সামি জোকার

রম্য রচনা (জুলাই ২০১৪)

মুহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ
আমি হাসিব। ঢাকার এক ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে পড়ি। আমাদের বিদ্যালয়ের ভবন দু’টি- একটিতে ক্লাস হয়, অন্যটি থাকার জন্য। দুটোই ছ’তলা করে।আমি আবাসিক ভবনটির এক রুমে থাকি। রুমটিতে আমি ছাড়া আরো কয়েকজন থাকে। তাদের মধ্যে একজন আছে, রহস্য ও রসিকতায় ভরা অন্তরটা। নাম-সামিউল ইসলাম। তবে ‘সামি জোকার’ নামেই সবাই চেনে। ওর মতে, দু’তিনবার নাকি ‘মিরাক্কেলে’ চাণ্স পেয়েছে। অনেক জোরাজুরির পরেও যায় নি।
আজ শুক্রবার। বাসায় যাই না অনেকদিন হয়েছে। সামির বাসা কাছে। প্রতি সপ্তাহে বাসায় যায়। এ সপ্তাহে ‘যাবে না’ বলে জিদ ধরেছে। গত সপ্তাহে নাকি ওর মা ওকে বকেছে। আমার বুঝেই আসে না যে, এত কাছে বাসা থাকতেও আবাসিক থাকে কেন? জিজ্ঞাসা করলে বলে- ‘তোদের সাথে থাকতে ভালো লাগে।
গতকাল রাতে আমাদের রুমে ‘কিশোর জলসা’ হয়েছিল। প্রতি মাসের প্রথম বৃহঃবার এই জলসা হয়। কিশোর না বলে ‘সামির জলসা’ বললে ভালো হবে। কেননা পুরো জলসার মধ্যেমনি সেই। পুরোটা সময় মাতিয়ে রাখে সবাইকে। গতকাল বাপ-বেটার অভিনয়টা খুব ‘জোস’ হয়েছে। মাহমূদকে সাজিয়েছে ছেলে আর ও হয়েছে বাবা-
শীতের এক সকালে বাপ-বেটা ধানক্ষেতের আইল ধরে যাচ্ছিল। ছেলেটি হঠাৎ ববাকে প্রশ্ন করলো- আব্বু ক্ষেতে এত পানি কেন?
বাবা বলল- বেটা এগুলো পানি নয় বরং শিশির।
ছেলে বলল- তাহলে আব্বু পুরো ক্ষেতে এত শিশি(!)কে করলো?
বাবা(সামি)দর্শকদের উদ্দেশ্য করে বলল- আমার ছেলেটা ‘শিশির’কে ‘শিশি’ (পেশাব) বুঝেছে। আপনারা তাকে ক্ষমা করবেন। নইলে আপনাদের সবার ক্ষেত নাপাক!!!
শুক্রবার সাতটা পর্যন্ত বই নিয়ে বসে থাকতে হয়। তারপর নাস্তা সেরে ঘুম। আমরা সবাই সকাল সকাল ঘুমিয়ে পরলাম। কেননা গতকাল অনেক রাত করে ঘুমিয়েছি। হঠাৎ ‘ভাইয়া! ভাইয়া!’ ডাকে ঘুম ভাঙল। দেখি- সামির ভাই শহিদ এসেছে।
-ভাইয়া! চলো আম্মু যেতে বলেছেন।
-না, যাব না।
- চলো না?
-এখান থেকে চলে যা। সবার ঘুমের ডিস্টার্ব হচ্ছে।
-চলো না ভাইয়া, বাসায় মেহমান এসেছে। দুপুরে জম্পেশ লাঞ্চ হবে।
-ভালো খাবারের লোভ দেখাচ্ছিস, না? এত দরদ থাকলে দুপুরে নিয়ে আসিস।
এই কথা শোনার পর তো আমার জিহ্বায় পানি এসে গেলো। হোস্টলের যেই খাবার!? একদিন খেলে পরের দু’দিন আর না খেলেও চলে!! আজ যদি শহিদের উসীলায় কিছু জোটে! কেননা আমি ওর মতে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড!
জুমুআর পরপরই হেস্টেল থেকে দুপুরের খাবার দেয়া হয়। শুক্রবার হিসেবে মসজিদে গিয়েছিলাম নামায পড়তে। এসে দেখি- সামি হেস্টেলের খাবার খেতে বসে গেছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম– ওর না বাসা থেকে খাবার আসবে? তাহলে ও একী করছে? বাদশাহী পেয়েও ফকিরী বেশ? হয়ত জিদের ঠেলায় ভুলে গেছে! মনে করালাম না। যদি ভাগেরটা চলে যায়? কেননা আমি ওর মতে ওর....।
নির্দিষ্ট খাবার থেকে কিছুটা কমিয়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠলাম ‘ভাগ্যে আমার শিওর আছে’ ভেবে! খাবার শেষে নিজ সীটে বই নিয়ে বসে পড়লাম। ওর সীট আমার পাশেই। ও খাবার খেয়ে আমার পাশে বসেছে এবং এটা ওটা বলে ওর কর্তব্য (হাসানো) পালন করছে-
-“জানিস দোস্ত! একবার পরীক্ষায় ক্রীয়েটার-এর অর্থ লিখতে হবে। কিন্তু আমি এর অর্থটা পারছিলাম না। দাড়িয়ে আমার প্রিয় শিক্ষক ছানাউল্লাহ স্যারকে জিজ্ঞাসা করলাম। স্যার বললেন- ‘ঠিকমত পড়ো নি, এখন জিজ্ঞাসা করছো?
-স্যার, পড়েছি, এই তো হঠাৎ ভুলে গেলাম।
-পরীক্ষার হলে তো বলে দেয়ার নিয়ম নাই।
-হালকা টাচ তো দিবেন।
-আচ্ছা এতটুকু বলে দিতে পারি যে, ক্রিয়েটার, এটা আল্লাহ তায়ালার একটি গুনবাচক নাম।
তারপর আমি কী লিখলাম জানিস?”
আমি বললাম- কী?
-লিখলাম........
ইতিমধ্যে উভয়ের দৃষ্টি দরজার ‘আগন্তুকের’ উপর পড়ল। শহিদের হাতে ব্যাগ এবং ওর পাশে একটা পিচ্চি! মেহমানদের কেউ হবে হয়ত। সামি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ভাইয়ের দিকে। শহিদ খাবার রেখে চলে গেল; এদিকে আমিও আমার পড়ায় মন দিলাম!(মানে একটু ভান ধরলাম যাতে কিছুতেই বুঝতে না পারে ওর খাবারের দিকে আমার মন)
একটু পরে-
-এই হাসিব! হাসিব! কিরে পড়ায় এত মন! শোন না একটা কথা! কথাগুলো একসাথে বলে গেলো বেস্ট ফ্রেণ্ড সামি!
আমি খুশি মনে ‘পড়ায় ব্যস্ত’ ভাব নিয়ে তাকালাম। ভাবলাম হয়ত খেতে বলবে।
বলল- দোস্ত একটা কাজ করে দিতে পারবি?
আমার তো মাথা খারাপ অবস্থা। কী ভাবলাম কী হলো? এখন হয়ত বলবে- খাবারটা ফ্রিজে রেখে আসতে নয়ত প্লেট ইত্যাদি ধুয়ে দিতে অথবা কোন চালাকি আছে কথায়। কেননা কোন শুভ কাহিনীর শুরুতে বা হাসানোর জন্য অথবা নিজের মান রক্ষার জন্য পেঁচিয়ে বলাটা ওর অভ্যাস। এই তো ক’দিন আগে এক বিকেলের ঘটনা। দেখলাম- মাঠ থেকে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে ফিরছে। ভাবলাম- হয়ত হেরে ভূত হয়ে এসেছে। এসেই সোজা গোসলখানায় হাটা দিল।আমি থামিয়ে একটু মজা করে জিজ্ঞাসা করলাম- কীরে এই অবস্থা কেন তোর? খাতার গোল্লা মাঠে মারলি নাকি!
হাসিমুখে বলল- নাহ তেমন কিছু হয় নি। তিন ম্যাচের একটা সিরিজ হয়েছে। প্রথমটিতে ওরা জিতেছে। পরেরটিতে আমরা হেরেছি, তার পরেরটা আবার ওরা জিতেছে!!!!সেই পেঁচানো হোয়াইটওয়াশটা বুঝতে যে কষ্টটাই না হয়েছিল!
আরেকদিন পারফেক্ট এবং পারফেক্ট কন্টেনিয়াস টেন্স সম্বন্ধে আলোচনা চলছিল। এমনিতেই এদু’টির নিয়ম একটু পেঁচানো। তারপর আবার সেটাই ছিল আমাদের এবিষয়ের প্রথম ক্লাস। আমরা অনেকেই ভালভাবে বুঝি নি। তাই সময় করে বড়দের কাছে গেলাম বুঝতে। সামিউলকে বানালাম লিডার। কেননা আমরা জুনিয়র হলেও হার মানতে রাজি না। বড়দের নিকট জানতে যাওয়া মানে নিজেকে ছোট করা এবং হার মানা। আর মান রক্ষার দায়িত্ব সামিউল বা ওর মত ছেলে ছাড়া আর ক’জনইবা পালন করতে পারবে।
সে বড়দের রুমে ঢুকেই বলল-
ভায়েরা, শুনলাম আপনারা নাকি টেন্সে অনেক কাঁচা।
একজন বলল- এমন কথা কে বলেছে রে তোদের?
-আজকের ক্লাসে স্যারই তো বলেছেন।
তারা তো রেগেমেগে আগুন। একজন তো তেড়েই আসল।
সামি তাড়াতাড়ি বলল- থামেন! থামেন! দাপট তো ভালই নিচ্ছেন। পারলে শেষ দুটোর নিয়ম শুনিয়ে দেন না!! (এই ফাঁকে আমাদের একটু মুখস্তও হয়ে যাক!)
দামটা আরেকটু বাড়াতে আমাদের লক্ষ্য করে বলল- এই তোরা ভাল করে ধর। আজ দেখিয়ে দেব ‘জুনিয়রদের’ কারসাজি!
দাপুটে ক্যাপ্টেন এন্ড ফার্স্টবয় ভাব-সাব নিয়ে এগিয়ে এলো এবং শুরু করে দিল ‘বয়ান’।
এদিকে আমাদের অবস্থা কাহিল। কেননা এরচে’ স্যার ভালভাবে সহজে বুঝিয়েছিলেন। আর ওদিকে সামি ইংরেজ ভাব নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমার তো চিন্তা হচ্ছে- কী লজ্জার মুখেই না পড়তে হয় শেষ পর্যন্ত। তারপর পুরো স্কুল জুড়ে বদনাম ছড়ানো তো আছেই। হঠাৎ সামির গলার ‘খাখা’ শুনলাম –
‘শুনেন ক্যাপ্টেন, কলকাতার মিস্টার নুরুল হুদা কিন্তু এটা আপনার মত বলে নি। একটু সহজ ও সংক্ষেপ করেছেন। তাছাড়া ইংল্যান্ডের জর্জম্যানের গ্রামারটা একটু উন্নত। সেটা পড়েই তো আমি টেন্সে এত দক্ষ হলাম!! স্যার কিন্তু ঠিকই বলেছেন। একটু মন দিয়ে পড়বেন। ঠিক হয়ে যাবে।’
এবার আমাদের দিকে ফিরে- ‘এই তোরা চল! ক্যাপ্টেনেরই যখন এই অবস্থা তাহলে আর বাকীরা কী করবে!!
বাইরে বেরিয়ে শুনলাম সামির কণ্ঠ – “বাঁচলাম!! যদি তারা কোন প্রশ্ন করে বসত তাহলে কী হতো কে জানে? আচ্ছা তারা যদি এখন স্যারকে জানায় যে,আমরা তাদের…….। চিন্তার ছেদ পড়লো সামির ঝারিতে-
- কী ভাবছিস? বলিস না কেন কাজটা করে দিবি কিনা। কাজটা কিন্তু মজার তবে একটু কঠিনও।করলে বুঝবি!!
সামির মুখের মজা শত কঠিনকে হার মানায়। সেখানে একটু কঠিন তো কিছুই না। সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম।
সামি বলল- জানসই তো, আজ আমার বাসা থেকে খাবার এসেছে। ওদিকে আমিও ভুলে পেট ভরেছি হোস্টেল থেকে। তুই যদি ‘খাওয়া’ নামক ক্রিয়া দ্বারা আমার একটু উপকার করিস!!! তবে কঠিনটুকু হলো ‘ধোয়া’ নামক ক্রিয়া দ্বারা অন্য উপকারটিও করে দিতে হবে।
আমি বললাম- ‘আচ্ছা বুঝলাম, তোর বাসার খাবারটা খাব আর বাটিগুলো ধুয়ে রাখব এই তো?’
‘খাওয়ার ইচ্ছা নেই’ ভাব নিয়ে কথাগুলো বললাম। তারপর আবার পিছনের কথায় টেনে নিয়ে গেলাম-
তুই পরীক্ষায় কী লেখলি সেটা তো আর বললি না।
- ও! ক্রিয়েটারের (সৃষ্টিকর্তা)অর্থ?
- হুম!
- লিখলাম- “ক্রিয়েটারের অর্থ আর যাই হোক না কেন এটা আল্লাহ তায়ালার একাটি গুণবাচক নাম।”
পরে শুনেছি ছানাউল্লাহ স্যার বলেছিলেন- এটা নিয়ে নাকি শিক্ষক মহলে হাসির রোল পড়ে গিয়েছিলো এবং পরীক্ষক খুশি হয়ে এর নাম্বারও দিয়েছিলেন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
শামীম খান “ক্রিয়েটারের অর্থ আর যাই হোক না কেন এটা আল্লাহ তায়ালার একাটি গুণবাচক নাম।” হা হা হা । পরীক্ষায় কত পেল জানার ইচ্ছা ছিল । সুন্দর রম্য লেখা । ভাল লাগলো । ভোট নিন ।
ওয়াহিদ মামুন লাভলু চমৎকার লিখেছেন। খুব ভাল লাগল। শ্রদ্ধা জানবেন।
প্রজ্ঞা মৌসুমী সামি চরিত্রটাকে ভালো লেগে গেল যে। সেন্স অব হিউমারতো আছেই; সাথে একটা ঝকঝকে ব্যক্তিত্ব আছে। 'আমি' চরিত্রে এক অস্বস্তি আছে--- পড়ায় ব্যস্ত ভাব বা খাওয়া নিয়ে লজ্জার ভাব। যারা সহজ হতে পারে তাদের সাথে সহজ হওয়াটাই ভালো। সামির না খাওয়া এবং বাড়ি না যাওয়া নিয়ে রহস্যটা গল্পের শেষে এসেও ভাবাচ্ছিল। সব মিলিয়ে সুন্দর গল্প। শুভ কামনা

১৫ আগষ্ট - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪