এক.
মধ্যবিত্ত জীবনের ট্র্যাজেডিই মনে হয় এখানে- আমাদের সাধ থাকে এক, সাধ্যে কুলায় আরেক। আমাদের ভাবনায় থাকে বসুন্ধরায় বাড়ি, বিএমডব্লিউ গাড়ি; অথচ ভাগ্যে জোটে ওই ভাড়া করা বাড়ি আর যান হিসেবে পাবলিক বাস। সেখানেও আবার একটা ‘কিন্তু’ জুড়ে থাকে। বাড়ি আছে, কিন্তু সেখানে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সংকট; বাস আছে, কিন্তু সেখানে সীটের সংকট। ফলাফল- ভালোবাসলেই যেমন ঘর বাঁধা যায় না, তেমনি ভাড়া থাকলেও সীট পাওয়া যায় না। তথাপি সেই বাসটিকেই নিজের অধিকারে ভেবে বাড়ির কর্তা ব্যক্তিটি মোবাইল ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা শ্রোতাটিকে বেশ ভাব নিয়ে বলেন, “গাড়িতে আছি, পরে কথা হবে।” যেমনটি বলেন এই পরিবারের কর্তা রশিদ সাহেব। ফোনে ভাব নিলে কি হবে, ভাড়া দেবার বেলায় ঠিকই দুই টাকা নিয়ে কন্ডাক্টরের সাথে খিটমিট করবেন তিনি। তারপর বাসায় গিয়ে গিন্নির কাছে বাসওয়ালাদের ‘ডাকাতি’র ফিরিস্তি দিবেন।
বাড়ির কর্তা ব্যক্তিটি যেখানে তুলাদণ্ডে সবকিছু বিচার করেন, সেখানে গিন্নিটি সবকিছু বিচার করেন হৃদয় দিয়ে। স্বভাবেও খুব ইমোশনাল সালেহা বানু। সেন্টিমেন্টাল বাংলা সিনেমার ভোঁতা-ভোঁতা ডায়ালগ শুনে যার চোখে পানি চলে আসে, তাকে তো আমরা সেইরকম ইমোশনাল বলতেই পারি।
রাগে-ক্ষোভে উত্তপ্ত স্বামীর মনটাকে আবেগে উর্বর করতে সালেহা নরম গলায় বলবেন, “আহা, দুইটা টাকা নাহয় দিয়েই দিতে। বেচারা গরীব মানুষ।”
পিতা-মাতার অবস্থান যেখানে উত্তর আর দক্ষিণে, সন্তানদের অবস্থান সেখানে পূর্ব আর পশ্চিমে। বাড়ির একমাত্র কন্যা এবং স্বঘোষিত ‘কুকিং এক্সপার্ট’ টুম্পার আফসোস বাংলাদেশে এখনও ‘মাস্টার শেফে’র মতন কোন আন্তর্জাতিক মানের রান্নার অনুষ্ঠান শুরু হয়নি বলে। নইলে এদেশের প্রথম মাস্টার শেফ সে-ই হতো। সিদ্দিকা কবীর থেকে শুরু করে সঞ্জীব কাপুর- কেউই বাদ যান না টুম্পার লিস্ট থেকে। সাধারণত যারা ঘরোয়াভাবে রান্নাবান্নায় পারদর্শী হয় তারা বাইরের খাবারের ব্যাপারে খুঁতখুঁতে থাকে। টুম্পাও সেই। আর এ নিয়ে ওর বন্ধুদের ঠাট্টার শেষ নেই। এইতো সেদিনের ঘটনা- এক ফাস্টফুড শপে গিয়ে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই চিবোতে চিবোতে টুম্পা একেবারে নাক-মুখ কুঁচকে বলতে লাগল, “এই ফালতু খাবার খাওয়ার জন্যে তোরা এতদূর এলি!”
সাথী জিজ্ঞেস করল, “কেন্, কী হইছে?”
টুম্পা বলল, “এর চেয়ে ভালো ফ্রেঞ্চ ফ্রাই তো আমি বাসাতেই বানাতে পারি।”
নাফিস মুচকি হেসে বলল, “তাই বুঝি!”
“সিরিয়াসলি! খেয়ে তোরা নির্ঘাত জ্ঞান হারাবি।”
“কেন্, তুই কি তোর ফ্রাইড চিকেনে ক্লোরোফর্ম দিবি?”
...এভাবেই চলছে টুম্পার দিনকাল। ইদানীং ওকে হালুয়া বানানোর বাতিকে পেয়েছে। হাতের কাছে যা কিছু পাচ্ছে ধরে ধরে হালুয়া বানাচ্ছে। আজ বানিয়েছে মিষ্টি কুমড়ার হালুয়া।
বাবাকে অস্থির দেখে টুম্পা তাকে চেয়ারে বসাল। এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি পান করিয়ে হালুয়ার বাটিটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, “বাসওয়ালাদের কথা এখন বাদ দাও তো বাবা। এই দেখ, আজ একটা বিশেষ ধরনের হালুয়া বানিয়েছি। টেস্ট করে বলতে হবে কী দিয়ে বানানো হয়েছে।” বলেই এক টুকরো হালুয়া রশিদ সাহেবের মুখে পুড়ে দিল টুম্পা।
রঙ্গমঞ্চের এই পর্যায়ে স্টেজে প্রবেশ করল বাড়ির ছোট ছেলে টোটন, হাতে গীটার। সালেহাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মা, বাইরে যাচ্ছি। টাকা লাগবে।”
ইতিহাস যতই বলুক বাড়ির ছোট সন্তানটি ‘আদরে’ থাকে, এইখানে কিন্তু দৃশ্যপট ভিন্ন। গানপাগল ছেলেটিকে নিয়ে বাবার অভিমত, “ও তো একটা ভাদাইম্যা। ওরে দিয়ে কিছ্ছু হবে না!” প্রতিবছর মাধ্যমিক উচ্চ-মাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশের পর পত্রিকাগুলোতে যখন খেটে খাওয়া অদম্য মেধাবীদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় তখন রশিদ সাহেব আফসোস করে বলতে থাকেন- তার মেহনতের টাকাগুলো তিনি যদি তার ছোট ছেলের পড়াশোনার পেছনে অপব্যয় না করে এলাকার একটা গরীব ছেলের পেছনে ব্যয় করতেন তাহলে সেই ছেলে এতদিনে তার মুখ উজ্জ্বল করে ছাড়ত। মেয়ে নাহয় রান্নাবান্না করে স্বামীর সংসারে গিয়ে প্রশংসা কুড়াবে, ছেলে এইসব গান-টান নিয়ে পড়ে থেকে কীইবা এমন করবে!
টোটন অবশ্য খুব একটা গায়ে মাখে না এগুলো। কারণ ও জানে ও একদিন বড় শিল্পী হবে। সামনেই সঙ্গীত প্রতিভা অন্বেষণমূলক এক অনুষ্ঠানে ওর অডিশন। ওর সফলতার প্ল্যাটফরম। আচ্ছা, সে অনুষ্ঠানে বিজয়ী হবার পর উপস্থাপিকা যখন ওকে জিজ্ঞেস করবে, “আপনার সফলতার পেছনে কার কার অবদান রয়েছে?” ও কি তখন আর সবার মতো ওর পরিবারের কথা গর্বের সঙ্গে বলতে পারবে?
দুই.
যে কাজ কারও উপর নির্ভর করে করতে হয় সে কাজ পরিকল্পনা মতো হবে না সেটাই স্বাভাবিক। তবুও মন তা মানতে নারাজ। কেননা সেই পরিকল্পনার সাথে হয়ত কোথাও না কোথাও সূক্ষ্ম একটি আশাও জড়িয়ে থাকে। আশা পূরণ না হবার সাথে থাকে আশাহত হবার সম্ভাবনা।
টোটন তখন মা’র কাছে টাকা চাইতে গিয়ে বাবার কাছে বকা শুনল। ড্রামস আর কী-বোর্ড নিয়ে অর্কদের বাসায় প্র্যাকটিস করার কথা ছিল, অথচ অর্ক একদম শেষ মুহূর্তে জানাল যে ও সময় দিতে পারবে না। এই কথাটা আগে জানালে কি হতো?
টোটন খেয়াল করে দেখেছে, অর্ক আজকাল কেমন যেন রহস্যময় আচরণ করছে, বিশেষ করে অডিশনের কথাটা শোনার পর। ওর মাঝে কি তবে ঈর্ষাবোধ কাজ করছে? টোটন বুঝতে পারে না।
এইসব ভেবে হঠাৎ টোটনের মন খুব খারাপ হয়ে গেল। একটু হালকা হওয়ার জন্য ও একবার ভাবল রামিমদের আড্ডায় যোগ দিবে কি না, কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে পড়ে গেল- ওদের মানসিকতাটা ঠিক ওর সাথে মিলে না। ওদের আড্ডার বিষয় থাকে বাবার প্রোপার্টি, লেটেস্ট প্রযুক্তি, নর-নারীর বিবাহ বহির্ভূত অবৈধ সম্পর্ক। কোনটাই ওর সাথে যায় না। এসব ভাবতে ভাবতেই টোটনের মনে হলো- প্রাণের বন্ধু বলে ওর কেউ নেই, যে বন্ধুর সাথে মনের কথাগুলো শেয়ার করা যায়, দুঃসময়ে কাছে পাওয়া যায়। এমন বন্ধু যাকে পরিবারের একজন বলেই মনে হয়। পরিবারের মানুষগুলোর সাথেই যেখানে ওর এত দূরত্ব, সেখানে প্রাণের বন্ধু পাওয়াটা তো ভাগ্যের ব্যাপার। প্রতিভাবান মানুষগুলো এমন দুর্ভাগ্য নিয়েই হয়ত পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। টোটন ভাবে, সাধারণ মানুষের জীবন ওর নয়- ও গানের পথিক। গানের ভাষায় মনের কথাগুলো ছড়িয়ে দেওয়াই ওর একমাত্র ব্রত।
মন খারাপ ছিল, তাই বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। টোটন ভাবতে লাগল কোথায় যাওয়া যায়।
তিন.
অনেকদিক পর টোটনকে দেখে ভাবী খুব খুশি হলেন। বললেন, “এতদিন পর আমাদের কথা মনে পড়ল তোমার?”
টোটন কী জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছিল না। আসাটা ঠিক হলো কি না- সেটাও বুঝে উঠতে পারছিল না। প্রতিটি পরিবারেরই কিছু গোপন দুঃখ-ব্যথা থাকে, যা বাইরের পৃথিবীর কাছে থাকে অজানা। তেমনি সবার অলক্ষ্যে টোটনদের পরিবারের মানুষগুলো যে দুঃখটা বয়ে বেড়াচ্ছে তা এই পরিবারের বড় ছেলে টুটুলকে কেন্দ্র করে। সবার অমতে বিয়ে করেছিল ও- এক অল্পবয়সী বিধবা মেয়েকে। রশিদ সাহেব সেটা মেনে নিতে পারেন নি। ছেলের সাথে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন তিনি। বাড়ির অন্যদেরও ওর সাথে যোগাযোগ না রাখার কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। টুটুলের ব্যাপারটা তাই ওদের পরিবারে একটা দীর্ঘশ্বাসের মতন।
টোটন কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই ভেতরে গিয়ে বসল।
দুই রুমের ছোট্ট বাসা। ছোট হলেও বেশ পরিপাটি। এই কয়েকবছরে বেশ গুছিয়ে নিয়েছে ওরা। রুমের একপাশে তাকের মধ্যে রাখা অনেকগুলো ওষুধের প্যাকেট আর ওষুধ কোম্পানির লোগো সম্বলিত মগ, কলমদানি, লিকুইড হ্যান্ডওয়াশ দেখে টোটনের আর বুঝতে বাকি রইল না যে ভাইয়া আজকাল মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি করছে।
টুটুল এসেই জিজ্ঞেস করল, “আরে টোটো! কিরে, কেমন আছিস?”
“ভালো নেই” বলতে গিয়েও বলতে পারল না টোটন, মাথা কাত করে বোঝাল যে ভালো আছে। অনেকদিনের দূরত্বে বুঝি সম্পর্কেও একটা জড়তা চলে আসে।
“বাবা-মা-টুম্পা কেমন আছে রে?”
“বাবার মেজাজটা খিটখিটে হয়ে গেছে, অযথাই রাগারাগি করে আজকাল। মা’র প্রেসারটা বেড়েছে”- এবারও বলতে গিয়ে আটকে গেল টোটন। কী হয়েছে ওর? ভাইয়া-ভাবী প্রাণপণ চেষ্টা করছে স্বাভাবিক হতে, অথচ ও কেন পারছে না? ওদের দেখে মনে হচ্ছে যেন কিছুই হয়নি কখনও। ইস্, সেটাই যদি সত্যি হতো! টোটন যদি পারত ওদের পরিবারের সব সমস্যাগুলো ঠিক করে দিতে।
চার.
মনের মাঝে বাঁচিয়ে রাখা স্বপ্ন মানুষকে হয়ত কঠিন পরিস্থিতিতেও উজ্জীবিত করে রাখে। আর তাইতো চৈত্রের খা-খা রোদে অডিশনের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতেও টোটনের ক্লান্তি লাগছিল না।
আশেপাশে অবশ্য বিনোদনেরও অভাব ছিল না। বুকের ভাঁজ প্রদর্শন করে বেড়ান এক মেয়ে নিজের সিরিয়াল নাম্বারটা প্রথমদিকে নেওয়ার জন্য অনেকক্ষণ ধরেই লাইনের সামনের দিকে দাঁড়ানো মানুষজনকে অনুরোধ করে যাচ্ছে। এই মেয়েকে কে বুঝাবে- এটা বুকের ভাঁজ দেখানোর প্রতিযোগিতা না, গলার আওয়াজ শোনানোর প্রতিযোগিতা। ম্যাগী নুডল্সের মতো ঝাঁকড়া চুলের এক ছেলে গীটার নিয়ে হাউ-মাউ করছে। ওর গলা আর হাতে পড়া শেকল দেখে মনে হচ্ছে পাগলা গারদের ডাণ্ডাবেড়ি ছিঁড়ে পালিয়েছে। টিভি ক্যামেরার সামনে লোকজনের ভাঁড়ামির কমতিও নেই কোন।
দীর্ঘ লাইনটি আস্তে আস্তে অডিটোরিয়ামের দিকে এগিয়ে যায়। কিছু মানুষ অহেতুক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে প্রবেশদ্বারে। দেশে তামাশা দেখা মানুষের অভাব নেই মনে হচ্ছে। টোটনের মেজাজ খারাপ হয়।
অডিটোরিয়ামের ভেতর আরও কিছু নমুনার সন্ধান মিলে। সেসব দেখে মনে হবে গানের অনুষ্ঠানের ফরম্যাটটা একটু পাল্টে দিয়ে সেটাকে সহজেই কোন কৌতুকের অনুষ্ঠানে পরিণত করা যাবে।
বিচারকরা কীভাবে এসব সহ্য করছেন কে জানে!
উত্তরটা পাওয়া গেল কয়েক ঘন্টার মাঝেই। যখন দেখা গেল, প্রথম এক হাজার জন প্রতিযোগীর মাঝে ‘ইয়েস কার্ড’ পেয়েছে মাত্র বারো জন। টোটন চিন্তায় পড়ে গেল। ওর স্বপ্ন আদৌ পূরণ হবে তো?
পাঁচ.
বিচারকদের রুমে ঢোকার আগে প্রতিযোগীদের মোবাইল ফোনটা সুইচ–অফ করে যেতে হয় বলে টোটন সংবাদটা পেল অনেকক্ষণ পর। ও ভেবেছিল বাবার কিছু হয়েছে। কিন্তু বাবাকে বিমর্ষ অবস্থায় হসপিটালের করিডোরের চেয়ারে বসে থাকতে দেখে ও কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে গেল। মা কাঁদছেন। ম্যাসেজটা করেছিল আপু, সুতরাং আপুরও কিছু হবার কথা নয়। তাহলে অ্যাকসিডেন্টটা কার হয়েছে?
ডাক্তার এসে যখন রশিদ সাহেবকে বললেন, ‘হেলমেট পড়া ছিল বলে রক্ষা, নইলে বড় ধরনের একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেত।” টোটনের কাছে তখন সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেল। ও ভাবল ও স্বপ্ন দেখছে না তো?
ভাইয়ার জন্য বাবাকে কখনও এতটা চিন্তিত দেখেনি টোটন। ও তো একদম আশা ছেড়েই দিয়েছিল। এখন কি আবার একটা ক্ষীণ আশার আলো জেগে উঠেছে? সবকিছু কি তাহলে আবার আগের মতো হয়ে যাবে? তবে আজকের দিনে এটাই হবে ওর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। কড়া রোদে অডিশনের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ধাপে ধাপে ধকল পেরিয়েও ও যখন ‘ইয়েস কার্ডটা’ পেতে পেতে পেল না, তখন একরকম ভেঙ্গেই পড়েছিল টোটন। এখন পরিবারের এই মানুষগুলোর এই দৈবাৎ কাছে আসা দেখে ও আবার জেগে উঠেছে।
বাইরে রাতের আকাশে জ্যোৎস্নার চাঁদ, দখিনা হাওয়া বইছে। হুমায়ূন স্যার বেঁচে থাকলে আজ হয়ত ওদের পরিবার নিয়েও কিছু একটা লিখতেন। এতটা সাদামাটাভাবে নয়, তার নিজস্ব সরস ভঙ্গিতে...