ভালোবাসা মানে কি শুধুই নিঃশেষিত পরাজয়!

অন্ধকার (জুন ২০১৩)

Tumpa Broken Angel
  • ১৫
সেই কখন থেকে পড়ে আছি অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে রুমের ভিতর। বাহির থেকে দরজা লাগানো! বন্ধ চোখেও কি করে যেন দেখতে পাচ্ছি চারপাশের সব কিছু! ভারি পুরাতন পর্দা সেটে দেয়া বিশাল জানালায়। তাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র! সেখান থেকে টিমটিম আলো এসে চুইয়ে পড়তে চাইছে গুমোট ঘরটিতে! শক্তি নেই উঠে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে বিকেলের আভাকে আমন্ত্রণ জানাবো। সারা শরীরের মাসেলগুলোও যেন শক্ত লোহা হয়ে গেছে। তৈরি হচ্ছে না শক্তি উৎপাদনের জন্য এ টি পি। নাকের পাশে কয়েক ফোটা রক্ত কণা শুকিয়ে হয়ে গেছে চটচটে। পাজি মাছি গুলো বার বার এসে সেখান থেকে শুকে নিতে চাইছে মৃতের গন্ধ! নাকের নালিকা দিয়ে ঢুকে পড়তে চাইছে ছোট ছোট পিপড়ের দল। দু হাতে শক্তি নেই হাত উঠিয়ে তাদের তাড়িয়ে দেব!
আচ্ছা অনিরুদ্ধ কি জানে আমি মরে মর্গে পড়ে আছি? বোধয় জানে না। তাই হয়ত এত নিশ্চিন্তে এখনো বিকেলের মৌনতাকে ছুঁয়ে বেড়াচ্ছে! আচ্ছা সে জানলে এখন কি করত? সে কি পাগলের মত ছুটে আসতো আমার কাছে? এই যাহ! কি আবল তাবল ভাবছি!
আগে দিনের মধ্যে বহুবার আমার অনিরুদ্ধকে দেখার সাধ হত। ইচ্ছে করত ওর হাতে হাত রেখে অনুভব করি ওর শিরা উপশিরা দিয়ে বয়ে চলা রক্তের গতি স্রোত। ওর বুকে মাথা রেখে শুনে নেই ওর মনের সব কথা। কিন্তু সেই সাধ আমার অপূর্ণই রয়েছে! স্বপ্নগুলো সুখের বাসরের ফুলশয্যায় নানা রঙে সাজার আগেই আমি চলে এসেছি ওর থেকে অনেক দূরে! অন্ধকারের এই একাকী জগতে! যেখানে কখনো ভোর হয় না! ভরাট অন্ধকারের মায়াজাল জড়িয়ে রাখে সর্বক্ষণ! খুব ইচ্ছে ছিল এখানে আসার আগে অন্তত একটিবার ওর সাথে কথা বলি। অভিমানী কন্ঠে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলি ''আমি চলে যাচ্ছি অনিরুদ্ধ! আর কোন দিন ফিরব না তোমার কাছে! তুমি আমাকে ছাড়া ভালো থেকো।'' হৃদয় অলিন্দে তখনো ক্ষীণ আশা দোদুল্যমান ছিল অনিরুদ্ধ ফোন রিসিভ করে আমাকে তার কাছে ফিরিয়ে নেবে। সে আমাকে কিছুতেই চলে যেতে দেবে না আলোর জগত ছেড়ে!
কিন্তু সে আমার ফোন একটি বারের জন্যও পিক আপ করে নি! মনে আছে গুনে গুনে ঠিক বিশ বার আমি তাকে ফোন করেছিলাম।
বাহিরের দরজায় শব্দ! অনিরুদ্ধ তুমি এসেছো কি? ভালো হয় তুমি এসে আমাকে এই স্যাঁতস্যাঁতে বদ্ধ ঘর থেকে নিয়ে গেলে! আমি যে আঁধারের বাসিন্দা হতে চাই না! আমিও যে চাই কুসুম রোদের সকালে গরম চায়ের কাপে ভালোবাসা মেশানো তোমার হাতের স্পর্শ!
নাহ এই যে অনিরুদ্ধ নয়। ডাক্তারের ইউনিফর্ম পরিধান করা একজন লোক এসেছে! সাথে আরো চার। একজন পুলিশও আছে। তার হাতে কেইস চালান রিপোর্ট!!!! তাদের একজন দেখতে কুচকুচে কালো। ডোম হয়ত! এই যাহ! আমি তো ভুলেই গেছি আমি এখন আছি লাশ কাটা ঘরে!
ওরা আমাকে নিয়ে আসার সময় মা অনেক কাঁদছিলেন। চিৎকার করে বলছিলেন ''আমার মেয়েকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ।''
একজন পুলিশ ইন্সপেক্টার গাঢ় স্বরে বলে ছিল ,''আত্মহত্যার বডি পোস্টমর্টেম ছাড়া রিলিজ দেয়া হয় না। কি কারণে ভিক্টিম ঘুমের বড়ি খেয়েছে তা খতিয়ে দেখতে হবে।''
ওরা প্রায় জোড় করেই মায়ের কাছ থেকে আমায় ছিনিয়ে নিয়ে এল মর্গে। মা মাটিতে আছড়ে পড়ে কাঁদলেন!
বাবার চোখ তখন রক্তলাল! আমার নিশ্চল পাথর চোখ দিয়েও বাবার চোখের দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছিলাম! কারন আমি যে অনেক বড় ভুল করেছি! তার শত মিনতির পরও তার একটি অনুরোধ আমি রাখি নি। তার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করি নি। বরং তার মুখে চুনকালি দিয়ে খেয়েছি গোটা বিশেক মরণ বড়ি! খুব ইচ্ছে করছিল বাবার পা জড়িয়ে ধরে বলি ''বাবা আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার মত মেয়ে তোমার মত বাবার যোগ্য না। এই অযোগ্য মেয়েকে ক্ষমা করে দিও।''
আমার দু চোখ দিয়েও গড়িয়ে পড়ছিল নিরব অশ্রু। অন্তরের হাহাকার বুক চিরে বেরিয়ে এসে ভুবন কাঁপিয়ে বলতে চাইছিল ,''আমি এমন পরিণতি চাই নি! আমিও যে চেয়েছিলাম প্রিয়মুখগুলোদের নিয়ে স্বপ্ন সুখের স্বর্গ! কিন্তু ভালোবাসার অপরাধে আমি মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত। আমি যে কিছুতেই অনিরুদ্ধকে ভুলে যেতে পারি নি!!''
আমার অশ্রু কেউ দেখেনি! বেঁচে থাকতেও না, মরে যাবার পরেও না!
............
কুৎসিত ডোমেরা শরীরের অঙ্গ পতঙ্গ কেটে বের করে বুঝতে চাইছিল মৃত্যুর কারণ। লিভার, স্টোমাক, অন্ত্র সব কিছুই পরীক্ষা করে দেখছিল!! এই পোস্টমর্টেমও যে খুব বীভৎস!!!!
কিন্তু আমি ভাবছিলাম অন্য কথা! ওরা আমার হার্ট বের করে দেখবে কি? দেখতে পাবে কি আমি অনিরুদ্ধকে কত ভালোবাসি?
বেঁচে থাকতে তো আমার ভালোবাসা কেউ দেখেনি! অনিরুদ্ধও না!

ডাক্তার স্টোমাকের বিষ দেখে নিশ্চিত হলেন মৃত্যু ঘুমের বড়ি সেবনের কারণেই হয়েছে। যাক বাঁচা গেল! সহজেই তারা পেয়েছেন মৃত্যুর কারণ। বেশি কাটাকাটি করতে হয়নি।
আর মেয়ে মানুষের দেহ পোস্টমর্টেমের একটা বাড়তি ঝামেলা হল পেটে বাচ্চা আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা। জরায়ু কেটে বের করে খুঁজে দেখা অঙ্কুরিত শিশুর বীজ!!!!
............
খুব ইচ্ছে ছিল অনিরুদ্ধের সাথে একটা খুব সুখের সংসার হবে আমার। ঐশ্বর্য না থাকলেও থাকবে ভালোবাসার প্রাচুর্য! কিন্তু অনিরুদ্ধ যে বোঝে নি আমার ভালোবাসার আর্তনাদ! তার কাছে ভালোবাসা ছিল মোহ। অবসরে যাপনের মাধ্যম। সে একবারও বুঝে নি তার ভালোবাসা আমার কাছে ছিল আমার জীবন!!!
একটু পর পোস্টমর্টেম শেষে একটি স্ট্রেতে আমাকে নিয়ে বাহিরে বেরিয়ে এল দু জন লোক। মাইক্রোবাসে তোলা হল। আমাকে ফিরিয়ে দেয়া হল আমার মায়ের কাছে। তিনি বার বার আমাকে দেখে মূর্ছা যাচ্ছিলেন। আমি তার এক মাত্র সন্তান কিনা!
আজ বাড়িতে অনেক লোক এসেছে! পাড়া প্রতিবেশি আত্মীয় স্বজন আরো অনেক চেনা অচেনা লোক। কেউ কেউ চাপা স্বরে বিড় বিড় করছে। উৎসুক জনতার অনুসন্ধিৎসু চোখ খুঁজে বের করতে চাইছে আত্মহননের কারণ। আমার কয়েক জন বান্ধবীও এসেছে। ওরা সবাই হতবাক! ঐ তো আমার বান্ধবী নীলাও এসেছে। মনের সব ছোট ছোট দুঃখ কথা গুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে শেয়ার করতাম তার সাথে। শুধু বলি নি অনিরুদ্ধকে নিয়ে আমার চাপা কষ্টগুলো! এই কষ্টগুলো যে একান্তই আমার!
চারিদিকে চলছে আমাকে পরপারে পাঠানোর আয়োজন। গোসল করানো, কাপড় পড়ানো, আতর মাখানো আরো কত কি! একটা মস্ত খাট পাতা হয়েছে বাড়ির বাহিরে উঠোনের ঠিক মাঝ বরাবর।
আর আমার দু চোখ শুধু খুঁজে চলেছে অনিরুদ্ধকে!!!!!! সে কি এসেছে শেষ বারের মত আমাকে দেখতে?...... না সে আসে নি। সে পুলিশি কেসে ফেঁসে যাবার ভয়ে কিছু দিনের জন্য পাড়িয়ে জমিয়েছে ঢাকার অদূরে। এদিকে যে আমি অনিরুদ্ধকে নিরাপদ রাখার জন্য লিখে রেখে গিয়েছি সুইসাইডাল নোট''আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না'' ।
আর সে কিনা স্বার্থপরের মত পালাল!
মনে আছে একবার অনিরুদ্ধ আমায় বলেছিল সে আমাকে কোন দিন ছেড়ে যাবে না। আর আমায় ভুলে যাওয়া? সেও কি সম্ভব! সেই অসম্ভবকেই অনিরুদ্ধ সম্ভব করেছে খুব সহজ করে। ঘুম থেকে উঠে দুঃস্বপ্নের মত আমাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে তার জীবন থেকে। তাই আমি নিজেই চলেছি ঘুমের জগতে! নিঃশেষিত পরাজয়ের দিকে, আমার অন্ধকারের জগতে.......
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিলন বনিক অনেক সুন্দর কাহিনী....ভালোবাসা আর হতাশা...সেই সাথে আত্মহত্যা...কিন্তু কেনই বা আত্মহত্যা...সে কারনটি অস্পষ্ট হলেও ধারনা করছি (জরায়ু কেটে বের করে খুঁজে দেখা অঙ্কুরিত শিশুর বীজ!!!!)...আত্মকথনের মতোই সুন্দর পরিপাঠি কাহিনী...খুব ভালো লাগল....
অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।
মোঃ আক্তারুজ্জামান অনেক অনেক সুন্দর লিখেছেন। তবে মনে হল খুব তাড়াহুড়ো করে শেষ করেছেন। লেখা শেষ করে কয়েকবার পড়লে লেখাটা অসাধারণ হয়ে উঠত। 'একটা মস্ত খাট পাতা হয়েছে বাড়ির বাহিরে'- মৃতের জন্য মস্ত খাট কথাটা বেমানান। 'চারিদিকে চলছে আমাকে পরপারে পাঠানোর আয়োজন'- মৃতকে আবার পরপারে পাঠানোর আয়োজন কী? এখানে বোধ হয় কবর দেয়ার আয়োজন বোঝাতে চেয়েছেন। এসব খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলি নির্ভুল করতে পারলেই লেখা সার্থক হয়ে উঠে। ধন্যবাদ।
না ভাই তাড়াহুড়ো মোটেও ছিল। আর আপনি যেই পয়েন্টগুলো বললেন সেগুলো ইচ্ছেকৃতভাবেই লেখা। আসলে একটি নিঃস্ব ব্যথিত মন বনাম জগতের কিছু অলঙ্ঘিত নিয়তি কখনো কখনো কত ব্যাপকভাবে হৃদয়কে আলোড়িত করে তা বোঝাতেই ''মস্ত খাট'' আর ''পরপারের আয়োজন'' কথাগুলো এসেছে। যাই হোক আপনার পরামর্শ আমার মাথায় থাকবে। শুভেচ্ছা জানবেন।
বিদিশা চট্টপাধ্যায় স্মার্ট ,ঝকঝকে গদ্য। বেশ লিখেছ।
অনেক ধন্যবাদ আপি।
এফ, আই , জুয়েল # ভিন্ন ভাবধারা আর আবেগী রোমাঞ্চে সুন্দর একটি গল্প । লেখককে ধন্যবাদ ।।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
এশরার লতিফ চমৎকার একটা লেখা।
শুভেচ্ছা জানবেন।
অনিমেষ রায় ভাল লেগেছে।
শামসুল আলম আপনি ভালো লিখেন অথচ একটু যত্নের দরকার, আপনি কথাসাহিত্য আরো পড়া জরুরী মনে করি...
সূর্য গল্প কবিতা দুটোতেই পাঠকের আলোচনায় এসেছ, এটা তোমার লেখার হাতের কারনেই। সুন্দর গল্প ভালো লাগা রইল।
খুবই উৎসাহিত হলাম। শুভেচ্ছা জানবেন।
অদিতি ভট্টাচার্য্য সাবলীল ঝরঝরে লেখনী। ভালো লাগল।
অনেক ধন্যবাদ আপুনি।

১৬ মে - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪