মোটরসাইকেলের পেছনে যাত্রী হিসেবে যে মেয়েটিকে শোভা পাচ্ছে,তাকে আমার চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কে? ফারজানা নয়তো?সন্দেহ দুর করতে গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে ভাল করে দেখে নিলাম। ট্রাফিক সিগনাল স্থিরতায় আমার সন্দেহ সম্পূর্ণরূপে দুর হয়ে গেল।আমি শতভাগ নিশ্চিত এ ফারজানা।
সামনে বসা যুবকটিকে ফারজানা শক্ত করে ধরে আছে। ফারজানার বুক আর যুবকটির পিঠের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই।হয়তো এ যুবকটির নির্দেশ শক্ত করে ধর নয়তো পড়ে যাবে।অথবা এ ফারজানারই ইচ্ছা।যুবকটিকে চেনার চেষ্টা করি কিন্তু লাভ হচ্ছেনা।কখনো একে দেখিনি।আমি ঘামতে শুরু করি।আমি আমার শার্টের বোতাম খুলতে ভুলে যাই।
দুই মাস ধরে ফারজানার সঙ্গে আমার তেমন কোন যোগাযোগ নেই।আমি ঢাকায় আসার পর থেকে আমাদের বেশির ভাগ যোগাযোগ হতো চিঠিতে।মাসে ফারজানার দুটি করে চিঠি পেতাম আমিও দুটি করেই লিখতাম।পড়াশোনার চাপে অথবা ইচ্ছে করেই পরপর ফারজানার দুটি চিঠির উত্তর আমি লিখিনি। পরপর দুটি চিঠির উত্তর না পেয়ে ফারজানাও বোধ হয় চিঠি লেখা বন্ধ করে দিয়েছে।বড় অভিমানী মেয়ে ফারজানা।একবার অভিমান করলে হাত ধরে ইনিয়ে বিনিয়ে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত তার অভিমান ভাঙবে না।
ফারজানাদের বাড়িতে আমার পরিচয় লজিং মাস্টার হিসেবে।ওর ভাইকে পড়াতাম।ওদের বাড়িতে আমার প্রথম ঢোকা এস.এস.সি পরীক্ষার কিছুদিন আগে।তারপর এস.এসসি এবং এইচএসসি ওদের বাড়িতে থেকেই পাস করেছি।ফারজানাও আমার সঙ্গে পড়ত।ভিন্ন স্কুল থেকে এস.এস.সি পাস করেছি কিন্তু কলেজ জীবনের দুটি বছর আমরা এক সঙ্গে কাটিয়েছি।খুব সাহসী এবং দুষ্টু স্বভাবের মেয়ে ফারজানা।যখন তখন যে কারো মুখের উপর যাতা বলে ফেলত।আমি অবশ্য ছোট বেলা থেকেই সামান্য ভীতু লাজুক টাইপের ছিলাম।সঙ্গত কারণেই প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিজে থেকে ওর সঙ্গে কখনো কথা বলতাম না।
লক্ষ করলাম ফারজানা ইদানীং আমার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছে।মেয়েদের আগ্রহ অনাগ্রহের কথা খুব সহজে বোঝা না গেলেও কেন জানি আমার প্রতি ফারজানার আগ্রহের কথা খুব সহজেই বুঝে ফেললাম।
একদিন দুপুরে খাওয়ার পরে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম।ফারজানা এসে আমাকে বলল,মাস্টার সাহেব আমাকে একটা অংক দেখিয়ে দেবেন?
ফারজানা আমাকে মাস্টার সাহেব বলেই ডাকত।বললাম, হ্যাঁ দেখিয়ে দেব।
আমি তাকে অংক বোঝাচ্ছি।আর সে হু,হু করছে।এক সময় লক্ষ করলাম ও শুধু মুখে হু হু করছে।ওর মন অন্যদিকে।কি যেন ভাবছে।
বললাম,ফারজানা,এক যোগ এক সমান সমান তিন না?
ফারজানা বলল,হু।
কি এক আর এক তিন?
ফারজানা মুচকি হাসল।বলল,আপনিই তো বললেন,যান আপনার কাছে আমি পড়ব না।
দেখেছ কাণ্ড!মেয়েটা আমাকে অংক বুঝিয়ে দিতে বলে আমার সামনে বসে কি যেন ভাবছে।সে কথা বললাম বলে আমার কাছে আর পড়বে না।ফারজানা আমাকে ভাবিয়ে তুলল।
এভাবে হটাৎ উপস্থিত হয়ে উদ্ভট সব কাণ্ড করে আমাকে চমকে দিত ফারজানা।একবার করল কি- একমনে বসে পড়া তৈরি করছি অথবা কিছু একটা করছি,হটাৎ পেছন দিয়ে উপসি্থত হয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বিকট শব্দে বলে উঠল,টু...উ।
চমকে পেছন ফিরে তাকাতেই বলল,কি জনাব ভয় পেয়েছেন?না,না,ভয় পেতে নেই আপনি হলেন গিয়ে পুরুষ মানুষ।পুরুষ মানুষের ভয় পেতে নেই।
কোনরকমে ঢোক গিলেগুলে বললাম,না ভয় পাইনি।
তাহলে একটা ধাঁধাঁ বলি দেখি পারেন কিনা?
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।
যদি পারেন তাহলে বুঝব ভয় পাননি।বলেনতো,আমার সোনার বাংলা_ এর পরের লাইনটা কি?
এটা কোন ধাঁধাঁ হল?এতো চক্ষুহীন ব্যক্তিও পারবে।আর আমি পারবো না এটা কেমন কথা।আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বলে ফেললাম,আমি তোমায় ভালবাসি।
ফারজানার ঠোটে চাপা হাসি।
বললো,সত্যি।
যখন বুঝতে পারলাম দুষ্টুমি করছে,তখন লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল।কোন মেয়েকে সরাসরি আমি তোমায় ভালবাসি বলা চাট্টিখানি কথা নয়। অন্তত আমার কাছে।লজ্জা সরমের একটা ব্যাপার আছেনা।যদিও আজ কালকার যুগে এটা লজ্জা পাওয়ার মত আহামরি কিছু না।
বললাম,দুষ্টুমি করছ?
ফারজানা খিলখিল করে হেসে উঠল।তার হাসি আমাকে মোহিত করে ফেলল।এমন সুন্দর মানুষ হাসতে পারে?এর আগে তো ফারজানাকেও এমন সুন্দর করে হাসতে দেখিনি?আমি অপলক চোখে ফারজানার হাসি দেখতে লাগলাম।সে আমাকে তার হাসি দিয়ে বেধে ফেলল।
সেই যে শুরু ।তারপর আমার পক্ষে আর সে বাধন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।
ফারজানা বলল,জনাব আপনার বয়স কত?
শুধু ফারজানাকে দেখছি।ওকে আজ আমার এত ভাল লাগছে কেন? অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলাম,বিশ।
ফারজানা বলল,আপনি কখনো প্রেম করেছেন?মানে কখনো ভালবেসেছেন কাউকে?
হকচকিয়ে গেলাম।মেয়েটা বলছেটা কি?কোন রকমে ঢোক গিলে বললাম,না।
ফারজানা যেন অবাক হলো এমন ভঙ্গিতে বলল,কি সর্বনাশ!কি সর্বনাশ!বলেন কি?আপনার বয়সেতো ছেলেরা প্রেম করে ডজন পুরায়,আর আপনি,হি..হি...হি....।আপনিতো দেখছি আস্ত একটা হাঁদারাম কিচ্ছু বোঝেন না।প্রেম করবেন মাস্টার সাহেব?
বাকশক্তি হারানোর মত অবস্থা!কি বলবো বুঝে উঠতে পারলাম না।কিন্তু একটা মেয়ের কাছে আমাকে এভাবে হেরে গেলে তো হবে না?তাই নিজেকে সামলে নিয়ে কোনরকমে বললাম,তুমিই তো বললে আমি হাঁদারাম।হাঁদারাম ছেলেদের সঙ্গে কেউ প্রেম করে নাকি?তাহলে আমি কার সঙ্গে প্রেম করবো?
কেন আমার সঙ্গে?
কি?
না,মানে..ইয়ে..আমার এক বান্ধবী আপনাকে মনেমনে খুব পছন্দ করে।আমাকে বলেছে সে কথা জানাতে।তাই জানালাম।আহা বেচারি আপনার সহজ-সরল মুখখানা দেখে একেবারে পাগল হয়ে গেছে।বিশ্বাস না হয় এই দেখুন না আপনাকে একখানা চিঠিও দিয়েছে।
ফারজানা আমার হাতে একটি ভাজ করা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে আবারো খিলখিল হেসে চলে গেল।আমি কাগজটা খুলে পড়তে লাগলাম।
ঐ দূর আকাশে অসংখ্য তারার মাঝে একটি উজ্জ্বল তারাকে তুমি ভেবে বসে ছিলাম মনের জানালর ধারে।বসে আর থাকা হল কই।আমাকে টেনেহিচড়ে নিয়ে গেল ভাবনা রাজ্যের অচীনপুরে। যেখানে বিচরণ শুধু একজনের।সে তুমি।ওহে আমার হৃদয় রাজ্যের মহারাজা আমার ভালবাসা নাও।কেমন আছ তুমি?নিশ্চয়ই ভাল আছ।ভাল থাকবে এটাই কামনা।কিন্তু প্রিয়তম,আমি যে ভাল নেই ।মনের মাঝে শুধু তুমি,তুমি,তুমি এই একটি শব্দ ঝড় তুলেছে।সে ঝড়ে ডানা ভাঙা পাখির মত তোমাকে কাছে পাবার তীব্র বাসনা নিয়ে না মরে বেচে আছি।প্রথম দেখাতেই তুমি আমার মনের ফ্রেমে বন্দি হয়েছ।আমার আলো আধারে শয়নে স্বপনে শুধু তুমি।তোমাকে আমি একটা মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারিনা।মাহবুব আমি তোমাকে ভালবাসি।বড় আশা নিয়ে এ চিঠির আশ্রয় নিলাম।তোমার ভালবাসা পাওয়ার জন্য তৃষ্ণার্ত চাতকের মত পথ চেয়ে রইলাম।আশা করি দ্রুত উত্তর দেবে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে চিঠিটা প্রায় মুখস্থ করে ফেললাম বেশ বুঝতে পারলাম ফারজানাই লিখেছে।কিন্তু ফারজানা আমাকে এমন করে চিঠি লিখতে পারে এটা আমার কল্পনাতীত।ফারজানাকে নিয়ে আকাশ কুসুম ভাবতে লাগলাম।শুনেছি ছেলেরা নাকি প্রেমে পড়লে যা হবার তা ভাবে,আবার যা হবার নয় তাও ভাবে।আমিও ভাবছি।তবে কি ফারজানার প্রেমে পড়ে গেছি?ঠিক বুঝতে পারছি না।কুড়ি,একুশ বছরের জীবনে কেউ কখনো বলেনি ভালবাসার কথা।সেদিন ফারজানার চিঠি পেয়ে আমার যে কি অবস্থা হল তা বলে বোঝাতে পারব না।দরজা বন্ধ করে ঘরের ভেতর শুয়ে চিঠিটা আবারো পড়তে লাগলাম।কি জানি এক অজানা আনন্দে আমার হৃদয় পূর্ণ হয়ে এলো।কি করব ভেবে স্থির করতে পারলাম না।
ওহে হৃদয় হরণকারিণী এক চিঠিতে আমাকে কুপোকাত করে ফেলেছ।আমাকে তোমার মনের খাঁচায় বন্দি পাখি করে ফেলেছ। এখন মুক্তি দাও।নয়ত,কোথায় তুমি সামনে এসে দেখা দাও...।এরকম টাইপ একটা চিঠি আমিও লিখে ফেললাম।অবশেষে এভাবে চিঠিতে দুটি মনের আদান-প্রদান হতে লাগল।
কিন্তু ফারজানা আমাকে ধরা দিলনা আর আমিও তাকে ধরতে পারলামনা।জালে আটকানো মাছের মত ছটফট করতে লাগলাম।আমি যেন নিরুপায়,অসহায়।
তারপর এক চিঠিতে লিখলাম,কোথায় তুমি সামনে এস প্লিজ,দেখা দাও।নইলে মরে যাব।
ব্যস,এটুকুই।
পরের চিঠিতে ফারজানাও লিখল,আজ রাত বারটায় কদম গাছের নিচে এস আমি অপেক্ষা করব।
সেদিন সকাল থেকে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন রাত বারোটা বাজবে।কখন ফারজানা আর আমার লুকোচুরি খেলার অবসান ঘটবে।কখন ফারজানার হাতে হাত রেখে প্রেমালাপ করব।ফারজানা আমার চুলে বিলি কেটে বলবে, মাহবুব আমি তোমাকে ভালবাসি।আমি ফারজানার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ব।ফারজানা তবুও বলতে থাকবে ভালবাসার কথা।যখন রাত পেরিয়ে ভোর হবে, ভোরের আলো আমাদের চোখে লাগবে,তখন আমরা বিরক্ত হব। ধ্যাত,এরাতটা কি আর একটু বড় হতে পারত না?
যখন অপেক্ষার কঠিন প্রহর শেষে ঘড়িতে রাত বারটা বাজল তখন ধরি পায়ে কাঁপা হৃদয়ে কথামতো কদম গাছের নিচে গিয়ে উপস্থিত হলাম।
দেখি ফারজানা দাড়িয়ে আছে।
আমি আস্তে আস্তে ফারজানার মুখোমুখি হলাম।
কি বলে যে কথা বলা শুরু করব তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না।কেন জানি আমার ভয় করছিল বুকের ভেতরের একটা অংশ দপদপ করে লাফাচ্ছিল।ফারজানা স্থির হয়ে দাড়িয়ে ছিল।কোনও কথা বলছিল না।আমি গলা খাকারি দিলাম।
তারপর ভণিতা করে বললাম,ফারজানা তুমি?সে আসেনি বুঝি?আচ্ছা ঠিক আছে আমি তাহলে যাই।
আমি চলে আসতে উদ্যত হলাম।এমন সময় কে যেন পেছন থেকে আমার হাত ধরল।আমি থমকে দাঁড়ালাম।মনে হল যার আসার কথ ছিল সে এসেছে।এতক্ষণ দুষ্টুমি করে লুকিয়েছিল।আমি ঘুর দাঁড়ালাম।আমি আবারো ফারজানার মুখোমুখি।
ফারজানা মাথা নিচু করে বলল,আমিই কি হতে পারি না?
ফারজানার গলার স্বর আমার বুকের গভীর থেকে আরো গভীরে প্রবেশ করল।আলতো কওে ওর নিচু মুখ উঁচু করে ধরলাম সাহসী কণ্ঠে বলেই ফেললাম,অবশ্যই হতে পার....
এভাবে চল্লিশ বছর ধরে অপেক্ষমাণ কদম গাছটির নিচে দাড়িয়ে আমাদের দুটি প্রাণের ভাব বিনিময়,ভালবাসাবসিতে আমরা একে অপরের হৃদয়ের সেলে আটকা পড়ে গেলাম।লুকিয়ে আমরা প্রায় প্রতি রাতেই দেখা করতাম।
এই মুহূর্তে ফারজানার একটি কথা আমার খুব মনে পড়ছে,তুমি মোটরসাইকেল চালানো শিখতে পারনা?
কেন?
আমাদের বিয়ের পরে আব্বুকে বলব একটা মোটরসাইকেল কিনে দিতে।যখন রাত গভীর হবে,যখন জ্যোৎস্না উঠবে,জ্যোৎস্নায় ভেসে যাবে পুরো পৃথিবী তখন আমরা ওটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ব নির্জন পৃথিবীর জনশূন্য রাস্তায়।তুমি মোটরসাইকেল চালবে আর আমি তোমাকে পেছন থেকে শক্ত করে ধরে বসে থাকব।বাতাসের তোড়ে আমার চুল এবং শাড়ির আচল ছিঁড়ে যেতে চাইবে।আর বাতাসে বাজতে থাকবে, এই পথচলা কভু শেষ হবে নাকো.....
হ্যাঁ,ঠিক এ কথাই তো বলেছিল ফারজানা।কিন্তু আজকে কার মোটরসাইকেলে চড়েছে ও।তবে কি ফারজানা এরই মধ্যে আমাকে....।
আমি গাড়ির জানাল দিয়ে মাথা বের করে চিৎকার করে ডাকি এই,এই ফারজানা।
ফারজানাদের হোন্ডা চলতে শুরু করে।
আমি গাড়ির জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে পেছন পেছন দৌড়াতে থাকি,আর চিৎকার করে বলতে থাকি,এই ফারজানা তুমি কার মোটরসাইকেলে চড়েছ?আরে ওটাতো আমি নই,আর এটা তো জ্যোৎস্না ভরা রাত নয়,এটা তো নির্জন জনশূন্য রাস্তা নয়।তুমি তো কেবল আমার মোটরসাইকেলে চড়তে চেয়েছিলে।আর চেয়েছিলে জোৎস্নাভরা চাদের রুপালি আলোয় ঝলমল করা পৃথিবীর নির্জন জনশূন্য রাস্তায়।তবে কেন তুমি এখন উল্টোটা করছ?এই,এ-ই মেয়ে কেন?
তুমিতো আমার চেনা ফারজানা, আজ এত অচেনা হয়ে যাচ্ছ কেন?