সারা রাত গাড়িতে ছিলাম। ভোর রাতে এসে পোঁছালাম বাড়ি। শরীরটা তাই ভালো লাগছেনা। ইচ্ছে করছে বিছানা থেকে পিঠ সরাতে। কিন্তু সেই উপায় নেয়, আজ সন্ধ্যায় চাঁদ উঠলে কাল ঈদ। এখনও অনেক কাজ বাকি। চোখ মেলতে দেখলাম আয়নার সামনে বউ আমার চুল গুলোর উপর চুরুনী চালাচ্ছে। আমি বিছানা থেকে তাকিয়ে রইলাম। হিসেব মতে আয়নায় সে আমাকে দেখার কথা। কিন্তু আমাকে দেখেছে এমন কোন ভাব প্রতিক্রিয়া তার মাঝে আমি দেখতে পেলাম না। বিছানা ছেড়ে উঠলাম। আস্তে আস্তে ওর পেচন থেকে চুলে হাত রাখতে গেলাম। ও বলে উঠল মা তোমাকে ডাকছে, যাও মায়ের ঘরে যাও। কণ্ঠস্বর অস্বাভাবিক মনে হল। চুলে হাত খানি রাখতে গিয়েও আর রাখলাম না। জিজ্ঞেস করলাম মা কেন ডাকছে বলতে পার? কিন্তু কোন উত্তর এলনা। দাড়িয়ে না থেকে কলঘরে গিয়ে হাতে মুখে পানি দিলাম। তারপর সোজা মায়ের ঘর হয়ে ফিরে এলাম। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতে কানের কাছে প্রশ্ন, মা কি বিষয়ে কথা বলল?
- ঐ...তো........ শিখার বিষয়ে। বিকেলে একবার ওদের বাড়ি যেতে বলল। ঈদ কোথায় করবে না করবে আরও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা তুলল।
- শুধু এই। আর কিছু বলেনি? তুমি কি বললে?
- আমি আর কি বলব। যেতে তো হবে একবার ওদের বাড়ি। ঈদ এইখানে নাই করুক, দেখে আসাতো আমাদের কর্তব্য। তাছাড়া ওর শাড়ি আর দিহানের পোশাক গুলো দিয়ে আসতে হবে।
- শুধু শাড়ি (রাগান্বিত কণ্ঠে) কেন? আলতা, লিপিসটীক, পাউডার, লাল চুড়িও দিয়ে এসো। সাথে একটা লাল জরির উড়না আর আমার জন্য একটা গলার ফাঁস নিয়ে আসতে।
- গলার ফাঁস? কেন ঝুলে পড়বে নাকি?
- ঝুলার আর কি বাকি আছে। আমি বলে রাখলাম, তুমি যদি তাদের এই প্রস্তাবে মতামত দাও আমি কিন্তু গলায় ফাঁস দেবো।
- তুমি কোন প্রস্তাবের কথা বলছ। আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা।
- বুঝতে পারছনা নাকি আমাকে বোঝাতে চাইছনা। কেন? মা ঘরে ডেকে নিয়ে বলেনি তোমায়। আর তুমি যদি কিছুই নাই জানতে, তাহলে তো এরকম একটা রঙ্গিন শাড়ি নিয়ে আসতে না। কোন বিধবার জন্য কেউ যদি রঙ্গিন শাড়ি কিনে আনে তাতে কি বোঝায় বল?
- ছি, ছি সাবিহা। তুমি কি করে এমন চিন্তা মাথায় আনলে?
- কপাল তো আমার পুড়বে, কার কি যায় আসে।
- আজ মাহিন বেঁচে থাকলে নিশ্চয় তাই করত। আর শিখা আমার বন্ধুর ছোট বোন।
- মাহিন নেয় তাতে কি? শাহিন তো আছে। মাহিনের অসমাপ্ত সংসারের গল্প শাহিন শেষ করবে।
- তোমার সাথে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। এরম একটা চিন্তা তোমার মাথায় আসলো কি করে।
- যত দোষ আমার কপালের। উপর ওলা আমাকে একটা সন্তান দিলে আজ এমন কথা বলার সাহস কেউ পেত না।
সাবিহার সাথে আর কথা বাড়ালাম না। আলনা থেকে লুঙ্গিটা নিয়ে সোজা পুকুর ঘাটের দিকে রওনা হলাম। মনটা খুব খারাফ হয়ে গেল। পানিতে পা দুখানি ডুবিয়ে ঘাটে বসে রইলাম। গত বছরও এই সময় মাহিন ছিল। আজ নেয়, ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
মাহিন আমার ছোট ভাই। বয়সে তিন বছরের ছোট। ইকোনমিক্স এই অনার্স মাস্টার্স শেষ করে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে চাকুরী পায়। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আতিকের ছোট বোন শিখার সাথে বিয়ে দেয় তার। বিয়েটা বলতে গেলে আমার ইচ্ছেতে হয়েছিল। মাহিনের ইচ্ছে ছিল আরও কিছুদিন পরে করবে। কিন্তু আমি দেরি করলাম না। বিয়ের এক বছরের মাথায় শিখার কোল জুড়ে সন্তান এলো। সব কিছু ভালই যাচ্ছিল, কিন্তু গত দুমাস আগে একটা রোড এক্সিডেন্টে মাহিন আমাদের ছেড়ে চলে যায়। মাহিনের জন্মের পর থেকে মাহিনকে ছাড়া এই প্রথম আমি ঈদ করছি। আমার দুঃখ টা আমি অনুবভ করতে পারছি, এর গভীরতা অনেক বেশী। কিন্তু দিহানের দুঃখ টা বোধহয় আমার ছেয়ে বড়। জীবনের প্রথম ঈদ জন্মদাতাকে ছাড়া করতে হবে। সৃষ্টিকর্তা একটা নিস্পাপ শিশুকে নিভৃতে দুঃখ দিল, যার কোন শান্তনা হয়না।
ঈদে দিহানের জন্য কয়েকটা পোশাক আর শিখার জন্য একটা শাড়ি কিনে পাঠিয়েছিলাম কিছুদিন আগে। কিন্তু কারও আর গিয়ে দিয়ে আসা হলনা। শিখার শাড়িটা নিয়ে আমার পরিবারে নানান গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। যার একটা অপ্রত্যাশিত আচরণ আমার বউয়ের কাছে পেলাম। শিখার জন্য শাড়ি কিনতে গিয়ে একটা বিধবা নারীর চেহারা আমার মনের চোখে একবারও ভেসে উঠেনি। একটা রঙ্গিন শাড়ি কিনলাম। শিখার এখন যা বয়স, এই বয়সে সাদা শাড়ি ওকে বড্ড বেমানান। বিধবার সাদা শাড়ীর প্রচলন কোথা থেকে এসেছে আমার জানা নেয়। আমাদের পরিবারে এই বিষয়টা খুব বেশী মানা হয়। মাহিনের মৃত্যুর পরে যে কদিন শিখা আমাদের বাড়ি ছিল আমি ওকে সাদা শাড়ীতে দেখেছি। ওর মুখের দিকে তাকানো যেতনা। বাইশ বছরের একটা মেয়ে, বর্ণহীন একটা সুনিদৃষ্ট ফ্রেমে আটকা পড়ে থাকবে। বিষয়টা খুবই করুন। অসয়ের সব মৃত্যুই করুন হয়ে থাকে। সমাজ কিংবা পারিবারিক নিয়মকে বৃদ্ধা অঙ্গুলি দেখাতে রঙ্গিন শাড়ি নেয়নি। নিজের বিবেকের সাথে যুদ্ধ করে পেরে উঠছিলাম না। শিখা আমার ছোট বোনের মত। যার বর্ণিল আনন্দের কথা ভাবি তার জন্য সাদা শাড়ি আমি আনতে পারিনি।
বিয়ের পাঁচ বছরেও আমাদের কোন সন্তান হয়নি। ডাক্তার দেখিয়েছি। দুজনেই ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলছি। ডাক্তার আশাবাদী তবু সবই উপর ওলার ইচ্ছে। দিহান আমাদের বংশের আগামী প্রজন্ম। ওদিকে শিখার জন্যও বাকি জীবন একা থাকাটা বোধহয় বড্ড বেশী শাস্তি হয়ে যায়। তাই আমার পরিবারের কিছু লোক চাইছেন শিখাকে যেন আমি বিয়ে করি। এতে নাকি শিখার প্রতি আমাদের কর্তব্য পালন হবে আর বংশও রক্ষা হবে। তাদের এইরম চিন্তার কথা আমি আগে জানতাম না। আমার পাঠানো রঙ্গিন শাড়িটা তাই কাল হয়ে উঠল। এই রঙ্গিন শাড়ি নাকি আমার সম্মতির বহিপ্রকাশ। কর্তব্য কিংবা বংশ রক্ষার জন্য স্নেহ ভাজন কাউকে একজন বিবাহিত পুরুষ বিয়ে করবে, যার প্রভাবে অন্য এক নিষ্পাপ নারীর স্বপ্ন ভঙ্গ হবে এরম চিন্তা কখনো আমার মাথায় আসেনি। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থা বড়ই কঠিন। এই কথা সত্য শিখার ভবিষ্যতের দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে। হয়ত আজ আমরা নিঃসন্তান হওয়াতে সমাজ রক্ষার তীরটা আমার দিকে আসছে। সমাজ সেই যাই বলুক না কেন, আমি হারবনা। আমি শিখাকে আবার বিয়ে দেব। সু-পাত্রের কাছেই বিয়ে দিব, নিজের ছোট বোন হলে যাই করতাম। মানুষ যে যাই ভাবুকনা কেন আমি রঙ্গিন শাড়িটাই ওকে দিয়ে আসব। ওর জীবনটা আমি আবার রাঙিয়ে দেব।
দুপুরের পর পরই শিখাদের বাড়ি যাওয়ায় উদ্দেশে বের হতে লাগলাম। বের হওয়ায় পথে আমার বউ বলে উঠল, তুমি যদি এই শাড়ি নিয়ে ঐ বাড়ি যাও ফিরে এসে আমাকে আর পাবেনা। উত্তরে আমি ওকে বললাম, তুমি অন্তত আমাকে বুঝতে চেষ্টা কর। আমার উপর বিশ্বাস রাখো। কথা বাড়ালাম না, এই বলে আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। খুব বেশী দূর যেতে পারলাম না। বাজার পার হলাম মাত্র, তক্ষুনি মায়ের ফোন পেলাম। সাবিহা নাকি বাড়ি থেকে ওর বাপের বাড়ির উদ্দেশে বের হয়ে গেল। খবরটা পেয়ে রিক্সাটা থামিয়ে নেমে পড়লাম। সাবিহা বড্ড অভিমানী। ওকে আমি এখন না ফেরালে হয়তো ও আর কোন দিনই ফেরবেনা। শিখাকে আর রঙ্গিন শাড়িটা দেওয়া হল না। জানি না শিখার জীবনটা কতখানি রাঙ্গাতে পারব আমি। আমি বুঝলাম, এই সমাজের কিছু চিন্তা চেতনার কাছে আমরা বড্ড বেশী অসহায়।
০২ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী