আজকে যার গল্প আপনাদের বলবো তার নাম মৃন্ময়ী, যে দেখতে মোটেই ভালো ছিল না, রোগা কালো সেই মেয়েটা যে নবম শ্রেণীতে পড়ে, যার বয়েস মাত্র পনের বছর, সে একদিন চুলে বেণী করে স্কুলের ইউনিফর্ম পড়ে স্কুলে গেল। তারপর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হল মৃন্ময়ী বাড়ি ফিরল না। অভিভাবকেরা সব জায়গায় খোঁজ নিল। কোন খবর পেল না। বাধ্য হয়ে পুলিশকে জানালো। এলাকার প্রভাবশালীদের কাছে গেল। মৃন্ময়ীকে কেউ কোথাও দেখেনি। বান্ধবীদের দু একজন দুপুরের আগে পর্যন্ত দেখেছে। এরপর ওরা মৃন্ময়ীকে ক্লাস করতে দেখেনি। ওরা ভেবেছিল ছুটি নিয়ে চলে গেছে।
কয়েক দিন পর বড় মৌলানা ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি আসার পথে দেখে পুকুড় পাড়ের বড় তেতুল গাছটায় একটা কাপড় ঝুলছে। ‘আফাহাসিবতুম আন্নামা খালাক্বনাকুম আবাসাও ওয়ান্নাকুম ইলাইনা তুর যাউন’ তিন বার পড়ে ফু দিয়ে ভালো করে খেয়াল করে দেখলেন একেবারে মগডালে একটা মেয়ে। তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে কয়েকজনকে নিয়ে এসে একটা উঁচু মই দিয়ে মেয়েটাকে নামানোর ব্যবস্থা করলেন। মেয়েটা অজ্ঞান। ক্রমে লোক জমে গেল। একটা ছেলে বলে উঠল- আরে এ মৃন্ময়ী না! আমাদের হরিকাকার মেয়ে মৃন্ময়ীই তো।- খবরটা বাতাসের আগে পৌঁছে গেল হরিপদ বাবুর কাছে। ছুটতে ছুটতে এসে তিনি অনেকটা আছড়ে পড়লেন মেয়ের কাছে। মেয়ের মাথাটা বামহাতে তুলে ধরে বুকফাটা আর্তনাদ করে বললেন- ‘কী হয়েছে আমার মায়ের! মৃন্ময়ী কথা বল মা। কথা বল’। বড় মৌলানা বললেন- অস্থির হয়ো না হরিপদ। ওর জ্ঞান নেই। একবার সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে ভালো হয়।
হাসপাতালে মৃন্ময়ীর জ্ঞান ফিরল। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। সে চোখ মেলে বলল- আমি কোথায়? ডাক্তার বলল- তুমি হাসপাতালে। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে। তাই এরা তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। মৃন্ময়ী বলল- কিন্তু শুভ্র! শুভ্র কই। ও কি তাহলে আমাকে রেখে চলে গেছে? মৃন্ময়ীর বাবা জানতে চাইলো- শুভ্র কে? মৃন্ময়ী বলল- শুভ্র হল দেবকুমার। সে ব্যাসদেবের বংশধর। নিজেও ব্যাস উপাধি লাভ করেছে। তাই তাকে সবাই বলে শুভ্র ব্যাস। সেদিন দুপুরে রোদের তাপ কম লাগার জন্য আমি মাঠের উত্তর দিকের অশ্বত্থ গাছটার ছায়ায় বসেছিলাম। হঠাৎ দেখি চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে কোন গুহার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর দেখি আমি একটা নীল কাঁচের ঘরের মধ্যে। একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। বলছে- ‘মৃন্ময়ী ভয় পেয়ো না। আমি শুভ্র। কিছু গবেষণার জন্য তোমাকে দরকার, তাই তোমার অনুমতি না নিয়েই তোমাকে এখানে আনতে হলো। খুব তাড়াতাড়িই তুমি ফিরে যেতে পারবে’। কণ্ঠ শুনে আমার মনে হলো বক্তার বয়স আমার চেয়ে খুব একটা বেশি হবে না। তাই আমি নির্ভয়ে বললাম- আমি ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছি না। আমি ভাবছি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন সে কথা। তখন লক্ষ্য করলাম কাঁচের ঘরটা অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছু আলোর কণা ঘণীভূত হয়ে রূপ নিল এক অনন্য সুন্দর কিশোরের। অনেকটা দূর্গাপূজার বানানো কার্তিকের মতো একটা ছেলে। এত সুন্দর ছেলে আমি কখনো দেখিনি। সে বললো- তোমাকে আমাদের জগতে স্বাগতম। দেবলোকে আসার জন্য মানুষ অনেক সাধনা করে। কিন্তু তুমি শুধু তোমার জন্মক্ষণের কারণে অনায়াসে দেবলোকে আসতে পারলে। তুমি অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষে বৃহস্পতি বারে মহানবমী তিথিতে রেবতী নক্ষত্রে মীন রাশিতে মীন লগ্নে সুকর্ম যোগে দেবগণে জন্মগ্রহণ করেছ। তাই তুমি আমার গবেষণার উপযুক্ত পাত্রী। আমি জিজ্ঞেস করলাম- তোমার গবেষণার বিষয় কী? সে বলল- তোমাদের মধ্যে আমাদের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা কমে যাচ্ছে, নরকের ভয়, পরলোকের ভয়, শাস্তির ভয় ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম -তাতে তোমাদের সমস্যা কী? ও বললো -আমাদের সমস্যা অনেক। তোমরা আমাদের উদ্দেশ্যে পশুবলি না দিলে, খাওয়ার শুরুতে আমাদের নাম না নিলে, আমাদের উদ্দেশ্যে দান না করলে, খাবার নিবেদন না করলে, নিয়মিত প্রার্থনা না করলে, উপাসনা না করলে আমাদের শক্তি কমতে থাকে। এজন্য আমাদের অনুসারী দরকার। আমি বললাম-একটা উদাহরণ দিয়ে বললে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারতাম। শুভ্র বললো- ঠিক আছে। আমি তোমাকে একটা অঙ্ক করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। যেমন তোমরা কোন অনুষ্ঠানে কোন অদৃশ্য শক্তির উদ্দেশ্যে পশু হত্যা কর। যে পশুটাকে যে বয়সে হত্যা কর সেটা তার স্বাভাবিক বয়স নয়। সেটা যদি বেঁচে থাকতো হয়তো আরো দশ বছর বাঁচতো। তাহলে একটি প্রাণীর দশ বছরের জীবনীশক্তি অদৃশ্য জগতের তহবিলে জমা হল। এভাবে বছরে এক লক্ষ, এক কোটি, একশ কোটি জীব হত্যার মাধ্যমে আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে। আমরা তা আনুপাতিক হারে ভাগ করে নিই।- ও বুঝেছি সেজন্যই সবসময় নিখুঁত প্রাণী বলি দেবার বিধান রয়েছে।- এই তো তুমি বেশ বুদ্ধিমতী। খুব সহজেই বুঝে গেছ। এছাড়া তোমরা খাবারের শুরুতে, কোন কাজের শুরুতে যখন অদৃশ্য শক্তিকে স্মরণ কর তখন সেখান থেকে একটা অংশ আমাদের বেঁচে থাকার শক্তি হিসেবে জমা হয়। তোমাদের সব প্রার্থনা, উপাসনা থেকেও আমরা শক্তি পাই। এভাবে ধীরে ধীরে আমরা তোমাদের উপর পরিপূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে গেছি। যদিও তোমরা আসার আগে আমরা অন্যভাবে শক্তি উৎপন্ন করতাম। কিন্তু তাতে ঝামেলা ছিল বেশি। তাছাড়া এমন নিরাপদ দীর্ঘস্থায়ী উৎস থাকতে সেসব আর খুব একটা কেউ করে না। -এখনোতো তোমাদের অনেক অনুসারী আছে। -তা আছে। কিন্তু ইউরোপের মতো মহাদেশে বেশির ভাগ মানুষ এখন অদৃশ্য শক্তির উদ্দেশ্যে কিছু করে না। এর ফলে ঐ অঞ্চলে অনুসারীর অভাবে আমাদের প্রজাতির একটা বড় অংশের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যারা আছে তারা একটা সিণ্ডিকেট করে প্রচুর অনুসারী তৈরিতে ব্যস্ত। ভারতবর্ষে যারা আছে এদের মধ্যে প্রচণ্ড মতভেদ। তাই সিণ্ডিকেট করা যাচ্ছে না। এদিকে প্রকৃতিবাদ প্রতিষ্ঠার সময় এগিয়ে আসছে। প্রকৃতিবাদীরা অদৃশ্য শক্তির টিকে থাকার রহস্য বিভিন্ন ওয়েব সাইটে প্রচার করছে। সবাই যদি তা জেনে যায় তবে আমাদের শক্তির সব উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এই সংকটের সময় সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে আমরা এক হতে যাচ্ছি। আমি তোমাকে আমাদের প্রজেক্টগুলো ঘুরে দেখাবো। বিরুদ্ধবাদীদের জন্য আমরা কত কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করছি তা তুমি নিজে দেখে যাবে। পৃথিবীতে গিয়ে তুমি মানুষকে তা জানাবে। তোমার সাথে আমাদের যোগাযোগ থাকবে। প্রতিদিন ফেসবুকের স্ট্যাটাসে বিরুদ্ধবাদীদের শাস্তির ভয়, পরকালের ভয়, মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে পোস্ট দিতে থাকবে। আমি একটা পেইজ খুলার চেষ্টা করেছিলাম। কেপচাটা বড় ডিসটার্ব করে। আর তোমাকে জানিয়ে রাখি, এ প্রজেক্টে তুমি একা নও। তোমার মতো আরো অনেককে দিয়ে আমরা সফলভাবে এ কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছি। তুমি তোমার প্রোফাইলে লিখবে 'অদৃশ্য শক্তিকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার শাস্তি যে কত ভয়ঙ্কর তা আমি নিজে দেখেছি।' যারা জানতে চাইবে তাদের বিস্তারিত বলবে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আখতারুজ্জামান সোহাগ
ভিন্ন স্বাদের একটা গল্প পড়ার সৌভাগ্য হলো। দারুণ লিখেছেন। এক নিঃশ্বাসে পড়েছি। ধন্যবাদ লেখককে এমন একটি ব্যতিক্রমধর্মী গল্প আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।