টাইম ট্রাভেলার টু 1827

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী (সেপ্টেম্বর ২০১৪)

মোজাম্মেল কবির
মোট ভোট ২২ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.৫১
  • ২১
তার বার্তায় কবিগুরুর সম্মতি পত্রটি প্রোফেসর স্যামুয়েল মালেট এর হাতে এসে পৌঁছে চোদ্দ জানুয়ারি দুই হাজার চোদ্দ। রবি ঠাকুর ১৮৮২ সালে চন্দননগরে বাগান বাড়িতে সাক্ষাৎ দিবেন। বার্ধক্যে সাক্ষাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। মধ্য বয়সে ব্যাস্ততার জন্য সময় হবে না বলে লিখেছেন। আমি যুবক রবির সাক্ষাৎ পাবো। মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিবের চিঠির উত্তর এখনো এসে পৌঁছেনি। কতৃপক্ষ নিশ্চিত তিনি রাজী হবেন। আমার দাদা ইসমাইল শেখ তাৎক্ষণিক সম্মতি প্রকাশ করে ফেরত বার্তা পাঠিয়েছেন। সম্রাট আকবর, চেঙ্গিস খান এদের কারো সম্মতি পাওয়া যায় নি। বর্তমান যুগের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার কথা শুনে চেঙ্গিস খান তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে সাধারণের সাক্ষাৎ প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমি যেহেতু শুধু মাত্র তিন জন ব্যাক্তির সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পাবো। আমার প্রত্যাশিত তিন জন ব্যাক্তির অনুমতি মোটামুটি নিশ্চিত।
শুরুর কথাঃ
কানেক্টিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের প্রফেসর স্যামুয়েল মালেট। দশ বছর বয়সে বাবার অকাল মৃত্যুতে মর্মাহত মালেট। অতিতে বাবার সাথে সাক্ষাতের তাড়নার তীব্রতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। টাইম ডাইলেশন নিয়ে ব্যাপক গবেষনায় এক পর্যায়ে মান্চেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়াং প্রফেসার মাইকেল কক্সকে সাথে নিয়ে সফলতার মুখ দেখেন। ২০১১ সালে মালেট ১৯৬৮ সালের মধ্য নভেম্বরে বাবার সাথে দেখা করে সফল ভাবে ফিরে আসেন। প্রথম বার তার টাইম ট্রাভেল সফলতার ঘটনা অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করলেও বিভিন্ন ভাবে গণমাধ্যম গুলোতে চলে আসে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখে মালেট তার পরবর্তী পরিক্ষার জন্য উৎসাহ বোধ করেন। মাঝ খানে একবার ব্যর্থ হয়েও হাল ছাড়েন নি। এবারও তিনি নিজে কিংবা তার সহযোগী কক্স যাত্রী হবেন না। ঠিক করেছেন তৃতীয় বিশ্বের একজন অপেশাদার সাধারণ মানুষকেই পাঠাবেন। তিন ধাপের ভ্রমন। ট্রিপল ডেষ্টিনেশন জার্নি এর আগে একবার দারুন ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সেই হিসাবে এটি এবারও একটি পরীক্ষামূলক যাত্রা। এর আগে ২০১২ সালে টিটিএম০১ এর মিশন ব্যর্থ হয়েছে। সেবার যাত্রী ছিলো ভারতের অজয় দাস। সব কিছুই ঠিক ছিল গতি নির্ধারণে সামান্য ভুলের কারণে যানটি কালের গর্বে হারিয়ে যায়। গতি থাকার কথা ছিলো আলোর গতির চাইতে এক সেকেন্ড দশমিক তিন তিন ন্যানো সেকেন্ড বেশী, ভুল ক্রমে দশমিক তিন চার ফিক্সড হয়ে যায়। এবার টিটিএম০২ তে অবশ্য এই সমস্যা থাকছেনা বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। তার পরও নানা রকমের ঝুকির সম্ভাবনা থেকেই যাবে। যেমন প্রথম গন্তব্য ১৯৩৫ সালে ল্যান্ড করার পর দ্বিতীয় গন্তব্য ১৮৮২ সালে যেতে পাওয়ার অন বাটনে চাপ দিতে ন্যানো সেকেন্ড সময়ের হের ফেরে নিয়ে যেতে পারে ৮৮২ কিংবা ২৮৮২ সালে। যেখান থেকে বর্তমানে ফিরে আসার ব্যপারে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে কোন প্রকার সাহায্য করা সম্ভব না। এখানে যদিও অটো পাওয়ার অন সিস্টেম জুড়ে দেয়া আছে তার পরও যাত্রীকে কনফার্ম বাটনে চাপ দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আরো অনেক গুলো ঝুকি মাথায় নিয়ে টিটিএম০২ এর গিনিপিগ যাত্রী হতে আমার প্রচণ্ড আগ্রহ দেখে মালেট ও কক্স দুজনকেই বেশ উৎসাহিত মনে হলো।
প্রস্তুতিঃ
আন্দামান নিকোবার দ্বীপপুঞ্জের উত্তরে মধুপুর। নির্জন পাহাড়ের চুড়ায় বাংলাদেশ ভারতের সাথে নাসার যৌথ প্রকল্প। এখানেই অবসারভেটরী ক্যাম্প। এখান থেকেই যাত্রা শুরু হবে। যাত্রা শুরুর এক বছর আগে আমাকে এখানে ক্লোজ মনিটরিং করা হয় এবং নির্ধারিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষে অবস্থান করতে হয়। তেত্রিশ দিনের যাত্রা। যাত্রা শুরুর তেত্রিশ দিন পূর্ব পর্যন্ত আমাকে স্বাভাবিক খাবার ও মোটামুটি পূর্বের মতো জীবনযাত্রার সুযোগ দেয়া হয়। শেষ বারের মতো আমি কয়েক মিনিটের জন্য রোকসানার সাথে ফোনে কথা বলার সুযোগ পাই। তেত্রিশ দিন আগে আমার ৪২ বছর জীবনের মেমোরি থেকে শত ভাগ কাট পেষ্ট করে সেভ করে রাখা হয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সুপার কম্পিউটারে। সেখান থেকে আমাকে প্রয়োজনীয় তথ্যের যোগান দেয়া হবে। ফিরে আসার পর আমাকে আবার আমার মেমোরি স্থায়ী ভাবে ফিরিয়ে দেয়া হবে। শুধু দুই ভাগ কপি পেস্ট করে আমাকে দেয়া হবে। এই দুই ভাগ মেমোরির মধ্যে শুধু তিন জন সাক্ষাৎ প্রার্থীর সাথে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু রাখা হবে। তবে আমার প্রয়োজনে দুই ভাগ থেকে এক ভাগ রিমুভ করে বাকী এক ভাগ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে সংরক্ষণে থাকা অংশ থেকে কপি করে নিতে পারবো।
২৪ ঘণ্টায় মাত্র ৩৩.৩৩৩৩ মিনিট জেগে থাকতে দেয়া হয়। একমাত্র খাবার এনার্জিবার। বিশেষ ভাবে তৈরি একেকটি বার মানব দেহের ২৩ দিনের সুষম খাবার এমন কি পানির চাহিদা পূরণে সক্ষম। পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়ে যাওয়া কিছু রোগের ভ্যাক্সিন আমার দেহে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। স্বল্প মেয়াদী একটি বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে শরিরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তিন শত ভাগ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমাকে কোন প্রকার ডিজিটাল সামগ্রী যেমন ক্যামেরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। বিশেষ ধরণের পোশাকে আমাকে একটি ভার্চুয়াল অবয়ব দেয়া হবে। যা শুধু সাক্ষাৎ প্রদানকারী ব্যাক্তি ছাড়া কেউ দেখতে পাবে না।

শর্ত:
স্বাক্ষাৎ প্রদানকারীকে তার সময়ের ব্যপারে কোন প্রকার পরামর্শ দেয়া যাবে না। তাদের সাথে হাত মিলানো, কুলাকুলি করা যাবে না। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। সেখানে কোন খাদ্য গ্রহন করা যাবে না। তবে তাদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু খাদ্য ও উপহার সামগ্রী সাথে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকছে। প্রত্যেকের সাথে সাক্ষাতের নির্দিষ্ট সময় ৩৩.৩৩৩৩ মিনিট। যান নির্দিষ্ট গন্তব্যে অবতরণ করবে রাত ৩ টা ৩৩.৩৩৩৩ মিনিটে। যানটি দেখতে খুব বেশী বড় না। দেখতে অনেকটা ১৯৭০ মডেলের কার ফোর্ড তরিনো এর মতো। সামনে একটা মনিটর যেখানে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে। আমাকে একটি এ্যাস্ট্রোনোমারস স্যুট পড়ে যান থেকে বের হতে হবে। একটি হ্যান্ড মনিটরে আমাকে প্রয়োজনে সার্বক্ষণিক বার্তা প্রদান করবে। চলন্ত অবস্থায় আমার কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তখন আমাকে টানা ২৩ দিন পর্যন্ত অসচেতন থাকতে হবে। তবে সাবকনসাস মাইন্ড কন্ট্রোল রুমের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। নির্দিষ্ট সময়ে আমাকে জাগিয়ে দেয়ার কাজটি তাদের হাতে। এমন কি তাদের ইচ্ছে মতো আমাকে দিয়ে কথা বলাতে এবং না বলাতে পারার ক্ষমতাও তাদের হাতে থাকছে।
একটা বিপদের কথা আমাকে বার বার মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে। কনফার্ম ফরোয়ার্ড বাটনে চাপতে মিস টাইমিং হলে আমাকে জিরো ভলিউমে ফেরত যেতে হতে পারে। এমন ঘটনা ঘটলে সেটা হবে গবেষনার সর্বোচ্চ ব্যর্থতা। অত্যাধুনিক এই যানে বিশেষ একটা প্রযুক্তিগত সুবিধা জুড়ে দেয়া হয়েছে। এতে পাওয়ারফুল সেন্সর ল্যান্ডিং স্পিড নিয়ন্ত্রন করতে পারবে। গাছ কিংবা পাথরে ধাক্কা লাগা কিংবা পানিতে ল্যান্ড করার সম্ভাবনা নেই। এক কথায় সেফ ল্যান্ডিং এর সুবিধা আছে।
যাত্রা শুরু:
২৩ মার্চ রাত ২টা ৩৩ মিনিটে আমাকে সচেতন করা হলো। আর মাত্র এক ঘন্টা পর যাত্রা শুরু হবে। নিজেকে একটা রোবটের কাছাকাছি যন্ত্রতুল্য মনে হচ্ছে। হাত পা চলছে অনেকটা রিমোট কর্ট্রোল সিস্টেমে। ভয় দুঃখবোধ এই সব অনুভূতি মুক্ত একজন মানুষ। শেষ বারের মতো আমাকে ৩৩ দিনের শক্তি শরিরে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হলো। উত্তর আন্দামানের সবচাইতে উচু পাহারের এই কক্ষে আমাকে ঘিরে ব্যাপক উত্তেজনা সবার মধ্যে। আমাকে টিটিএম০২ যানে প্রবেশ করানো হলো। অত্যন্ত গোপন এই মিশনের কোন খবর প্রিন্ট ইলেক্ট্রনিক কিংবা যে কোন অনলাইন মিডিয়াতে প্রচারে কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে। মনে হচ্ছিলো আমি স্ট্রেচারে শুয়ে আছি। আমার চোখের সামনে থেকে দুটি প্লেট ডানে বায়ে সরে গেল। স্বচ্ছ ছাদ, যানের ভিতর থেকে চোখে ভাসছে মধ্য আকাশের ঝলমলে উজ্জল নক্ষত্র। বাইরে থেকে বাটন চাপার সাথে সাথে আমার চোখে ঘুম নেমে এলো।
তখনো বাবার জন্ম হয়নি:
১৯৩৫ সালের ডিসেম্বর মাস। ময়মনসিংহ শহরতলীর আকুয়া মৌজা। রাজা শশীকান্তের বাগানবাড়ী থেকে খুব বেশী দূরে নয়। কদিন আগে রাজার সিপাইরা ঘোড়ায় করে এলাকায় খাজনা তুলতে এসে বিদ্রোহী জনতার তাড়া খেয়ে পালিয়ে যায়। ইসমাইল শেখের মনে কিছুটা আশংকা কাজ করছে। রাজার কানে খবর গেছে সে নাকি এই ব্যাপারে প্রজাদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। ইসমাইল শেখ মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে আমার অপেক্ষা করছে পুকুর ঘাটে। গতকাল বিকেলে পুকুর ঘাটের দুই পাশে দুটি নারকেল গাছের চারা লাগিয়েছে। হারিকেন হাতে গাছ দুটির গোড়াতে আরো মাটি দিতে হবে কি না তাই দেখছিলো। যানটি নি:শব্দে লিচু বাগানে অবতরণ করে। সিগনাল লাইট থেকে মৃদু আলো ইসমাইল শেখের চোখে পরে। হারিকেনটি মাটিতে রেখে কয়েক মুহুর্ত অবাক তাকিয়ে থাকলেও স্বাভাবিক ভাবেই এগিয়ে আসেন আমার দিকে। যেনো সব রকম চমকের জন্যই প্রস্তুত ছিলেন। হারিকেন হাতে বেশ লম্বা এক যুবক এগিয়ে আসছেন আমার দিকে। সাদা পান্জাবী তার উপরে চাঁদর আর লুঙ্গী পড়ে আছেন । আমার বর্তমান বয়সের চাইতে কম করে হলেও বারো বছর কম। মেনে নিতে একটু জড়তা আসলেও তিনিই আমার দাদা। যখন আমার বাবার জন্ম নিতে আরো সাত বছর বাকী। কাছে এসে আমাকে সালাম দিলেন -আসসালামু আলাইকুম।
-অয়ালাইকুম আসসালাম। উত্তরে আমি বললাম।
-আমাকে চিনতে পারছেন?
-তর লেগ্যাই খাড়য়া আছি। তার পরে ক তর বাড়ির কি খবর?
-আব্বা বছর দেড়েক আগে মারা গেছেন উনশত্তুর বছর বয়সে। তার বছরখানেক আগে হজ্বে গেছিলেন, ২০১১ সালে। মারা যাওয়ার পরে আব্বার তসবীটা আমার কাছে রাইখ্যা দেই। মক্কা থেইক্কা কিনছিলেন। সেই তসবীটা আপনের জন্য নিয়া আইছি দাদা। আমি যান থেকে বেরিয়ে এসেছি। দুজন মুখোমুখি। দাদার দিকে তসবী বাড়িয়ে দিলে আমার হ্যান্ড মনিটরে কন্ট্রোল রুম থেকে সিগনাল আসতে থাকে। আমি নিরাপদ দূরত্ব পার হতে চলেছি। আমাকে নূন্যতম এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। দাদাকে বললাম খুলে ব্যপারটা। দাদা বললেন -তুই এক কাজ কর, তসবীটা ঔ চারা লিচু গাছের ঢালে ঝুলায়া রাখ। আমি তাই করলাম।
হঠাৎ আমার কানে অপরিচিত একটা শব্দ আসতে থাকলো। ক্রমেই শব্দটা কাছে এগিয়ে আসতে থাকে। আমার হ্যান্ড স্ক্রিনে হলুদ বাতি জলতে থাকে। কন্ট্রোল রুমে বার্তা পৌছে, ভয় পাওয়ার পরিস্থিতির বার্তা। ভয় আবেগ এই অনুভূতি গুলো মুক্ত রাখা হয়েছে আমার মধ্য থেকে। এরকম পরিস্থিতিতে আমার মধ্যে ভয় জাগবে না কিন্তু বার্তা পৌঁছে যাবে। দাদাকে বললাম -এইডা কিসের শব্দ দাদা?
- মাটির রাস্তা দিয়া গরুর গাড়ি চাইলের বস্তা নিয়া শহরে যাইতাছে। এইডা গাড়ির চাক্কার কচ্ কচ্ শব্দ। সাথে সাথে হ্যান্ড স্ক্রিনে সবুজ বাতি জলে উঠে। দাদা জানতে চাইলো আমি কয় দিনের সফরে বেরিয়েছি। আমি বললাম। সাথে এটাও বললাম যে আমার আর মাত্র সতের মিনিট সময় বাকী আছে। দাদার খুব ইচ্ছা ছিলো তার পুকুরে একটা আঠার সের ওজনের মাছ আছে এই মাছ তুলে রান্না করে আমাকে খাওয়াবেন। সময় ও সেই সুযোগ নেই জেনে খুব মন খারাপ হলো তার। আমি বললাম -দাদা আপনার এই পুকুরটার কি অবস্থা জানেন ?
- কি হইছে?
-এই পুকুরটা এখন নাই। আপনার পোলারা বিক্রি কইরা দিছে। যারা কিইন্যা নিছে তারা ভরাট কইরা চাইর তলা বাড়ি করছে। আর উত্তরে পূর্বে আপনার যত আবাদি জমি দেখতাছেন সব ঘর বাড়ি হইয়া গেছে। সারা দেশের এক অবস্থা। এই বৃটিশ সরকার নাই, বৃটিশ গেছে, পাকিস্তান গেছে এখন আমাদের নিজের দেশ বাংলাদেশ।
-আলহামদুলিল্লাহ। তাইলে তো তরা এহন স্বাধীন।
-হ দাদাজান আমরা স্বাধীন।
-খুব ভালা একটা খবর শুনাইলি। কিন্তু দাদা এত মানুষ দেশে আবাদী জমি নাই, তরা খাস কি?
-ভাত রুটি সবই খাই। জমিতে বছরে তিন চাইরটা আবাদ হয়।
আমি দাদাকে বর্তমান সময়ের সব অগ্রগতির কথা বলতেই দাদার কপালে কিছুটা ভাজ পরতে দেখা গেলো।
আমি বললাম -দাদা কি চিন্তা করতাছেন? দাদা বললেন কিতাবে তো এই সময়ের কথাই বলা হইছেরে দাদা ভাই... একটু সাবধানে থাকিস।
আমার সময় ফুরিয়ে আসার সিগনাল আসছে। আমাকে তিন মিনিটের মধ্যে কথা শেষ করে যানে উঠতে হবে। আমি দাদাকে বললাম আমার পরবর্তী সফর ১৮৮২ রবি ঠাকুরের সাথে সাক্ষাতের কথা। দাদা বললেন -যা দাদা ভাই ঠিক মতো ফিইরা আইস। কিন্তু দাদা ভাই... এইটা তুই কি করলি, নিজের এত বড় সর্বনাশ করলি? চোখ দিয়ে পানি ঝড়তে লাগলো। আবার হলুদ বাতি জলতে থাকে হ্যান্ড স্ক্রিনে। শুধু বললো -আমার কিছু বলার থাকলেও এখন আর বলে লাভ নাই দাদা ভাই। শুধু দোয়া করি ভুল করিস না ঠিক মতো ফিইরা যা।
-দাদা আমাদের যুগের মানুষের জন্য আপনার কোন পরামর্শ থাকলে দিয়া দেন আমি পৌছায়া দিবো। দাদা চোখ মুছতে মুছতে বললেন -যেই মানুষ যতো কম মিছা কথা কয় তার জীবনে ততবেশী শান্তি।
আমি যানে ঢুকে পরি। মনিটরে কাউন্টডাউন চলছে। সঠিক সময় চাপ দিলেই যাত্রা শুরু হবে নতুন গন্তব্যে। দাদা লিচু গাছের ঢাল থেকে তসবীটা হাতে নিয়ে আবেগে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। একটা এনার্জীবার খেতে খেতে আমার চোখ জড়িয়ে আসে মুহুর্তেই।
চন্দননগর বাগন বাড়ী:
১৮৮২ সাল। রবি তার ভাগ্নে সত্যপ্রসাদকে নিয়ে লন্ডনে এক সাথে ব্যারিস্টারী পড়তে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলেও মাদ্রাজে জাহজ থেকে নেমে ফিরে আসতে বাধ্য হন। ভাগ্নে তার স্ত্রী আর সন্তানের মায়ায় দেশ ছেড়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য দূরে থাকতে কষ্টের কথা মনে করে পেটের পিড়ার কথা বলে কান্নাকাটি শুরু করে। সাথে রবিকে না নিয়ে সে বাড়ি যাবে না। বাধ্য হয়ে রবিকেও যাত্রা বাতিল করতে হয়। পরিবারের লোকজনের নানা কথা শুনতে হবে এই ভয়ে চন্দননগরে জ্যোতিদার ভাড়া করা বাগান বাড়িতে উঠেন। সেখানে জ্যোতিদা ও কাদম্বরী আছে। রবিকে কাদম্বরীর মতো করে কেউ বুঝে না। জ্যোতিদার স্ত্রী নতুন বউ শুধু রবির বন্ধু না অনেক কিছু। জ্যোতিদা রবিকে পেয়ে কোলকাতা চলে যায়। তার নতুন নাটক নিয়ে অনেক কাজ বাকী।
পূর্ণিমা রাতে রবি সারা রাত জেগে থাকেন। গঙ্গার ধারে এই বাড়ি লাগোয়া পাথরে বাধানো সিঁড়ি। আজ নদীর ঘাটে বসে চাদের অস্ত যাওয়া দেখবেন সাথে অতিথির জন্য অপেক্ষা। নদীর জলে একটা চাঁদ আর আকাশে আরেকটা চাঁদ কাছাকাছি আসতে আসতে এক সময় দুটোই হারিয়ে যাবে। রাত্রির দ্বিপ্রহরে খালি গায়ে এক যুবক বসে আছে একা। আম বাগানে একটা আলো আকাশ থেকে নেমে আসতে দেখে এগিয়ে আসে কাছে। চাদের আলোয় পৌরাণিক দেবতাদের মতো লাগছিলো সদ্য যৌবনে পা দেয়া রবিকে। আমি যান থেকে বের হয়ে আসি।
-আমাকে দেখে বললেন -সুস্বাগতম আগামীর অতিথি।
-ভালো আছেন গুরুদেব?
-আপনি আমাকে গুরুদেব বলিতেছেন কেন? আজকের হিসাবে আপনি বয়সে তেইশ বছরের বড়।
-না গুরুদেব আমার কালের হিসাবে আপনার জন্মের নব্বই বছর পরে আমার জন্ম হইয়াছে।
-কালের হিসাব নিকাশ বাদ দিয়া চলো আমরা ক্ষানিকটা সময়ের জন্য মহকালের বন্ধু হইয়া যাই। বন্ধুর মতো সহজে আর কাহারো নিকট মনের কথা ব্যাক্ত করা যায় না।
কবি গুরু আমাকে নিয়ে নদীর ঘাটে বসতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আমি যানটি আম বাগানে রেখে গুরুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে থাকলাম। নদীর ঘাটে যেতে দুই পাশে দুটি উচু নিচু ঘরের মাঝখান দিয়ে সরু একটা গলি পথ পার হতে হবে। গুরু আমাকে শুধু সতর্ক করে দিলেন -এই সরু গলি পথটা একটু সতর্কতার সাথে চলিতে হইবে পাছে নতুন বউ জাগিয়া উঠে। আমি তাকে আস্বস্ত করলাম -আপনি ব্যতিত অন্য কেহ আমাকে দেখিতে পাইবে না।
আমার মেমোরিতে থাকা অধিকাংশ তথ্যই সরিয়ে রাখা হয়েছিল এতে তার অনেক প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারার আশংকায় গুরুর জন্য লিখিত কিছু তথ্য কাগজে ছেপে দেওয়া হয়েছে। আমি প্রথমে তার হাতে সেই ফাইলটা দিলাম। তিনি তা তখনি পড়ার জন্য আমাকে নিয়ে উপরের ঘরটিতে গেলেন। কয়েক পা হেটে আমি খুব ক্লান্ত বোধ করছিলাম। আমার হাটুতে শক্তি পাচ্ছিলাম না। ঘাটের দুই তিনটি সিড়ি উঠে মনে হচ্ছিলো এখনি বুঝি হোচট খেয়ে পরে যাবো। রবি তার ঘরে প্রবেশ করে একটি মোম বাতি জালালেন। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পাতা উল্টিয়ে আমার দিকে অবাক হয়ে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকলেন। আমি তার জন্য নেয়া সুনীলের প্রথম আলো অখন্ড তার হাতে দিলাম। আর বললাম -এই বইতে আপনাকে নিয়া অনেক কিছু লেখা আছে। দেখুন আপনি আজ -
অনন্ত এ আকাশের কোলে
টলমল মেঘের মাঝার
এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর
তোর তরে কবিতা আমার...
এই কবিতাটি লিখিয়াছেন তাহাও উল্লেখ আছে।
বই থেকে কয়েক পাতা পড়ে কিছুটা হতাশা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালেন, বললেন -তোমরা আমার সাথে কাদম্বরীকে জড়াইয়া প্রণয়ের গল্প লিখিয়াছ? তাহাকে আমি প্রাণের বন্ধু মানি ইহা ঠিক কিন্তু তাহাকে আমি কতটুকু শ্রদ্ধা করি তোমরা তাহা বুঝিতে পার না? সাহিত্যের বিচারে ইহা ক্ষমার যোগ্য। কিন্তু কাদম্বরী যদি ইহা পড়িয়া ফেলে তাহা হইলে লজ্জায় মরিয়া যাইবে। তাহার অভিমান আমি ছাড়া কেহ জানে না। আমার কথা অনেক বলিলাম এই বার তোমার কথা কিছু শুনি।
-আপনার সহিত সাক্ষাতের পর মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালীবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে হইবে।
রবি কিছুটা চিন্তিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আফসোসের সুরে বললেন -এই বিজ্ঞানের গবেষনায় তোমার এক মাত্র জীবনটা উৎসর্গ করিলে? তোমার স্ত্রী সন্তানের জন্য আমার বড় মায়া লাগিতেছে। আমি এর অর্থ কিছুই অনুধাবন করতে পারলাম না। হ্যান্ড স্ক্রিনে হলুদ বাতি সিগনাল দিতে থাকলো। তার মানে রবি আমাকে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু বলেছেন। আমাকে যানে উঠতে হবে। আমি রবিকে অনুরোধ করলাম একুশ শতকের সব কিছু জেনে মানুষের জন্য মূল্যবান কোন বার্তা প্রদানের জন্য। তিনি নি:সংকোচে বললেন। -তোমাদের মধ্যে পড়ার চাইতে লেখার প্রবণতা অধিক। এই চর্চা পরিহার করিতে হইবে।
বিদায় আগামীর অতিথী... তোমার কারণে ধণ্য আমার এই ক্ষন এই রাত্রি...
ঘাটে দাড়িয়ে হাত নেড়ে আমার বিদায়ের পথে তাকিয়ে থাকলেন যতদূর দেখা যাচ্ছিলো। একটা এনার্জীবার মুখে দিয়ে নিদ্রায় যাওয়ার আগে আমিও রবির প্রিয় চাঁদটিকে নদীতে ডুবে যেতে দেখলাম।
দিল্লীর কাঠের সম্রাট:
১৮২৭ সাল। দিল্লীর বাদশা কাঠের পুতুল ছাড়া কিছুই না। গালিব তার পেনশনের কাগজে সই করার জন্য বাদশাকে আনুরোধ করেছিলো। বাদশা তার অক্ষমতা প্রকাশ করে কোলকাতায় কোম্পানী বাহাদুরের দারস্থ হতে পরামর্শ দিলেন। বাহাদুরের নিকট চাটুকারী করে তৈল মর্দন করে কাগজে সই করার সুযোগ রয়েছে। সাথে এই পরামর্শও দিলেন কোম্পানী বাহাদুরের নিকট গালিব যদি এই মুচলেকা দেয় যে সে আর ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটি বাক্যও উচ্চারণ করবেনা তাহলে স্বাক্ষর পাওয়া আরো বেশী সহজ হবে। গালিব সিদ্ধান্ত নিলো সে কোম্পানী বাহাদুরের সাথে এই ব্যপারে সাক্ষাৎ করবে কিন্তু মাথা কেটে ফেললেও নত করবে না।
দিল্লী থেকে কোলকাতা নয় মাসের যাত্রা। পথে বিশ্রাম বিরতি সব মিলিয়ে এগার মাস সময়ের ব্যাপার। এই বয়সে শরির কুলোচ্ছে না। চেষ্টা সফল হবেনা জেনেও দিল্লী থেকে কোলকাতার পথ ধরলেন গালিব। এই পেনশনের টাকার আশায় চার দিকে পাওনাদার বাড়ছে প্রতিদিন। যাত্রা পথে লৌখনু পৌঁছে অসুস্থ হয়ে পরেন। বিশ্রামের জন্য কয়েক দিন থাকবেন। প্রায় দেড় মাস হয়ে গেছে শরির ভালো হচ্ছে না। আরো কয়েক দিন থাকতে হবে। প্রতি রাতে মধ্য রাত পর্যন্ত চলে শের শায়েরী। স্থানীয় ফার্সি কবিরা তার সঙ্গ লাভে ধণ্য।
একটা ঘরের মেঝেতে বিছানা। দেয়ালে একটা হারিকেনের বাতি জলছে। সাদা চাদরের বিছানায় বসে গালিব গাইছে -হার এক বাত পে ক্যাহতেহো তুম কে তু ক্যায়া হ্যা... কাশিতে গাইতে পারছেন না খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি তার কাশির শব্দ শুনে চিনতে পারলাম। ঘন জঙ্গলের পাশেই এই ঘর। আমি যান থেকে বের হয়ে গালিবের দরজার কাছে দাড়ালাম। আস্লামালেইকুম হুজুর। আমি কি ভাষায় কথা বলবো বুঝতে পারছিলাম না। মুখ দিয়ে সালামের পর মনের অজান্তে চলে আসে -হাউ আর ইউ?
তিনি হেসে ফেললেন। আমাকে ভিতরে যেতে হাত দিয়ে ইশারায় ডাকলেন আর বললেন -হাম কলিকাতা যাচ্ছে। কিছু বাংলা শিখে নিয়েছে। তুম বাংলামে বলো। এই বলে আবার আনেক্ষণ ধরে কাশতে থাকলেন।
আমি তার জন্য নেয়া বারোটি কাশির সিরাপ ডেক্সপোটেন তার সামনে দিয়ে বললাম -আমাদের নিজের দেশের তৈরী কাশির দাওয়া। আমরা বৃটিশদের তাড়িয়ে এক বার স্বাধীন হয়েছি আবার পাকিস্তানীদের তাড়িয়ে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়েছি। এই কথা শুনে গালিবের চোখে জল এসে গেলো। আমাকে জড়িয়ে ধরতে উঠে আসতে থাকলো। আমার হ্যান্ড মনিটরে হলুদ বাতি জলে উঠলে আমি বললাম -হুজুর নিরাপদ দূরত্ব বজায় না রাখলে আমার ক্ষতি হয়ে যাবে। -তোমার ক্ষতির বাকী কিছু নেই... চল্লিছ সালমে হাম ছ্যায় বাচ্চে জনম দিয়া। কিন্তু এক ভি বাচে নেহি। এক অর ভি বাকী, যাব মার্জি উঠা লেগা...
চল্লিশ সাল এর মানে কি বোঝাতে চেয়েছেন আমি কিছুই বুঝলাম না।
এর মধ্যেই এক বোতল সিরাপ ডক ডক করে পুরোটা খেয়ে ফেলেছিলেন। কাশিটাও মনে হলো কমেছে। কথা বলে বেশ আরাম পাচ্ছেন তিনি।
-হুজুর আপনার বেগম তো আল্লার খুব বন্দেগী করে দিন রাত। সে মনে করে আপনি নাস্তিক। আপনি কি আসলেই নাস্তিক?
-তুম ভি দেখছি আমার বেগমের মতো বাচ্চা। আরে নাস্তিকভি এক আস্তিক হ্যা। এ খবর জানো? খোদার সাথে আমার দোস্তী আমার বেগমসে বহুত য্যাদা। খোদা লেবাসমে নাহি আচারমে নাহি, খোদা তো হ্যা দিলোমে।
কিছুটা ঝিমিয়ে আসছেন মির্জা সাহেব। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন। এ্যা কেয়া দাওয়া পিলাদি তুমনে? এ্যা তো মিঠা শারাব হ্যা।
আমি বললাম হুজুর এই দাওয়া এতোটা এক সাথে খেতে হয় না, কম করে খেতে হয়।
তিনি শায়ারের ছন্দে বলতে লাগলেন -জিন্দেগীকা সফরমে য্যাদা কম কেয়া হে... জিন্দেগীকা সফরমে য্যাদা কম কেয়া হ্যা।
পিলানে কে বাদ নেশা না আয়ে তো গাম ক্যায়া হে...
আমার প্রথম এ্যালার্ট সিগনাল চলে এসেছে। আমি শেষ বারের মতো জানতে চাইলাম আমাদের প্রজন্মের জন্য আপনার কি পরামর্শ হুজুর? তিনি কিছুক্ষণ সময় চুপ থেকে বললেন -পেয়ার দিলছে কারো নাহি জিসিমসে... পেয়ার দিলসে কারো নাহি জিসিমসে...
দিল বিকতা নেহী, জিসিম বিকতাহে খোলে বাজারমে...
শেষ এ্যনার্জি বার মুখে দিয়ে মির্জা সাহেবের ভালোবাসা নিয়ে শায়েরীটা আমাকে কিছুটা চিন্তায় ফেলতে চাইলো। কিন্তু আমার মাথায় তেমন চিন্তা কাজ করছে না। চিন্তার সীমাবদ্ধতা দূর হবে আমার পরিপূর্ণ মেমোরি ফেরত দেয়ার পর।
বাড়ি ফেরাঃ
আমি যখন চোখ খুললাম তখন জানতে পারলাম তিন দিন আগে আমি ফিরে এসেছি। আমর হাত পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছিলাম। এর মধ্যে আমাকে জীবাণুমুক্ত করে আমার পূর্বের স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। বার বার আমার দুই সন্তান নবনী সৃজন আমার মা স্ত্রী রোকসানা ভাই বোন সবার কথা মনে হচ্ছিলো। ছেলে মেয়ে দুটো বাবাকে সাত দিন না দেখলে অস্থির হয়ে উঠে আজ প্রায় পনর মাস পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন না জানি ওরা কেমন আছে। বার বার আমি বিছানা থেকে উঠতে চাইলে তারা কেউ উঠতে দিচ্ছে না। আমার নাকি আরো চব্বিশ ঘণ্টা বিশ্রাম লাগবে।
প্রোফেসর মালেট এবং কক্স কোথায় জানতে চাইলে কেউ উত্তর দিচ্ছে না। প্রোফেসর ব্রায়ান কক্স এর মিষ্টি হাসি মাখা মুখ খুজছিলাম আমি। এই মানুষটি আমাকে বেশ মনোবল যুগিয়েছে। তার সহকর্মী যারা ছিলেন তাদেরও কাউকে দেখছি না। সব নতুন মুখ। যাই হোক আমার এখন বাড়ি ফিরতে হবে।
বাইরে হেলিপ্যাডে হেলিকাপ্টার দাড়িয়ে আছে। আমাকে আমার শহর ময়মনসিংহের সার্কিট হাউজ মাঠে পৌঁছে দেয়া হবে। আমাকে বিছানায় বসিয়ে সেভ করে নতুন পোশাক পড়িয়ে দেয়া হয়। তৈরি হয়ে হেলিপ্যাডের দিকে এক পা এগোতেই হোঁচট খেয়ে রুমের ফ্লোরে পরে যাই। দুই জন দুই বাহুতে ধরে দাড় করিয়ে দেয় আবার। কিন্তু শরিরে যেই পরিমাণ শক্তি থাকার কথা তা পাচ্ছি না। অনেক কষ্টে শরিরের সমস্ত শক্তি খরচ করে হেলিকাপ্টারে উঠি। সাথে দুই জন সঙ্গী যাচ্ছে আমাকে পৌঁছে দিতে। দুজনই বিদেশী। আমি এদের নাম জানি না।
সার্কিট হাউজ মাঠে নামার পর আমি চার দিক তাকিয়ে অবাক হলাম। লাখ লাখ মানুষের ভিড়। কড়া নিরাপত্তা। আন্তর্জাতিক মিডিয়া সহ শদুয়েক টেলিভিশনের ক্যামেরা। কাউকে সাক্ষাৎ দেয়া বা প্রশ্ন করতে দেয়া হচ্ছে না। নির্দিষ্ট দূরত্বে দাড়িয়ে শুধু ভিডিও করতে পারবে। বিভাগীয় পুলিশ কমিশনার নিজে উপস্থিত থেকে নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন। মেডিক্যাল টিম সহ একটা গাড়ি হেলিকাপ্টারের কাছে এসে দাড়ায়। আমি গাড়িতে উঠে বসলে সাথে সাথে গাড়ি ছাড়ে আমার বাসার দিকে। বাইরে তাকিয়ে আমার কাছে সব কিছু অপরিচিত লাগছে। রাস্তার দুই পাশে সব উচু উচু দালান। সব চাইতে ছোট দালানটি বারো তলা। মনে হচ্ছে আমি হংকং কিংবা সিঙ্গাপুর শহরের কোন পথ দিয়ে যাচ্ছি। আমি পাশের সঙ্গীকে বললাম ভাই আমাকে এখানে কোথায় নিয়ে এসেছ? তারা কিছুক্ষণ একজন অন্যজনের দিকে তাকিয়ে বলল -এটা আপনারই শহর ময়মনসিংহ। আমার বিশ্বাস হল না। ওরা মিথ্যা কথা বলছে।
একটা চার তলা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে এসে বলে এটা নাকি আমার বাড়ি। গেটের সামনে এসে একজন আমেরিকান যুবক সঙ্গী আমাকে বলে -সরি স্যার, দিস ইজ টু থাউজেন্ড ফিফটিসিক্স!
এতক্ষণে আমার শরির মন আরো বেশী দুর্বল হয়ে আসছে। হাঁটুতে দাড়িয়ে থাকার মতো শক্তি পাচ্ছি না। আমার ভমি আসছে। বাসার ভিতর থেকে একজন বৃদ্ধা এসে আমাকে তার কাঁধে ভর দিয়ে ভিতরে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেয়। কপালে ভাঁজ, গালে ঢিলে চামড়ায় গড়িয়ে পরা জল দেখে বুঝতে পারলাম বৃদ্ধা আমার রোকসানা। অভিমানে নীরব সেই আগের মতোই মুখটি আছে এখনো। চল্লিশ বছর হারিয়ে গেছে আমাদের জীবন থেকে! শুধু এইটুকু গোপন রাখা হয়েছিলো আমার কাছে।
নবনী আমেরিকায় স্বামীর সাথে বসবাস করছে পঁচিশ বছর। সৃজন আছে কানাডায়। দুজনেই সন্তানের মা বাবা হয়েছে। আমি হেটে হেটে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখে চিনতে পারি না। এই বৃদ্ধ মানুষটি কে দাড়িয়ে আছে আমার সামনে! মাঝ খানের চল্লিশটি বছর ফেলে রেখে আসলাম অতিতে! আমার বুড়ো চামড়ার দুটি গাল জলে ভিজে গেলো। রোকসানা আমাকে ধরে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দেয়। মাথায় ঠাণ্ডা তেল ঢেলে হাতের আঙ্গুলে বিলি কাটতে থাকে। চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে... চল্লিশটা বছর আমি এই মায়ার স্পর্শ থেকে বঞ্চিত! প্রফেসর কক্স জানতো আমার ফিরে আসতে চল্লিশ বছর লাগবে অথচ আমার কাছে গোপন রেখেছে! হঠাৎ চোখ থেকে ঘুম চলে যায়... হাহাকার জেগে উঠে... হায় একি হলো! এই করতে করতে এক সময় হারিয়ে যাই ঘুমের রাজ্যে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এফ, আই , জুয়েল # ধন্যবাদ । অনেক সুন্দর লেখা ।।
রোদের ছায়া অনেক অভিনন্দন কবির ভাই।
ধন্যবাদ আপা। ভালো থাকুন।
নেমেসিস অভিনন্দন! অনেক শুভকামনা রইল।
অনেক ধন্যবাদ। আপনার সুন্দর মন্তব্য গুলো বিজয়ের আনন্দের চাইতে কম নয়... ভালো থাকুন।
আফরান মোল্লা অভিনন্দন রইলো॥
ধন্যবাদ আপনাকে।
নাজনীন পলি অভিনন্দন।
অনেক ধন্যবাদ।
শামীম খান অনেক অভিনন্দন ।
ধন্যবাদ শামীম ভাই।
সাদিয়া সুলতানা অভিনন্দন
ধন্যবাদ আপা। ভালো থাকুন আপনি।
নাজমুছ - ছায়াদাত ( সবুজ ) অনেক অভিনন্দন
ধন্যবাদ সবুজ ভাইয়া। ভালো থাকুন।

২৫ মে - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৪৬ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.৫১

বিচারক স্কোরঃ ৩.৬২ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ১.৮৯ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪