এক:
গত সন্ধ্যায়, মানে গতকাল, রেবেকা বাপের বাড়ি চলে গেছে। যেমন হরহামেশা অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারে হয়, আমার বেলায় তেমনটি ঘটেছে। আমার সংসারের কপালে ঝাঁটা মেরে হনহন করে সে বেরিয়ে পড়েছে। সিঁড়ি দিয়ে প্রায় নিচে নেমে গিয়ে আবার ঝড়ের বেগে ফিরে এসে সে আমার দুবছর বয়েসি আদরের মেয়ে তিতলীকে এক ঝটকায় টান মেরে কোলে নিয়ে ঘটঘট করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়। তার মস্তিষ্কের যন্ত্রপাতি এমনই বিকল হয়েছিল যে সে মেয়ের কথা ভুলেই গিয়েছিল।
মেয়ে অবশ্য বাবা বাবা বলে চিৎকার করে মায়ের কোল থকে নেমে যাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করেছিল। কিন্তু মায়ের হাতের এক প্রকাণ্ড চটকনা খেয়ে সে দপ করে নিভে যায়। ঘটনার এই উপাখ্যানে আমি অবশ্য আগাগোড়া মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলাম। কেননা, যাত্রার প্রাক্কালে আমিও মতিচ্ছন্ন রেবেকার গালে ওজনদার একটা চপেটাঘাত বসিয়ে দিয়েছিলাম।
সাড়ে তিন বছরের সংসারে খচখচ আরও বহুবার হয়েছে। গলার আওয়াজ চড়া হয়েছে, নর্তন-কুর্দন হয়েছে; তারপর একসময় মেজাজের পারদ নিচে নেমে এসেছে। তবে এবারই প্রথম আমার ধৈর্যের বাঁধ হুড়মুড় করে ভেঙ্গে যায় আর আমার ভেতরের পশু হালুম লম্ফ দিয়ে বসে।
রেবেকা চলে যাওয়ার পর আমি কী করবো না করবো তা নিয়ে ধন্দে পড়ে যাই। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে ভাবনার তেমন কিছু নেই; প্রয়োজনে বাইরে থকে কিছু একটা এনে খাওয়া যাবে। রেবেকার সাথে ঘটে যাওয়া সমস্যাও হয়তো ধীরে ধীরে গুরুজন পর্যন্ত পৌঁছাবে, বাদানুবাদ হবে এবং শেষ পর্যন্ত মিটমাট করার চেষ্টা হবে। কিন্তু আমার মানসিক অবস্থা যে পর্যায়ে স্থিত হয়েছে সেখান থকে সরে আসা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। রেবেকা নিজে যদি আমার চেয়ে আরও অনড় অবস্থানে থাকে তবে ভালোই হয়। সহজেই ল্যাঠা চুকে যায়। সে তার পথ দেখবে, আমি আমারটা। কিন্তু ঐ মুহূর্তে আমার করনীয় কী তা ঠিক করতে পারছিলাম না।
অস্থিরতার উপশমকল্পে এক নাগাড়ে দুটো সিগারেট টেনেও কোনো দিশে না পেয়ে সাদাতকে ফোন দিই। সে আমার পরিস্থিতির কথা শুনে বলে, ‘ধুর শালা, তুই টেম্পার লুজ করলি ক্যান। আয়, আমার বাসায় চলে আয়। নাকি আমি আসবো?’
‘না, দোস্ত। আমি আসবো না।’ আমি আপত্তি করে বলি, ‘তোর বউ বিষয়টা ভালো চোখে দেখবে না।’
সাদাত বলে, ‘ঠিক আছে, আমিই আসতেছি। কী আনবো, কী খাবি বল?’
আমি নিষেধ করি, ‘কিস্সু আনা লাগবে না।’
সাদাত আমার স্কুলবন্ধু। স্কুলের পাচিল ডিঙানোর পর তার মামা তাকে নিজের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি এবং বায়িং হাউসে শিক্ষানবিশি করার জন্য নিয়ে যান। একই সাথে তাকে পোশাক বিষয়ক কি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে দেন। মামার হোটেলে থেকে পোশাক শিল্পে বেশ দক্ষ হয়ে ওঠার পর নিজের একটি স্বাধীন ব্যবসার জন্য তার মনে খায়েস জাগে। তখনই তার সাথে আমার যোগাযোগ ঘটে। সাদাতই হঠাৎ একদিন বললো, ‘অ্যাই পণ্ডিত, আধা খেঁচড়া পণ্ডিতি বাদ দিয়া আমার সাথে আয়।’
আমি জানতাম আমার বিদ্যার ধার ততো প্রখর নয়, তাই উচ্চাকাঙ্ক্ষাও তেমন ছিল না। তবে কোনোরকমে মাস্টার্স শেষ না করলে তো মর্যাদা একেবারেই থাকে না। সাদাত বললো, ‘কোনো অসুবিধা নাই। তুই তোর পণ্ডিতি চালায়া যা। একই সাথে আমার সাথে বস। আমার বায়িং হাউস রেডি। কপালে থাকলে আর চাকরি-বাকরির ধান্ধা করতে হবে না।’ সেই তখন থেকেই সাদাতের পার্টনার হয়ে আজ একটা মোটামুটি ভাল অবস্থানে পৌঁছেছি। অফিস বড় হয়েছে। আরও তিনজন স্টাফ নিয়োগ দিতে হয়েছে।
গতকাল সাদাত আসার পথে বিরিয়ানি, কোল্ড ড্রিংক্স আরও কী কী নিয়ে এসেছিল। ঘটনার পূর্বাপর শুনে সে বললো, ‘এ অসুখ তো পুরানা; সবার ঘরেই এই রোগের লক্ষণ আছে। তো তুই লিমিট ক্রস করলি ক্যান?’
আমি বললাম, ‘তুই তো জানিস, বায়াররা এলে তারা ফ্যাক্টরি ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় যেতে চায়, শপিং করতে চায়। মেয়ে ক্লায়েন্ট হলে তো কথাই নেই। সাথে কখনও তুই যাস, কখনও আমি। তা নিয়ে খুনসুটি তো ছিলই। তাই বলে সে আমাদের স্টাফ প্রিসিলার ওপরও সন্দেহ করে বসবে? সে নাকি আমাকে প্রিসিলার সাথে কোন এক রেস্টুরেন্টে দেখেছে।’
বউয়ের ঘনঘন ফোন আসায় সাদাত আর বেশিক্ষণ আমার বাসায় বসেনি। যাবার সময় সে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘তুই চিন্তা করিস না, আর মাথা গরমও করিস না। দুই-একদিন চুপ করে থাক; দেখি কী করা যায়।’
উত্তেজনা প্রশমিত না হলেও আজ বাসায় ফিরে মাথাটা চক্কর দেয়। উত্তেজনা চরমে ছিল বলে মেয়ের কথাটা আজ সন্ধ্যা অবধি মাথায়ই আসেনি। বাসায় ফিরলেই বাবা বলে সে লাফ দিয়ে কোলে চড়ে বসতো। তারপর তার জন্য কী এনেছি সে তল্লাশি চালাতো। অভ্যাসবশত তার জন্য কিছু একটা কিনতে দোকানে ঢুকেই পড়েছিলাম প্রায়, পরে বোধোদয় হয়।
রান্নাবান্নার ঝামেলা নেই। বাসায় ফেরার পথে নান-কাবাব খেয়ে এসেছি। কিন্তু মেয়েটার কথা মন থেকে সরাতে পারছি না। সাদাত তো বলেছে কয়েকদিন চুপ করে থাকতে। তার সাথে আজ আর এসব কোনো কথা বলিনি। এখন তাকে ফোন করলে সে আবার খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠতে পারে। হঠাৎ আমার বন্ধু মুরাদের কথা মনে পড়ছে। দেবো নাকি একটা কল?
মুরাদ আমার দুরবস্থার কথা শুনে খুশি হবে নাকি দুঃখ পাবে সে কথা ভাবতে ভাবতে শেষপর্যন্ত তাকে কল দিয়েই বসি।
‘হ্যালো! কী রে! সূর্য পশ্চিম দিকে উঠলো নাকি।’ মুরাদ ফোন ধরে ক্ষোভ ঝাড়তে থাকে, ‘বউয়ের প্রেমে এমন ডুবে আছিস যে আমাদের কথা ভুলেই গেলি।’
আমি বলি, ‘স্যরি দোস্ত। আমার কাজের ধরণ তো জানিস; ব্যস্ততার কারণে অনেকের কাছেই ফোন করতে পারি না। আর তুইও তো মক্কেল নিয়ে ডুবে আছিস। হ্যালো বলার সময় পাস না।’
‘তো, ভাবী কেমনে আছে? ও, তুই তো আবার রেসপন্সিবল ফাদারও; মেয়েটা কেমন আছে?’
আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। মেয়েটার জন্যই বুকটা খাঁখাঁ করছে। মুরাদের প্রশ্নের কোনো জুতসই উত্তর খুঁজে পাই না। তবু বলি, ‘দোস্ত, তুই কি কালকে একটু সময় বের করতে পারবি?’
‘কেন, কী হয়েছে?’ মুরাদ একটু থমকে গিয়ে বলে, ‘আয়; বিকেলে চেম্বারে চলে আয়।’
আমি বলি, ‘ঠিক আছে। তাহলে আগামীকাল বিকেল পাঁচটায়।’
মুরাদ উকিল মানুষ। ডাক্তার রুগির নাড়ি টিপে রোগ নির্ণয় করে আর উকিল গলার স্বর থেকেই মক্কেলের সমস্যা বুঝে নেয়। মুরাদও বুঝেছে, তবে কতটুকু ও কী বুঝেছে জানি না। সে শুধু বললো, ‘কোনো সমস্যা নাকি রে?’
আমি বললাম, ‘সাক্ষাতে কথা হবে।’
মুরাদের কপাল আমার চেয়েও খারাপ। আইন পড়ে ওকালতি পেশায় ঢুকেই অল্প-জানা এক সুন্দরীকে সামাজিকভাবেই বিয়ে করে ফেলে। কিন্তু বছর না ঘুরতেই তাদের সুখের সংসারের মধ্যে অবিশ্বাসের কুজ্ঝটিকা ঘন আবরণ ফেলে। তার স্ত্রী ডালিয়া নাকি মুরাদকে তার এক তরুণী মক্কেলের সাথে মাখামাখি করতে দেখেছে। ডালিয়াকে আমিও অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি। বলেছি, মক্কেল পেতে হলে উকিলদের অনেক কূটকৌশল ও কথার যাদুর আশ্রয় নিতে হয়; সবকিছুতে খুঁতখুঁতে হলে চলে না। কে শোনে কার কথা। মুরাদের সংসারটা টেকেনি।
বলক-বিক্ষুব্ধ সমাজের এ অবস্থা দেখেই বিয়ের আগেই আমি ও রেবেকা পণবদ্ধ হয়েছিলাম যে আমরা কেউ কাউকে ১) অমূলক সন্দেহ করবো না এবং ২) সন্দেহ উদ্রেককারী কোনো আচরণের ধারেপাশেও যাব না। অবশ্য ইডেনের ছাত্রী থাকাকালে যখনই সে আমার সাথে দেখা করতো তখন আমাকে সাবধান করে বলতো, ‘ডানে-বায়ে যা দেখার এখনই দেখে নাও, বিয়ের পরে এসব করলে কিন্তু চোখে চুলের কাঁটা ঢুকিয়ে দেবো।’ তখন তার কথা স্বাভাবিকভাবে মশকরা হিসেবে ধরে নিয়েছি।
দুই:
ঘটনার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। রেবেকা বা তার অভিভাবকদের কাছ থেকে আমি কোনো ফোন পাইনি। এজন্য আমি মোটেই উদ্বিগ্ন নই। নিত্যনৈমিত্তিক ঘ্যানঘ্যানানি আমার সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। সে আমাকে লম্পট বলেছে; আমার সাথে ঘর না করার হুমকি দিয়েছে। তা নাহয় করুক। কিন্তু আমার মেয়ে? আমার মেয়ের কী হবে? একথা ভাবতে গেলেই আমার মাথা ভোঁ-ভোঁ করে।
মুরাদের কাছে গিয়েছিলাম ভাল কথা শোনার জন্য। সে আবার আইনের বুলি কপচায়। সে আমাকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২০২০ সনের ২২/৬ (ক), ২০০৩ সনের ৩০/১৩, ২০২৫ সনের ১১ নং অধ্যাদেশের ২৩ ধারা আরও কত কি হিজিবিজি কথা শোনায়। তার আইনের কচকচানি শুনে আমার মাথা ধরে যায়। আমি চলে আসতে চাইলে আমাকে টান দিয়ে বসিয়ে বলে, ‘দোস্ত, আমার কথা তোর কাছে বিরক্তিকর লাগবে আমি জানি। তারপরেও আমি কেন এসব ধারা, উপধারা টানলাম বল তো।’
আমি বিরক্ত হয়ে বলি, ‘কেন, তার আমি কী জানি।’
মুরাদ বলে, ‘তুই অল্প হলেও জানিস; দেড় বছর নাইট কলেজে আইনের বই নাড়াচাড়া করিসনি? শোন, মেয়েমানুষ কী জিনিস আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। আমার কথা তুই একেবারে ভুলে গেলি?’
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘তুই কী বলতে চাস?’
‘বলি, আপাতত চুপ করে থাক।’ মুরাদ বলে, ‘ফুটানো জল শীতল হোক। তারপর একটা কিছু করা যাবে। এখন তুই যদি আর বাড়াবাড়ি করিস তবে, ওই যে ধারার কথা বললাম! রাগের মাথায় তোর বউ একটা মিথ্যা মামলা ঠুকে দিয়ে লালঘরে ঢুকিয়ে দিলে তিন মাসের আগে কোনো কথাই বলতে পারবি না।’
মুরাদের ওকালতি কথা শুনে তাকে একটা চড় মারতে ইচ্ছা করলেও নিজেকে সংযত করি। কেননা তার কঠিন সময়ের কথা আমার মনে পড়ে যায়। তার বউ অবশ্য কারুর কথা শোনেনি, মামলার ধারও ধারেনি। সে সরাসরি ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়।
আমি মুরাদকে বলি, ‘আমি ওসব পরোয়া করি না; আমার মেয়েটাকে কেমনে পাবো সেটা বল।’
আমার সাথে নিরিবিলি কথা বলবে বলে মুরাদ কয়েকজন ক্লায়েন্টকে পরে আসতে বলেছে। সে হয়তো আর বেশি সময় দিতে পারবে না। তাই চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলে, ‘দোস্ত ওটা আরও জটিল। আদালতের রায়ও তোর বউয়ের পক্ষে যাবে; মেয়ে মায়ের কাছেই থাকবে।’ তারপর সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমি যা বললাম তাই কর। আর ক’টা দিন চুপ করে থাক, আমরা তো আছি।’
ওদিকে সাদাতের কাছে আমার মুখ ছোট হয়ে গেল। সে ওস্তাদি করে রেবেকার কাছে ফোন করতে গিয়েছিল। রেবেকা ওকে যা তা বলেছে। বলেছে, ‘আপনারা তো স্বর্গে আছেন। বায়িং হাউস না; হুরদের বালাখানা!’
সাদাত বলেছে, ‘আমি কি দোষ করলাম? আর, মানিকই বা কী করছে – আমরা তো একসাথেই ব্যবসা করি।’
‘মানিক তো শুধু আপনার পার্টনার না, বন্ধুও।’ রেবেকা প্রত্যুত্তরে বলেছে, ‘বন্ধু সেঞ্চুরি করবে, আর আপনি কি বসে বসে দেখবেন?’
রেবেকা সাদাতের সাথে অমন অশালীন আচরণ আগে কখনও করেনি। সাদাত কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হলেও শুধু আমার অবস্থা বিবেচনা করে তেমন কিছু বলেনি। বরং আমাকে বুঝিয়েছে, ‘ধৈর্য ধর, মেয়েটার মুখের দিকে তাকাইয়া ধৈর্য ধর।’
আমি উষ্মা ঝেড়ে বলেছি, ‘ও চলে গেছে যাক, কিন্তু আমার মেয়েকে নিয়ে যাবে কেন?’
সাদাত বলেছে, ‘তো, বাচ্চা মেয়েটারে তোর কাছে ফেলে যাবে নাকি? পাগলামি করিস না। ওই তোর উকিল বন্ধু যা বলছে তাই কর। চুপ করে থাক। দেখি কী করা যায়।’
এখন আরেকটা প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি তো সাদাতকে সব বলেছি, মুরাদের কাছেও গিয়েছি; কিন্তু রেবেকা কি ওর বাপের বাড়িতে কাউকে কিছু বলেনি? বললে তো আমার পরিবারের কেউ না কেউ, অন্তত মা, আমাকে ফোন করে এ বিষয়ে জানতে চাইতেন। বাবা অবশ্য ফোন করেছিলেন; চট্টগ্রামে কবে যাবো, বউমা কেমন আছে, তিতলী কেমন আছে এসব মামুলি কথা জানতে চেয়েছেন। আমি হাঁ-না বলে চালিয়ে দিয়েছি।
তাহলে কি সে তার বাপের বাড়ি যায়নি? নাকি অন্য কোনো আত্মীয় বা বান্ধবীর বাসায় উঠে ওদের মুখ বন্ধ করে রেখে দিয়েছে? আমি ওদের অনেককেই চিনি। কিন্তু আমি কেন গায়ে পড়ে খোঁজ নিতে যাবো? শুধু প্রাণটা আনচান করছে মেয়েটির জন্য।
সন্দেহ একটার পর একটা মাথার মধ্যে জিলাপির মতো প্যাঁচ খাচ্ছে। রেবেকা আবার চাকরির ধান্ধা করছে না তো? আমার মেয়ের জন্মের পরপরই তাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে এনেছি। সে ধানমণ্ডিতে একটি প্রাইভেট স্কুলের টিচার ছিল।
তিন:
রাত বারোটায় হঠাৎ একটি ফোন আসে। মুরাদ। মুরাদ জিজ্ঞেস করে, ‘সেলিনাকে চিনিস?’
‘সেলিনা? কোন সেলিনা?’
মুরাদ বলে, ‘আরে আমি তো তাকে চিনতাম না; তোর অবশ্যই চেনার কথা। তোর বউয়ের বান্ধবী।’
হ্যাঁ, ঠিকই আছে। সেলিনা রেবেকার বান্ধবী। তার আবার মুরাদের সাথে কী কাজ? আমি বলি, ‘তো, সেলিনার কথা বলছিস কেন?’
মুরাদ বলে, ‘সে এক লম্বা কাহিনি। কালকে আয় একবার আমার চেম্বারে।’
আমি আঁচ করতে পারি, রেবেকার বিষয় নিয়েই তাদের মধ্যে কথা হয়েছে। মুরাদ হয়তো সে কাহিনিই বিস্তারিত বলতে চায়। আমি বলি, ‘আমার কাজ আছে, আমি আসতে পারবো না।’
মুরাদ জোরাজুরি করলেও আমি যেতে রাজি হইনি। যাইও নি।
পরদিন অফিস থকে রাত আটটার দিকে ফিরে আসি। ঘরে তো খাওয়া-দাওয়ার কোনো ঝামেলা নেই। শুধু মনটাই কাতর। মেয়েটার জন্য শুধু আমিই হাঁসফাঁস করছি এমন তো নয়, আমার মেয়েটিও নিশ্চয় আমার জন্য কান্নাকাটি করছে। তার মা নিজের রাগ প্রশমন করতে গিয়ে অবশ্যই মেয়েটির ওপর হাত তুলবে।
এসব ভাবতে ভাবতে শোবার জোগাড় করতে যাচ্ছি এমন সময় ডোরবেল বেজে ওঠে। অসময়ে কে আসলো ভেবে বিরক্ত মুখে দরজা খুলতেই দেখি, কী বিস্ময়! আমার মেয়ে তিতলী, সেলিনার কোলে! এক মুহূর্ত দেরি না করে আমার মেয়ে বাবা বলে চিৎকার করে উড়াল দিয়ে আমার কোলে এসে পড়ে। আমি কান্নার বান চেপে রাখতে পারি না। আমার মেয়েকে বুকের সাথে পিষতে থাকি।
সেলিনা রাগী কণ্ঠে ভর্ৎসনা করে বলে, ‘আপনি কেমন মানুষ, মানিক ভাই? আপনার বউ চলে গেছে যাক, আপনার রক্ত এই মেয়েটা বেঁচে আছে না মরে গেছে সেই খোঁজ নেবেন না?’
আমি কোনো জবাব খুঁজে পাচ্ছি না, জবাব দেবার প্রয়োজনও বোধ করছি না। আমার মেয়েটা আমার অশ্রুভেজা মুখে মুখ ঘষছে এবং ভ্যাবাচ্যাকার মতো সে-ও কাঁদছে। সেলিনাকে ভদ্রতার খাতিরে বসবার কথা বলতেও ভুলে গেছি।
সেলিনা বলে, ‘আপনার মেয়েকে রাখুন; আমি গেলাম।’
সেলিনার কথা শুনে আমি আঁতকে উঠি। ওকে রাখবো মানে, ওকে খাওয়ানো, পরানো, ঘুম পাড়ানো…? আমি ঝড়ো কাকের মতো সেলিনার দিকে তাকাই। কিন্তু গমনোদ্যত সেলিনাকে কিছু বলবার শব্দ খুঁজে পাই না।
সেলিনা হতোদ্যম হয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালে আমি হড়বড় করে বলি, ‘দাঁড়ান। আমার মেয়েটাকে পেলেন কোথায় বুঝলাম না।’
সেলিনা এবার তার দুই হাত কোমরে ঠেকিয়ে বলে, ‘আচ্ছা, মানিক ভাই! আপনাকে তো স্মার্ট মানুষ বলেই জানি। সংসারে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে, ঝগড়াঝাঁটি হতে পারে; আপনি আপনার বউকে আটকে রাখতে পারলেন না? মেয়েকে কোথায় পেলাম জিজ্ঞেস করছেন, মেয়ের মা কোথায় আছে জিজ্ঞেস করতে পারলেন না?’
আমি বলি, ‘বলুন, সন্দেহ, মিথ্যা অপবাদ কাঁহাতক সহ্য করা যায়? আমিও তো রক্ত-মাংসের মানুষ। আমারও সহ্যের লিমিট ক্রস করতে পারে। আর অমনি সে ঘটঘট করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে?’
সেলিনা বলে, ‘ঠিক আছে, সে বেরিয়ে গেছে; আপনার একটা দায়িত্ব আছে না? আপনি সংসারের কর্তা না? আপনি স্ত্রী-কন্যার খোঁজ নিয়েছেন? কাউকে জিজ্ঞেস করেছেন? যাক, শুনলাম মেয়ের জন্য আপনি অস্থির হয়ে পড়েছেন; তাই মেয়েকে দিয়ে গেলাম।’
আমি সেলিনার কথা শুনছিলাম আর আড়চোখে সিঁড়ির দিকে তাকাচ্ছিলাম। সেলিনা যে আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেছে তা তার মৃদু দুষ্টু চাহনিতে বোঝা যাচ্ছে। আমি আমতা আমতা করে বলি, ‘আমি খুব খুশি হয়েছি কষ্ট করে আমার মেয়েকে নিয়ে এসেছেন বলে। এখন একটু পরামর্শ দিয়ে যান ওকে সামলাবো কীভাবে।’
সেলিনার দুষ্টুমিটা আরও পরিস্ফুট হয়। সে বলে, ‘এখন মেয়ে সামলানোর জন্য লোক লাগবে, তাই না? এটা এতদিন বুঝতে পারেননি? আরে ভাই, আপনার চ্যাং ব্যাং লোকজন বিদেশ থেকে আসে, তাদের নিয়ে হোটেল-মোটেলে যেতে হয়, সাথে আপনাদের অফিসের লোকজনও থাকে – এসব কথা বউকে ভালভাবে বুঝিয়ে বলেননি কেন? এক লাফে হাত উঠিয়ে ফেললেন।’
আমি বুঝতে পারি, আমার অতদূর যাওয়া ঠিক হয়নি। কিন্তু সেলিনার কাছে এখন পুরো উপাখ্যান তুলে ধরা অনর্থক। আমি তাই প্রশ্নবোধক চোখে সেলিনার দিকে তাকিয়ে থাকি।
‘মেয়ে সামলানোর একটা ব্যবস্থা আমি করতে পারবো তবে আপনাকে প্রমিজ করতে হবে…আসুন’ বলে সে আমাকে সিঁড়ির দিকে যেতে ইশারা করে।
নিচে এসে আরও মিনিট পাঁচেক সেলিনার ভাষণ হজম করে সেলিনার কারে অপেক্ষমাণ রেবেকাকে নিয়ে আমি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় আমার বাসায় উঠি। ঘরে পৌঁছানো পর্যন্ত আমরা কেউ কারুর মুখের দিকে তাকাইনি কিংবা কোনো কথা বলিনি। শুধু তিতলী একবার আমার দিকে আরেকবার তার মায়ের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছিল।
আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টায় একবার বলি, ‘খাওয়া-দাওয়া করে এসেছ তো?’
রেবেকা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলে, ‘ঢং করো না; মেয়ের জামাকাপড় পালটিয়ে পরিষ্কার করে দাও।’