ইসলাম ও তবলিগ--
* প্রথমে নিজেকে জানুন তারপর অপরকে জানান। নিজেকে ভালভাবে জানতে না পারলে অপরকে জানানো সম্ভব নয়। আমি কে? আগে আমার আমিকে জানতে হবে। প্রথমত--আমি একজন মানুষ। দ্বিতীয়ত--আমি জাতিগতভাবে যাই-ই হই, একজন সাধারণ। তৃতীয়ত--আমি কোন নবিরসূল বা পীরমুর্শিদ ও আওলিয়াবুজুর্গু এমন তপস্বী মহাপুরুষও নই। তা হলে মনে রাখতে হবে, আমার প্রতি কোন প্রত্যাদেশ (ওহি) নাজিল হবে না এবং কোন স্বপ্নযোগেও এমন কিছু আদেশপ্রাপ্ত হওয়ার নয়। তবে? এক দিন, দুই দিন, তিন দিন, সাত দিন, পনের দিন, এক মাস--চার-ছয় ও বছরের জন্যে গাঁট্টিগাঁঠুরি বেঁধে কোন্ ধর্ম প্রচার-প্রসারে আমি বের হচ্ছি! ইসলাম চৌদ্দশ বছরপূর্বে নবি মুহাম্মদ (স) প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। আর প্রথম থেকে আল্লাহ্য় ইসলামকে প্রসারিত করে আসছেন এবং শেষ পর্যন্ত করে যাবেন। যুগেযুগে--এক-এক সময় এক-এক প্রতিনিধির (খলিফা) মাধ্যমে প্রচার করে আসছেন। তাঁদের কর্মকাণ্ড এতই অনুসরণীয় যে, বলার শেষ নেই। দীন-বেদীন তাঁদের মধ্যে ভেদাভেদ ছিল না। তাঁদের এমন মহত্ত্বের মনোভাব দেখে বেদীনরা দলেদলে দীনে এসেছেন। এটাই ইসলামের মৌলিকতা এবং এটাই ইসলামের মূলনীতি। ইসলাম জোরের ধর্ম নয়। দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও রক্তারক্তি ইসলামে নিষিদ্ধ।
আল্লাহ্ সুবাহানুতালা (মহা ক্ষমতাবান) ইচ্ছে করলে গোটা পৃথিবীকে ইসলামে পরিপূর্ণ করতে পারেন। কিন্তু না, তিনি তা করবেন না। কারণ, অন্ধকে চক্ষু দিতে নেই, খুঁড়াকে সচল করতে নেই। সকলে পরিপূর্ণতা লাভ করলে সাত দোযখের আধার কে হবে। তাই আমার মতো ভুঁইফোঁড় নতুন করে ইসলামকে জাগরিত করার দরকার নেই। ইসলাম কখনো ঘুমিয়ে যায়নি এবং কেয়ামত তক ঘুমাবে না। ইসলামের কখনো মৃত্যু নেই। কারণ ইসলাম আল্লাহ্র মনোনিত পথ। ইসলামকে একমাত্র আল্লাহ্য় রক্ষা করে আসছে এবং করবে, প্রচার ও প্রসার ঘটাচ্ছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত ঘটাবে। যতক্ষণনা আল্লাহ্য় চায়, ততক্ষণ তুমি আমি কেউই হাজার চেষ্টা করেও কোনকিছুতে একরত্তি পরিবর্তন আনতে পারব না এবং একধুল-পরিমাণ ক্ষতিও করতে পারব না। সমস্ত কিছুই আল্লাহ্র হাতে ধৃত এবং রক্ষিত।
দাওয়াত (নিমন্ত্রণ) আমি এমন দাওয়াত না করে বোধহয় আমি নিজেই আল্লাহ্র দাওয়াতি (নিমন্ত্রিত) হওয়া নিশ্চয় আমার জন্যে উত্তম। কারণ দাওতের জন্যে আল্লাহ্ আমাকে মনোনিত করেননি। একাজ নবিরসূলদের পর সাহাবিদের তারপর ওলি গওস কুতুব আবদাল মুর্শিদ ইত্যাদির মারফতে এখন আলেমওলামাদের হাতে। তাঁদের ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে সমাজের কলুষিত দূর করা সম্ভব এবং ইসলামের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। আর এটার জন্যে ছোটবড় সম্মেলন (অন্তত বার্ষিক) হওয়া দরকার। যা আমাদের উদ্যোগ নেই। আমার মতো সাধারণের কাছে এই হিকমত নেই। তাই আমার জন্যে এটা করণীয় নয়। বরংচে আমি আমার নিজের জন্যে আল্লাহ্র সমস্ত আহকাম (আদেশ) নীরবে নিশ্চুপে পালন করে যেতে পারলেই মনে করতে হবে আমার জিন্দেগি সার্থক।
হাশরের ময়দানে শুধু ‘ইয়ানাফসি’ ‘ইয়ানাফসি’ (হায় আমার কী হবে...) জপন নয়। দুনিয়াতেও ‘ইয়ানাফসি’র জিকির করা দরকার। লাঠালাঠি ছোরাছুরি ইসলামের আহকাম (বিধানসমূহ) নয়। এদল-ওদল দলেদলে দল গঠন করে এক ইসলামকে বহুতে বিভক্ত করা কোরআন-হাদিসের নির্দেশ নয়। প্রকৃত মুসলমান (ইমানদার) সে কখনো হতে পারে না, যে কাউকে কষ্ট দেয় এবং কারও কষ্টের লাঘব নয়। ‘ইসলাম’ ‘ইসলাম’ করে শুধু জান দিলে মুসলিম না, প্রকৃত মুসলিম সে, যে হিংসাবিদ্বেষ ভুলে সমস্ত জীবের প্রতি দরদি হয়।
ইসলামে আহ্বানের সবচেয়ে বড় মাধ্যম আযান। যা আমরা দৈনিক পাঁচবার, পাঁচ ওয়াক্ত শোনতে পাই। এমন মধুর আহ্বানে যাঁরা সাড়া দিচ্ছে তাঁরাই মুমিন। তাঁদেরও ভুলত্রুটি হবে না এমনটাও নয় তবে ক্ষমাপ্রার্থনা আল্লাহ্র কাছে অতীব প্রিয়। যারা সাড়া দিচ্ছে না তারাই পথভ্রষ্ট। তাদের বিচারের গুরুভারেও আছে একমাত্র আল্লাহ্। আল্লাহ্য় যাকে হেদায়েত দান করেন না, তাকে কোন মহামানবই হেদায়েত দিতে পারেন না। এই হেকমত একমাত্র আল্লাহ্র আছে। হাঁ, বড় বড় মাহফিল এবং ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে ইসলামকে আরও ছড়িয়ে দেওয়া যায় এবং অনেককে উদ্বুদ্ধ করা যায়। অথচ আমরা এই সৌন্দর্য কাজটা না করে--করছি বিশ্রীটা।
‘তবলিগ’ কথাটাতে খুব ‘তকলিফ’। এটা নবির আদর্শের মধ্যে কতটুকু চলছে জানি না, তবে এমন তবলিগ বোধহয় নবিজি করেননি। কারণ, যুগেযুগে নবিদেরকে পাঠানো হয়েছে সৌন্দর্য বর্ধন করতে এবং সত্য প্রতিষ্ঠা করতে--নষ্ট করতে নয়। তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যা পেরেছেন এবং যতটুকুই পেরেছেন করেই গেছেন। তাঁদের অবদান অপরিসীম। তাঁদেরকে সব সময় তসলিম। তাঁরা আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁদের মধ্যে অন্যতম মহানবি মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্যের মালিক। তিনি তবলিগ করেছেন আল্লাহ্র ইশারায়। সাহাবিদের নিয়ে দূরদূরান্তে গিয়েছেন। সেখানে খাইমা (শিবির) গেড়ে ইসলামের ডঙ্কা বাজিয়েছেন। বেদীনদের দীনে এনেছেন। রাস্তাঘাটে কোনেক মুসলিমকে ধরে ধরে, চুপিচুপি, কানেকানে দুই-চারজন মিলে মিলে, কারও ঘরে ঘরে গিয়ে গিয়ে (বিশেষ করে মুসলিমের) মসজিদে মসজিদে খেয়েনেয়ে-ঘুমিয়ে এবং মসজিদে মসজিদে আলাপ-আলোচনা করে এভাবে বোধহয় নয়। এই তবলিগি ইলিয়াছি তবলিগ হতে পারে--নবির নয়। কারণ, তিনটি কারণে মসজিদে ঘুমানো যায়। এক. এতেকাফের নিয়তে। দুই. কোন বিপদ-আপদে। তিন. মুসাফির হলে। অন্যথা মসজিদে ঘুমানো এবং আলাপ-আলোচনা মিটিংসিটিং মোটেও জায়েজ নেই। এটা ইসলামের বরখেলাপ। মসজিদ এবাদতের জায়গা, কোরআন-হাদিস পাঠের জায়গা, কোন আড্ডার কাছারি নয়। ওসব নাইবা হল মন্দ। তবে মোদ্দা কথা হল, এসব বিবাহিত-অবিবাহিত যুবকেরা এবাদতখানায় (মসজিদে) ঘুমানো ও রাত কাটানো কতটুকু যৌক্তিক আমাদের বুদ্ধির অতীত!
ইসলাম শান্তির ধর্ম। সত্য ও সুন্দর ইসলামের বৈশিষ্ট্য। কোন বিশ্রী স্বভাব ইসলামের মধ্যে নেই। কে (মুসলিম) মসজিদ থেকে বের হল অথবা মসজিদে এল। কে (মুসলিম) অফিস-আদালতে বা হাটবাজারে যাচ্ছে। কে (মুসলিম) টাট্টিতে দৌড়ছে অথবা আসছে। কে (মুসলিম) পেটের দায়ে জীবিকানির্বাহে বা ব্যবসায়ী-কাজে বের হচ্ছে কিবা ফিরছে তাঁকে ধরে নসিহত করলাম--এই তবলিগি ভুল।
একজন মুসলিম ঘরেবাইরে হাটেমাঠে খেতখামারে যখন যেখানে পারছে আল্লাহ্র এবাদত (নামাজ) আদায় করে যাচ্ছে। কারণ, পরকালে বিশ্বাস, হাশরনশর, বেহেশত-দোযখ শাস্তির ভয় একজন (মুমিন) মুসলমানের আছে। তাই কোন মুসলমান (মুমিন) গাফেল হতে পারে না। যারা গাফেল তাদেরকে বুঝালেও বুঝবে না। কারণ আল্লাহ্র সিলমোহর কোন গাজির পক্ষেও উঠানো সম্ভব না। আল্লাহ্ স্বয়ং যেখানে নিষেধ করেছেন, জমিনে (ফাসাদ) অশান্তি সৃষ্টি করো না। তা হলে, এসব রক্তারক্তি খুনখারাবি কেন? কোন্ শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে? ইসলাম শান্তির ধর্ম, ভালবাসার ধর্ম, একে অপরের প্রতি সহানুভূতি ও সৌহার্দপূর্ণ ভ্রাতৃভাব বজায় রাখার এবং গড়ে তোলার ধর্ম। তবে? প্রায় দেড়শ কোটি মুসলমানের এই ইসলামকে আজ বিরাট অশান্তির সন্ত্রাসবাদী (টেররিষ্ট) ধর্ম হিসাবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে! কেন? বড়ই দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ‘বাহাত্তর ফেরকা’ যদিওবা এখনও বাকি আছে, তার ফল আগেই আমাদেরকে ভোগ করে যেতে হচ্ছে! আরও দুঃখ হচ্ছে, আমাদের ভাইবেরাদরেরা উস্কে যাচ্ছে আর এতে যোগ দিচ্ছে!
ইসলামের পাঁচ কলেমা ও পাঁচটি স্তম্ভ (খুঁটি) প্রত্যেক মুসলমানের জানা আছে। ইমান (বিশ্বাস) সর্বপ্রথম খুঁটি। নামাজ রোজা হজ যাকাত সামর্থানুযায়ী করণীয়--বেশ আর কম সকলে পালন করে এবং করতে চেষ্টা করে। ভুল হলে? সেটার হিসেবনিকেশের দায়িত্ব একমাত্র আল্লাহ্র কাছে, পৃথিবীর কোন ইনসানের কাছে নয়। আমি কোন্ মসিহ বা ফেরেশতা--ভুলের সংশোধনকারী! আমার নিজের স্থান কোথায়--কোন্ জাহান্নাম আমি নিজেও ত তা জানি না! চলছি অন্যকে হেদায়েত দিতে! আসলে মানুষ নিজে নিজেকেই মনে করে সঠিক--অন্যরা ভুল।
চলবে...