বিরাশি সিক্কা ওজনের চড় খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে ছেলেটি বাসের গায়ে ঠাস করে মাথায় বাড়ি খায়। টলতে টলতে সে নিচে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়, অমনি দশাসই লোকটা খপ করে ছেলেটির শার্টের কলার চেপে ধরে তার চৈত্রের ঠনঠনে মাটির মতো চোয়ালে সিনেমা স্টাইলের একটি ঢিসুম বসিয়ে দেয়। এতে তার কয়টি দাঁত ভাঙলো তা জানা না গেলেও তার ঠোঁট উপচিয়ে একটি কালচে তরল ধারা গড়িয়ে পড়ে। একই সঙ্গে সে ‘ও মাগো’ বলে গগনবিদারী আর্তনাদ করে ওঠে।
হঠাৎ তখনই কোথা থেকে দুটি হায়েনা টাইপের বিটলা যুবক হি হি করে জটলার ভেতর ঢুকে পড়ে। জটলা বড় না হলেও জটপাকানো গাড়ির ফাঁকফোকর গলে চলা উৎসুক কয়েকজন পথচারী ঘটনা কী ঘটেছে তা দেখতে অকুস্থলের দিকে এগিয়ে এসেছিল। যুবক দুটি এসেই বলা নেই কওয়া নেই হালুম করে ওই দাঁতভাঙা ছোকরার পিঠের ওপর দুমদুম করে কয়েক ঘা বসিয়ে দেয়। তারপরই দশাসই লোকটির দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘কী হইছে ভাই?’
দশাসই লোকটা হাত ঘুরিয়ে বলে, ‘কী আরে হবে? শালার পুত ছিনতাইকারী, ভদ্রমহিলার মোবাইলটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিছে।’
তখন একটা ছেলে ছিনতাইকারীর পায়ের নিচ একটা স্যামসাং মোবাইল ফোন উঠিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘এই ফোন নাকি? নিচে পাইলাম।’
বাসের জানালা দিয়ে মাথা বের করে তখন এক সুন্দরী তরুণী ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে, ‘এইটা, এইটাই আমার ফোন।’
ছেলেটি হাত বাড়িয়ে মেয়েটিকে ফোন দিতে চাইলে হায়েনার মতো যুবকদু'টি হৈ হৈ করে ওঠে, ‘আরে থামেন থামেন। ফোনটা দেখান তো।’ একথা বলে ওদের দুজনের একজন ছেলেটির হাত থেকে ফোনটি কেড়ে নিতে চায়। কিন্তু ছেলেটি ওদের হাতে ফোন না দিয়ে মেয়েটির হাতে তা ছেড়ে দিয়ে হাঁপমুক্ত হয়।
তখন দশাসই লোকটি খেপে গিয়ে বলে, ‘ফোন দেখার কী আছে? যার ফোন সে-ই দেখবে। এখন এই শালার কী করা যায় সেইটা দেখেন।’
হায়েনামুখো একজন তখন গর্দান ঝাঁকি দিয়ে বলে, ‘আরে মিয়া, এইডা কেমন কথা! ফোন টুকাইয়া পাইলেন রাস্তা থেইকা, আর বিনা কারণে একটা পোলারে পিডাইয়া নাকমুখ ফাটাইয়া দিলেন। আমরা আইসাও পিডাইলাম। এইডা কি ঠিক অইছে?’
শুধু দশাসই লোকটি কেন ঢাকার যানবাহনে-চড়া প্রত্যেক লোকই রাস্তার চোরছ্যাঁচড় আর ছিনতাইকারীদের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। তাই বাসে চলার সময় সবাই মোবাইল ফোন সাবধানে ব্যবহার করে। একটু বেখেয়াল হলেই চোরাই গ্যাংগের ছোকরারা এসে খপ করে ফোন নিয়ে দৌড় লাগায়। সবাই এও জানে যে ওরা দলবদ্ধ হয়েই চুরিচামারি করে এবং প্রয়োজনে মারামারি করে তাদের দলের ছেলেদের রক্ষা করে।
দশাসই লোকটিরও বুঝতে বাকি থাকে না যে হায়েনামুখো দুটিও এই মোবাইল-চোরচক্রের সহকর্মী কিংবা নেতা। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে মোটা গা-গতরই যথেষ্ট নয়। তাই বিচার-সালিশির কোনো কথা না তুলে গা বাঁচিয়ে কেটে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ। লোকটি তখন বলে, ‘আরে মিয়া, আমিই তো তারে হাতেনাতে ধরলাম। থাপ্পড় দিছি, আর অমনি ফোনটা নিচে ফেলে দিছে।’
জটলার ভেতর থেকে একজন লোক দশাসই লোকটার পক্ষ নিয়ে বলে, ‘আরে মিয়া, আমরাও তো দেখছি। আপনারা কোথা থেকে আইসা মাতব্বর সাইজ্জা গেছেন।’ অন্য একজন বলে, ‘এই শালার পুতেরে আরও পিডানো দরকার।’
হায়েনামুখো দু’জন বুঝতে পারে এখানে প্যাঁচ লাগিয়ে সুবিধা হবে না। তারা তাই কৌশল করে মোবাইলচোরকে আরও দু’ঘা লাগিয়ে ঠেলতে ঠেলতে ভিড়ের বাইরে নিতে নিতে চেঁচাতে থাকে, ‘খানকির পুত, চল তোরে পুলিশে দিমু।’
ফোনটি ফেরত পেয়ে বাসযাত্রী সুন্দরী মেয়েটি, যার নাম চপলা, বড় করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে কারওয়ান বাজার থেকে মোহাম্মদপুরের বাসে চড়েছিল এবং ভাগ্যক্রমে এক মহিলার পাশে সিটও পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জটের মধ্যে সাঁতার কাটতে কাটতে কুড়ি মিনিট পরে বাসটি ফার্মগেটে এসে থামে। আর ফার্মগেটই টানা-পার্টির স্বর্গরাজ্য।
চপলার ঘোর কাটতে হঠাৎ তার মনে হলো, আরে, যে লোকটার সাহায্যে সে তার ফোনটি ফেরত পেলো তাকে তো একটা ধন্যবাদ দেয়া হয়নি। সে তড়িঘড়ি করে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখে সেই দশাসই ভদ্রলোকটি নেই। শুধু তাই নয়, মোবাইলচোরকে কেন্দ্র করে যে লোকজনের যে হল্লা জমেছিল তা-ও ইতিমধ্যে জনস্রোতে মিশে গেছে।
ইন্দিরা রোডের গলদঘর্ম লোকগুলো ঠেলেঠুলে পথ করে নিলেও চার চাকার গাড়িগুলো নড়ছেই না। বাসের যাত্রীরা চেঁচামেচি, খিস্তিখেউড় থামিয়ে ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে এবং বসে আছে। বাসের পেছনের ফ্যানটি চলছে না বলে কিছুক্ষণ আগে যে যাত্রীটি ড্রাইভারের চোদ্দগোষ্টী উদ্ধার করেছিল সেও নিরুপায় হয়ে বাসের হাতল ধরে ঢুলছে।
এই অচলাবস্থার মধ্যে বাসের পেছন দিকে হঠাৎ আবার শোরগোল শোনা গেল। চপলার মনে হলো, আবার হয়তো কারুর ফোনে ছোবল মেরেছে চোরেরা। কিন্তু না, ফাটাফাটি চিৎকার শুনে মনে হচ্ছে এ চুরির ব্যাপার নয়; অন্যকিছু।
বাসের ড্রাইভার গলা বের করে ঘটনা পরখ করে কর্কশ কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘সুঁই ফেলাইবার জাগা নাই, খানকির পুত উইড়া যাইবার চায়! ওর পাছা দিয়া রিস্কা ঢুকায়া দে।’
ড্রাইভারের খিস্তিতে ঘেন্না ধরলেও চপলা ব্যাপারটা জানার জন্য কৌতূহলী হয়। সেও সাবধানে জানালার বাইরে মাথা গলিয়ে পেছন দিকে তাকায়।
দোষটা ব্যাটারিচালিত রিক্সার হলেও ধ্বস্তাধস্তিটা দ্বিপক্ষীয় হয়ে পড়েছে। দুহাতের মতো জায়গা ফাঁক পেয়ে ওই রিকশাওয়ালা লাফ দিয়ে এসে একটি ঝা-চকচক প্রাইভেট কারের গায়ে ধাক্কা দেয়। আর যায় কোথায়! এক ঝটকায় দরজা খুলে কারের ড্রাইভার রাস্তায় নেমে রিকশাওয়ালার গলার গামছা চেপে ধরে।
রিকশাওয়ালাও কম যায় না; সেও কেউটের মতো ঘাড় ফুলিয়ে ফোঁস করে ওঠে। কারের ড্রাইভারকে সে পেটানো দুহাতের ধাক্কায় হটিয়ে দিয়ে গলা ফাটিয়ে হুঙ্কার দেয়, ‘অ্যাই মিয়া, গায়ে হাত দিছো ক্যান? তোমার গাড়ির কুনু ক্ষতি অইছে?’
প্রাইভেট কারের পেছনের সিট থেকে নেমে ততক্ষণে মধ্যবয়সী কর্তা দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে তার ড্রাইভারের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। রিকশাওয়ালার উগ্রতা দেখে তিনিও রিকশাওয়ালার দিকে তেড়ে যান। খেপে গিয়ে তিনি বলেন, ‘চুপ কর ইতরের বাচ্চা; তুই কি আমার গাড়ির উপর দিয়া রিক্সা চালায় নিয়া যাবি?’
মুহূর্তের মধ্যে জটের মধ্য থেকে আরও চার-পাঁচজন রিকশাওয়ালা এসে জড় হয়ে যায়। এদের একজন নিজের শার্টের কলার ডানেবায়ে টানাটানি করতে করতে গাড়ির মালিকের চোখে চোখ রেখে হুঙ্কার দিয়ে বলে, ‘গালি দ্যান কা? গাড়ির মালিক হইতে পারেন, রাস্তার মালিক তো হোন নাই।’
কারের ড্রাইভার মোবাইল ফোনের লাইট দিয়ে তার গাড়ির ব্যাকলাইটের আশপাশ খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে রিকশাওয়ালাকে বকে যাচ্ছিল। তখনই অভিযুক্ত রিকশাওয়ালা ছুটে এসে কারড্রাইভারকে কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে বলে ‘পাইছো? কিছু পাইছো?’
রিকশাওয়ালাদের সম্মিলিত আক্রমণে কারড্রাইভারের ভড়কে যাওয়ারই কথা। সে সাহস করে কিছু বলবার আগে মালিকের সহযোগিতার জন্য পেছন ফিরে তাকায়। কিন্তু মালিক অবস্থা বেগতিক দেখে ইতিমধ্যে গাড়িতে উঠে পড়েছেন। কিছু একটা না-বলা অসম্মানের ব্যাপার হয় ভেবে কার-ড্রাইভার কণ্ঠ নামিয়ে সমবেত মারমুখী রিকশাওয়ালাদের উদ্দেশে বলে, ‘আচ্ছা তোমরা কও, আধাঘণ্টা ধইরা জ্যামে আটকাইয়া রইছি, ডাইনে-বামে কাইত অইবার পারতাছি না; এর মইদ্যে সে আইসা ঠেইলা-ঠুইলা আমার গাড়িতে বাজাইয়া দিল!’
কথা বাড়ালে পরিস্থিতি যে ঘোলাটে হয়ে যাবে এটা বুঝতে পেরে জটে আটকানো পেছনের একটি প্রাইভেট কারের বয়স্ক ড্রাইভার নেমে এসে দুই পক্ষের মাঝামাঝি দাঁড়ায়। সে বলে, ‘অ্যাই মিয়ারা ক্যাচাল কইরো না; একটু ধৈর্য ধরো। গরমে এমনিতেই সবার মাথা গরম। আর খেচাখেচি বাদ দেও। যাও, যাও। কথা বাড়াইও না।’
চপলা এতক্ষণ ধৈর্য ধরে জানালার বাইরে বারবার মাথা গলিয়ে ঘটনাপ্রবাহ নিরীক্ষণ করছিল। হঠাৎ তার খেয়াল হলো রাত তো অনেক হয়েছে। হাতঘড়ি এখন কেউ বেশি একটা ব্যবহার করে না; চপলার হাতেও ঘড়ি নেই। সে তার পার্স থেকে মোবাইল ফোন বের করে দেখে, ওমা, রাত প্রায় ন’টা। সে টাচস্ক্রীন ঘষে দেখে মা দু’বার ফোন দিয়েছেন, সুমন তিনবার। হট্টগোলের মধ্যে সে বুঝতে পারেনি কখন ফোন এসেছিল।
ঝটপট মাকে ফোন করে যানজটের কথা বুঝিয়ে বলতে না বলতেই মাঝখানে ঢুকে পড়ে সুমনের কল। চপলা ‘স্মরি’ বলে ফোন ধরতেই খেপে ওঠে সুমন, ‘কীসের স্মরি?’
চপলা বলে, ‘আরে বাবা, এতো খেপছো কেন? আগে শোনো…’
‘কী শুনবো?’ সুমন দমে না, ‘তুমি না বলেছিলে আটটার মধ্যে চলে আসবে; ফোনটা পর্যন্ত ধরো না।’
চপলা আবারও ঠাণ্ডা গলায় বলে, ‘আরে, বুঝতে চেষ্টা করো, আমি তো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি।’
সুমন বলে, ‘বুঝলাম প্রাইভেট, কিন্তু তুমি তো আর সাংবাদিক নও যে ইমার্জেন্সিতে দৌড়াতে হবে; অ্যাডমিনে কাজ কর। তোমার দেরি হবে কেন?’
সুমনের সাথে কথা বলতে বলতে চপলা বুঝতে পারে যানজট একটু ঢিলে হতে শুরু করেছে। তাছাড়া যাত্রীভর্তি বাসে বসে ফোনে ঝগড়া করতে তার লজ্জাও করছে। তাই সে কথা সংক্ষেপ করার জন্য বলে, ‘তুমি এখন কোথায় আছ?’
‘কোথায় আবার? সন্ধ্যা থেকে বসে আছি সংসদভবনের সামনে’, সুমন জবাব দেয়।
জট খুলেছে। গাড়ির হর্নের প্যাঁ-পোঁ আওয়াজে কান ঝালাপালা হয়ে উঠছে। চপলা চেঁচিয়ে সুমনকে জানায়, ‘শোনো, আমি ফার্মগেটে এতক্ষণ জ্যামে আটকা ছিলাম; এখন জট খুলেছে। আমি কি নামবো?’
গাড়ির শব্দে সুমনের উত্তর আর শোনা যায়। ঘোঁত-ঘোঁত শব্দে সবগুলো যানবাহন কে কার আগে যাবে সে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। চপলা ফোন রেখে দিয়ে শক্ত করে সিটে চেপে বসে। সবগুলো গাড়ি ডান-বা করে উন্মাদের মতো সামনে এগোচ্ছে। যাত্রীবাহী বাসগুলো গায়ে গায়ে লাগিয়ে পড়িমরি করে ছুটছে। মোটরসাইকেলগুলো অধিক দুরন্তপনা করছে। অল্প ফাঁক পেলেই ওরা মাথা ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
মানিক মিয়া এভেন্যুর গোলচত্বর পর্যন্ত যেতেই হুড়োহুড়ি আরও বেড়ে যায়। কেউ যাবে আসাদ গেটের দিকে মানিক মিয়া এভেন্যু হয়ে, বাকিরা ডানদিকে মোড় নিয়ে মিরপুর অভিমুখে।
চপলা ভেবেছিল এখানেই নেমে পড়বে, কিন্তু গাড়ির গুঁতোগুঁতির মুখে সেই সুযোগ নেই। একটু সামনে গিয়ে গাড়ি ব্রেক করলে সে যাতে নেমে যেতে পারে সেজন্য যেই প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে অমনি সামনের দিকে একটি দ্রিম শব্দ শুনতে পায়। একই সময়ে বাসের ড্রাইভারও কিচ কিচ শব্দে জোরে ব্রেক কষে। যাত্রীরা চিৎকার করে হুমড়ি খেয়ে সামনের দিকে পড়ে। অনেকের মতো চপলাও মাথায় ব্যথা পায়। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভয় পায় ‘কী হলো’ সে কথা ভেবে।
পরমুহূর্তেই তরুণ তুর্কির একটি দল মারমুখো হয়ে বাসের দিকে ছুটে আসে। ওরা দুটি মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে হৈচৈ করে কোথাও যাচ্ছিল। একটার পেছনে বাসের ধাক্কা লাগতেই উড়ে গিয়ে রাস্তায় পড়ে। মারাত্মক কিছু না ঘটলেও হাত-পা ছড়ে যাওয়ার কথা।
বাইকারদের মধ্য থেকে মোটাতাজা একজন যখন বাসের ড্রাইভারকে চড়-থাপ্পড় দিচ্ছিল, বাকিরা তখন বাসের জানালার ভঙ্গুর গ্লাসগুলি ঠুনকো আঘাতে ঝুরঝুর করে ভেঙ্গে ফেলতে থাকে। এসবের মধ্যেই হুড়মুড় করে অধিকাংশ যাত্রী বাস থেকে নেমে নিজেদের গা বাঁচানোর জন্য চম্পট দেয়। অপেক্ষাকৃত কম বয়সী কয়েকজন মহিলাও তাদের অনুসরণ করে। চপলাও হয়তো তাই করতো, কিন্তু তার আগেই একটা ভাঙ্গা কাঁচের টুকরা ছুটে এসে তার কপালে পড়ে। নিজেকে সামলাবার আগেই সে বুঝতে পারে একটি ক্ষীণ রক্তের ধারা গাল বেয়ে নেমে তার জামাকাপড় ভিজিয়ে দিচ্ছে। এ অবস্থা দেখে তার পাশের সিটের মহিলা-যাত্রীরা বিকট চিৎকার করে উঠলে চপলা ঘাবড়ে যায়।
অন্য কোনো যাত্রীর গায়ে আঘাত লাগলেও লাগতে পারে, কিন্তু চপলার ক্ষতই সবার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। যুবা গোছের দু’তিনজন যাত্রী কিংবা বহিরাগত সহমর্মী হৈ হৈ করে চপলার কাছে ছুটে এলে সে তাদের সাহায্য নিতে অনীহা জানায়। ততোক্ষণে সে ওড়না দিয়ে কপালের ক্ষতস্থানে চেপে ধরেছে। পুলিশের একজন সার্জেন্ট জানালার পাশ থেকে ডেকে বলে, ‘ম্যাডাম, নামেন, আপনাকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করি।
পুলিশ এসে হস্তক্ষেপ করাতে বাইকাররা দ্রুতগতিতে রণক্ষেত্র ত্যাগ করে ঠিকই, কিন্তু বাসটিকে রাস্তার পাশে নিয়ে থামিয়ে দেয়। অগত্যা যাত্রীরা ড্রাইভারকে গালাগালি করতে করতে বাস থেকে নেমে যায়। চপলা অনেকটা স্থির হয়ে দাঁড়ালেও পুলিশের সার্জেন্ট আবার এসে তাকে জিজ্ঞেস করে যে ফার্স্ট এইডের জন্য পাশাপাশি কোনো ডাক্তারখানায় তাকে নিয়ে যাবে কি না।
চপলা পুলিশকে ধন্যবাদ দিয়ে বলে, ‘আমার লোক আসবে। অসুবিধা নেই, আমরাই ব্যবস্থা করব।’ বলে, সুমনকে ফোন করার জন্য সে ফোনসেটটি হাতে নেয়। তখনও তার কপাল থেকে সিঁদুর-রঙা রক্ত চুইয়ে পড়ছিল।
ফোন বের করে সুমনের নম্বরে যেই চাপ দিতে যাবে তখনই অতর্কিতে কেউ একজন এসে চপলার দুই কাঁধ চেপে ধরে। চপলা ভয়ে কেঁপে উঠে তাকিয়ে দেখে ও ভীত-সন্ত্রস্ত সুমন। ট্রাফিক জ্যামের কথা শুনে চপলাকে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে সে ইন্দিরা রোডের দিকে এগিয়ে এসেছিল।
সুমন এত ঘনিষ্ঠ হয়ে চপলার কপালের দিকে তাকিয়ে বলে ‘আর কোথাও লাগেনি তো?’ যে চপলা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। সে মুখে কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ে।
সুমন বলে, ‘বেশ কেটেছে; স্টিচ লাগতে পারে। তাড়াতাড়ি মোটরসাইকেলে ওঠো।’
চপলা মৃদুকণ্ঠে বলে, ‘রাগ কি এখনও আছে?’
মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে সুমন রগড় করে বলে, ‘কপালে সিঁদুর লাগিয়ে বসে আছ, আর তো রাগ করা যায় না।’