পূজার বন্ধে বাড়ী চলে এলাম। তফিজ মিয়া ভাইও তাঁর ছেলেদেরকে নিয়ে বাড়ী এলেন, মোজাহারও এলো। সকলেরই বন্ধ হয়েছিল। তফিজ মিয়া ভাই তাঁর ছেলেদেরকে নিয়ে ঢাকায় থাকতেন, তাঁর স্ত্রী থাকতেন বাড়ীতে।
বাড়ী থাকতেই আমরা খবর পেলাম যে ঢাকাতে হিন্দু-মুসলমানের ‘রায়ট’ আরম্ভ হয়েছে। এই রায়ট কথাটা এর আগেও একবার শুনেছিলাম ঢাকাতে থাকতেই। তখন এটা আরম্ভ হয়েছিল বিহারে। হিন্দুরা বিহারে সংখ্যাগুরু। তারা বিহারের মুসলমানদেরকে মেরে শেষ করে ফেলছিল। তখন ঢাকা থেকে একটি স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসক দল বিহারে গিয়েছিল। মুনু ভাই সেই দলের সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তখন এল. এম. এফ. পাস করে মিটফোর্ডে ‘মেটিরিয়া মেডিকা’র শিক্ষক হিসাবে চাকরী করছিলেন। পাটনা পৌঁছে তিনি যে টেলিগ্রাম করেছিলেন, ‘Reached Patna safely’-তা আমার খুব ভালো মনে আছে। এই রায়টেরই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পরে নোয়াখালীতে সামান্য একটু গোলমাল হয় কিন্তু সরকারের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপে তা অংকুরেই দমন করা হয়েছিল।
বাড়ীতে থাকতেই যখন খবর পেলাম যে ঢাকায় ভীষণ রায়ট শুরু হয়েছে তখন ঢাকা যেতে মন খুব সংকুচিত হয়ে গেল। এমনিতেই, ঢাকাতে পড়ার আমার মোটেই ইচ্ছা ছিল না, তার উপর আবার এই রায়ট, হিন্দু-মুসলমানে কাটাকাটি! কিন্তু তবুও যেহেতু তফিজ মিয়া ভাই সাথে ছিলেন তাই কোনো অজুহাতেই ঢাকা না গিয়ে পারা গেল না; ছুটি শেষ হতেই ঢাকা রওয়ানা হলাম। গোয়ালন্দ থেকেই শুনতে থাকলাম যে ঢাকায় খুবই রায়ট চলছে তবুও আমরা নারায়নগঞ্জ পর্যন্ত গেলাম এবং প্লাটফরমে নামলাম। নেমেই শুনলাম যে ট্রেনে উঠেও হিন্দুরা মুসলমানদেরকে মেরে ফেলছে। এইমাত্র যে ট্রেনটা এলো তার এক কামরায় বারো জন মুসলমানের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, সবই গলাকাটা। আমি আজও বুঝি না কীভাবে একজন মানুষ ঠান্ডা মাথায় আর একজন মানুষকে হত্যা করতে পারে। আমি তো জীবনে একটা মুরগীও জবাই করতে পারি না, খুব মায়া হয়! সেও তো একটা জীব, তারও তো বেঁচে থাকার ইচ্ছা এবং জীবনের সাধ–আহ্লাদ, আশা-আকাংখা আছে ঠিক আমারই মতো। আমরা আর নারায়নগঞ্জ থেকে ঢাকা গেলাম না, নারায়নগঞ্জ প্লাটফরমেই তিন দিন থাকলাম-রায়ট একটু থামে কিনা এই আশায়। কারণ মুসলমানের পক্ষে ঢাকা প্রবেশ করার কিংবা ঢাকা থেকে নারায়নগঞ্জের দিকে বের হয়ে আসার পথটা খুব বিপজ্জনক ছিল।
ঢাকা শহরে নবাবপুর রোডের পূর্বের সব ছিল হিন্দু বসতি আর নবাবপুর রোডের পশ্চিমের সব ছিল মুসলমান বসতি, তখন পুরোনো রেল রাস্তার উত্তরে খুব একটা বসতি এলাকা ছিল না। নবাবপুর রেল ক্রসিং-এর পর থেকে নারায়নগঞ্জের দিকের রেল রাস্তা চলে গিয়েছিল গেন্ডারিয়া পর্যন্ত প্রধানতঃ হিন্দু এলাকার মধ্য দিয়েই। কাজেই নারায়নগঞ্জ থেকে ট্রেনে উঠে আমরা ঢাকা যেতে সাহস পাচ্ছিলাম না; তিন দিন প্লাটফরমেই বসে থাকলাম। আমি তো এমনিতেই ঢাকা যেতে অনিচ্ছুক ছিলাম, তার উপর এই অজুহাতে আমি আর ঢাকা যেতে রাজী হলাম না। তফিজ মিয়া ভাইও ঝুঁকিটা কিছুতেই নিতে রাজী হতেন না যদি শূলসুধায় তাঁর চাকরী না থাকতো। তাছাড়া সঙ্গে তাঁর তিনটে ছেলে ছিল, যারা ছিল তাঁর, বলতে গেলে, বৃদ্ধ বয়সেরই সন্তান; তাঁর প্রথম ছেলের জন্ম হয় তাঁর বিয়ের অন্ততঃ পনর বছর পর যখন ময়-মুরুব্বী সকলেই ধরে নিয়েছিল যে তাঁর আর ছেলে-পিলে হবেই না। সন্তানের আশায় নিরাশ হয়ে তিনি যখন তাঁর আপন বোনের মেয়েকে দত্তক বা পালিতা গ্রহণ করেন তখনই তাঁর ছেলে-পিলে হতে শুরু করে এবং তিনি একে একে সাতটি ছেলে-মেয়ের পিতা হন। পালিতা এই মেয়ে আয়েশাকে তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং রসায়নশাস্ত্রে এম. এস-সি. পাস একটা ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়েছিলেন, যে বর্তমানে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। নারায়নগঞ্জ প্লাটফরমে তিন দিন বসে থাকার পর চতুর্থ দিনে আমি বাড়ী ফিরে গেলাম, মিয়া ভাই নারায়নগঞ্জেই বসে থাকলেন রায়ট কমার বা থামার অপেক্ষায়। একবার তিনি তাঁর ছেলেদেরকে আমার সাথে বাড়ীই ফেরৎ পাঠাতে চাইলেন কিন্তু সেবারই আমার প্রথম একা একা জার্নি বলে তিনি আর তাদেরকে আমার সাথে পাঠালেন না। পরে জেনেছিলাম, আরো দু-দিন বসে থাকার পর সরকারী হস্তক্ষেপে রায়ট যখন থেমে যায় এবং সরকার যখন ট্রেনের কামরায় পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করেছিল তখন মিয়া তাই নারায়নগঞ্জ থেকে ঢাকা গিয়েছিলেন।
বাড়ী আসার ক-দিন পরেই তফিজ মিয়া ভাই-এর চিঠি পেলাম যে রায়ট থেমে গেছে, ঢাকার অবস্থা তখন সম্পূর্ণ শান্ত, আমি যেন তাড়াতাড়ি ঢাকা চলে যাই। আরো ক-দিন পর ঢাকা চলে গেলাম। আমি বাসায় গিয়ে জামা-কাপড় ছেড়ে গোসল করে আসতেই দেখি কবির সাহেব করম আলীর হাতে আমার খাবার দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে এসেছেন। করম আলী ছিল বাসার চাকর। করম আলী খাবার দিয়ে চলে যেতেই কবির সাহেব পাশে বসে আমাকে খেতে বলে বাড়ীর খবর, এলাকার খবর ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করতে ও অন্যান্য কথাবার্তা বলতে থাকলেন। ভাত নীচে আনা দেখে মনে খুব একটা ধাক্কা খেলাম। তাহলে আজ থেকে আমি আর এদের এমন আপন কেউ নই যে তাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খেতে পারে; এতদিন আমি উপরে খাবার ঘরে তাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসেই খেতাম। সেদিন অত তাড়াতাড়ি এবং কবির সাহেবের নিজের করম আলীকে দিয়ে ভাত নিয়ে আসার কারণ এই ছিল যে করম আলী যাতে আগের মতোই আমাকে খাওয়ার জন্য উপরে ডেকে না নিয়ে যায়। এবার বাড়ী যাবার পর তিনি বোধহয় এটাই ঠিক করে রেখেছিলেন আমার জন্য। অবশ্য বাড়ি-ঘর তাঁদের, আমি তাঁদের কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয় নই। তাঁরা আমাকে কোথায় খাওয়াবেন সেটা তাঁদের ব্যাপার এবং তাঁরা আমাকে যেভাবে রাখেন ও যেখানে খাওয়ান সেভাবেই আমাকে থাকতে হবে এবং সেখানেই আমাকে খেতে হবে; তাঁরা যে দয়া করে আমাকে তাঁদের বাসায় থেকে পড়ার সুযোগ দিয়েছেন তাতেই আমার তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত এবং আমি তা আছিও। কিন্তু তাঁরা যদি একেবারে প্রথম থেকেই আমাকে নীচেই খাওয়াতেন, উপরে যেতে না দিতেন, তাহলে আজ হঠাৎ করে এই নীচে খাওয়ানোর ব্যবস্থায় আমার মনে কোনো আঘাত লাগতো না; আজ হঠাৎ করে এটা মনে হতো না যে এঁরা আমাকে মোটেই এতখানি আপন ভাবেন না যাকে এক টেবিলে বসে খাওয়ানো যায়!
ছোটবেলা থেকেই আমি খুব সেন্টিমেন্টাল ছিলাম। সামান্য আঘাতেই খুব মানসিক ব্যথা পেতাম। সেদিনও খুব ব্যথা পেয়েছিলাম। খাওয়া-দাওয়ার পর শুয়ে শুয়ে সেই কথাই ভাবছিলাম, এমন সময়ে মুনু ভাই ঘরে ঢুকলেন; তিনি মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল থেকে ফিরছিলেন। ঘরে ঢুকতেই টেবিলে খাবার থালা-বাসন দেখে চমকে উঠলেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘এগুলো এখানে কেন?’’
বললাম, ‘‘আমি ভাত খেয়েছি।’’
‘‘তো এখানে নীচে কেন?’’
বললাম, ‘‘করম আলী দিয়ে গেল; মিয়া ভাই সাথে ছিলেন।’’
বোধহয় ব্যাপারটা তিনি বুঝলেন এবং তাঁর কাছে ব্যবস্থাটা ভালো মনে না হলেও তিনি আর কিছু বললেন না; অন্যসব কথাবার্তা ও কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর উপরে চলে গেলেন। জানি না এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে আর কোনো কথা হয়েছিল কিনা; তবে তারপর থেকে বরাবর আমি নীচেই খেয়েছি। বিকালবেলা কলেজ মাঠে খেলতে গেলাম। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা হলো। কলেজে ক্লাস ঠিকমতোই চলছে এখন, খোলার পরে রায়টের কারণে ক-দিন ঠিকমতো ক্লাস হয়নি। প্রিন্সিপ্যাল নিজে, একজন ছাড়া Mathematics-এর সব শিক্ষক, Biology ও Botany-এর বেশ ক-জন শিক্ষক ও অন্যান্য বিষয়ের দু-একজন করে শিক্ষক হিন্দু ছিলেন; তাঁরা ঠিকমতো আসতে পারেননি। আমাদের কলেজটা ছিল ‘পশ্চিম ঢাকায়’-পুরোনো রেল ষ্টেশনের ঠিক দক্ষিণে, সিদ্দিক বাজারে, একেবারে মুসলমান এলাকায়। এ ক-দিন দেরী করে আসায় আমার খুব একটা ক্ষতি হয়নি।
ক্লাস ঠিকঠাক মতোই চলতে লাগলো। রায়টের তীব্রতা যদিও কমে গিয়েছিল তবুও একেবারে সম্পূর্ণ থেমে যায়নি। মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন দু-একটা করে ঘটনা ঘটতোই, Stabbing বা ওই ধরণের অন্য কিছু। কোনো কোনো রাতে আগুন লাগানোও দেখা যেতো এবং ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ীর ঘণ্টা বাজানো শোনা যেতো ও ছুটাছুটিও দেখা যেতো! একদিন আমাদের বাসার কাছেই নাজিরাবাজার রাস্তায় কে বা কারা এক নেপালীর পিঠে ছুরি মেরেছিল। পিঠে ছুরি নিয়েই সে চিৎকার করতে করতে রাস্তা দিয়ে বংশালের দিকে সে কি দৌড়! তারপর তার কি হয়েছিল জানি না। এইসব দৃশ্য আমি কোনোদিন দেখা তো দূরের কথা কল্পনাও করিনি। সবসময়ে একটা ভয় ও আতংক নিয়েই থাকতাম। আমার চলাফেরা যদিও কেবলমাত্র বাসা আর কলেজ, কলেজ আর বাসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তবুও সব সময়ে শঙ্কিত থাকতাম; কি জানি রাতে যদি কেউ বাসায় ঢুকে আগুন লাগিয়ে দেয় বা ছুরি মারে, যদিও বাসার গেটে সারা রাত পাহারা থাকতো একজন পাহারাদার-বন্দুক হাতে। কলেজে যেতে আসতে ভয় করতো। কলেজের একমাত্র মুসলমান অংকের শিক্ষক শামছুল করিম স্যারকে একদিন সিদ্দিক বাজারের কয়েকজন ধরেছিল তাঁকে হিন্দু বলে সন্দেহ করে। নিজের নাম এবং কালেমা বলার পরেও তারা তাঁকে মুসলমান বলে বিশ্বাস করেনি; প্যান্টের বোতাম খুলে ‘খত্না’ দেখিয়ে তবে তাঁকে রেহাই পেতে হয়েছিল। শামছুল করিম স্যারের ব্যাপারে ওদের সন্দেহের কারণ ছিল, তিনি ছিলেন বয়সে তরুণ, সদ্য পাস করা ও অতি সুদর্শন; তখন মুসলমানের ছেলে সুন্দর ও সুদর্শন হয় এমনটি সচরাচর বিশ্বাস করা হতো না। শামছুল করিম স্যারের ঘটনার কথা শোনার পর আমার কলেজে যেতে আসতে আরো বেশী ভয় করতো; কারণ আমারও সে সময়ের চেহারা খুবই সুন্দর ছিল। ভয় করতো হিন্দুর ছেলে মনে করে কেউ Stab করে বসে কিনা। তবে একটি সাহস আমার এই ছিল যে আমি যে শূলসুধায় থাকি তা এলাকার সকলেই দেখেছে এবং তারা জানতো যে আমি তাদেরই আত্মীয় এবং মসজিদে তারা আমাকে নামাজ-কালাম পড়তেও দেখেছে।
এভাবেই চলছিল। ক্লাসও বেশ পুরাদমেই চলছিল। এরই মধ্যে একদিন হঠাৎ করে ঘটে গেল এক অঘটন। সকালে নাস্তা খেয়ে ক্লাসে যাওয়ার জন্য শার্ট-পাজামা পরছি-এই পোশাকেই ক্লাস করতাম। তখন ডিসেম্বর মাস-শীতকাল, দুপুরে বাসায় এসে গোসল করতাম। কাপড় পরা শেষ হয়নি এমন সময় বাবু খাঁ এসে খবর দিলো যে আমাদের কলেজের প্রিন্সিপ্যাল নাকি Stabbed হয়েছেন কলেজের মধ্যেই। প্রিন্সিপ্যাল মহাশয় হিন্দু ছিলেন। তিনি এবং অন্যান্য হিন্দু প্রফেসররা সব ওয়ারীর দিকে থাকতেন। রায়ট শুরু হওয়ার পর থেকেই তাঁরা সবাই একসঙ্গে নবাবপুর থেকে রেল ষ্টেশনের দিকে যে রাস্তাটা এসেছে সেই রাস্তা দিয়ে এসে কলেজের উত্তর গেট দিয়ে কলেজ কম্পাউন্ডে ঢুকতেন। সেদিনও নাকি তাঁরা কয়েকজন ওইভাবেই আসছিলেন এবং কলেজ কম্পাউন্ডে প্রবেশও করেছিলেন। এমন সময় একাধিক আততায়ী তাঁদেরকে আক্রমণ করে। প্রিন্সিপ্যাল, ইতিহাসের প্রফেসর ও সম্ভবতঃ একজন কেরানী-এই তিনজন Stabbed হন। ইতিহাসের প্রফেসর সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান, কেরানী বাবু গুরুতরভাবে আহত হন আর প্রিন্সিপ্যাল অল্প আঘাত পান; তাঁর গায়ে Double breast কোট, সোয়েটার, জ্যাকেট, গেঞ্জি, জামা এইসব ছিল বলে অতগুলি ভেদ করে ছুরি তাঁর গায়ে খুব বেশী আঘাত করতে পারেনি। এতসব কথা অবশ্য আমি ঠিক তখনই জানতে পারিনি; জেনেছিলাম পরে। তখন বাবু খাঁর কাছে শুধু প্রিন্সিপ্যাল মহাশয়ের Stabbed হওয়ার কথাই শুনেছিলাম। কলেজে আর গেলাম না; শুনলাম কলেজ সাতদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।
সাতদিন পর আবার যখন কলেজ খুললো তখন ভয়ে ভয়ে কলেজে গেলাম। গিয়ে শুনলাম যে প্রিন্সিপ্যালসহ কলেজে যত হিন্দু প্রফেসর ছিলেন তাঁরা সব চলে গেছেন কলেজ থেকে। কোথায় গেছেন তা অবশ্য জানলাম না, কিন্তু তাঁরা আর কখনো কলেজে আসেননি; প্রিন্সিপ্যাল মহাশয় নাকি অল্পদিনেই সেরে উঠেছিলেন, কেরানী বাবুর ভালো হতে কয়েক মাস সময় লেগেছিল। প্রথমদিনের পারফরমেন্স আমার যতই ভালো হোক এবং মুনু ভাইয়েরা যত উৎসাহই আমাকে দিন না কেন আসলে কলেজে I. Sc.-এর ক্লাস শুরু হওয়ার পর থেকেই আমি কিন্তু খুব উৎসাহ পাচ্ছিলাম না। প্রথম কারন, একেবারে শুরু থেকেই I. Sc.-তে ভর্তি হতে আমার মন চায়নি, আমি অংকে কিছুটা কাঁচা ছিলাম, আর ম্যাট্রিকে আমার Additional Mathematics ছিল না। অথচ ক্লাস আরম্ভ হলে দেখলাম যে, Algebra-এর একেবারে প্রথমেই পড়ানো হলো Variation, Surd ইত্যাদি যা কিনা ম্যাট্রিকের Additional Mathematics-এ করানো হয়। আমার কাছে এগুলো খুব কঠিন মনে হতে লাগলো। দ্বিতীয়তঃ আমি নিজেকে অত্যন্ত নিঃসঙ্গ বোধ করতাম। এ পর্যন্ত জীবন আমার কেটেছে আপনজন ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে একটা আজন্মের পরিচিত মণ্ডলে, অথচ এখানে আমি যেখানে যে পরিমণ্ডলে এসে পড়েছি তা আমার পরিচিত তো নয়ই অনেক ক্ষেত্রে বিরূপ। শূলসুধার ওই নির্দিষ্ট কয়েকটি মুখ ছাড়া আর একটি মুখও আমার পরিচিত নয়, সেই কয়েকটি মুখের কথা ছাড়া একটি লোকের কথাও আমি ভালো করে বুঝি না। ভাষার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করার ও অন্যকে বুঝবার সামর্থ্য থাকার কারণেই মানুষ আর সব জীব থেকে পৃথক। অথচ আমি প্রাণ খুলে যেমন বন্ধু-বান্ধবদের কাছে প্রকাশ করতে পারছিলাম না নিজেকে তেমনি তাদেরকেও বুঝতে পারছিলাম না সম্পূর্ণরূপে। ফলে একটা দম বন্ধকর অসহ্য অবস্থার মধ্যে নিপতিত দেখছিলাম নিজেকে। ক্লাসেও মাত্র দু-জন শিক্ষকের কথা বুঝতাম। একজন অধ্যাপক মনসুর উদ্দীন স্যার, বাংলার অধ্যাপক, যাঁর বাড়ী ছিল আমাদের পাবনা জেলারই সাতবাড়িয়ার কাছে খলিলপুরে, আর অপরজন ছিলেন Physics-এর অধ্যাপক নুরুল আলম স্যার, তাঁর বাড়ী ছিল আমাদের পাবনা জেলারই স্থল-এর দিঘল কান্দিতে। আর সব শিক্ষকই ছিলেন নোয়াখালী, চিটাগাং প্রভৃতি অঞ্চলের যাঁদের ইংরেজী উচ্চারণের মধ্যেও তাঁদের আঞ্চলিক টান ও স্বর থাকতো বলে শুনতে মোটেই ভালো লাগতো না, যদিও বুঝতে খুব একটা অসুবিধা না হলেও। যাহোক I. Sc. বিশেষ করে I. Sc.-এর অংকের প্রতি ভয় আর বিতৃষ্ণা এবং প্রাণ খুলে কথা বলতে না পারা ও ছাত্র-শিক্ষক কারো কথাই পরিষ্কারভাবে বুঝতে না পারাজনিত দমবন্ধ ভাবের মধ্য দিয়েই আমার দিন কাটছিল। তাই এমনিতেই আমার মন ছিল উড়ু উড়ু তার উপর কলেজের ভিতরে সংঘটিত সেই ঘটনার ফলে মন আমার একেবারে দমে গেল, চিন্তা করতে লাগলাম গোপনে এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে কি পাবনা কলেজেই ভর্তি হই? খালাতো ভাই হামিদরা সব সেখানে আছে।
এ কয়েকমাস ছুটি-ছাটা কিছুই নাই, ক্লাস চলছে ঠিকমতোই-যে সব ক্লাসের শিক্ষক আছেন। এপ্রিল মাস এলো। তখন বসন্তকাল। বসন্তকাল যে একটি ঋতু, এ ঋতুতে যে আকাশ-বাতাসের রং বদলে যায়, মানুষের দেহে-মনে যে একটা অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে তা যেন সেবারই প্রথম উপলব্ধি করতে পারলাম। আগের বছর ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে আসার পর থেকে যে পরিবর্তনটা সূচিত হয়েছিল দেহ-মনে, এবার যেন সেটাই আরো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। ঠিক এই সময়েই এপ্রিল মাসের ষষ্ঠ বা সপ্তম তারিখে ডাঃ চাচা মিয়ার নামে বাপজানের একটা টেলিগ্রাম গেল, ‘‘Send Yusuf immediately.’’ টেলিগ্রাম পেয়ে সকলেই কেমন হতবুদ্ধি হয়ে গেল, আমিও কিছু বুঝতে পারলাম না। ওনারা ধারণা করলেন যে, বাপজান বুড়া মানুষ, বোধহয় আমার বিয়ে-টিয়ে ঠিক ঠাক করে টেলিগ্রাম করেছেন। এই রকমের একটা কথা আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পর থেকেই বড় বু এবং বাপজানও দু-একবার বলেছেনও। আমিও মনে করলাম যে সম্ভবতঃ তাই-ই হতে পারে, মনের কোনে একটু ভালো লাগার ঝিলিকও লাগলো। বাড়ী রওয়ানা হলাম। ওনাদের দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছিল যে বাপজান আমার বিয়ের জন্যই আমাকে বাড়ী পাঠাতে বলেছেন। কাজেই রওয়ানা হওয়ার সময় আমার সামনেই তাঁরা বললেন যে এই সময়ে ছেলের বিয়ে দেওয়াটা বাপজানের জন্য ঠিক হলো না, ছেলেটার পড়াশুনা নষ্ট হবে। যাহোক, বাড়ী রওয়ানা হলাম, একা একাই। গোয়ালন্দ এসে ঢাকা মেইল থেকে নেমে কালীগঞ্জ মেইলে উঠে বিছানা করে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্নে দেখলাম, ‘‘ষ্টীমারের উপরতলায় যেন একটা লোকও নেই-ফাঁকা। আমি আর আমার জ্যাঠাতো ভাইয়ের ছেলে হাবি ভাস্তে যেন মারামারি করছি। হাতাহাতি থেকে শুরু করে আমরা যেন দু-জন তলোয়ার যুদ্ধ শুরু করলাম; দু-জনের হাতেই দু-টো বড় বড় তলোয়ার। হঠাৎ করে হাবি ভাস্তের তলোয়ারের এক কোপ লেগে আমার ডান হাতখানা যেন বগলের কাছ থেকে কেটে একেবারে পৃথক হয়ে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙ্গে গেল।’’ জেগে উঠে বসলাম। এই স্বপ্নের যে কি মানে হতে পারে তা বুঝতে চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। সাহাবুদ্দীন সরকার, যে তখনো আমার ভগ্নীপতি হয়নি, আমাকে আনতে গিয়েছিল সাধুগঞ্জ ষ্টেশনে, বাড়ী থেকে কেউ যায়নি। টেলিগ্রাম সম্বন্ধে প্রশ্ন করায় সে আমাকে জানালো যে বাড়ী থেকে এরকম কোনো টেলিগ্রাম করা হয়নি এবং সেও আমি আসতে পারি এরকম কোনো ধারণা করে সাধুগঞ্জ ঘাটে আসেনি, এমনিতেই এসেছে; অথচ পরে আমি বুঝেছিলাম যে টেলিগ্রাম পেয়ে আমি ওইদিনেই আসতে পারি এই হিসাব করেই বাড়ী থেকে তাকে পাঠানো হয়েছিল আমাকে আনার জন্য এবং এমন কোনো ভাব না প্রকাশ করার জন্য বলা হয়েছিল যাতে আমি বুঝতে না পারি যে বাড়ীতে কোনো শোকাবহ ঘটনা ঘটেছে। তাই টেলিগ্রামের কথা অস্বীকার করার পর আমি তাকে বলেছিলাম যে আমার নির্বিঘ্নে পড়াশুনা যারা চায় না সেই সব শত্রুরাই এই সময়ে বাড়ী আনার জন্য আমাকে টেলিগ্রাম করেছে। সরকার সাহেবের সাথেই মেজো বু’র ওখানে নয়ানপুরে এলাম এবং সেখানে সামান্য বিশ্রাম করে বাড়ী এলাম বিকালবেলায়। গ্রামের মধ্য দিয়ে আসতে কারো কথায় বা ব্যবহারে কোনোরকম অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলাম না, বাড়ীতে এসেও নয়। ছোট ভাইবোন-আফছার, সাত্তার, ফেলীর কথা বিশেষ করে আফছারের কথা জিজ্ঞাসা করলাম; বলা হলো যে ওরা সব খেলতে গেছে, পরে আসবে। কারো কথাবার্তাতেই কোনোরূপ অস্বাভাবিকতা যদিও নাই তবুও সকলকেই কেমন যেন স্বল্পভাষী বলে মনে হলো। প্রায় সাত মাস পর বাড়ী এলাম; সকলের মধ্যে যে একটা প্রাণ–চাঞ্চল্য সৃষ্টি হওয়ার কথা, বিশেষ করে আমার দেহের পরিবর্তন লক্ষ্য করে, কারণ এই সাত মাসে আমার স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য অনেক বেড়েছিল, তা যেন কারো মধ্যেই লক্ষ্য করলাম না। সকলেই দু-চারটে মামুলী কথা ছাড়া আর কিছুই বলছিল না, এমনকি টেলিগ্রামের কথাও সবাই অস্বীকার করলো। তখন আমিও আমার সেই সিদ্ধান্তের কথাই জানালাম যে যারা আমার শান্তিমতো পড়াশুনা চায় না তারাই তাহলে টেলিগ্রামটা করেছে। এ সম্বন্ধেও স্পষ্ট কোনো মন্তব্য বাড়ীর কেউ-ই করলো না, বাপজানও নয়। বিয়ের সম্ভাবনায় মনের মধ্যে যে একটা রং রং গোছের লাগছিল তাও উবে গেল। বিকালে কাছারী ঘরের বারান্দায় বসে বাপজানের সঙ্গে দু-একটা কথা বলছিলাম এমন সময় ও পাড়ার অমিন আলী ভাই এসে বললেন, ‘‘তাহলে ও ছেঁড়ার মানুষ ক-জন কবে খাওয়ান হবে?’’
অমিন আলী ভাই বাপজানের ছোট ভাগ্নে। ও ছেঁড়ার মানুষ খাওয়ানো? কোন ছেঁড়ার? কিসের মানুষ খাওয়ানো? বাপজান চুপ। অমিন আলী ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘কার, কিসের মানুষ খাওয়ানো ভাই?’’
‘‘কেন আফছারের? আফছার না মারা গেছে, তুমি শোনোনি? মামু ওকে বলোনি?’’ ভাই আমার কথার জবাব দিয়ে একই সঙ্গে আমার ও বাপজানের দিকে তাকালো। মুহূর্তেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল। টেলিগ্রামের কথা, সাহাবুদ্দীন সরকারের সাধুগঞ্জ যাওয়ার কথা, বাড়ীর সকলেরই স্বল্পভাষীতা এবং প্রাণ–চাঞ্চল্যহীনতার কথা এবং এমনকি ষ্টীমারে ডান হাত কেটে পড়ে যাওয়ার সেই স্বপ্নের কথাও। আফছার ছিল ঠিক আমার ছোট, তার মৃত্যু মানেই আমার ডান হাতই কেটে পড়ে যাওয়া! বাপজান কেঁদে ফেললেন, আমিও কাঁদতে লাগলাম। মা, বড় বু সকলেই এলো এবং সকলেই কাঁদতে লাগলাম। অমিন আলী ভাই কথাটা বলে ফেলে যেন বোকা হয়ে গেলেন। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো কথাটা আমাকে জানাতেই হতো অথবা আফছারকে না দেখে আমি নিজেই বুঝতে পারতাম। মৃত্যুর খবর ক-দিন গোপন রাখা যায়? আফছারের মৃত্যুতে খুব শক্ড্ হয়েছিলাম। মাত্র তিন দিনের পারনিশাস ম্যালেরিয়ায় আফছার মারা যায়!