অন্যপ্রকাশ প্রকাশনার ব্যানারে বহুল আলোচিত গল্পকবিতা সংকলন বেরুলো। বইটি হাতে নেয়ার সুযোগ হয়েছে। মোড়ক উন্মোচনের দিনই জেনেছি কার কার লেখা গেছে। আমাদের দু’জনের লেখা আছে, পছন্দের নবীণ প্রবীণ কয়েকজন লেখকের লেখা গেছে, খুব প্রিয় গুণী কিছু লেখকের লেখা যায় নি-সব মিলিয়ে আনন্দ হতাশার মিশ্রন। লেখা নির্বাচন, নির্বাচিত লেখার সংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সেগুলো কর্তৃপক্ষের ব্যাপার ধরে নিয়ে আলোচনায় যাচ্ছি না।
‘‘গল্পকার ও কবিদের সৃজন ধারায় স্বাগতম’’- এই সংকলনের দু’জন সম্পাদকের মুখবন্ধের শিরোনাম এটি। এখানে বলে রাখি, গল্পকবিতা.ডট.কম আযোজিত লেখা প্রতিযোগিতার অন্যতম দু’জন বিচারক জনাব মনি হাযদার ও মোমিন রহমান সম্পাদনার গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। ভূমিকাটি মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। জানার আগ্রহ ছিল, কীভাবে নব্য লেখকদের লেখা পাঠক সমাজে তুলে ধরা হয়।
গল্পকবিতা সাইটে বিষয়ভিত্তিক লেখা হয়। তার উপরই প্রতিযোগিতা। সৃজনশীলতা, মনন, ভাষাশৈলীর পাশাপাশি বিষয়বস্তুতে থাকার কঠিন শর্তের মধ্যে থেকে লেখক/কবিদের লিখতে হয়েছে। বিষয়বস্তুতে আবদ্ধ থেকে উন্নত রচনার সব শর্ত পূরণ যে কতটা কষ্টকর লেখকমাত্রই জানেন। বিষয় দিয়ে প্রতিযোগিতা হয়, কিন্তু লেখকের মুক্ত সৃজন হয়না। নতুন লেখক সৃষ্টির জন্য বিষয়বস্তু দিয়ে লেখা আহবানের একটা যুক্তিও আছে। এ কথাগুলো ভূমিকাতে থাকলে লেখকদের প্রতি সুবিচার হতো। যদিও কবিতার ক্ষেত্রে মুখবন্ধের শেষদিকে এ ব্যাপারে কিছুটা বলেছেন।
কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মুখবন্ধে গল্পকবিতা.কম এর লেখক-কবিদের মান নিয়ে, তাদের লেখার উচ্চতা নিয়ে তীব্র কটাক্ষ রয়েছে। তা্ও আবার একেবারে প্রথম পাতায় । যে কেউ এটা পড়লে ভেবে বসতে পারেন- কোন কট্টর সমালোচকের পুস্তক সমালোচনা বোধহয় এটি। সমালোচনা, দূর্বলতা তুলে ধরে পরামর্শ সবসময়ই আকাঙ্খিত। কিন্তু সম্পাদক(গণ) যখন এগুলো বলেন, তখন মনে হয় যেন বিক্রেতা তার পণ্যের গুণাগুণের চেয়ে দোষগুলোই বেশী বলছেন।
আলোচনার প্রেক্ষিতে সম্পাদকগণ কী কী বলেছেন তার কিছু অংশ তুলে ধরা আবশ্যক। “…..আমাদের ধারণা ছিল-ইন্টারনেট আধুনিক সময়ের শ্রেষ্ট বাহন, যারা এই মাধ্যমে লেখালেখি করেন, তারা সময়ের চেয়ে বেশী এগিয়ে থাকবেন। যারা এখন ইন্টারনেট সময় বলয়ের গল্পকার, কবি- তাদের লেখা নিশ্চয়ই স্মার্ট, আধুনিক আর চৈতন্যে গভীরতর হবে।…..যত দিন যেতে লাগল, ইন্টারনেটে পাওয়া গল্প-কবিতা পড়ে দেখে খুব যে আনন্দ পেয়েছি, আশাবাদী হয়েছি এমন বলতে বা লিখতে পারছি না। এ পর্যন্ত বহু গল্প-কবিতা পাঠ করেছি। চেতনায় নতুন করে নাড়া বা সাড়া দেয়ার মতো গল্প বা কবিতা উঠে আসে নি।’’ ….এখানে সম্পাদকগণের বয়ানে অনলাইন লেখালেখির প্রতি প্রচ্ছন্ন বিষোদগার পরিলক্ষিত হয়। সেটা নাহয় তাদের ব্যক্তিগত অভিমত। দুই ঘরাণার লেখকের মধ্যে চিন্তার বিভেদ থাকতেই পারে, বিতর্কের অবকাশ আছে। যদিও্ অনেক ক্ষেত্রে অনলাইন আর প্রথাগত সিস্টেমের লেখক এখন কিন্তু মিলেমিশে একাকার। তবে আমাদের প্রশ্ন এখানে, সম্পাদক যদি বলেন এখানে চেতনায় সাড়া কিংবা নাড়া দেয়ার মত গল্প নেই, তবে পাঠক এ বই পড়বে কেন? সম্পাদকগণ কেনইবা পাঠককে মানহীন লেখা তুলে দেবেন? সেক্ষেত্রে বিচারক আছেন সেটি অন্য বিষয় কিন্তু নিজের বোধের বিরুদ্ধে এমন একটি বই কেনইবা তিনি/তারা সম্পাদনা করতে সম্মত হলেন?
‘‘এখানে অংশ নেয়া গল্পকার বা কবিরা সমকালীন লেখকদের লেখা পড়েন, আমাদের মনে হয় না। আর পাঠ করলেও তা চেনা ও জনপ্রিয় লেখকদের অল্পকিছু লেখাতেই সীমাবদ্ধ। এতে আর যাই হোক একজন নিবেদিতপ্রাণ লেখক হয়ে ওঠা যায় না।’’ গল্পকবিতায় চার হাজারের উপর গল্প-কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। বিচারকগণের কাছে পাঁচ ছয় শ’য়ের বেশী যাওয়ার কথা নয়। অনেক ভাল লেখা পাঠকদের ভোটে সেরা পঁচিশে যায় না বলে বিচারকের হাতে পৌঁছে না। আবার অনেক গুণী লেখক তাদের লেখা ভোটের জন্য উন্মুক্ত রাখেন না। পুরো সাইটের অল্পকিছু লেখা পড়েই এ ধরণের চূড়ান্ত কমেন্ট ভয়ানক অবিবেচনাপ্রসূত বলে মনে হয়েছে। তার উপর একজন লেখকের লেখা পড়ে তার ব্যক্তিগত পাঠাভ্যাস সম্বন্ধে মন্তব্য করাটা শোভনীয় নয়। এই অশোভন আচরণটি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। বিষয়টা এমন- একজন লেখক মনে করি দশজন লেখকের বই পাঠ করেছে। তারপর তিনি যখন একটি গল্প লিখলেন সেখানে সেই দশজনের ছাপ এলোনা, কোন একজনের ছাপ এল। তার মানে কি সে কেবল ঐ একজনের লেখাই পড়েছে? আবার যদি কারও ছাপ না এসে নিজস্ব একটা স্টাইল চলে আসে লেখায় (যেটা ভাল বা মন্দ দুইই হতে পারে), তার মানে কি লেখক অন্য দশজনের বই পড়েনি? এমন অদ্ভুত মনোভাব কেন সম্পাদকদের?
‘‘……………খুন হতে বা খুন করতে না পারলে লেখালেখিতে না আসাই ভাল। ….গল্পকবিতা ডটকমের লেখকেরা পাঠ করেন না আমাদের চিরায়ত ও শ্রেষ্ঠ গল্পকারদের গল্প, কবিদের কবিতা। পাঠ করলে তাদের লেখায় অবশ্যই তার মোচড় থাকত। থাকত আঁচড়। রাখতো দাগ।’’ মাঝে মাঝেই তাদের এ জাতীয় মন্তব্য পড়ে হতবুদ্ধি হয়েছি, তারা এই সাইটটির নেতিবাচক প্রচারণা করছেন, নাকি লেখকদের! অবাক হয়েছি, গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই প্রচারণা(!) ভাষ্য দেখেছেন কি না। একজন নবীন লেখককে ডিমোটিভেট করার মত এইসব উক্তি খুবই কষ্টদায়ক, হৃদয়বিদারক। যোগ্য সম্পাদক/বিচারকের কাছ থেকে এমনটি নবীন লেখক/কবিগণ অবশ্যই প্রত্যাশা করেনা। বিশিষ্ট গল্পকার/লেখকদের লেখা নব্য লেখককে অনেক কিছু শেখাবে। তাই বলে তার আঁচড়, মোচড় কেন থাকতে হব, কেন অনুকরণ করতে হবে, এটা আমাদের বোধগম্য নয়। বিচারকগণ লেখকদের নিজস্বতা কেন বিচার করছেন না? নাকি তারা নিজেরাই প্রথাবদ্ধ? আধুনিক সাহিত্য কিন্তু প্রথাহীন বহু দিকে মোড় নিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে।
তাছাড়া তারা বলেছে প্রায় বছরখানেক আগে তারা বিচারক নিযোজিত হয়েছেন, কথাটা ঠিক না। প্রথম কয়েকমাস কোন বিচারক ছিলনা। সে সময়ের প্রচুর ভালো এবং মান সম্পন্ন গল্প তারা হয়তো পড়ার সুযোগই পাননি। তখন পাঠক ভোটের ভ্রান্তির কারনে অনেক ভালো লেখা সামনের সারিতে আসতো না।
এসব গেল সাধারণ মন্তব্য। এবার আসি ১৩টি গল্পের সার-মন্তব্যে। উল্লেখযোগ্য মন্তব্য- একটি গল্পেরে ক্ষেত্রে বলেছেন‘ “….গল্পের আখ্যান মনঃসমীক্ষায় পরিপূর্ণ।” আরেক গল্পের জন্য বলেছেন, “…পাঠ করতে করতে নিজের চোয়ালই একসময় শক্ত হয়ে ওঠে।” তাহলে দেখা যায়, একটা দুটো গল্প তাঁদের নাড়া দিয়েছে!!!
কবিতার ক্ষেত্রে আলাদা মূল্যায়ন- ‘‘….কবিতার যে নিজস্ব চরিত্র, ছন্দ, শব্দের আধুনিক বর্ণায়ন, উপমার নিঁখুত প্রয়োগ, নিটোল রস, যা থাকলে একটি কবিতা প্রকৃত কবিতা হয়ে থাকে, অধিকাংশ কবিতায় সে সবের উপস্থিতি নেই। এক ধরণের ফেনানো আবেগের সঙ্গে কিছু শব্দের সমাবেশ মাত্র অধিকাংশ কবির কবিতা। সম্ভবত কবিদের আধুনিক কবিতার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই….।” গল্পকবিতায় আধুনিক চিন্তার কবি নেই, কবিতা আসছে না-মানতে পারি না। বরং অনেক সময়েই কবিতা বিচারের মানদণ্ড নিয়েই পাঠক সমাজে প্রশ্ন উঠেছে। বিচারকদের কাছে তাদের লেখা আধুনিক কবিতার উদাহরণ চেয়েও অনেক সময় ক্ষুব্ধ কবিগণ সাইটে পোষ্টও দিয়েছেন। আমাদের ব্যক্তিগত অভিমত, সংকলনে যে সকল কবিতা স্থান পেয়েছে এর চেয়েও আধুনিক সুন্দর কবিতা সাইটে পাঠ করার সুযোগ হয়েছে। গল্পের ক্ষেত্রেও একই অভিমত।
সাইটের অভ্যন্তরে লেখকদের গঠণমূলক সমালোচনা হতে পারে। বিচারকগণ তাদের সীমাবদ্ধতার মাঝে মন্তব্য করুন, আপত্তি নেই। লেখকদের মধ্যে জেদ সৃষ্টি করার জন্যও কটাক্ষ করা হয়ে থাকতে পারে। তবে একটি প্রকাশনা, এটি একটি কট্টর দলিল, যেটি ‘গল্পকবিতা ডটকম’ এর প্রচার প্রসারে কাজ করবে, সেখানে এ ধরণের বক্তব্য কেন? নব্য লেখকদের লেখা একটি নামী প্রকাশনীর মাধ্যমে পাঠকদের কাছে আনার সময় তাদের গুণগত, অভ্যাসগত বিষয় নিয়ে কল্পিত কথন কেন? তদুপরি নেতিবাচক ভঙ্গিতে অনলাইন লেখালেখিকেই এখানে টেনে আনার কারণ কি?
আমার মনে হয়েছে, সম্পাদকদের মহান বাণী পড়লে সচেতন পাঠক আর এই বইটি পড়তে আগ্রহবোধ করবে না। তার পাশাপাশি ‘গল্পকবিতা ডটকম’-এ প্রবেশ করে সাইটটি দেখতে আগ্রহ হারাবে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সকলকে ভেবে দেখার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।
আহমাদ মুকুল
এবং
মামুন ম. আজিজ
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।