এটা কোনো গাল-গল্প নয়, বাস্তব ঘটনা। মেয়েটি গত দশ-পনেরো দিন আগে আমাকে ফোন করে বললো, ‘স্যার আমাকে বাঁচান, আমি একটি কিডনী বিক্রি করবো।’
আমি মেয়েটির মুখে এ কথা শুনে কিছুক্ষণ থ’ বনে গেলাম। উত্তর দিতে পারলাম না। তারপর তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনার বাড়ি কোথায়?’
সে বললো, ‘আমার বাড়ি রংপুর।’
‘কী করেন?’
‘কলেজে পড়াশোনা করি স্যার।’
‘কোন্ কলেজে, কোন শ্রেণীতে?’
‘অমুক কলেজে, অনার্সে।’ মেয়েটি উত্তর দিলো।
আমি বললাম, ‘কেনো কিডনী বিক্রি করবেন?’
সে উত্তর দিলো, ‘আমার গার্ডিয়ান নেই, টিউশনী করে পড়াশোনা ও পরিবারের খরচ চালাই। কিন্তু এখন আর তা পারছি না। আমার মা খুব অসুস্থ, তাছাড়া ছোট ভাইবোন আছে। তাদের পড়াশোনা ও পরিবারের খরচ চালানোর জন্য কিডনী বিক্রি করতে চাই।’
আমি অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে উত্তর দিলাম, ‘কিডনী তো বিক্রি করা বেআইনী। বাংলাদেশ সরকার কিডনী বিক্রি করা নিষিদ্ধ করেছেন। তাই কিডনী বিক্রি করা যাবে না। একটি কথা চিন্তা করুন, আপনি যাদের জন্য কিডনী বিক্রি করার কথা ভাবছেন, আপনার প্রয়োজনে আপনি কিন্তু কিডনী পাবেন ন। তখন কী করবেন?’
সে নিরাশ হয়ে বললো, জানি না। আমার টাকার খুব প্রয়োজন।’
আমি তাকে সে মুহূর্তে আর কিছু বললাম না। শুধু বললাম, ‘টাকার প্রয়োজন সবারই থাকে। সেজন্য কিডনী বিক্রি করার চিন্তা আপনার মাথায় এলো কেনো? আপনি মনে হয় খুব বেশি ছায়াছবি দেখেন। কারণ ছায়াছবিতেই এমন ধারণা দেয়া হয়ে থাকে। ছায়াছবিতে দেখানো হয় একজন মানুষ কিডনী বিক্রি করে তার ভাইবোনদেরকে লেখাপড়া করায়, কোনো কোনো ভাইবোন তার সে ত্যাগের কথা স্মরণ রাখে আর কেউ বেঈমানী করে।’
সে কথাটা বুঝতে পারলো না। সে আবারও বললো, ‘আমার কিডনী বিক্রি করা খুব প্রয়োজন।’
আমি বললাম, ‘আইনতঃ কিডনী বিক্রি নিষিদ্ধ।’
সে বললো, ‘তাহলে আমাকে একটা চাকুরি দিন। আমার ভাই-বোনদেরকে সঠিকভাবে মানুষের মতো গড়ে তোলা আমার বাবার একটি অপূরণীয় স্বপ্ন; আমি বাবার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে চাই। ’
আমি বললাম, ‘তা চেষ্টা করা যেতে পারে। আচ্ছা আমি ভেবেচিন্তে আপনাকে জানাবো।’
পরদিন অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম। যেভাবেই হোক, মেয়েটাকে সহায়তা করতে হবে। তাই তার বায়োডাটা আমার কাছে পাঠানোর জন্য তাকে ফোন দিলাম, কিন্তু কেউ রিসিভ করলো না।
এক ঘণ্টা পর আবারও ফোন দিলাম। একজন মেয়ে লোক কাঁদতে কাঁদতে ফোন রিসিভ করলো, সে বললো, ‘মীম আর নেই।’
হ্যাঁ, ঘটনাটা এমনই হয়তো হতে পারতো। আবেগপ্রবণ মানুষদের অনেক সময় কিছু না পাওয়ার হতাশায় আত্মহত্যার প্রবণতা জেগে ওঠে। তারা ভাবে, আমার জীবন রেখে আর কী হবে? মানুষ স্বার্থপর, কেউ সহায়তা করতে চায় না, এ সমাজে ভালো মানুষ নেই, সব স্বার্থপর।
তবে না, সেরকম হয়নি। আসলে কিডনী বিক্রি করার জন্যে যে মেয়েটা আমার কাছে ফোন করেছিলো, সে কাছে ছিলো না। বাড়ির কাউকে না বলে কোথাও চলে গিয়েছিলো। যে মহিলা ফোন রিসিভ করেছিলেন, তিনি তার মা। তিনি বললেন, মীম গতকালই কাউকে না বলে সবার অগোচরে কোথায় যেন চলে গেছে।’
মেয়েটার জন্য কিছুটা সময় মনটা বিষন্ন হয়ে রইলো। এ সমস্ত বিষন্নতা কেটে গেলো যখন ভাবলাম, মহান আল্লাহ আমাদের এই শরীরটা তৈরি করেছেন। এই শরীরের কিডনী, রক্ত, চোখ, মুখ, নাক, হাত-পা, লিভার (যকৃত), রূহ ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গসহ পুরো শরীর কতটা মূল্যবান। এই রূহ ও শরীর মানুষকে আল্লাহ বিনে পয়সায় দান করেছেন। অথচ বেশিরভাগ মানুষ তার শোকরিয়া করা তো দূরের কথা, মানুষ সৃষ্টিকর্তার কথাই বেমালুম হয়ে যায়। এমনকি আল্লাহর বিধানেরও বিরোধিতা করে। শিরক করে। আল্লাহকে অস্বীকার করে।
বেশিরভাগ মানুষই জানে না তার শরীরটা কত মূল্যবান, তার শরীরটা আল্লাহ কী কী দিয়ে, কোন প্রকারে কতকিছু দিয়ে তৈরি করেছেন। মহাবিজ্ঞ এই আল্লাহর সৃষ্টি শরীরটাকে মানুষ যদি ব্যবচ্ছেদ করে তাহলেই আল্লাহর স্বরূপ দেখতে পাবে। কিন্তু মানুষ এসব চিন্তা-ভাবনা করে না। শুধু খায়-দায় আর ফুর্তি করে। পৃথিবীতে এসে তার কর্তব্য কাজ কী? বেশিরভাগ মানুষ তা থেকে গাফেল (বিমুখ) থাকে।
বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না। মেয়েটি একদিন রাত প্রায় বারোটায় আমাকে ফোন দিলো। আমি তার ফোন পেয়ে খুশি হলাম।
রিসিভ করতেই সে বললো, ‘স্যার, আম্মা জানালো আপনি আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি কাউকে না বলে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলাম। পরে বুঝতে পারলাম কাজটা ঠিক হয়নি। পরদিনই বাড়ি ফিরে আসি। মোবাইল থেকে নেটে আপনার একটা লেখা পড়লাম। লেখাটির শিরোনাম ছিলো : ‘মেয়েটি বললো একটি কিডনী বিক্রি করবো’। লেখাটি পড়ে আমার বেশ ভালো লেগেছে। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা এই জন্যে যে, আপনি আমার মতোন গরিব মানুষদের স্মরণ করেছেন।’
‘পৃথিবীতে সব মানুষই গরিব অবস্থায় আসে। ঠিক নয়? প্রতিটি শিশু যখন ভূমিষ্ট হয় তখন তার কিছুই থাকে না। একদম গরিবভাবেই আসে। তবে বড় হয়ে তার শিক্ষা-দীক্ষা, কর্মগুণে সে সমাজে তার আসনে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করে নেয়। তেমনিভাবে তুমিও হতাশায় না ভুগে, সঠিক সিদ্ধান্ত নাও। দেখবে তোমার মন থেকে সব হতাশা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা চলে যাবে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারাটাই বুদ্ধিমানে কাজ। আশা করছি তুমিও তাই করবে।’
সে কিছুটা সময় নিরুত্তাপ থেকে বললো, ‘আল্লাহ আসলে আপনার মতো সঠিক মানুষের সাথেই যোগাযোগ করার তৌফিক আমাকে দিয়েছেন। সেজন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা অশেষ।’
আমি বললাম, ‘ধন্যবাদ। তোমার বায়োডাটা পাঠিয়ে দাও। দেখি তোমার কোনো উপকার করা যায় কি-না।’
এই মেয়েটি প্রায় পাঁচ বছর পর তার কর্মগুণে তাকে সমাজের একজন যোগ্য মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তার বাবার স্বপ্ন পূরণ করে। নিজেরও স্বপ্নগুলোকে বাস্তবায়ন করে। তার আর কিডনী বিক্রির প্রয়োজন হয়নি।