বৃষ্টিরঙ্গ, সাথে জলতরঙ্গ

বৃষ্টি (আগষ্ট ২০১২)

আহমাদ মুকুল
  • ৪০
  • ১৭
এক.
হাসতে হাসতে ব্যাংকে ঢোকে মতলিব মিয়া। মহাজনের ঋন সময়ের আগে মিটাইয়া দেওয়ার সুখই আলাদা।
-এই লন আপনের পুরা টেকা।
-টাইমের আগে টেকা ফেরত দিলা, বিষয় কী?

বিষয়টা ম্যানেজাররে বুঝাইয়া বলে মতলিব মিয়া। যেই কামে টাকা নিছিল সেই কাম মাগনা হাছিল হইয়া গেছে। মহাজনের ম্যানেজারের লগে মতলিব মিয়ার আগে থেইকা খাতির। পোলার চাকরির লাইগা টাকা লাগবো- ম্যানেজার এইটা শুইনা পাঁচ লাখ টাকা লোনের ব্যবস্থা কইরা দিছিল।

-বিনা টাকায় চাকরি, তুমি কোন জমানার খবর লইয়া আইছো?
-হয় হয়, মিয়া ভাই, সবই হয়। কায়দা-কানুন বদলায় না?

কায়দাটা বুঝাইয়া বলে মতলিব মিয়া। এইডা হইল গিয়া ইনস্টলমেন্ট সিস্টেম। বাঙালী তো আইজকাল এই সিস্টেমে ভালই মিশা গেছে। সাত হাত পানি দেইখা জমি কেনার ডাউন পেমেন্ট দেয়। এক ওড়া মাটি না পড়তে পড়তেই অর্ধেক কিস্তি দেওয়া শেষ। কিস্তি ফুরায়, জমির পানি হুগায় না। নক্সা আর ছবিতে জমির প্লট, রাস্তা, রং বেরং এর নাগরিক সুবিধা দেইখা দেইখা স্বপ্নে মালিকানা পায়। স্বপ্নের বাড়ি স্বপ্নেই বসবাস….দারুন ব্যাপার স্যাপার। আসল জায়গা নিয়া পুরাণ মালিক আর রিয়েল এস্টেট কোম্পানীর টানাহ্যাচড়া; রাজউক, পরিবেশ অধিদপ্তরের কোঁদাকুদিতে একসময় কষ্টের বিনিয়োগ দুঃস্বপ্ন হইয়া যায়। আদি মালিক আর অন্তগ্রাহক- দুই পক্ষের কাছে রিয়েল এস্টেট মানে হইয়া যায় ‘নাইটমেয়ার প্রজেক্ট’!

যাউকগা, এইসব প্যাঁচাল কে কারে হুনায়। কে বুঝাইবো- এই দেশে উনাগো কাছ থেইকা জমি বাড়ি বুইঝা পাওয়ার চেয়ে চান্দের দেশের দখল পাওয়া বেশী সোজা। আসল কথায় ফিরে মতলিব। বিষয়ডা হইলো গিয়া চাকরির টাকার লেনদেনে আজকাইল অনেক বিপত্তি, টাকাভর্তি ব্যাগবস্তা টানা ঝক্কির ব্যাপার হইয়া গেছে। টেন্ডারবাজ, দখলবাজগো মতন নতুন গজাইয়া উঠা চাকরিবাজেরা নয়া ফন্দি বানাইছে- ‘‘বিনা পয়সায় চাকরি নেও, কিস্তিতে অর্থ দেও।’’ মানে হইলো গিয়া চাকরি পাওয়ার পর পাঁচ বচ্ছর বিনা বেতনে খাটতে হইবো….বেতনখান তিনারা নিয়া যাইবো। বক্রি টাকা আলাদা কিস্তিতে পরিশোধ। কারো উপরে মোটা অঙ্কের প্রেসার নাই।

‘‘বেতন নাই, উল্টা মাসে মাসে টেকা দেওয়া, চলবো কেমতে বেডারা….’’ ম্যানেজারের প্রশ্নে কিঞ্চিত অবাক হয় মতলিব। কয়- ‘‘আপনে দিহি প্রাগৈতিহাসিক সময়ে বসবাস করতেছেন। অফিসের চেয়ার টেবিল কক্ষ ভোগ করবো- এইগুলার ভাড়া নাই? চাকরিজীবী স্ট্যাটাসের একটা দাম নাই? তার উপর চাকরিতে ‘উপরি’ বইলা কোন কথা নাই?....য্যায় চাকরি নিতাছে হ্যায় বোকা নি? ঠিকই ম্যানেজ কইরা লইবো।’’ কলি যুগের বেসাতি…বুঝতে অক্ষম ম্যানেজার ঠাণ্ডা মাইরা যায়।

মতলিব মিয়া বাড়ি ফিরে। বিকালে মজলিস আছে, গ্রামের খালে সাঁকো তৈরি নিয়া। এক বিরাট ভেজালে পড়ছে গেরামের লোক। এই বছর বর্ষায় অতিবৃষ্টিতে ছোট খালখান পানিতে থৈ থৈ। একখান পুল হইলে পোলাপান ভালালে স্কুলে যাইতে পারতো, মানুষজন মালটাল নিয়া পার হইতে পারতো।

তেজু মিয়া এই গ্রামের মানুষ না, ভিন গ্রামের হইলেও নানান সুখ সুবিধায় সাহায্য কইরা থাকে। সে একখান মজবুত বাশের সাঁকো কইরা দিবো বইলা প্রতিশ্রুতি দিছিলো। তেজু মিয়ার পরামর্শ মতন একখান এস্টিমেটও হইছে। শুধু মানুষ পারাপার না, বাই-সাইকেল মোটরসাইকেল যাতে পার হইতে পারে সেই ব্যবস্থা রাখারও কথা হইছে। চেয়ারম্যান সাব স্থানীয় মেম্বার সাবু মিঞারে সব যোগাড়যন্ত্রের দায়িত্ব দিছিল। ভিলেজের মইদ্যে পলিটিক্স, নাকি পলিটিক্সে আস্তা ভিলেজ হান্দাইছে- কেডা কইবো? গ্রামের কিছু পল্টিবাজ লোক বলে তেজু মিয়ারে গিয়া লাগাইছে- ‘‘মেম্বারে সাকোর লাইগা সব ফাটা বাশের অর্ডার দিছে, ফাটা বাশের সাউক্কা টিকবো না, উল্টা গ্রামবাসী চিপায় আটকাইবো।’’

এইডা হুইনা তেজু মিয়া সাফ সাফ কইয়া দিছে, ‘‘ঐ মেম্বাররে দিয়া কাম করান যাইবো না।’’ কথাডায় চেয়ারম্যানের আত্বসম্মানে ঘাই লাগছে। হেও কইয়া দিছে, ‘‘নিজেগো টাকায় করুম, নিলাম না তেজু সওদাগরের টেকা।’’ বিকালে মজলিশে এই সিদ্ধান্তই শুনাইয়া দিল চেয়ারম্যান।

মানুষজন কেউ সাঁতরাইয়া, কেউ দুই মাইল ঘুইরা স্কুলে, বাজারে যায়। ঠ্যাটা মকিম এইসবের ধার ধারে না। সে কয় আমি এইহান দিয়া হাইটাই খাল পার হমু। লুঙ্গি উঁচাইয়া পার হইতে থাকে। উঠাইতে উঠাইতে হাটু পার হইয়া কোমর ছোঁয়ার জোগার। দুই পারের মাইনষে কয়-
-আর উডাইস না রে…ইজ্জত ছুই ছুই করতাছে…
-আমার ইজ্জত নাইলে গেরামের মাইনষের কাছেই গেল….তোমাগো হগ্গলের ইজ্জত তো সাত গেরামে হারাইছে!

ঠ্যাটা মকিম শুকনা কাপড় হাতে লইয়া প্রকাশ্য দিবালোকে দিগম্বর হইয়া খাল পার হয়। গেরামের বিবেকবান মানুষগুলা পরিপাটি কাপড় পইড়াও নিজেগো ‘ল্যাংটা’ বইলা আবিষ্কার করে। চেহারা লুকাইতে মাথা নিচু কইরা হাইটা যায়। নির্লজ্জ মেম্বার এইসব দেইখাও ঠিকই ফেক ফেকাইয়া হাসে!

দুই.
শহরে কাজে আইসা অবাক হয় মতলিব মিয়া। যা দেখতাছে, তা কারো কাছে কইলে আষাইড়া গল্প বইলা উড়াইয়া দিবো।…..ফুটপাতে হকার নাই, মানুষজন ওভারপাস দিয়া রাস্তা পার হইতাছে….গাড়িতে কোন কালো ধোয়া নাই! মাথাডা চক্কর দিয়া ওঠে, দিশা হারায়। হাটতে হাটতে কোমর পর্যন্ত পানি উঠার আগে ঠাওরই পায় নাই ঘটনা কী? হুগনাকালে পানি পানি কইরা চিল্লাইন্না মাইনষেরা আষাইড়া পানির ঠেলায় সোজা হইয়া গেছে- ফুটপাত জাগনা থাকলে না হকার বইবো? রাস্তা পার হইতে গেলে ফেরি লাগবো, তাই বেসিদা মানুষগুলা উঠছে ওভারপাসে। আর গাড়ির ইঞ্জিন, সাইলেন্সার সব পানির তলায়- মাথাভাসা সাবমেরিন হইয়া গেছে, ধুযা বাইর হওনের পথ নাইক্কা।

গেরামে বর্ষার পানিতে সাঁকো সংকট, এইদিকে শহরে অতি বর্ষনে জলচন্দ্রমা চলে। একদিকে গরীব মাইনষের ঘরের ছাউনি পলিথিনের ছেন্দা দিয়া টপাটপ পানি পড়ে। গরমে ঘামে আধাভেজা বিছনা-বালিশ নতুন কইরা বৃষ্টিতে ভিজে। ঐদিকে আঙিনায় ঢোকা পানিতে বড়লোকেরা রবার বোট নিয়া নৌ-বিহার করে।

নদ-নদী ড্রেজিংএর অভাবে ভরাট হইলে কি হইবো, নগরচালকেরা শহরের রাস্তায় খাল কাইটা তা পোষাইয়া দিতাছে। ছপছপ জলডুবি সড়ক হরেক রকম যানে ছয়লাপ। স্থলচর, জলচর, উভচর যানবাহনের মধ্যে সড়কের জায়গা দখল নিয়া কাড়াকাড়ি।

অতি ইসমার্ট কিছু পরিবহন কোম্পানী ড্রাইভার হেলপারগো বিশেষ নৌ-ট্রেনিং দিয়া বাস মিনিবাস চালাইতেছে। ফটিকের গল্পের ‘একবাও মেলে না, দো বাও মেলে না’ স্টাইলে বাসের ছাদে লগি লইয়া খাড়াইয়া সূর ধরে এক হেলপার, নিচে আরেক জন জোগালী ধরে, বাসের ভিতরে কমেন্ট্রি দেয়; ড্রাইভার ঝিমাইয়া ঝিমাইয়া স্টিয়ারিং, গিয়ার মারে-

উপরের জন- ….এক বাও, সোজা যাও….দুই বাও, বামে ওয়াসা, তাড়াতাড়ি ডাইনে কাটো….
নিচের জন- ডাইনে গেলে ভাড়া বাটো, বামে গেলে নাইমা হাটো
উপর জন- তিন বাও, সামনে তিতাস
তাড়াতাড়ি উল্টা ঘোরো।
নিচের জন- জলদি সবাই নামো নামো
কাপড় খুইলা সাতার মারো।

কোনদিকে যাইবো মানুষ হগল….উত্তর দক্ষিণ পূব পশ্চিম ঈশান নৈঋত- সবদিকেই কোন না কোন সেবাওয়ালা পরিখা মাইন পাইতা রাখছে!

সাত তাড়াতাড়ি অবস্থা নিরূপণ প্রয়োজন, কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। হাতি ঘোড়াগণ সদলে আসেন। অর্বাচিনের মত জলের তল মাপতে গিয়া উনাগো সলিল সমাধি ঘটে। হাল আমলের গাধা বাহাদুর অত বোকা নন। গজ ফিতা লইয়া কাছে-কিনারে না যাইয়াই রিপোর্ট দিয়া দেন- ‘‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, সংকটসমূহ উন্নয়নের নিদর্শন। জল বৃদ্ধি আশংকাজনক নয়, তয় সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ভয়াবহ! যেই কোন সময় অর্থনীতির চাপে দেশ উল্টাইয়া যাইতে পারে।’’

হাটতে হাটতে মতলিব মিয়া ভাবে, ডুইব্যা যাওনের সময় হাতি-ঘোড়াগুলান বাঁচার আশায় কি জানি হাতরাইয়া খুঁজতেছিল….হায় রে অভাগা হগল, কিছুই বাদ থোস নাই, খড়কুটা বিচালি সবই তো চাবাইয়া খাইছস!!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়সাল বারী গল্পটার কথা শুনেছিলাম, আজ পরলাম. নিদারুন.. সন্দেহ nai
মোঃ আক্তারুজ্জামান এক দল বিনে পয়সায় চাকুরী কবুল করে তো আরেক দল বেতনের দ্বিগুন বাসা ভাড়া দেয় এসবই নীতি আদর্শ বিকিয়ে দেয়ার ফসল| যার পরিণতিতে ওরা বিত্তে আকাশমুখী হয়ে উঠলেও স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরেও এদেশের সাধারণ মানুষের মুক্তি মিলেনি| আপনার শব্দবান এইসব জ্ঞান পাপীদের বিবেককে জাগিয়ে তুলতে, এদেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের পথটি কুসুমাস্তীর্ণ করতে ভুমিকা রাখবে বলে আশা রাখি|
জয়নাল হাজারী মনের অন্দর মহলের ফুসফুসানি আর কত আটকিয়ে রাখা যায় ? মুগ্ধ হলাম ।
মোঃ মুস্তাগীর রহমান আবার আসিলেম ফিরে,কী জানি কী ভেবে..............হয় ত বা ভালবাসার টানে.....................
মাহবুব খান ভাই সমকালীন ,জাতীয় ,আন্তর্জাতিক রাজনীতি কে একটা ক্যসকা মার দিলেন মনে আয় ? আপনার লেখা গুলো কথা বলছে ইদানিং /
তানি হক পুরো গল্পজুড়ে দারুন ভালো লাগা ছড়িয়েছেন ভাইয়া ..মোহিত ভাবে গল্পটি শেষ করলাম ..আর আঞ্চলিক ভাষা টা ভীষণ উপভোগ করলাম ..সব মিলিয়ে সুন্দর গল্পটির জন্য ধন্যবাদ ..আর ঈদের আগাম আন্তরিক মোবারকবাদ আর শুভকামনা রেখে গেলাম ...ধন্যবাদ
বশির আহমেদ আমাদের মন থেকে যত দিন পক্ষপাতের মুদ্রা দোষ না যাবে ততদিন যতই স্যাটায়ার ধর্মী লেখা লিখিনা কেন কোন লাভ হবে না ।
প্রদ্যোত অনেকদিন পর আমিও ...
রওশন জাহান অনেকদিন পর এসে আপনার লেখাটায় আগে পড়লাম .

১৯ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪