এগারো বছরের একটি মেয়ে ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে সূর্যোদয় দেখছিলো। সেই সূর্যোদয়ে যেন ছিল মেয়েটির জীবনের আশার আলো, যা নাকি তার ছায়ার অস্তিত্ব থেকে শক্তি জোগাত। আর সেই সূর্যোদয়টা ঘন্টাখানেকের মত দেখেছিল মেয়েটি। তারপর সে তার রুমে এসেই জানালার পাশেই থাকা একটি সোফায় বসে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ে এবং গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে। সে তখন তার সম্পর্কে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ স্বপ্ন দেখছিলো। স্বপ্নে সে ছিল তার বয়সের তুলনায় বেশ পরিণত, কারণ সে তার জীবনের কয়েকটা ধাপে দেখেছিল। যদিও সে মাত্র এগারো বছরের বয়সী মেয়ে ছিল, তবুও সে যেন দেখতে পেয়েছিলো তার পরিণত বয়সটাকে। সে ছিল তীক্ষ্ণ অন্তর্মুখী, বেশ স্পর্শকাতর, যা নাকি অন্যদের কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। সে ছিল চুপচাপ ও নিরব দর্শকের মত এবং অন্যদের সাথে সে খুবই কম কথা বলতো। সে ছিল সহজ-সরল একটি বইয়ের মত, যেটাতে অনেক শব্দ আর বর্ণ দিয়ে ভরে ছিল যদিও, কিন্তু তাতে যেন কিছুই বলা ছিল না বা তাতে কোনো ব্যাখ্যাও করা ছিল না।
আধা ঘন্টা পর যখন মেয়েটি ঘুম থেকে জেগে উঠে। এবং সে দেখতে পেয়েছিল সূর্যটা মেঘের আড়ালে লোকানো। হঠাৎ প্রচন্ডভাবে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছিল এবং সবাই ছুটাছুটি করে যার যার বাড়িতে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই কিশোরী মেয়েটি খুবই অদ্ভুত দৃষ্টিতে সেইসব দেখছিলো। তারপর সে তার রুমে চলে গেল এবং দরজা বন্ধ করে দিল-- তখন তার রুমটাকে মনে হচ্ছিল, গাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন, খুবই নিরব-শান্ত, আর বিপর্যস্ত-বিধ্বস্ত হয়ে আছে। সে তখন ফ্লোরেই বসে পড়েছিল এবং তার বুক ফেটে কান্না আসছিল। পরোক্ষনেই তার মায়া ভরা চোখদুটি দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল এবং তার গাল আর চোখদুটি লাল হয়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে সে ফ্লোরে বসেই গভীর তন্দ্রায় চলে গিয়েছিল। ঠিক তখনি সে দেখতে পেয়েছিল, ছয় বছরের একটি ছোট্র মেয়ে খুবই একাকী হয়ে বসে আছে, তার পুতুল খেলার ঘরটাও এক্কেবারে ভেঙ্গে গিয়েছে, কিছুক্ষণের জন্য তার জীবনটা যেন থেমে গিয়েছিল, অন্ধকার আর গভীর গর্তের ভিতর যেন সে চলে যাচ্ছিল। তখন সে সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিল, কিন্তু কোন কাজ হচ্ছিল না। সে শুধুই চলেই যাচ্ছিল গভীর থেকে গভীরে, তার জীবনটা যেন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। কেহই জানতেও পারেনি কি হয়েছিল সেই কিশোরী মেয়েটির। অকস্মাত সে তার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো এবং চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো। সে তখন অনুভব করলো, তার শরীর ঘেমে ভিজে গিয়েছে, তার হার্ট বিট প্রচন্ড রকম বেড়ে গিয়েছে এবং সেই সবকিছু ঠিক হতে তার বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল। সে তখন নিজেকে সান্তনা দিয়ে বলেছিল, " এটা শুধুই একটা দুঃস্বপ্ন ছিল"।
সেই কিশোরী মেয়েটি ছিল এমনি একটি মেয়ে যে নাকি কখনই কারোর সাথে কোনো কিছুই শেয়ার করতোনা, এমনকি এতটুকু তার মনের আবেগও না। সে ছিল খুবই একাকী এবং নিঃসঙ্গতাই ছিল তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, আজ পর্যন্ত তার শ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসেবেই আছে তার একাকিত্বই। অথচ সে কখনই কাউকে আঘাত করেনি এবং কাউকে কষ্ট দিয়ে কিছু বলেও নাই, তবুও মানুষ তার স্বভাব বুঝতে পারেনা এবং কেহই যেন তাকে বুঝতেও চায়না। বরং কোন সময়ে কিছু ভুল হলেও, সে তার নিজের সাথেই আত্ম সমালোচনা করে থাকে। সে যেন সমগ্র বিশ্বের সবচেয়ে দুঃখী মেয়ে। তবুও কখনই সে ভেঙ্গে পড়ে নাই বা কখনই তার আশা হারায় নাই। সে সব সময়ই পজিটিভ ভাবে ভাবতে পছন্দ করে। তারপরও কেন যে অনেকেই তাকে বন্ধুত্ব থেকে বাদ দিতে চায় বা কেন যে অনেকেই তার সাথে বন্ধুত্ব ভাবে যত্নশীল হতে চায় না। তবুও সে কখনই কারোর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভাবতেও পারেনা। কারণ সে জানে যে, "যদি সে অন্যদের মতই একইরকম করে, তাহলে আল্লাহ তাকে পছন্দ করবেন না বা তার দিক থেকে আল্লাহ মুখ ফিরিয়ে নেবেন।" তাইতো সে আর যাই হোক, আল্লাহকে সে হারাতে চায়না কখনই।
কিশোরী সেই মেয়েটি আবারও যখন বারান্দায় গিয়েছিল, ঠিক তখনই সূর্যাস্তটাকে হচ্ছিল। সে তখন আকাশের দিকে মুখ করে তাকালো, এবং সে দেখতে পেলো -- বিশাল নভোনীল আকাশটায় উজ্জল নক্ষত্রে ভরে ছিল, তা দেখে মেয়েটি এত আনন্দিত হয়েছিল যে খুশিতে তার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। এবং তখন সে আপন মনেই বলতে ছিল, "যতটুকুই আমি ভুগিনা কেন, সেটাই মাত্র যেন আমার জীবনের শুরু। আমি যতই ব্যাথা পাইনা কেন, আমি সহ্য করে যাবো। আমি কখনই আমার অনুভূতিটাকে কাউকে দেখাবো না বা বলতেও চাইনা। কারণ এই পৃথিবীটা হলো ঘৃণ্য আর এই পৃথিবীর মানুষগুলো হলো মেকি। কিন্তু হে আল্লাহ, আমি কখনো কারোর ক্ষতি করিনি এবং কাউকে আঘাত করতে চাইও নাই। আমি ব্যথাকে সহ্য করেছি, আমি আমার মনের যন্ত্রনাটাও সহ্য করেছি। কেন আমি সমানভাবে ভালবাসা পেতে পারিনা? কেন আমি খেলনার মত ব্যবহৃত হচ্ছি? কেন আমার জীবনটা আমাকে এত শিক্ষা দিচ্ছে, যা আমি কখনই শিখতে চাই নাই? কিন্তু কেন? কেন?" তখনই সে দেওয়ালে নিজের মুষ্টি দিয়ে প্রচন্ড আঘাত করছিল এবং চিৎকার করে কাঁদছিল আর বলছিল মনের সমস্ত কষ্টগুলোর কথা। তারপর সে তার রুমে গিয়ে, তার না বলা সমস্ত বিষন্নতা আর কষ্টগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে আবারও গভীর তন্দ্রায় চলে গেল। সেই দিনের পর থেকে ঐ কিশোরী মেয়েটি তার দুঃস্বপ্নের জগতটাকে ভাবতে বন্ধ করেছিল এবং বাস্তব জগতের মুখোমুখি হতে শুরু করেছিল।
অথচ সেই কিশোরী মেয়েটি ছিল, অন্যদের খুশি করার জন্য এবং দুর্বল মানুষদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য--যদিও সে ছিল সবচেয়ে হতভাগী মেয়ে, কিন্তু কেহই জানেনা বা জানতেও চায়নি তার অতীত এবং তার মনের কষ্টগুলো আর তার যন্ত্রনাগুলো।
মূলতঃ মাঝে মাঝে পৃথিবীতে কোন শব্দ বা ধ্বনি না থাকলেও কিন্তু নীরবতাটাকেও ঠিকই অনেক জোরে বা উচ্চ-স্বরেই শুনা যায়। তাছাড়া যারা অন্যের নীরবতাটুকু অনুভব করতে পারেনা এবং কারোর না বলা কথাগুলো বুঝতে পারেনা, তারাই সবসময় অন্যদের ভুল বুঝে থাকে। কিছু কিছু প্রতিশ্রুতি আছে যা নাকি নিরবিচ্ছিন্ন থাকে, কিছু কিছু স্মৃতি আছে যা নাকি অলিখিত থাকে, আবার এমনও কিছু বাস্তব অনুভুতি আছে যা নাকি সবসময়ই অনুক্তই থেকে যায়। তেমনি কিছু অনুক্ত ভালবাসা, অনুভুতি, স্মৃতি থাকে মানুষের জীবনে যা নাকি এতই বিষাক্ত হয়ে থাকে যে দীর্ঘ দিন হৃদয়ে রাখা হলে, তা ভিতরে ভিতরে মানুষকে একেবারেই গ্রাস করে ফেলে।
৩১ জানুয়ারী - ২০১৪
গল্প/কবিতা:
৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪