আমি এবার বলতে চাই আমার নিজের শোনা এক দুঃখভরা কথা। যার কাহিনী বলবো তার নাম মারুফ (ছদ্মনাম)। সঙ্গত কারণেই আমি তার আসল নাম বলবো না। কয়েক মাস আগে আমাকে সে বলেছিলো তার জীবনের দুঃখ ভরা কাহিনীর কিছু অংশ।
মারুফ আমার চাইতে বেশ কয়েক বছরের ছোট হবে। সিঙ্গাপুর আঙ্গুলিয়া মাসজিদের ভেতরে ওর সাথে দেখা। ছোটখাট, সৌম্যদর্শন চেহারার যুবক। শিপইয়ার্ডে কাজ করে। অনেক কঠিন পরিশ্রমের কাজ। সপ্তাহে একদিনই যা একটু সময় নিয়ে মাসজিদে আসে। তখন দেখা হয়। রাতে এশার নামাজের পরে আমরা অনেক্ষন ধরে গল্প করি সবার সাথে। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন আর জিজ্ঞাসা থাকে। কথায় কথায় জানতে পারলাম মারুফ কোরানে হাফেজ। শুনে খুব খুশি হলাম। কোরানে যারা হাফেজ তাদের জন্য আমার মনে আলাদা একটা সন্মানের জায়গা তৈরি করা আছে। জিজ্ঞাসা করলাম, প্রতিদিন তেলাওয়াত করেন তো? আমার আবার একটা অভ্যাস আছে। কোরানে হাফেজ কাউকে পেলে তার কাছ থেকে মুখস্ত কোন আয়াত বা সূরা শুনতে চাই। আমার ভাল লাগে। তখন মারুফ জানালো যে, না তার ভালো মুখস্ত নাই। আমি শুনে অনেক অবাক হয়ে গেলাম।
-কেন? আমি জানতে চাইলাম?
-কাজের চাপে পড়ার তেমন সময় পাই না। লজ্জার সাথে মারুফ বলে।
-এটা কোন কথা হল? প্রত্যেকদিন কয়েক পারা করে পড়া উচিত আপনার। আমি তিরস্কারের সুরে বললাম।
-ভাই মাদ্রাসা ছাড়ার পরে আর পড়া হয় নাই তেমন করে। কাউকে শুনাতে পারি নাই। যার কারণে চর্চা হয় না ঠিকমত।
-চর্চা করতে হবে। আমি আবার শাসালাম।
-ঠিক আছে ইনশাল্লাহ এখন থেকে বেশী করে করে পড়বো।
-আমি চাই আপনি যেন আমার পুরোটা না দেখে মুখস্ত বলতে পারেন। আমি এরপর থেকে শুনতে চাই আপনি রোজ তেলাওয়াত করছেন।
-ভাই পড়তে তো চাইই। আমার মাথাও ভাল ছিল। কিন্তু ভেতরের কিছু কারণে আমার জেহান (স্মরণশক্তি) থেকে নূর চলে গেছে মনে হয়।
-এমন কেন হবে? আপনার এমন কেন মনে হল? আমি অবাক হয়ে গেলাম।
-ভাই মাদ্রাসার ভিতরে অনেক ব্যাপার ঘটে অনেক সময়। আপনারা জানেন না। মাথা নীচু করে বলে গেল মারুফ।
-কি ঘটে? আমি একটু অবাক হয়ে বললাম। আসলে আমি চাইছিলাম সে তার নিজের কথা নিজেই বলুক।
-ওস্তাদরা ছাত্রদের সাথে খারাপ কাজ করে কেউ কেউ।
-বলেন কি? আমি বিস্ফোরিত চোখে জানতে চাইলাম। খারাপ কজা মানে কি লাওয়াতাত (সমকামিতা)?
-হা। ঠিকি বলছেন।
-মাদ্রাসার ওস্তাদরা এই কাজ করে? আমার বিশ্বাস হতএ চাইলো না।
-সবাই না ভাই! কেউ কেউ আছে এই কাজ করে। মারুফ আবার লজ্জায় মাথা নিচু করলো।
-কাদের সাথে করে? আমি কঠিন স্বরে জানতে চাইলাম।
-ছোট ছোট ছেলেদের সাথে যারা বোর্ডিং (হোস্টেল) এ থাকে।
-ছিহ! বলার সাথে সাথে আমার মুখ কালো হয়ে গেল। আমি কিছু কিছু আগেই শুনেছিলাম কিন্তু এইভাবে একজন ভুক্তভোগীকে এইভাবে পেয়ে যাবো এইটা ভাবিনাই।
-আপনি জানেন না। অনেক মাদ্রাসায় এইগুলা গোপনে গোপনে হরদম হয়। কেউ মুখ খুলে না।
-কারা করে এইসব?
-কোন কোন ওস্তাদরাও করে আবার অনেক সময় সিনিওর ছাত্ররাও করে যাদের সাথে এইগুলা আগে হয়ে আসছে। এইটা শুনে আমার মাথায় কেমিস্ট্রি এর চেইন রিঅ্যাকশনের কথা মনে পড়ে গেল। যারা আগে এই জাতীয় ঘটনার শিকার হয়েছে, বড় হয়ে তারাও আবার একই কাজ করছে অন্যদের সাথে।
-ভাই! মারুফ আবার বলা শুরু করে।
-বলেন।
-এই ঘটনার সাথে অনেক আলেম, হাফেজ, মুফতি, মুহাদ্দিস রাও আছেন।
-বলেন কি?
-আর এই জাতীয় ঘটনা প্রায়ই ঘটে। ছেলেপেলেরা ঘরে গিয়ে এইগুলা বলতে পারে না। তাই এইসব কথা অগোচরেই থেকে যায়।
-আপনার সাথে কি এমন কিছু হয়েছিল?
-জ্বী। মারুফ ওকপটে শিকার করে আমার কাছে।
-ওস্তাদরা কেন করে এগুলা?
-কেন করে আমার জানা নাই। হয়ত সে নিজেও এই ঘটনার শিকার হইসে কখনও। যেসব ছেলেরা দেখতে সুন্দর তাদের ক্ষেত্রে এইগুলা হওয়া খুবি স্বাভাবিক। (মারুফ দেখতে বেশ সুদর্শন যুবক আগেই বলেছি)
-কিভাবে সম্ভব? আমার নিজেরমুখ তখন লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
-ওস্তাদরা ছাত্রদের খেদমত করার নাম করে কামরায় নিয়ে পা টেপায়, মাথা বানায়, আর মন চাইলে এইগুলা করে।
-হায় আল্লাহ! আমার মুখ দিয়ে এইগুলাই বের হল।
-আপনার ক্ষেত্রে কিহ হইসিল?
-আমাদের হাফেজী শাখার হুজুর আমাকে একদিন খেদমতেনা নাম করে উনার কামরায় নিয়ে গেল। নিয়ে আমাকে বলল পা টিপে দিতে। আমি পা টিপে দিচ্ছিলাম। তখন উনি আমাকে টান মেরে উনার বিছায় নিয়ে আমাকে চুম দিতে লাগলো...
-এরপর?
-এরপর আমার সাথে খারাপ কাজ করল।
আমার আর শোনার ধৈর্য্য সাহস কোনটাই হল না। শোনার দরকার ও নেই। যা বোঝার বুঝে নিলাম।
-এরপর আপনি কি করলেন? বাসায় বলেন নাই?
-সব তো আর বলতে পারি নাই, আমি অনেক ছোট ছিলাম। এই ঘটনার পরে মাদ্রাসায় যেতে চাইতাম না। আমার বাসায় বুঝতো না। আমাকে পিটায়ে পিটায়ে মাদ্রাসায় পাঠাতো। আমি অন্য মাদ্রাসায় যেতে চাইতাম। কিন্তু কেন যেতে চাই জিজ্ঞাসা করলে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। বাসায় বুঝলো আমি পড়া ফাকিদ এবার জন্য এইসব বলে পার পেতে চাই। কেউ বুঝতে চাইলো না আমার কথা। এক নাগাড়ে মারুফ বলে গেল কথাগুলা।
-আহারে! এই শব্দটা উচ্চারন করা ছাড়া আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না।
মারুফ আবার বলা শুরু করে।
-এরপর আমি উনার কাছে পড়াই দিতাম না ঠিকমত। উনার ধারে কাছেও যেতে চাইতাম না। আমু থাকতাম দূরে দূরে। নিজেরমত করে যা পড়ার পড়তাম।
-কেন? উনি আপনার পড়া ধরতে চাইতেন না?
-চাইবে কেমনে? আমার সাথে যেই কাজ করছে, এরপরে আমার দিকে তাকাতেও পারতো না ঠিকমত।
-উনি কি বিবাহিত ছিল?
-জ্বি ছিল। তাই তো জানতাম।
আমি মারুফকে অনেক সান্ত্বনা দিলাম। শুনে সে খুশি হল। আমি তাকে আবার পড়ার প্রতি উৎসাহ দিলাম। এখন সে নিয়মিত কোরান পড়ে যাচ্ছে। ভুলে যাওয়া অংশগুলো আবার উদ্ধার করতে সে এখন অনেক সচেতন। সম্প্রতি জানতে পেরেছি, মারুফ বিয়ে করেছে আর বর্তমানে সে ৭ মাসের এক ছেলের জনক। মারুফের গল্প এই পর্যন্তই।
ঘৃণায় মনটা বিষিয়ে গেল। হাফেজী পড়া বা মাদ্রাসা’র উপরে না। বরং এই সমকামী জঘন্য লোকগুলার উপরে। দুই একজন খারাপ বলে সবাইকে এক পাল্লায় বিচার করবেন না। শুধু মাদ্রাসার ওস্তাদরাই খারাপ, আর বাকীরা ধোয়া তুলসীপাতা সেটা ভাববেন না। যে খারাপ সে সব জায়গাতেই খারাপ। আমাদের দরকার আমাদের ছেলেমেয়ের প্রতি বাড়তি সচেতনতা যেটা আমাদের দেশের অধিকাংশ বাবা মায়ের নেই। আসুন আমরা আমাদের সন্তানদের দিকে বাড়তি নজর কেউ যেন কোন কালো ছায়া আমাদের সন্তানদের গ্রাস করে নিতে না পারে।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।