।। শ্রাবণ মাসের কতো তারিখ আজ যেন, বাংলা তারিখ বাঙালী আর মনে রাখে না, কেনোই বা মনে রাখবে, বাংলা হিসাব কি অফিস-কাছারিতে চলে! চলে না বলেই তো প্রচলন নেই বাংলার, শুধু ওই একুশ এলেই সরকারী ছুটিকে বৈধ বা হালাল করবার জন্য একটু মায়াকান্না, একটু নস্টালজিয়া, স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো আর কি,তখন বাংলার জন্য ওই একটু-আধটু চোখের অফুরন্ত জল না ফেললে কি একুশের চেতনা সার্থক হয়, হয় না বলেই তো রাজনৈতিক রঙ মিশিয়ে প্রতিপক্ষকে একটু নাকানিচুবানি খাওয়ানো আর কি! সে যাই হোক না কেনো, পাড়াগাঁয়ে মানুষগুলো কিন্তু আজো বাংলা হিসাবেই চলে,তাহলে দাঁড়ালো শহর মানে ইংরাজি, ওই কিন্ডারগার্ডেন-এ-লেবেল, ও-লেবেল...দিনে দিন শহরের ধারণায় পাল্টে যাচ্ছে, মানুষ এখন এতোটাই ব্যস্ত যে দৈনন্দিন জীবনের কাজ ছাড়া অন্য কিছু চিন্তাই করতে পারে না। সামনে যা পাচ্ছে তাই গিলছে, বলা যায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো গিলাচ্ছে আর বলছে, আকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখে কিসের ভয়, আমরা তো আছি হাতের কাছে, চলে আসুন আমাদের নবনির্মিত এপার্টমেন্টে, সেই আশ্বাসের বাণী শুনে আমরা ধেই-ধেই করে ছুটে যাচ্ছি, নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট হাতে ধরিয়ে দীর্ঘ মেয়াদি কিস্তির সুবিধা নিয়ে...তারপর কি চমৎকার দেখা গেলো, সাজো রে ভাই রঙিন মেহেদি রাঙিয়ে, যতো সুখ ওই ঘাড়ের কাছের দোকানটাই...
নদীর কথা ভাবতে গিয়েই হোঁচট খাচ্ছে কয়েকদিন থেকে নোমান, কলেজে ঠিকমত আসছে না, কেনো যে আসছে না তাও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। মুঠোফোনে খবর নিয়েছে ক’ দিন, তেমন অসুখও করেনি, গত সেমিস্টারগুলোর ফলাফল তেমন আশানুরূপ হলো না বলে একটা ক্ষোভ রয়েছে, নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করবে বলে পণ ধরেছে, বড় বেশি আবেগপ্রবণ মেয়ে, এই শ্রেণীর মেয়েরা কখন কি যে করে বসে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, নোমানের কোর্সের এসাইনমেন্টে যতোটুকু সাধ্য নোমান বেশি মার্কই পাইয়ে দিয়েছে, কিন্তু অন্যের গুলো সে কিভাবে পারবে! তারপরও চেষ্টার এতোটুকু গাফলতি করেনি, যাকে পেয়েছে বলেছে, এভাবে হয় না, নদীর জন্য করতে হয়েছে আর কি!
নদীকে কেনো যে এতো ছাড় দেয়, তারও কোনো মানে হয় না, কে যেন বলেছিলো মেয়েরা সবই পারে, পুরুষদের নাকে দড়ি দিয়ে সাত মুল্লুক ঘোরাতে পারে, কিসের সেই ক্ষমতা, নোমান ওসব হয়তো অতোখানি বুঝতে চায় না, তারপরও ওই মেয়েটার জন্য মনটা কেমন খচখচ করে, কি যেন আছে মেয়েটার মধ্যে, একটা স্বপ্ন-স্বপ্ন ভাব মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারে, নদীর দেশের বাড়ি শিবগঞ্জে, নোমানের এলাকারই মেয়ে,ওদের পরিবারের সঙ্গে খুব বেশি না হলেও একটু- আধটু সম্পর্ক যে নেই তা বলাও যাবে না। একসময় নদীর ভাই সাগর ছিলো নোমানের স্কুল বন্ধু,সেই পাড়াগাঁয়ের জীবনে ভাব-ভালোবাসার এতোটুকু কমতি ছিলো না। সাগর মাধ্যমিক পাশ করবার আগেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়, সে অনেক কাল আগের কথা, স্মৃতি বড় নিষ্ঠুর, ছেড়ে যেতে চায় শুধু আঁকড়ে ধরে রাখে, সাগরের কথা মন থেকে কোনোদিন মুছে ফেলার নয়, আজ সাগর বেঁচে থাকলে হয়তো সে বিসিএস পাশ করে তার মতো সরকারী কলেজে অথবা অন্য কোথাও বড় চেয়ারে চাকুরী করতো, একটা মৃত্যু মানুষকে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করে, সামনে এগুতে দিতে চায় না, নোমান এখনো স্মৃতির দর্পণে দেখে, সাগরের মুখখানি, তারই বোন নদী যেন সাগরের মুখের আরেক টুকরো হিরকখন্ড।
অনেক রাত্রি, বাতাসে কামিনী ফুলের ঘ্রাণে মৌ-মৌ করছে পৃথিবী, নোমান বিছানা থেকে উঠে বসে, বাইরের পৃথিবী এখন ঝলমল করছে, আকাশে থালার মতো চাঁদটা তার তামাম রূপ সাজিয়ে বসে আছে, এমন রাতে কে পারে ঘুমের অতল সমুদ্রে হারিয়ে যেতে, বিছানায় মমতা মেয়েকে নিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে, বেশ কয়েকদিনের গুমোট গরমের পর আজ বিকেলের দিকে খানিক বৃষ্টি হয়েছে, সেই বৃষ্টিতে মমতা আবার রেলিং দেওয়া ছাদে এলোমেলো হয়ে গোসল করেছে, তাই মনটা আজ ভারী শান্ত ওর। নোমান ভেবেছে অনেকদিন পর বৃষ্টি মানে তো প্রত্যাশার বৃষ্টি, সেই বৃষ্টির শীতল পানি পেয়ে তৃণলতা পশুপাখি যেমন আহ্লাদে আত্মহারা হয়, ভূ-প্রকৃতির মতো মানুষের মনও বিচলিত হয়, আনন্দে আর ভালোবাসায় ভরপুর হয় অবশেষে।
বাইরের ঠাণ্ডা বাতাস মনটাকে ভিজিয়ে দেয়, নোমান নিজেকে হারিয়ে ফেলে, এই শহরে মমতা একটুকরো মাটি চায় নিজের মতো করে, অথবা ১৪০০/১৬০০স্কায়ার বর্গফুটের একটা এপার্টমেন্ট, চিরদিন ভাড়াটে বাড়িতে বাস করতে-করতে মন কেমন কাঙালপনা হয়ে থাকে, বন্দি পাখি মনে হয় নিজেকে, একটা স্বাধীন আকাশ কার না ইচ্ছে, নোমান আশ্বাস দিয়ে রেখেছে, হবে-হচ্ছে... এদিকে মেয়েটাকে ভালো কোনো কিন্ডারগার্ডেনে ভর্তি করাতে হবে এ’ বছরই,ও-লেবেল এ-লেবেলে না পড়ালে সোসাইটিতে মুখ দেখানো যাবে না, ষ্টার্টস বলে একটা যে কথা আছে, সেদিকে কড়া নজর না থাকলে সব কিছু গোল্লায় যাবে! হাজারো চিন্তায় সে যখন দিশেহারা সে সময় আরেক ঝামেলা নদীকে নিয়ে, মেয়েটির চিন্তায় সমস্ত পরিকল্পনা গুবলেট হতে বসেছে, যদিও মমতা এখনো সেভাবে নদীর কথা জানে না, একটু-আধটু শুনলেও তেমনিভাবে ভ্রুক্ষেপ করেনি, তবে নোমান জানে পুরোপুরি জানলে মমতা কিন্তু একটা বড় রকমের লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে বসবে। মেয়েদের মন বলে কথা, সব মেয়েদেরই ওই একই মন আর কি! তাই বলে নদীর কথা কি বাদ দেওয়া যায়? সাগরের বোন বলেই তো নয়, একটা দায়িত্ব আছে না, মেয়েটির হলো কি, বুঝতে পারছে না। রাত্রে একটু-একটু করে ফিকে হয়ে আসছে, কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে অনুমান করতে পারেনি, হঠাৎ মমতা পেছনে এসে দাঁড়ায়, কি হলো, ঘুম কি আসছে না? কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে...
নোমান যেন মৃদু ধাক্কা খেলো, কিন্তু কি বলবে ভেবে পেলো না। শুধু মুখে বললো, না ঠিক আছে, তুমি বরং আরেকটু ঘুমোও।
মমতা তৎক্ষণাৎ জানালো, কি ব্যাপার বলো তো, ক’ দিন ধরে তোমার মনটা কেমন উতলা লাগছে।
- কি যে বলো না, মন আবার উতলা হবে কেনো।
- না বলছিলাম শরীর ঠিক আছে তো!
- তা থাকবে না বা কেনো?
- সেদিন দেখলাম, ঘুমের মধ্যে কি যেন নাম মনে করতে পারছি না, হ্যাঁ মনে হয়েছে, নদী-নদী বলে চিৎকার করে কার নাম ধরে ডাকছিলে...
- নদী... না তো, হ্যাঁ ওই একটা মেয়ে, কলেজে অনেকদিন ধরে আসছে না, পরীক্ষায় তেমন রেজাল্ট করতে পারেনি বলে।
- তাতে তোমার এতো কি, ওই মেয়ে নদী-ফদি রেজাল্ট ভালো করলেই কি, না করলে তোমার কি, তুমি কি ওর অভিভাবকত্ব নিয়েছো, মেয়ে দেখলে আধিক্যেতা...
- না মানে বিশ্বাস করো, আমি আসলে...
- আর বিশ্বাস কি, সারাদিন শুধু ওই মোবাইলে কান পেতে বসে থাকতে তো দেখছি, তারপর আবার দামী গ্লাক্সি থ্রি-জি মোবাইল, কথা পষ্ট শোনা যাবে প্লাস মহারাণীর ছবি, একের ভেতর ডবল লাভ, কি যে জন্তু তোমরা...
- না বুঝে এতো কথা বলছো, মিছে সন্দেহ ভালো না।
- ভালো না তো জানি, আমি এখন পুরানো হয়ে গেছি, আর বুঝবো কি, সবই তো বোঝ তুমি, বিদ্যার জাহাজ আর আমি কোন্ মূর্খ...
- আসলে মমতা তুমি যা ভাবছো তা সত্যি নয়। কোনো কিছু না বুঝে গভীরভাবে না জেনে আন্দাজে অন্ধকারে ঢিল ছুড়া কি উচিৎ বলো!
মুহূর্তে মমতা গম্ভীর হয়ে যায়, নোমান আর কিছুই বলে না। সত্যিকার একটা কুরুক্ষেত্র থেকে যেন রেহায় পেলো,মানুষ আসলে বিচিত্র বটে, সে যে কি ভাবে কখন, তা বোঝা বেশ কঠিন। সেই কঠিনেরে নিয়েই মানুষ আজীবন পথ চলে, সেই চলা হয়তো কখনো ফুরোবার নয়, তারপর তো চলতে হয়, বেঁচে থাকার হয়তো এটাই এক বিড়ম্বনা, সবাই নিয়ে চলতে হয়, সবাই মানিয়ে নিয়ে চলা কি চাট্টিখানি কথা, নোমান সত্যিই কিছু ভেবে পায় না। অকস্মাৎ আবার নদী এসে যায় ভাবনায়, মেয়েটি বাস্তবিক ভালো মেয়ে, এই বয়সে একটু আবেগপ্রবণ বটে, তারপরও ভালো লাগে, ওর বাবা-মায়ের কাছে কি বলবে, মোবাইল বন্ধ করে রাখার মতো বেয়াদপি আর নাই, মেয়েটা এমন করে কেনো, সাগরও এমনই ছিলো, কেমন যেন, এখন সবটাই মনে করতে পারছে না, অনেকদিনের পুরানো বন্ধু সাগর, বাল্যকালের অনেক স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলবার নয়, তারপরও মানুষকে অনেক কিছু ভুলে যেতে হয়,নয়তো সংসারে অশান্তি এসে জোকের মতো রক্ত খায়, হয়তো এটাই বাস্তব, সংসার মানে একটা সীমান্ত, সেই সীমান্তের মধ্যে থাকাটাই সমীচীন, এদিক-ওদিক হলেই মহা বিপত্তি, তখন কেউই বাঁচাতে পারবে না, নোমান ভেবে পায় না, তাহলে সেও একটা ঘেরাটোপের সীমান্তের মধ্যে আঁটকে আছে, নদী ওই সীমান্তের বাইরের আরেক বাঘেণী, সেই বাঘিনী তার নয়, সে শুধু মমতার একচেটিয়া সম্পদ, আর সে কারণে তাবৎ স্বামিত্ব অধিকার মমতা ভোগ করছে এবং আর কাউকে সে অধিকারে ভাগ বসাতে দেবে না।
এই শহরে একটা ফ্লাট যেমন মমতা চায় নিজের করে, স্বামীকেও চায় চিরকালের বন্ধনে জড়িয়ে থাকুক, হয়তো এটাই স্বাভাবিক! নোমান ভাবে বিয়ে মানে কি ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে কোনো কিছু থাকবে না। আচমকা মোবাইলটা বেজে ওঠে, স্কীনে যে নামটি ভেসে এলো সেটি দেখে নোমানের চোখ-মুখ খুশিতে নেচে উঠলো, মমতা শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে, নোমান একটু হেসে মোবাইলের লাল বটমে হাত দিয়ে কেটে দিলো, মমতার কাছাকাছি এসে তারপর একগাল হেসে জানতে চাইলো, শ্রাবণ মাসের কতো যেন...
মমতা কিছু না বলে গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে তখনো। নোমান পাজাকোলে মমতাকে তুলে নিয়ে বেডরুমের দিকে যেতে থাকে, বলো না শ্রাবণের কতো...
- জানি না, আমি কি জানি, তুমি বলো!
- সত্যিই আমি জানি না, বলো না?
মমতা নাক ধরে টিপে বলে উঠলো, ১৭ই শ্রাবণ--
- আরে আমাদের বিবাহবাষিক না আজকে।
- মনে আছে, তাহলে...
- কি মনে থাকবে না, চলো দেখাচ্ছি মনে আছে কি না!
মমতা শুধু ‘না-না’ বলতে থাকে, নোমান বেডরুমে ঢুকে বিছানায় মমতাকে আলগোছে রেখে, করিডোরের দিকের দরোজা বন্ধ করে দেয়। রুমের ভেতর কামিনী ফুলের ঘ্রাণ কিছুটা হালকা হলেও মমতার চুলের মিষ্টি খুশবু সুদে-মুলে পুষিয়ে দেয় নোমানের মনটাকে, বাতাস তারপরও আত্মহারা।