বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দু’ বছর পর রাহেলা বেগমের জন্ম। যুদ্ধের সময় যারা লুটপাট করেছি তারা এখন অনেক ধনী ও সম্মানিত ব্যক্তি।তারা বুক ফুলিয়ে, সিনা টান টান করে বাহিরে ঘুরে । যারা মধ্যবিত্ত ছিল তারা যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে সহায়- সম্বল বিক্রয় করে আহার যোগার করতে গিয়ে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে পরিনত হয়েছে। আর যারা স্বজন হারিয়েছিল তাদের চোখ থেকে তখনো পানি ঝর ছিল, যদি ও তাদের চোখের পানি আজো শুকায়নি। এমন একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে রাহেলার জন্ম। চারিদিকে শুধু অভাব আর অভাব। তাই নতুন অথিতির আগমনে কেউ আনন্দ প্রকাশ করছেনা, মনে কষ্ট পেয়েছে তা ও নয়। গর্ভস্থ ময়লা পরিস্কারে করে পুরনো কাপড়ে তৈরী কাঁথায় জড়িয়ে, আতুর ঘর থেকে বের হন রাহেলার দাদী। কোলে ফর্সা তুলতুলে রাহেলা। স্বামীকে ডেকে বলেন ----- আস , তোমার নাতনীর মুখ দেইখা যাও। নাতনীর রূপে কেমুন আমার বাড়িডা আলো হইয়া গেছে দেখ, দেখ।
উঠানের এক কোনে বসে ঝিমাচ্ছিল বুড়ো। বুড়ির গলা শুনে তাড়াতাড়ি ছুটে আসে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে নাতনীর ফুটফুটে মুখ পানে। নাতনীকে অনেকক্ষন দেখার পর বুড়ো বলে---- এ অভাবের সংসারে ক্যন আইলি ? এক টেকার চাইল এখন দুই টেকা, পাঁচ টেকার শাড়ি পঞ্চাশ টেকা, তোরে কেমনে পালুম।
একজন সদস্য বাড়লেই খরচ বাড়ে, তাই নিজ সংসারে রাহেলা একজনের অধিক সন্তান নিতে চায়নি। স্বামী মফিজের অনুরোধে দুই সন্তানের মা এখন রাহেলা।বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি পর্যন্ত অভাব হল তার নিত্য সঙ্গী। তাই আজ পঞ্চাশ টাকা কেজি চাল বা এক’শ টাকা কেজি পেয়াজ কিনতে ভয় পায় না । তবে প্রতিমাসে বাজেট করে কঠিন হিসাব কষে সংসার চালাতে হয়।
বুড়ি মমতা মাখা কন্ঠে বুড়াকে বলে ----- চিন্তা কইরোনা । জিব দে্ইছেন যে খাবার দেইবে সে, তুমি ভাল কইরে নাতনীর কানে আযান দেও। জলদি কর। এমুন জোরে দিবা য্যন গেরামের সগল মাইনসে হুনে।
বৃদ্ধ দাদা নাতনীর জন্য হৃদয়ের সমস্ত দরদ দিয়ে আযান দিয়ে ছিল সেদিন। সেই আযানের ধ্বনি গ্রামের সব লোক শুনুক বা না শুনুক রাহেলার কানে ঠিকঠাক পৌঁছেছিল। তাই আজ সে কারো মমতাময়ী মা, দায়িত্বশীল প্রেয়সী, স্নেহময়ী বোন বা ভাবী , আস্থাশীল সহকর্মী , নিঃচিন্তে নির্ভর করার মত প্রতিবেশী। দেশ স্বধীন হওয়ার আগে হাতে গোনা কয়েকজন বড় এবং সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ছিলেন। এই মুহূর্তে যাঁদের নাম মনে পড়ছে তাঁরা হলেন, সেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, স্যার সৈয়দ সলিমুল্লা,মাওলানা ভাসানী, বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তাঁদের হৃদয় ছিল দেশ প্রেমে পরিপূর্ন। তাঁরা সর্বদা দেশের কল্যানের কথা ভেবে ছিলেন।ব্যক্তি স্বার্থের উপরে ছিল দেশ। স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ পর আজ বাংলাদেশে আঠার কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ষোল কোটি জনতা দেশপ্রেমিক। এ ষোল কোটি মানুষকে যদি আমি দেশপ্রেম অনুযায়ী তালিকা তৈরি করি , প্রথম সারিতে থাকেন আমাদের রাজনৈতিক দল গুলো। তারা সনদ প্রাপ্ত বড় দেশপ্রেমিক। যার ফলে ক্ষমতায় গেলে ইচ্ছে মত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করতে পারেন, যখন- তখন যাকে-তাকে গ্রেফতার করতে পারেন, পুলিশ বাহিনী দিয়ে মনের মত করে পিটিয়ে পাবলিকের ঘাড়ের বাঁকা রগ সোজা করে দিতে পারেন, পারেন ইচ্ছে মত ঘুষ নিতে ও সরকারি তহবিলের টাকা নির্বিগ্নে আত্তসাৎ করতে। আর যদি বিরোধী দলে থাকেন তাহলে সাপ্তাহে কমপক্ষে তিন দিন হরতাল দিবেন, পাবলিকের গাড়ি ভাঙ্গবেন, যেখানে- সেখানে ককটেল ফাটাবেন যাতে জনগন হাড়ে হাড়ে টের পায় তাদের ভোট না দেয়ার নতিজা। যখন- তখন মানুষ মেরে , জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়- ক্ষতি করে সাধারন জনগণকে বুঝিয়ে দেয় আগামী নির্বাচনে তাদের জিতাতে হবে। আর তালিকার দ্বিতীয় সারিতে যারা আছেন তারা দেশ প্রেমে ভরপূর দেশের ধনী সমাজ। পেয়াজ-কাঁচা মরিচ থেকে শুরু করে গরু- ছাগল সব কিছু নিয়ে সিন্ডিকেট করে কোটি কোটি টাকা আয় করে টাকার পাহাড় গড়েন।টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন ক্লাবের সদস্য হন। অসহায় পাবলিকে পাতলা খিচুড়ি ও চিড়া মুড়ি খাইয়ে পেয়ে যান দেশপ্রেমিকের খেতাব। তারপর নানা জাতিয় উৎসবে একের পর এক ফুলের মালা পরানো হয় দেশ-দরদী দেশপ্রেমিকের গলায়। আর তালিকার তৃতীয় সারিতে আছে দেশের সেই জনতা, যারা রাজাকারের ফাঁশির দাবীতে গনজাগরণ মঞ্চ তৈরী করে রাতদিন রাস্তায় পড়েছিল।এ তালিকায় কোলের শিশু থেকে লাঠি ভর দেয়া বৃদ্ধ ও আছেন , নেই শুধু রাহেলার মত গুটি কয়েক জনগণ।
রাহেলা এ তালিকার কোন সারিতেই পড়েনা। সে কোন রাজনীতি করেনা আর আর্থনৈতিক দিক থেকে যাদের নুন আনতে পানতা ফুরায় তাদের সারিতে। কারন সে গরীব প্রাইমারি স্কুল শিক্ষকের সহধর্মী ও সহকর্মী। স্কুল আর সংসারের হাজারো দায়িত্ব পালন করে গনজাগরণ মঞ্চে একদিনের জন্যও যেতে পারেনি। তার মাথায় থাকে কোন বাচ্চার খাতা নেই, কে বই হারিয়ে ফেলেছে? সর্বক্ষন দৃষ্টি শিশুদের উপর, কে স্কুলে আসেনি? কে মারামারিতে ব্যস্ত?কার চিকিৎসা লাগবে ? কোন নারী নির্যাতিত ? এ কাজ গুলো নিজ গরজে খুঁজে নেয় সে । নিজের স্বল্প বেতন থেকে ব্যয় করে স্কুলের ছোট ছোট শিশু ও অসহায় নারীদের জন্য । তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে সে বড়ই তৃপ্ত। তার রাজনীতি, অর্থনীতি বা রাজাকারের ফাঁসি নিয়ে ভাবার সময় বা সুযোগ কোথায় ? গ্রামে মেট্টিক পাশ করে শহরে খালার বাসায় থেকে কলেজে ভর্তি হয় । শহরে আসার অল্প কিছু দিন পরেই মফিজের সাথে পরিচয় হয়। মফিজ তখন রাহেলাদের পাড়ার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। রাহেলা কলেজে যাওয়া আসার সময় প্রায় দেখা হতো মফিজের সাথে। খালাতো বোন মিলাকে স্কুলে ভর্তি গিয়ে কথা হয় দুজনের। তারপর রাস্তায় দেখা হলেই কথা হতো, কথা থেকে হল প্রেম । সেই প্রেম চললো টানা দুই বছর। তখন মোবাইল তো ছিলই না , তাদের হাতের কাছে ছিলনা কোন ফোন। তাদের মনের কথা হতো চিঠিতে আর সময় কাটতো হলে সিনেমা দেখে। কলেজের রেজাল্ট হওয়ার পর একদিন মফিজ বললো—‘ প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক নিচ্ছে , তুমি একটা দরখাস্ত দাও । রাহেলা দরখাস্ত লিখে মফিজের হাতে দিল। মফিজ বেশ কিছু দিন এ অফিস সে অফিস ছুটাছুটি করে একদিন নিজেই মিষ্টি নিয়ে হাজির হয় রাহেলার খালার বাসায় । সবাইকে জানায় প্রাইমারি স্কুলের চাকরিটা রাহেলার হয়ে গেছে। মেয়ের সরকারি চাকুরি হয়েছে শুনে রাহেলার বাবা- মা খুব হয়েছিল। রাহেলার মাথায় হাত রেখে বারে বারে বলেছিল—‘ মা, চাকরিটা খুব মন দিয়ে করিস । আজ থেকে তুই হলি মানুষ গড়ার কারিগর , কথাটা মনে রাখিস।
আজ অব্দি কথা টা মনে রেখেছে রাহেলা। সততা ও নিষ্ঠার সাথে আজো দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। দীর্ঘ চাকুরি জীবনে অনেক বাঁধা এসেছে, এসেছে অনেক কু- প্রস্তাব । জীবনের সমস্ত বাঁধা অতিক্রম করে মানুষ গড়ার কাজ করে যাচ্ছে রাহেলা। হরতাল বা বন্যার সময় আমাদের বড় বড় দেশপ্রেমিকেরা দেশপ্রেম বুক নিয়ে হিম শীতল গৃহে খাওয়ার রেসিপি নিয়ে চিন্তায় মগ্ন থাকেন, আর রাহেলা হরতালের দিন হেঁটে এবং বন্যার কোমর পানি মাড়িয়ে স্কুলে হাজির হয়। হয়তো সে দিন পাঁচ- দশটা বাচ্চা থাকে বা থাকেই না, তাতে দেশপ্রেম হীন রাহেলার কর্তব্য পালনে কোন হের ফের হয় না।
১৮ সেপ্টেম্বর - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪