জায়গীর থাকা বড়ই অবমাননাকর ব্যাপার। অবশ্য সবসময়ে নয়। আমি যে বাড়িতে থাকতাম তারই তিন-চার বাড়ি দক্ষিণের একটা বাড়িতে শামছুল হক নামে আমার এক সহপাঠী জায়গীর থাকতো। তার বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলায়। তার জায়গীরদার তাকে ‘মাষ্টার সাহেব’ বলে সম্বোধন করতো এবং ঠিক ‘মাষ্টারের’ মতোই শ্রদ্ধা ও সম্মান করতো। তাকে মাষ্টারের মতো রেখে নিজেরা কৃতার্থবোধ করতো; খাওয়া-থাকা প্রভৃতি সব ব্যাপারে তাকে সুখে স্বাচ্ছন্দে রাখার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করতো। তার জায়গীরদার ছিলো এক বোতাম প্রস্তুতকারক। হাড়ের বোতাম, চিরুনী এইসব প্রস্তুতের কারখানা ছিলো তার। লোকটার অবস্থা মোটামুটী ভালোই ছিলো। কোনো কোনোদিন দেখেছি তার বাসায় গিয়ে; পরিচয়ের পর শামছুলের কাছে মাঝে মাঝেই যেতাম। বেশীর ভাগই যেতাম বই-এর জন্য; পরে, বলতে লজ্জা নেই, সকাল বা বিকালের নাস্তার সময় যেতাম ক্ষুধার তাড়নায় খাওয়ার জন্যই। ওর জায়গীরদার ওকে সকালে এবং বিকালে নাস্তাও দিত। ভাত তো ভালো তরি-তরকারী দিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে দিতই-নাস্তা যা এবং যেভাবে দিত তাও পরিমাণে ও প্রকৃতিতে বেশ ভালো ধরণের। কোনো কোনোদিন ওই নাস্তার লোভেই ওর ওখানে যেতাম।
ওকে তিনটে ছাত্র-ছাত্রী পড়াতে হতো; বড়টি ছিল একটি ছাত্র, স্কুলগামী-ক্লাস সেভেনের ছাত্র। নাস্তার সময়ে গেলে প্রায়ই দেখতাম যে ও-ও নাস্তা করছে কিংবা করবে অথবা এইমাত্র করেছে। আমি যেতেই ওর ছাত্রী নুরজাহান দৌড়ে বাসার মধ্যে চলে যেত এবং আমার জন্যেও নাস্তা নিয়ে আসতো। প্রথমে আমি আপত্তি জানালেও পরে তা খেতাম, আসলে খাওয়ার জন্যেই তো গেছি। তবে একেবারে খাওয়ার জন্যেই যে যাইনি বা যাই না এই প্রমাণটা রাখার জন্য কোনো কোনোদিন ওদের দেওয়া নাস্তা ফেরতও দিতাম-হয়তো শুধু চা’টা খেতাম-নিছক ‘ভদ্রতা রক্ষা করছি’-এইটা দেখানোর জন্য। নইলে সবদিনই যদি ওদের নাস্তা দিলেই খেতাম তাহলে ওদের কাছে ধরা পড়ে যেতাম-প্রমাণ হতো যে আমি নাস্তা খাওয়ার জন্যই ঠিক নাস্তার সময়েই ওদের বাসায় যাই বা যেতাম।
সকালের নাস্তার পর গোসল করে ক্লাসে যাওয়ার সময় শামছুলের ভাত খাওয়ার মতো ক্ষুধাই হতো না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুপুরে বাসায় এসে ভাত খেয়ে যাওয়ার মতো টিফিনের সময় পাওয়া যেতো না বলে ও সকালেই যা হয় একবারে খেয়েই যেতো। দুপুরটা হয়তো ওর একটু কষ্ট হতো কিন্তু বিকালে ফিরে এসে ভালো নাস্তা পেতো বলে দুপুরের কষ্টটা ওর খুব একটা গায়ে লাগতো না।
যে ছোকরা চাকরটা আমার জায়গীরদারের মূল বাড়ি থেকে আমার ভাত নিয়ে আসতো অনেকদিনই সে আমাকে শামছুলের জায়গীর বাড়িতে নাস্তা করতে দেখেছে। তার মণিবের কাছে এ কথা সে কখনো বলেছে কিনা জানি না তবে আমার খাওয়ার পরিমাণে বা প্রকৃতিতে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করিনি তার পরেও। একদিন সকালে শামছুলের ওখানে বসে নাস্তা করছিলাম এমন সময় দেখি যে সেই ছোকরা চাকরটা আমার ভাত নিয়ে যায়। কী মনে করে জানি না শামছুলই ছেলেটিকে বললো, ‘‘দেখি কি দিয়ে ভাত?’’
কি দিয়ে এবং কী পরিমাণের যে ভাত তা তো আমি জানিই। তাই নিজেই লজ্জায় পড়তো এই ভেবে তাড়াতাড়ি ছেলেটিকে বললাম, ‘‘তুমি নিয়ে যাও, আমি আসছি।’’
কিন্তু শামছুল যেভাবে ওকে ঘাড়ে-মোড়ে ধরে কথাটা জিজ্ঞাসা করেছিলো তাতে ও-ও না দেখিয়ে যেতে পারলো না, রাস্তা থেকে সিঁড়ির উপর দু-ধাপ উঠেই ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বাঁ হাতে ভাতের প্লেটটা ধরে ডান হাতে ঢাকনার প্লেটটা শূন্যে তুলে ধরলো। শামছুল এবং তার ছাত্রী ও ছোট ছাত্রটা দেখলো। ছাত্রীটা যেন আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু দেখছে এইভাবে আঁতকে উঠে বলে উঠলো, ‘‘ওম-মা, এই ভাত আপনারা মাষ্টার সাহেবকে খাওয়ান?’’
আমিই তাড়াতাড়ি বললাম, ‘‘না, ওটা ভাত নয়, নাস্তা।’’
মেয়েটি বেশ চালাক। বললো, ‘‘এই ভাত দিয়ে নাস্তা?’’
বললাম, ‘‘হ্যাঁ, আজ বোধহয় অন্য নাস্তা হয়নি।’’
ছেলেটিকে ধমক দিয়ে বললাম, ‘‘দাঁড়িয়ে আছো কেন? চলে যাও; চলো আমিও আসছি।’’
বলেই উঠে পড়লাম এবং ওর পিছে পিছে হাঁটা দিলাম। বুঝলাম, আমাদের যাওয়ার দিকে পিছনে তাকিয়ে আছে অন্ততঃ দু-জোড়া বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখ।
তারপর আরও একদিন। সেটা কোরবানীর সময়। কোরবানীর সময় আমি আমার জায়গীর বাড়িতেই ছিলাম। সে বছর কোরবানী দিতে না পারার অবমাননার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই বাড়ি আসিনি; তখন আমাদের আর্থিক অবস্থা কোরবানী দিতে পারার মতো ছিল না। বন্যা ও ফসলহানির কারণে এমনিতেই ফসলাদি হতো না এবং তাও আবার আমরা সব জমিই বর্গা দিয়েছিলাম, আর বর্গাদাররা তো দয়া করে ফসলাদি প্রায় দিতই না। বাড়িতে থাকত শুধু মা, স্ত্রী আর দুটো ছেলে-দুলাল আর রুমী; রুমীর বয়স তখন এক বছরের কিছু বেশী। জমির ফসলে এই ক-জনের খোরাকীই হতো না। আমাদের স্টাইপেন্ডের টাকা দিয়ে বাড়িতে ধান কিনে দিয়ে যেতাম।
কোরবানীর দিন নাজিরাবাজারের শূলসুধাওয়ালারা দাওয়াত করেছিলো। লালবাগ মসজিদে ঈদের নামাজ পড়ে জায়গীর বাড়ি থেকে সামান্য কিছু খেয়ে শূলসুধায় চলে এসেছিলাম। শূলসুধাওয়ালারা একটা গরু ও দুইটা খাসী কোরবানী করেছিলো। ওদের কোরবানী দেখলাম ও দুপুরে শূলসুধাতেই খেলাম। সন্ধ্যায় আমার জায়গীর বাড়িতে এসে দেখলাম যে ওরাও কোরবানী করেছে-অবশ্য ভাগে না একাই তা আর জানতে পারিনি-জানার চেষ্টাও করিনি। রাত্রে খাওয়ার সময় ওরাও গোশতই খেতে দিয়েছিলো, তবে শূলসুধার খাওয়া খুব ভালো হয়েছিলো বলে জায়গীর বাড়িতে সেদিন খুব একটা খেতে পারিনি। প্রায় দু-বছর ওদের বাড়িতে ছিলাম, ওই কোরবানীর দিন এবং তারপর আর বোধহয় দু-একদিন তারা গোশত এবং বেশ পর্যাপ্ত পরিমাণ ভাত খেতে দিয়েছিলো, অবশ্য তার পরিমাণও এমন নয় যে আমি খেয়ে শেষ করতে পারিনি-বরং আমার খেয়ে তৃপ্তি হয় ঠিক এমন পরিমাণ।
এই কোরবানীর পরে পরেরই একদিনের কথা। আমার জায়গীরদারের গোশত বোধহয় শেষ হয়ে গেছে; কারণ আমার খাবার আবার সেই সাবেক বরাদ্দ এক প্লেট ভাত, খেসারীর ডাল ভর্তা ও কখনও সখনও এক আধটুকু মাছে এসে ঠেকেছে। এই সময়েই একদিন শামছুলের ওখানে গিয়েছিলাম সকালবেলা। সেদিন অবশ্য যদিও গিয়েছিলাম একটা বই আনতে। কিন্তু গিয়ে দেখলাম, ওর নাস্তা এসেছে; ওর ছাত্র-ছত্রীরাও ঘরের মধ্যে আছে। আমাকে দেখেই ওর ছাত্রীটা দৌড়ে ভিতরে গেল এবং একটু পরেই আমার জন্য এক প্লেট নাস্তা নিয়ে এলো। নাস্তা আর কিছু নয় প্লেট ভর্তি এক প্লেট মূড়ী এবং এক পাশে দু-তিন টুকরা গোশত ও বেশ খানিকটা গোশত-এর ঝোল। বাড়িতে এই গরম গরম ‘জ্বাল দেওয়া’ গোশত আমার অতি প্রিয় খাদ্য; ছোটবেলায় মা’র কাছে খেয়েছি, এখন যদিও তা আর পাই না! সেই ‘জ্বাল দেওয়া’ গরম গরম গোশত এখানেও দেখে মন খুশিতে ভরে উঠলো। কিন্তু মূড়ী দিয়ে? গোশত দিয়ে মূড়ী কোনোদিন খাইনি, সেইদিনই প্রথম খেলাম এবং এত ভালো লাগলো যে তা আর প্রকাশ না করে পারলাম না; মনের উচ্ছাসে তা প্রকাশ করে ফেললাম ভাষায়, ‘‘গরম গরম গোশত দিয়ে মূড়ী এত ভালো লাগে তা তো জানতাম না!’’
শামছুলের ছাত্রীটি বলে উঠলো, ‘‘কেন স্যার, এর আগে খাননি?’’
বলতে লজ্জা নেই। বললাম, ‘‘না কখনও খাইনি।’’
সে বললো, ‘‘তাহলে আরও এনে দিই, খান।’’
এই বলেই সে প্লেট নিয়ে দৌড়াতে চেষ্টা করলো। থাপা দিয়ে হাত ধরে থামালাম, ‘‘না, আর আনতে হবে না, এখন আর খাবো না।’’
প্লেটটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বললো, ‘‘তাহলে কাল সকালে আবার আসবেন?’’
আমি বললাম, ‘‘আচ্ছা কাল দেখা যাবে।’’
এই বলে ওদের ওখান থেকে উঠে এসেছিলাম ক্লাসে যাওয়ার জন্য।
সেই ‘কাল’ আর যাইনি, লোভ হলেও লজ্জার কারণে। তবে একটি কথা সেদিন বুঝেছিলাম যে মেয়ে জাতটাই খাওয়ায়ে খুশি হয়, ওদের দেওয়া খাবারের প্রশংসা করলে ওরা খুশি হয় এবং আরও খাওয়াতে চায়। এ কারণেই চিরকালের ভোজন বিলাসী পুরুষ কোনো মেয়ের কাছ থেকে খাবার আদায় করতে চাইলে তার হাতের রান্নার প্রশংসা করার পথ বেছে নেয়। সেদিনের ছোট্ট ওই মেয়েটির মধ্যে চিরকালের মেয়েজাতের ওই ‘খাওয়ায়ে খুশি হওয়ার’ রূপটিই দেখেছিলাম-যার পশ্চাতে ছিলো তার চিরন্তন মাতৃমন। খোদা তার সেই মাতৃরূপীনী অন্নদায়ী রূপকে সার্থক ও দীর্ঘজীবী করুন।
লালবাগের জায়গীরটা আমার খুব ভালো ছিল না। সেখানে থাকার সময় আমি খুব অবমানিতও বোধ করেছি এবং আমি নিজেকে কখনও ওদের পরিবারের একজন বলে ভাবতে পারিনি; ওরাই সে পরিবেশ সৃষ্টি করেনি। তবুও প্রায় দু-টো বছর আমি সেখানে থেকেছি কেন? কারণ আমার না থেকে উপায় ছিলো না। আমার তো শুধু ঢাকাতে থাকা খাওয়ার প্রশ্ন ছিলো না-আমার পড়াশুনা করার এবং বি. এস-সি. পাস করার প্রশ্নও ছিলো এবং সেটাই ছিলো আমার তখনকার এবং তার পরবর্তী ভবিষ্যতেরও বাঁচা-মরার প্রশ্ন। সুতরাং কোনো একটা জায়গীরে থাকা ছিলো আমার পক্ষে জরুরী যেখানে অন্ততঃ রাত্রিতে পড়ার একটা সুবিধে থাকবে; মেসে রাত্রির বেলাতেই আড্ডা হয় বেশী, আর যে কারণে মেসে থাকাও আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। অন্য কোনো জায়গীর খোঁজার জন্য নষ্ট করার মতো সময়ও আমার ছিলো না কিংবা সে ঝুঁকি নেওয়ারও সাহস হয়নি। যত অসুবিধাই হোক না কেন অন্ততঃ থাকার এবং রাত্রিতে পড়ার মতো একটা নিশ্চয়তা তো আছে। কাজেই যতদিন ওরা নিজেরা আমাকে না তাড়ায় ততদিন, আর যদি সম্ভব হয় তবে পূরো দু-বছরই আমি ওদের ওখানেই থাকায়ই সম্মত ছিলাম। তাই লালবাগের ওই ‘খারাপ জায়গীর’ই ছিলো আমার জন্য একেবারে ‘রাজসিক’ এবং পূরো দু-বছর না হলেও যতদিন এবং যেভাবেই তারা আমাকে রেখেছে ততদিন এবং সেইভাবের জন্যেই আমি তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
কিন্তু আমার লালবাগের জায়গীরটা চলে গেল! ডিসেম্বর মাসের বড়দিনের বন্ধে পাবনায় আমাদের বাড়ি এসেছিলাম কয়েকদিনের জন্য। ছুটির পর ফিরে এসে দেখি যে আমার সেই জায়গীরটা প্রায় নেই হয়ে গেছে। তখনও ওরা ‘না’ করে দেয়নি আমাকে, তবে আমারই যে থাকা আর সম্ভব হবে না সেখানে তা বুঝতে পারলাম। জায়গীর বাড়িতে পা দিয়েই দেখি যে দুই রূমের দালানটার যে রুমে আমি থাকতাম সেইটা বাইরে রেখে সামনের ছোট্ট বাগানটাসহ সমগ্র উঠানটা তাড়াই বাঁশের বেড়া দিয়ে একেবারে ঘিরে ফেলা হয়েছে এবং রান্না ঘরটাও ওই বেড়ার মধ্যে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। ‘লাল চাঁদ’ সাহেবের বিয়ের কথাবার্তা শুনেই গিয়েছিলাম, এসে দেখলাম তার বিয়ে হয়ে গেছে এবং সস্ত্রীক তিনি ওই বাড়িতেই থাকবেন। আমি যে রুমটাতে থাকতাম সে রুমটাও যে তার দরকার সেটা বুঝেই আমি মনে মনে প্রস্তুতই হচ্ছিলাম জায়গীর ছাড়ার জন্য। কিন্তু কোথায় যাই এই পরীক্ষার সামনে? তবুও মনে মনে একটা আশা ছিল যে আমার থাকার জায়গা পরিবর্তন করে এরাই যদি আমাকে এদের মূল বাড়ির ‘চামড়ার গুদাম ঘরে’ রাখে, যে ঘরে আমাকে প্রথমদিন রেখেছিল। কিন্তু তা হলো না। দু-তিন দিন পরেই এরা ‘নোটিশ’ দিল যে তারা আর আমাকে রাখতে পারছেন না।
যদিও মনে মনে প্রস্তুতই ছিলাম এরূপ নোটিশের জন্য কিন্তু তথাপি বাস্তবে নোটিশটা পেয়ে মনটা খুব খারাপই হলো, কোথায় যাই এই পরীক্ষার মুখে-হয়তো মে মাসেই পরীক্ষা হবে? দু-বছর যে ডিগ্রী লাভের জন্য বলতে গেলে, জীবনকে বাজী ধরেছিলাম, ঢাকাতে একটা জায়গীরের অভাবে সে বাজীতে আমি হেরে যাবো! এই জায়গীরের চিন্তা ও খোঁজই করবো না ক্লাস করবো ও পড়াশুনা করবো! যারা নোটিশ দিয়ে দিয়েছে খাওয়া এবং রাত্রি যাপনের জন্যে ঘুরে ঘুরে সেই তাদের বাড়িতেই আসা খুবই অবমাননাকর বলে মনে হতো! ছাত্ররাও আর পড়তে আসে না, অর্থাৎ ওদের কাছে আমি আর ওদের বাসায় ‘নাই’, ওদের সাথে আমার ‘জায়গীর’-এর বন্ধনটাও আর নেই। এ অবস্থায় দিনের শেষে আবার ওদের বাসায় ঢুকতে খুব সংকোচ হতো! মনে হতো যে আমাকে ঢুকতে দেখেই ওরা বোধহয় ভাবছে, ‘এ বেটা আপদ দেখছি আজও জায়গীর পায়নি-আজও তো আমাদের এখানেই থাকবে।’ সবসময়েই ভয় হতো, ‘কখন জানি ঘাড় ধরে বের করে দেয়!’ যদিও এ-ও মনে হতো যে দু-এক সপ্তাহের সময় তো আমাকে দিবেই এবং দু-চারদিনের মধ্যেই এমন কোনো পদক্ষেপ ওরা নিবে না। তবুও দৈনিকই বাসায় ফিরতে খুব সংকোচ হতো; মনে হতো, ওরা বোধহয় ভাবছে, ‘এ আপদ তো আজও গেল না রে!’
শূলসুধায় তফিজ মিয়া ভাইকে কথাটা সেই প্রথমদিনই জানিয়েছিলাম। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে শূলসুধায় যেতেই তিনি বললেন, ‘‘ইউসুফ, তোমার জন্য একটা জায়গীর ঠিক করেছি, কালকেই তুমি বেডিংপত্র নিয়ে চলে এসো।’’
একটু আশ্চর্যই হলাম! মাত্র দু-একদিন আগেই তো জায়গীর যাওয়ার কথা তাকে বলেছি এবং নতুন একটা জায়গীর খোঁজ করতে হবে বলে তাকে জানিয়েছি, ঠিক খুঁজে দেওয়ার কোনো অনুরোধও তাকে করিনি। বিনা অনুরোধেই আজ এই দু-দিনের মধ্যেই আমার জায়গীর তিনি একেবারে ঠিক করে ফেললেন! মনের সে ভাব গোপন করেই তাকে বললাম, ‘‘কোথায়?’’
মিটিমিটি হাসতে হাসতে তিনি জবাব দিলেন, ‘‘আছে এই কাছেই কোথাও; তুমি আসো তো।’’
কেমন যেন একটু রহস্যময় রহস্যময় মনে হলো তার কথা। কোনো ষড়যন্ত্র নয় তো আমার বি. এস-সি. পড়া নষ্ট করার জন্যে? কিন্তু এখন এতো সব কথা ভাবা আমার চলে না। আসল কথা হচ্ছে আমার জায়গীর দরকার, আর তফিজ মিয়া ভাই তা দিতে চাচ্ছেন। সুতরাং বললাম, ‘‘ঠিক আছে, কাল আসবো ইনশাআল্লাহ্।’’
শূলসুধা থেকে বের হওয়ার মুখেই ছোট ভাই সাত্তারের সঙ্গে দেখা হলো; ও তখন প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করে ফিরছিলো। সাত্তার বাইরে খেয়ে শূলসুধাতে থাকছিল।
ওর সাথে সাথেই আবার ‘হল কামরায়’ ঢুকলাম এবং বললাম, ‘‘মিয়া ভাই নাকি আমার একটা জায়গীর ঠিক করেছেন; কাল সব সহ আসতে বললেন।’’
সাত্তার একটা চিন্তামুক্তির হাসি হেসে বললো, ‘‘ঠিক আছে কালই এসো।’’
আমি জায়গীর বাড়িতে চলে গেলাম। বাসায় ঢোকার মুখেই ছোকরা চাকরটাকে জানিয়ে দিলাম যে পরদিন সকালেই আমি চলে যাবো-যেন আজও ওরা আর না ভাবে, ‘‘এ বেটা তো আজও গেল না রে!’’
সেদিন সন্ধ্যা থেকেই কেমন যেন ভালো লাগছিলো না। পরদিন চলে যাবো বলে মনের মধ্যে খুব খারাপ লাগছিলো। যত অসুবিধাতেই থাকি এক বছরের বেশী সময় ধরে এদের মধ্যে ছিলাম তো, কেমন যেন একটা অদৃশ্য বন্ধন সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলো এদের সঙ্গে-যা ছিন্ন করার কথা মনে হয়ে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। ছাত্ররা তখন আর পড়তে আসতো না; তাই একা একা অন্ধকারে বসে থাকতে খারাপ লাগছিলো। শামছুলের ওখানে গেলাম; গিয়ে ওকেও জানালাম, ‘‘হক সাহেব, আগামীকাল সকালে চলে যাচ্ছি।’’
শামছুল মুখ তুলে তাকালো, বললো, ‘‘কি রকম?’’
‘‘একেবারেই চলে যাচ্ছি; এখানে আর থাকবো না।’’
‘‘কেন? এরা কি না করে দিয়েছে?’’
‘‘হ্যাঁ, এরা না করে দিয়েছে। এদের এখন অসুবিধে হয়। বড় ছেলে বিয়ে করেছে তো!’’
‘‘ও। তা কোথায় যাচ্ছেন?’’
‘‘আপাততঃ শূলসুধায়।’’
ওর সেই ছাত্রীটা বললো, ‘‘স্যার, আর আসবেন না?’’
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, ‘‘না আর আসবো না, ভালো করে পড়াশুনা কোরো। খোদা তোমাদের ভালো করুন, ভালো রাখুন।’’
আমার দুলাল-রুমীর কথা মনে হলো! মনটা কেমন বিষাদে ভরে উঠলো। চুপচাপ বসে থাকলাম অনেকক্ষণ, কারো মুখে কোনো কথা নেই। ওর সেই ‘কথারু’ ছাত্রীটিও সেই একবার কথা বলেই একেবারে চুপ করে মাথা গুঁজে বসে রইলো। শামছুলের সঙ্গে এবং ওদের সঙ্গেকার প্রথম পরিচয়ের দিনগুলোর কথা মনে হলো।
তারপর কত ঘনিষ্ঠতা, কতবার যে ও আমার নোটখাতা নিয়েছে আর আমি নিয়েছি ওর বই। ওর সব বই-ই ছিল আর আমি বই কিনতে পারিনি; ও বই দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছে। তারপর ওর ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে পরিচয়-সেই গোশত দিয়ে মূড়ী খাওয়া-ওর ছাত্রীর সেই ‘আবার খেতে আসবেন’ বলে আমন্ত্রণ জানানো-সব কথা একে একে মনে হলো।