বছরের পর বছর মিরু নিজেকে প্রশ্ন করে যে উত্তরটা খুঁজে পেলনা তা হল অর্ক এর সাথে নিজেকে জড়ানো উচিত হবে কি-না। যে বয়েসের গগনে এসে একটা ছেলে বা মেয়ে আবেগ নির্ভর হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেটা অধীকাংশ ক্ষেত্রে চারিপার্শ্বীক বাস্তবতার সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠে ঠিক সেই সময়ে দুজনের পরিচয়, ইন্টারমিডিয়েট এর পাঠ চুকিয়ে অনার্সে যখন যাত্রা শুরু, সেই থেকেই দু’জনের পরিচয় সূত্র।
মিরু কিংবা অর্ক কেউ কোনদিন কাউকে বলেনি আমি তোমাকে ভালবাসি, তথাকথিত চলমান প্রেম ভালবাসার উপকরণ গুলো তারা ব্যাবহার করেনি কখনো, তারা হাত ধরে যায়নি পহেলা বৈশাখ এর জনসমুদ্রে নিজেদের ডুবিয়ে দিয়ে ধুলোর জগতে মিশে নিজেদের বর্ণ ধূসর করার প্রতিযোগীতায়, পার্ক রেষ্ট্রুরেন্ট এ গিয়েছে সেটা কোন ডিম লাইটের আলোতে নিজেদের রঙ্গিন করে দেখার তাড়নায় নয়, ভাল লাগা ভালবাসা এটা প্রকৃতির একটা উপাদান, এটাকে অস্বীকার করলে মানব কিংবা জীব জগৎ সকলেরই অস্তিত্ব বিপন্ন হতে বাধ্য, মিরু অর্কের ভাল লাগা ভালবাসা দুটোই ছিল কিন্তু তার প্রকাশ যতটানা বাহ্যিক তার চাইতে ঢের বেশী মননে, মানসিকতায়, আচার ব্যাবহার আর নিজেদের মধ্যে না বলা অনেক কথা বুঝে নিয়ে সামন্তরালভাবে এগিয়ে চলার।
মিরু অর্ক ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেনি তা কিন্তু নয়, তারা নিয়ত এটা নিযে যুদ্ধ করেছে নিজেদের সাথে, সামাজিক দুরুত্ব খুব বেশী না হলেও অর্থনৈতিক ব্যাবধান ছিল ঢের, মিরুরা যেখানে উচ্চবিত্তের স্তরে সাবলিল সেখানে অর্কদের পরিবার মধ্যবিত্তের স্থানটা ধরে রাখার প্রাণন্তকর চেষ্টা, পড়ালিখার পাঠ চুকিয়ে যখন মিরুর বিয়ের তোড়জোর চলছিল তখন অর্ক পায়ের জুতো ক্ষয় করছিল একটা চাকুরীর, মিরুর বিয়ে যেমন হয়-হচ্ছে ঠিক তেমনি অর্কের চাকরীও।
এখনো মাঝের মধ্যে ফোনে যোগাযোগ হয় তাদের, সেদিন মিরু জিজ্ঞেস করছিল চাকরী বাকরি কোন কিছু হল কিনা, অর্ক বলেছিল চেষ্টা করছি, মিরু সেদিন বার বার বলছিল, সবাই জুটিয়ে নিয়েছে চাকরী, ব্যাবসা যে যার মতো, তুমি পারনা কেন? কথাগুলো বলার সময় খুব বিষন্ন মনে হচ্ছিল মিরুকে, অর্ক হয়তো বুঝতে পেরেছে সেই বিষণ্নতার কি মানে।
ভাল মন্দ মিলে অবশেষে যখন একটা চাকরী হয়েই গেল তখন অর্ক হাফ ছেড়ে বাঁচল, বেকারত্বের বোঝা যে কত বিষাদ, প্রতিটা সেকেন্ড যে কি তুফান বয়ে চলে মস্তিষ্কে সে ভয়ংকর দৃশ্যগুলো অর্ক আর ভাবতে চায়না, আজ তার কেন জানি কেবল মিরুর কথা মনে পড়ছে, মিরুকে কি জানাবে এখন! চাকরী পাবার নিউজটা? ভাবছিল অর্ক, ঠিক সেই মুহুর্তেই মিরুর ফোন, সুখবরটা পেয়ে মিরুর অভিব্যাক্তি বোঝা গেলনা, সে শুধু বলেছে অর্ক তোমার সাথে জরুরী কথা আছে, দেখা করা যাবে? আজকাল কিংবা পরশু? অর্ক বলেছিল হুম যাবে, তবে নেক্সট শনিবার হলে ভাল হয়, সেদিন অফিস বন্ধ না, তবে চাইলে ছুটি নেয়া যায়।
আজ শনিবার, অর্কের সাথে মিরুর দেখা করার কথা, অথচ মিরুর ঘরে চলছে গৃহযুদ্ধ, সেই কবে ছয় সাত মাস পূর্বে পাত্রপক্ষ মিরুকে দেখে গিয়েছিল, তারপর শান্ত হয়ে গিয়েছিল নদীর ঢেউ, এখন হঠাৎ তা তুফান বেগে দশ নাম্বার মহা বিপদ সংকেত হয়ে ধরা দিল। হঠাৎ করে পাত্রপক্ষ তোড়জোড় শুরু করে দিল, এত দিন থাকতে সেই শনিবারই বেছে নেয়া হল আকদ এর জন্য।
মিরু বেকে বসল, সে এই বিয়ে করবেনা, তার অন্যত্র পছন্দ আছে, অভিভাবকরা বলল তোমার পছন্দ থাকতেই পারে, আমরা তোমাকে প্রশ্নটা হাজার বার করেছি তুমি তখন মিথ্যা বলেছ, বিয়ের ব্যাপারে তোমার নির্মোহের ধরন দেখে আমরা সেটা অনুধাবন করতে পেরেছি, আর পেরেছি বলেই আমরা তোমার অনুমতি নিয়েছি বারবার। আজকে আমরা যখন একটা ফাইনাল করলাম ব্যাপারটা, আর কিছুক্ষণ পর তোমার আকদ আর তুমি বলছ এই বিয়ে করবেনা, এটা হয়না, তোমার মান সম্মান সমাজ না থাকতে পারে আমাদের আছে, এতগুলো মানুষকে কষ্ট আর অপমান করা তোমার ঠিক হবেনা। তবুও মিরু আজ অনড়, এত বছর যাবত যে প্রশ্নটা নিজেকে করে কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলনা আজ সে উত্তর খুঁজে পেয়েছে, অর্ক ছাড় অন্য কিছু আর ভাবতে পারছেনা সে।
সবাই যখন বোঝাতে ব্যার্থ হল মিরুকে তখন মিরুর মা বলে বসলেন, ওয়েল, দরজা খোলা আছে তুমি যেতে পার মন যেখানে চাই, এবং সেটা চিরতরে, মিরু যেন এতক্ষণ ঘোরের মধ্যই ছিল, এবার সম্বিত ফিরে পেল, তাকাল দরজার দিকে, সেটা সত্যিই খোলা ছিল, তবে নাড়ির বন্ধনকে আর অস্বীকার করা গেলনা।
আজ মিরুর বিয়ে, পিড়েতে বসে মিরু ভাবছিল, আজতো অর্কের সাথে দেখা করার কথা ছিল, সে নিশ্চয় অপেক্ষা করছে আমার জন্য...............