বাহারী আঁচল ।
যা হোক , সে রাতে যাত্রা পালার রুপভানকে একটুকুও মনে  ধরলো না ফুল্লরার! বেটা মানুষ মেয়ে সাজে কি করে ? ছি , লাজ লজ্জা যেন কিছুই নাই তার !মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো সে , না , না। আর কিছুতেই স্বামীকে  যাত্রা কোরতে দেবে না সে ।  অন্তত মেয়ে সেজে যাত্রা পালা করা তো নয়ই ।  কি লজ্জা ! কিন্তু হা  হতোগ্মি ! স্বামীকে ঘরে আগলে রাখার কোন বারণ কান্দন কিছুই  তেমন কাজে লাগলো না । শাশুড়ি পরামর্শ দিলো ,   কাচ্চাবাচ্চা নিতে ।  তাতে যদি ছেলে তার ঘর মুখী হয় । 
সন্তান পেটে আসার কিছুদিন রুস্তম যাত্রাপালা ছেড়ে বউয়ের শরীরের দিকে মন দিলো । কিন্তু ছেলে হতে না হতেই আবার সে তাঁর পূর্বাবস্থায় ফিরে গেল । ছেলে  কোলে নিয়ে  গভীর রাতে একাকী ফুল্লরা স্বামীর  পথ গুণে। রাত গড়িয়ে শেষ রাতের ফিকে আলো  নেতিয়ে পড়ে তাল আর নারকোল পাতার গায় । দূর বন থেকে খেক শিয়াল শিয়ালী হুক্কা হুয়া , হুক্কা হুয়া করে  শেষ প্রহরের ডাক ডাকে । পাখীরা ঘুম ঘুম ভাঙ্গা চোখে গানের বাঁশী বাজায় । কিন্তু যার জন্য এত প্রতীক্ষা তাঁর ফেরার নাম গন্ধটি পর্যন্ত  নাই। হয়তো বা  যাত্রার  পোশাক খুলে সেই সাজ ঘরের এক কোনে পড়েছে  নেতিয়ে পড়েছে সে ।
আর সেই সময়টাতেই কোত্থকে যেন একদিন সেই  কুচকুচে কালো বেড়ালটা  তাঁর সামনে এসে হাজির হোল! কি ভয়ঙ্কর  কালো তাঁর গায়ের রঙ । অমাবশ্যা রাতের আন্ধারের মতো কুটকুটে কালো  ।  শাশুড়ির কানে  সেই কালো বেড়ালের কথা গেল , গেল বাড়ীর আর সবার কানে । শাশুড়ি বউকে শান্তনা দিয়ে বললো , তোমার মনের ভুল  গো বউ। মনের ভুল ।  তয় রাত বিরেতে আর দাদুভাইকে নিয়ে দাওয়ায় হাটাহাটি কোর না ! ওদিক নানান গাছা অগাছা আছে ।
ফুল্লরা গলায় যেন অসুরের শক্তি । সে জোড় গলায় শাশুড়িকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে , ভুল  নয় মা। কালো বেড়ালটা  যে  প্রতিরাতে আমার  সন্মুখে আসে । দূর হ , দূর হ  বলে  কোন কোন দিন সে চেঁচিয়ে পাড়া মাত করে । কালো বেড়ালটাকে তাড়াতে কবরেজ , বৈদ্য  , হাকিম ডাকা হোল । কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। কোথা থেকে যেন উড়ে এসে জুড়ে বসে সে রাতের  বেলায় । আর আশে পাশে কেউ না থাকলে  তার যেন পোয়াবাড়ো !
কালো সেই বেড়ালটাকে  তাড়াতে না তাড়াতেই একদিন ফুল্লরার যাত্রা করা স্বামীটা  ধপাস করে গেল মরে ! দূর গ্রামে যাত্রাপালা কোরতে গিয়েছিল তাঁর দলবল আর সে। আষাঢ় মাসের  রাত।  মাঝ গাঙ  ভরা  উতাল পাতাল জল । ঢেউ আর ঢেউ । দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন জলের সমুদ্দুর । এর মধ্যে মাঝ রাত্রিরে  গাঙ্গে উঠে  জোর তুফান । আকাশের তারার  আলোগুলো  সহসা কে যেন এক  ফুঁয়ে দেয়  নিবিয়ে । আর সেই গহীন রাত্রিরের  আঁধারে ঝড় তুফানের মধ্যেখানে পরে যাত্রাপালার নৌকাটা গেল ফস কোরে তলিয়ে ।
ফুল্লরার  কালো রাত আরও কালো হোল। গহীন কালো । পাহাড়ের মত ভারী  সে রাত । এতিম ছেলে বুকে ধরে তাঁর দু চোখে কেবলই আন্ধার ।রাত গভীর হলেই তাঁর ঘর থেকে কেবলি  তীক্ষ্ণ কান্নার শব্দ ভেসে আসে । আর  সে সময়টাতে কালো বেড়ালটাই কেবল তাঁর নিত্য সহচর !
সব শুনেটুনে রুস্তম আলীর ভাই আর তাঁদের বউরা  রটিয়ে দিল নানা কথা । আর তার সহজ মানে করলে এই দাঁড়ায় যে ; নির্ঘাত জীন আছে ফুল্লরার সাথে ! কালো বেড়াল ! আর কালো বেড়াল করতে করতেই  জোয়ান স্বামীটাকে অকালে খেয়ে ফেলেছে সে । বড় ভয়ানক সে ! তাই ফুল্লরা  এ বাড়ীতে থাকলে , তাঁরা  কিছুতেই হেথায় থাকবে না ।  
এরপর  ছেলেসহ একদিন ফুল্লরাকে  জোড় করে এক কাপড়ে বাপের বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়া হোল   ! 
তিন
ফুল্লরা খাতুনকে ঘিরে  মন্দ  কথা  বলা শুরু করলে  অনেক কথাই আসবে ঘুরে ফিরে ।  আপন ভাই আর বউরা আর স্বামীর বাড়ীর লোকগুলো অনেককাল ধরে তাঁর সন্মন্ধে যা বলে এসছে  তাইই । 
ফুল্লরার সাথে যে কালো বেড়াল! তাই তাঁর সাথে মানুষ থাকে কি করে ? স্বামী মরার কদিন  যেতে না যেতেই  নিজের ভাইবউরা চিল্লিয়ে  চিল্লিয়ে পাড়া মাত করলো । ফুল্লরাকে নিয়ে বুড়ো বাপ মায়েরই  যেন কেবল  মাথা ব্যথা । বাপ  তাই এবার না দেখে শুনেই  মেয়ের জন্য দ্বিতীয় বিয়ে ঠিক করে ফেললো । পাত্র অঢেল টাকা পয়সার মালিক । কেবল বয়সটা একটু বেশী ।  এই সত্তর বাহাত্তরের কাছাকাছি । পাত্রের আগের তিন  তিনটে বউ গত হয়েছে । এই শেষ বয়সে আর নতুন করে বিয়ে সাদীর সখ  ছিল না তার।কিন্তু ছেলে বউরা  আর দেখাশুনা করতে চায়না তাকে ।  পান থেকে চুন খসলেই  শ্বশুর  নাকি ঘ্যানর ঘ্যানর  শুরু করে । এখন এসব আর ভালো লাগে না ডানা গজিয়ে উঠা বউদের! শেষমেশ ছেলেরাই একরকম জোড় করে বাপের আবার বিয়ে দিয়ে দিল । কিন্তু লাল ঘোমটা টানা  নতুন বৌ এর মুখ দেখে তাদের দুশ্চিন্তা গেল বেড়ে । দিন কি গ্যালো ?   বুড়া বাপকে নির্ঘাত এবার এই মেয়েলোকটাই  চরকার মত  ঘুরাবে । 
হোলও তাই । বুড়ো কসিম ব্যাপারী তাঁর নতুন যুবতী  বউ ছাড়া কিছুই  যেন বোঝে না । দিনে রাতে কেবল বউ আর বউ ।  সুন্দরী বউ এর ভবিষ্যতের  কথা ভেবে তলে তলে তাঁর নামে  ম্যালা জমি জমা লিখে দিলো সে  । দিন দিন এসব কথা তার জোয়ান ছেলেদের কানে আসে । তাঁদের চিল্লাচিল্লি বুড়ো বাপ একবারেই গায়ে মাখে না ! ফুল্লরাও না!
কালো সেই বেড়ালটা তারপরও আসে  ফুল্লরা খাতুনের কাছে রাত বিরেতে ।মাঝে মধ্যেই  বুড়ো আধ বাতিল লোকটাকে  দেখিয়ে দেখিয়ে ভেংচি কাটে । 
কয়েক বছর  বাদে , কসিম ব্যাপারীর মৃত্যুকে ঘিরে গ্রামে নানান রটনা শোনা গেল ।  নিন্দুকেরা  বলে বেড়ালো কসিম ব্যাপারীর নতুন বউ  ফুল্লরা খাতুনের  সেই কালো বেড়াল রুপী জীনটাই নাকি  তাঁকে  নিশিরাতে ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলেছে ! 
চার
একমাত্র ছেলে সোরহাব আলীর প্রথম বিয়েতে ধুম ধামের কোন কমতি রাখে নাই ফুল্লরা খাতুন । তবে  সেবার মেয়ে খুঁজতে খুঁজতেই ভারী পেরেশান হয়ে গিয়েছিল সে । খুব সুন্দরী মেয়ে চাই তাঁর । যেন গাঁয়ের আর দশজন লোক দেখে বলে , বউ এনেছে বটে সোহরাব আলীর মা তাঁর ছেলের জন্য । চাঁদের রুপকেও হার মানায় যেন  সে রুপ ।  সত্যি সত্যি অনেক গাঁ খুঁজে খুঁজে শেষমেস দূরের অচেনা এক গাঁ থেকে  মনের মতো বউ নিয়ে  আসলো  ফুল্লরা । গাঁয়ের দু চারটা সুন্দরী মেয়ে ছিল বটে , কিন্তু  নিজের গায়ের মানুষজন কেন জানি ফুল্লরার সাথে আত্নীয়তা করতে চায় না ।  এটা ওটা নানা মন্দ কথা বলে তাঁর নামে।
ছেলের বউয়ের নাম আলপনা । দেখতে শুনতে ভারী রুপসী। মেয়ের বাপ এত দূরে মেয়েকে বিয়ে দিতে কিছুতেই রাজি হোচ্ছিল  না । তারপরও অনেক দিয়ে থুয়ে বলে কয়ে তাঁকে রাজী করানো গেছে।
রুপের অহঙ্কারে  বউয়ের মাটিতে  যেন পা পড়ে না । ফুল্লরা খাতুন বউয়ের ভাবসাব দেখে  আর মনে মনে হাসে ।  নিজের কথা মনে কোরে ভাবে সুন্দরী মেয়েদের রুপের এক আধটু দেমাগ থাকবেই । এ তেমন দোষের কথা নয় । ছেলের খুব মনে ধরেছে বউ , তাতেই খুশী  সে  । কিন্তু দিনকে দিন ছেলের বউ বউ কোরে পাগলামি দেখে , তাঁর বাপের কথাই মনে পড়ে ফুল্লরার । নাহ , আর বাড়তে দেয়া যাবে না । এই যে বিশাল সম্পতি , ব্যবসাপাতি সে তিল তিল কোরে গড়ে তুলেছে , তার সবই তো ছেলের মুখের দিকে চেয়েই ।  তাই ছেলে মায়ের  হুকুমমতো  অনিচ্ছাস্বতেও গঞ্জের দিকে পা বাড়ায় ।   
কিন্তু বউ এর  নিত্য নতুন রঙ ঢং দেখে  মাথা ধরে যায়  ফুল্লরার । ইদানীং আবার নতুন এক বেশ ধরেছে সে । রাতের বেলায় ঘর থেকে বের হতে  নাকি বড়  ভয় লাগে তাঁর। এত ভয় যে রাতের খাবারও তার ঘরে দিয়ে আসতে হয় ।  দিনকে দিন সে ভয় যেন বেড়েই চলেছে তাঁর । কিন্তু কারণটা কি ? না , তা বলা নাকি হুজুরের বারণ । কেবল স্বামীকেই সে চুপি চুপি বলেছে  সে , এ বাড়ীতে একটা প্রকাণ্ড কালো বেড়ালের ছায়া  ঘুরে বেড়ায় ! আর তা  রাতের  বেলায় মায়ের ঘরে !   
সোরহাব আলীর মনে  একটা গভীর দুশ্চিন্তা্র ছায়া ভর করে ।বউয়ের কথা বিশ্বাস  কোরতেও ইচ্ছে  হয় না  তার ।  আবার না করলে সে অভিমান করে বসে থাকে ।  এ ব্যাপারে মাকে কিছু বলতেও সাহস হয় না তাঁর। একদিকে মা আর অন্যদিকে বউ , কাউকেও মনে কষ্ট দিতে পারে না  যেন সে ।
সোরহাব আলী  তবুও ভাবে ; আচ্ছা, বউ তাঁর কালো বেড়ালের কথা শুনলো কি করে ?   তারপর   অনেকটা নিশ্চিত  হোয়েই মনে মনে বলে , নিশ্চয়ই বাড়ীর কোন কাজের মেয়ে মার সেই কালো বেড়ালের গপ্পো  শুনিয়েছে আলপনাকে। মায়ের কালো বেড়ালের কাহিনী  যদিও সে নিজে একটুকুও বিশ্বাস করে না  । কিন্তু  তাঁর বউ  কেন যেন কালো  বেড়ালের গপ্পোটা একেবারেই  ভুলতে পারছে না , কেন ?   কালো বেড়ালটা নিয়ে এদ্দিনবাদে যেন একটা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ালো  সোরহাব আলী   ! তা থেকে যেন তাঁর মুক্তি নাই ! তবুও বউকে সামলে রাখার নানা চেষ্টা চালাতে  ত্রুটি রাখে না সে !
এত কিছুর পর তবুও যেন শেষ রক্ষে হোল না ! একদিন ছেলে হতে গিয়ে  হুট কোরে সোরহাব আলীর  সুন্দরী  বউটা গেল মরে। মা  আর সন্তান এক সাথে ।  সন্তান ভুমিস্ট হওয়ার আগে দুইদিন সে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায়  পড়েছিল । গ্রামে  তখন তখনই রটে গেল সোরহাব আলীর অচেতন বউ নাকি মরে যাবার আগ মুহূর্তে  তাঁর স্বামীর কানে কানে বলে গেছে ,  শাশুড়িকে সে  নাকি কালো বেড়াল হয়ে যেতে দেখেছে । আর তাতেই সে ভয় পেয়ে  --------! 
বউ এর আচমকা  মৃত্যুর পর অনেকদিন গোঁ ধরে ঘরে বসে থাকলো  সোরহাব আলী । কাজে কামে  তাঁর আর আগের মতো মন বসে না । মার সাথেও কথা বলতে ইচ্ছা করে না ! ফুল্লরাও সাহস করে ছেলেকে কিছু বলে না !
পাঁচ 
একদিন দ্বিতীয় বিয়ের কথা উঠতেই সোরহাব আলী  মাকে সাফ সাফ  জানিয়ে দিলো ,  এতো শীঘ্রই আবার বিয়ে করার মতো মনের অবস্থা তাঁর নাই । একেবারের নাই ।
ফুল্লরা খাতুন  ছেলের এহেন আচমকা পরিবর্তনে খুব অবাকই  হয় । মনটাও বেশ খারাপ হয় যায় তাঁর । বউকি কারও মরে যায় না নাকি ?  তাই বলে ঘর সংসার বাদছাদ দিয়ে একেবারে বৈরাগী সাজা !ছেলেকে নিয়ে যেন নতুন কোরে ভাবতে বসে সে । তাইতো, যে ছেলে  তাঁর মায়ের মুখের  সামনে কোনদিন একটা ক্থাও মুখ ফুটে বলে নাই  ,  সে আজ  তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কথা বলতে শিখেছে । বলুক ।  পরক্ষণেই নিজের মনকে  শান্তনা দেয় ফুল্লরা । বলুক, আহা বলুক। সদ্য সদ্য বউ হারিয়ে বেচারার মাথা ঠিক নাই  । বলতেই পারে । সে মা হয়ে তো আর ছেলেকে ফেলে দিতে পারে না । পেরেছে কি সে কোনদিন ? ছেলেকে হাতে ধরে সে সব  বিষময়  দিনের কথা ভোলে কি কোরে  ফুল্লরা।একটা কথাও  ভুলতে পারে নাই সে । দিনের বেলা কাজকামের মধ্যে সব ভুলে টুলে এভাবে ওভাবে কাটানো যায় বটে ! কিন্তু রাত হলেই চারদিকের সেই ঘনঘোর অন্ধকার ! সেই নিদারুন যন্ত্রণা ! 
ছেলের জোর অনিচ্ছা থাকা সত্তেও তা্ঁর দ্বিতীয় বিয়ের জন্য  জোর  মে্যে খোঁজা শুরু করে ফুল্লরা খাতুন ।রাতের বেলায় মেয়ে দেখা একেবারেই পচ্ছন্দ নয় তাঁর। এতে নাকি মেয়ের খুঁতটুত বোঝা দায় । তারপরও অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিজের গরজেই  এ মেয়েটিকে রাতের বেলায়ই দেখতে গেল সে । মেয়ের বাপের অবস্থা তেমন ভালো নয় । ছিটা ফোঁটা জমি আছে , এছাড়া অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করে সে ।  তবে কুলসুম নামের এ মেয়েটিকে বেশ পছন্দ হোল  ফুল্লরার । সে দেখতে শুনতে আগের বউ আলপনার মতো চাঁদপানা সুন্দরী নয় । বরং বেশ একটু শ্যামল ঘেঁষা তাঁর গায়ের রঙ্ । সেই ভালো । বেশী সুন্দরী বউদের বাড়তি ডানা গজায় পিঠের উপরে । বড় বউকে নিয়ে তো কম ঝক্কি সামলাতে হোল না ।  অতো চাঁদপানা সুন্দরী মেয়ের আর দরকার নাই  , ফুল্লরা আপন মনে বলে ।
ছেলের মতি গতির কথা ভেবে তাঁর বিয়ের ব্যাপারে আর  কোন সময় নিতে চাইল না ফুল্লরা । তাই সে রাতেই বিয়ের তারিখ , দেনা পাওনা এসব সব ঠিকঠাক করে ফেলে সে । ছেলেকে কিছুই দিতে হবে না মেয়ের বাপকে । বরং ফুল্লরা খাতুন নিজেই সোনাদানায় ভরে দেবে মেয়েকে । রাজরানী সাজিয়ে  ঘরে তুলবে তাঁকে।
আগামী  শুক্রবার জুম্মার নামাজের পরে বিয়ে !
কুলসুমের ভাইরা গাইগুই করে দিনের বেলায় বিয়ের আয়োজনের কথা শুনে । এত বড়লোকের  ঘরে  বোনের বিয়ে হোচ্ছে ! গ্রামসুদ্ধ লোকজন না জানলে কিসের আবার বিয়ে । বাড়ীঘর সাজানো , গেট বানানো আর তার মাথায় লাল নীল হলুদ আলোর ফোয়ারা না ছুটালে আবার বিয়ে কিসের ? এসব হলে , তবেই তো গায়ের সবাই বলবে , বিয়ে একটা হোচ্ছে বটে বসির মিয়ার বেটি কুলসুমের !
কিন্তু ফুল্লরা খাতুন  সব ইচ্ছেয়  বাদ সেধে সবাইকে অবাক কোরে দিয়ে জোর গলায় বলে  উঠে ;  না , কিছুতেই না ! বিয়ে দিনের বেলাতেই হবে !
ছেলের মা বাড়ী ফিরে গেলে কুলসুমের মা তার স্বামীকে  ফিস ফিস কোরে বললো , ঐ ঘরে আমার মেয়ের বিয়া  কিছুতেই দিমুনা আমি । দ্যাখো পাড়ার লোকের কথাই সত্য । রাতের বেলায়  সে যে নিজেই কালো বিলাই হয় , তাই রাতে ছেলের বিয়ে দিতে এতো আপিত্তি !
বসির মিয়া বউয়ের কথায় কান দেয় না ! মেয়ে মানুষের কথায় অতো  গুরুত্ব দিলে কি আর এই পৃথিবীটা চলে !
ছয় 
এবার প্রথম থেকেই ছেলের বউয়ের উপর নজর রাখে ফুল্লরা । আগের  বউয়ের মতো তাঁর যখন যা ইচ্ছে করার ক্ষমতা যেভাবে পারে ছেটে কুটে রাখে । কুলসুম বেশ ভয়ই পায় জবরদস্ত শাশুড়িকে । সে যত তাকে ভয় করে , মুখ বুঁজে  নমনীয় আর চুপচাপ থাকে , ততই মনে মনে খুশী হয় ফুল্লরা । মুখে অবশ্য কিছু বলে না ।  কিন্তু ধীরে ধীরে বউয়ের আসল চেহারা  ফুটে উঠে তাঁর কাছে  ।  ফুল্লরা বেশ  বুঝতে পারে এতদিন তাঁর ছেলের বউ কেবল ভাল সাজার ভান করেছে। না হলে পুচকে ঐ একরত্তি মেয়ের সাহস হয় কি করে তাঁর মুখে মুখে উত্তর কাটা।  ইদানীং শাশুড়ির কোন কথাই যেন সহ্য হয় না তার । কিছু বললে  দৌড়ে গিয়ে ঘরের দুয়ার দেয় । এ যে প্রথম বউকেও  ছাড়িয়ে গেল ! ফুল্লরা উদাস  সুরে মনে মনে বলে !  
ছেলে বউয়ের উপর রাগ করে  শরীর খারাপের অছিলায় ফুল্লরাও দরজায় খিল দেয়। ছেলে বাড়ীতে ফিরে এলে মাকে ভাত  খাওয়ার জন্য সাধাসাধি করে । ইচ্ছে হোলে দোর খুলে ফুল্লরা । আবার কোনদিন জেদ করে চুপ করে থাকে । বিছানায় শুয়ে  শুয়ে নিজের ভাগ্যকে  কেবল দোষারোপ করে সে । সবই তাঁর কপাল । দু চোক্ষের পানি ছাড়া আর বোধহয়  কিছুই ভাগ্যে লেখা নাই তাঁর । আর সেই ফাঁকে কোথা থেকে যেন সেই  ভয়ঙ্কর কালো বেড়ালটা লেজ গুটিয়ে তার পাশে এসে বসে । বলে ; কাঁদ ফুল্লরা , কাঁদ , আরও জোরে জোরে  কাঁদ । মন খুলে কাঁদ । কেঁদে কেঁদে ভাসিয়ে দে চারদিক । রাত যত গহীন হয় , বেড়ালটার উৎপাত ততই বাড়তে থাকে । আঁধার ঘন কালো রাত , নিঝুম আর নিথর । তার সাথে মিল রেখে কালো বেড়ালের কান্নার শব্দ ! 
একদিন  রাতদুপুরে কুলসুম  শাশুড়িকে শুনিয়ে শুনিয়ে  স্বামীকে জোর গলায় বলে , আমি হেথায়  আর থাকতে পারবনি ।
ক্যান ? সোরহাব মিয়া অবাক হয়ে জানতে চায় ।
জান না না তুমি  ? পাড়ার ছেলে বুড়া সবাই জানে তোমার মায়ের কথা , আর তুমি না জানার ভাব করো , পিচ্চি মেয়েটা  যেন অগ্নি মূর্তি ধারণ করে ।
কি , কি জানো তুমি ? কলহ ভারী অপচ্ছন্দের সোরহাব মিয়ার ।তারপরও সে যেন জানতে চা্য় তাঁর মায়ের  বিরুদ্ধে কি কি অভিযোগ  আছে নতুন বউয়ের ।
কুলসুম কিছু বলে না। আর কিছু বলতে চায় না সে । সে যেন বুঝে গেছে তাঁর স্বামী সব জেনেও না জানার ভান করছে । আসলে মায়ের বিরুদ্ধে  কোন দিন কিছুই বলেনি সে আর বলবেও না । 
তারপরও কি ভেবে সাহস কোরে হঠাৎ  সে বলে উঠে , জানোনা তুমি না ? তোমার মা যে ডাইন , কালো বিলাই ! বলতে বলতে উচ্চস্বরে  ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সে । আগে জানলে কি আর এই ঘরে আসি !
ফুল্লরার কানে ছেলের বউয়ের সব কথা যায় । নিজের কানকে যেন নিজেই বিশ্বাস কোরতে পারে না সে। এত বড় কথা তাঁর  মুখের উপর কোনদিন  যে কেউ বলতে পারবে  তা স্বপ্নেও ভাবতে পারে নাই সে। কিন্তু এখন কি হবে ? কি হবে ? ছেলের কানে তো  বুদ্ধীহীন  মেয়েটার সব কথা  এতক্ষণে ঢুকে পড়েছে  নিশ্চয়ই ।এখন কি হবে? এখন কি হবে তা  যেন  ভুলেও ভাবতে পারছে না ফুল্লরা । মায়ের নামে কূট কথা , মাকে অবজ্ঞা আর গালাগালি । বিশ্রী রটনা ! ছেলে নিশ্চয়ই এবারে আর কিছুতেই ক্ষমা করবে না তাঁর বউকে । ফুল্লরা কান খাড়া করে রাখে । তাঁর বুকের স্পন্দন বেড়ে যায় দ্রুতগতিতে । ধক ধক ! ধক ধক !  আহা   বুদ্ধীহীন মেয়েটি কি সাধ করে  মৃত্যুর পরোয়ানা গলায় পড়ল ?
অনেক অনেকক্ষণ  ধরে চুপ করে থাকে সোরহাব মিয়া । একেবারে  নিস্তব্ধ ।  বড়ই নিঃশ্চুপ যেন সে। কুলসুমকে বোবা করে দেবার কোন ভাষা  যেন জানা নাই তাঁর ।  কিন্তু তাঁকে বিশ্বাস না করেই বা থাকে কি কোরে সে । এমন  একটা কথা আলপনাও তো মরে যাবার আগ মুহূর্তে তাঁর কানে কানে বলে গিয়েছিল।  দুজনার কথা এক হয় কি করে ! ভাবতে থাকে সোরহাব মিয়া । ভেবে ভেবে  তাঁর মন উতাল পাতাল মাতাল ঢেউয়ের মতো আকুলি বিকুলি করে !
বউকে আর কিছু বলতে পারে না সোরহাব মিয়া, বলার  কোন ভাষা যেন  জানা নেই   তার! কেবল মায়ের ঘরের  দরজার দিকে তাকিয়ে  ক্লান্ত ,  হতভম্ব , বিপর্যস্ত সোরহাব মিয়া  ব্যাকুল কণ্ঠে এক সময়  ফস কোরে বলে ফেলে ;  মা , মাগো , তোমার ছেলের বউদের সাথে তোমার এত কি শত্রুতা ? আমাকে কি তুমি একটু শান্তিতে ঘরসংসার কোরতে দিবে না ? 
সাত 
ফুল্লরা খাতুন এক্ষণে  যেন  বুঝে গেছে  মস্ত এ পৃথিবীটাতে সে বড় একা ! বড়ই একা । তাঁর আকাশ নাই।  বাতাস নাই । তাঁর জমিন নাই । আসমান নাই । তারঁ রাত নাই । দিন নাই । তাঁর আপন নাই , পর নাই। তাঁর নাই , কিচ্ছু নাই । থাকলে কি আর নিজের বুকের রক্ত পানি করা যক্ষের ধন , নয়নের মনি তাঁর সোরহাব , সোরহাব মিয়া , তাঁর বাবলু  তাঁর মুখের উপর এত বড় কথা কইতে পারে ? 
ফুল্লরা আর কি কোরতে পারে? ঘরের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালে দেখা যায় দূরের আকাশ।  গাঢ়  অন্ধকার সে আকাশ। আকাশে কোন চাঁদ নাই । নাই তারা । তারার বাতি জ্বালিয়ে সুতো কাটে না  আর গুড়িসুড়ি চরকা বুড়ি  । চাঁদের আলোর সাথে হেলেদুলে বাতাস যে পাতাবাহারী ঢেউ তোলে নদীর বুকে , বট পাকুরের মাথায় আর  অলিন্দে , সে আলো আজ  যেন  চিরতরে  করে  হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে  !
ফুল্লরার প্রাণ নাই । আত্মা নাই । দয়া নাই , মায়া নাই । নাই আর কারো জন্য দুশ্চিন্তা। নেই ভালবাসা । 
কালো বেড়ালটা আগের  মতোই আজোও  হুট বেড়িয়ে এলো , কোত্থকে কে জানে । কি ভয়ঙ্কর  কালো তাঁর গায়ের রং , অমাবশ্যার  আকাশের মতো মিসমিশে কালো আর ভয়ঙ্কর । কি সুতীব্র তাঁর চাহুনি । তা হার মানায় রা্তের বিজলী হায়েনাকে!
কালো বেড়ালটা ফুল্লরা খাতুনের কানে ফিসফিসিয়ে বলে , আর ক্যানো ফুল্লরা ! আর ক্যানো অনেক তো হোল !  এবারে ক্ষমা দে ! ক্ষমা দে !
ফুল্লরা খাতুনের দেহটা ঝুলছে ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে! বড় করুণ আর  বীভৎস সে দৃশ্য । পাড়া প্রতিবেশীরা তাঁর নিস্পান দেহখানা দেখে  অনেক্ষণ  ধরে কানাঘুষা  করে । ফিসফিসিয়ে বলে  ;  উহ , কি ভয়ঙ্কর কালো বেড়ালের মতো  হয়ে গেছে মুখটা !
হতবিহ্বল , ম্লান আর বেদনাক্লিষ্ট সোরহাব মিয়া তাকাতে পারে না , কিছুতেই তাকাতে পারে না ,  মায়ের অভিমানী সেই মুখের দিকে! ভয় পায় । বড় ভয় পায় সে। পাছে আর পাঁচজনের মতো সেও কালো বেড়াল খুঁজে পায় মার সেই অনিন্দ্র সুন্দর মুখে !