জানিনা কার দুঃখে বৃষ্টিতে এতো জল ঝরে। বৃষ্টির সময় গুলো আমার জন্য শুধু দুঃখ নয় বরং দুঃসহময়। বৃষ্টি আমার জন্য কখনো দুঃখ ছাড়া কোন সুখের স্মৃতি নিয়ে আসতে পারেনি। আমি বরাবর এই বৃষ্টিকে বড্ড ভয় পেতাম। এই ভয়ের শুরুটা আমার ছোট বেলায়। সেই সময়কার স্মৃতি গুলো আমি ভালো করে মনে করতে পারিনা। তবে সেই রাতের কথা আমার স্পষ্ট মনে পড়ে। রাত তখন কত হবে সেইটুকু সময় জ্ঞান আমার তখন ছিলনা। মায়ের কান্নার শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। আমাদের আধা পাকা ঘরের সামনে ছিল বিশাল বারান্দা। সেই বারান্দায় কিছু মানুষের সমাগম। এরা সবাই আমার কম বেশী পরিচিত ছিল। আমার এইটুকু মনে পড়ে, আমি যখন একে বারে ঝটলার সামনে যাই আমার মা আমাকে ঝরিয়ে ধরে কি যেন বলতে গিয়ে তাঁর গলা দিয়ে আর কোন শব্দ বের হল না। আমার মা হটাৎ শক্ত হয়ে কেমন যেন স্থির হয়ে গেল। আমি মায়ের গলা চেপে ধরে বলতে লাগলাম, মা কি হয়েছে তোমার। মা বলনা কি হয়েছে তোমার। কেউ একজন পেছন থেকে আমাকে ঝরিয়ে ধরে বলতে লাগল, বাবা তুই এতিম হয়ে গেলিরে। তোর বাবা আর নেয়। বাবার কথা আমার তখন মাথায় কাজ করছেনা। আমি আমার মায়ের গলা আরও শক্ত করে ধরে রাখলাম। তখন আমার চোখে পড়ল কেউ একজন ঝটলার মাঝখানে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। তাঁর দেহ বৃষ্টির জলে ভিজে আছে। দেহ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে সেই জল ঝরছে। জলের বর্ণ রক্তের মতো লাল। বুঝতে খুব একটা সময় লাগলোনা। শুয়ে থাকা লোকটা আমার বাবা। আমি মায়ের গলা ছেড়ে বাবার কাছে যাই। কেন জানি বাবাকে ছুয়ে দখেতে ইচ্ছে হলনা। আমার কেন জানি ভয় ভয় লাগছিল। তখন একদল মানুষ আমার মাকে ধরে ঘরে ভেতর নিয়ে যেতে লাগল। বাবার ঠিক কি হয়েছে তা আমি বুঝতে উঠতে পারিনি। আমার পূর্ণ মনযোগ মায়ের দিকে। আমি ঘরের ভেতরে মায়ের কাছে গেলাম। মা কোন কথা বলছে না। কয়েকজন মিলে মাকে কথা বলানোর চেষ্টা করছে। কেউ আবার পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগল। কিছু না বুঝেয় আমি আবার বারান্দায় যাই বাবার কাছে। বাবাকে বলতে লাগলাম, দেখ বাবা মা না কথা বলছেনা। বাবার নিশ্চুপতা দেখে কেন জানি চোখের কোনে জল চলে এলো। তখন আমি বুঝতে পারলাম, আমার বাবা আর কোনদিন কথা বলবেন না।
রাতে কান্না করতে করতে কখন যে আমি গুমিয়ে পড়েছিলাম তা আর বলতে পারিনি। খুব সকালে দেখলাম আমাদের উঠোন বাড়ি আর ঘর ভর্তি অনেক মানুষের ভীড়। আমার মা একটা ধবধবে সাদা শাড়ি পড়ে আমার পাশে বসে আছেন। তিনি একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছেন না। সবাই আসছে যাচ্ছে মাকে কি কি যেন বলছে। কিছুক্ষণ পরে কেউ একাজন আমাকে কোলে করে নিয়ে গেল। খোলা বারান্দার অন্য কোনে বাবা শুয়ে আছেন। তাঁর পরনে সাধা কাপড় জড়ানো। দেখে আমার কেন জানি ভয় করে উঠল। কিছুক্ষনের মধ্যে একদল লোক বাবাকে কোথায় নিয়ে গেল।
কয়েকদিন পড়ে মা আর আমি গেলাম নানা বাড়ি। নানা বাড়ি অনেক লোকের সমাগম। সারা বেলা খেলাধুলা করে দিন কাটাতাম। রাতে মায়ের সাথে ঘুমুতে যেতাম। এইসবের মাঝে হটাৎ হটাৎ বাবার কথা মনে পড়ত। মাকে জিজ্ঞেস করলে মা শুধু কাঁদত। এইভাবে দিন কাটতে লাগল। বাবার কথা তখন আর তেমন একটা মনে পড়ে না। একদিন আমার নানা বাড়িতে দাদা বাড়ির পরিচিত লোক গুলোর সমাগম। সেদিনও দিন ভর টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল। এদের অনেকে আমার কাছে আসছে। আমাকে কোলে নিচ্ছে। কি কি জিজ্ঞেস করছে। আমি আমার মত করে খেলা করছিলাম। কেউ একজন আমাকে নিয়ে মায়ের কোলে বসিয়ে দিল। মা আজ লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পরেছে। মায়ের আসে পাশে যারা বসে আছে আমার পরিচিত কিছু লোক। আমার নানা মায়ের কোল থেকে আমাকে তুলে নিলেন। মা এই লোক গুলোর সাথে যেতে লাগলেন। আমি নানার কোল থেকে মায়ের কাছে যেতে চাইলাম। কিন্তু নানার শক্ত বাধন থেকে আমি ছুটতে পারলাম না। আমার ভেতরে তখন থেকে শূন্যতা কাজ করতে লাগল। সেদিন সারা সন্ধ্যা আমি কেঁদেছি। আমার বাবার চলে যাবার দিনও আমার এতো কান্না আসেনি।
কয়েকদিন পর নানা আমাকে নিয়ে গেলেন আমাদের দাদা বাড়ি। বারান্দায় এসে দাড়াতে আমার বাবার কথা মনে পড়ল। মা আমাকে এসে জড়িয়ে ধরল। আমিও মাকে পেয়ে খুব খুশি। বিকেলের দিকে নানা, আমি, মা আর আমার এক কাকা আমাদের সাথে নানা বাড়ি চলল। রাতে আমি মায়ের গলা চেপে ধরে শুয়েছিলাম। নানু এসে আমাকে অন্যঘরে নিয়ে গেল। আমি কিছুক্ষণ পড়ে আবার মায়ের কাছে ছুটে আসলাম। এসে দেখালাম খাটের উপর দাদা বাড়ির সেই কাকা মায়ের পাশে বসে আছে। কেন জানি দরজাতে আমি আটকে গেলাম। মা বলল, কিরে ছোটন কিছু বলবি। আয় কাছে আয়। আমি ফিরে এলাম। আমি ভেবেছিলাম মা আমার পেছন পেছন ছুটে আসবে। মা আসেনি। মা আর কোনদিনও আমার কাছে ছুটে আসেন নি।
আমি নানা বাড়িতে বড় হতে লাগলাম। স্কুলে ভর্তি হলাম। স্কুলে যাই আসি। পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলাধুলা করি। কিন্তু কোঁথাও শান্তির ছোঁয়া টুকু পাইনা। হটাৎ হটাৎ খুব শূন্যতায় ডুবে পড়ি। বৃষ্টির দিন গুলোতে বাবার মৃত্যুর স্মৃতি বড্ড মনে পড়ে। বারান্দায় পড়ে থাকা বাবার নিথর মুখ খানি খুব মনে পড়ে। বৃষ্টির দিন গুলোতে আমার খুব ইচ্ছে করে বাবার গলা ধরে কাঁদতে। কিন্তু বাবকে আর কোঁথাও পাইনা। এই কষ্টের সময় গুলোতে যখন চোখের কোনে এক আকাশের চেয়ে বেশী জল নেমে আসে আমার কেন জানি মনে হয় আমার মা এখনই পেচন থেকে এসে আমার মাথেয় হাত বুলিয়ে দেবে। আমার চোখের জল মুছে দিবে। কিন্তু মা আর কখনই আসেনা। তাই বৃষ্টি নামলে আমি ভিজতে থাকি। বৃষ্টির জল আমার চোখের জল ছুয়ে নিয়ে যায়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ম্যারিনা নাসরিন সীমা
আপনার লেখা পড়ে সত্যি আমার চোখে পানি চলে এল । জানিনা এটা আপনার জীবনের কথা কিনা যেটা আজ গল্প হয়েছে । এই গল্পের কথা আমার বহুদিন পর্যন্ত মনে থাকবে । শুভকামনা ।
দিদি এইটা আমার নিজের জীবনের গল্প নয় | তবে যে কোন গল্প লিখার সময় আমি বরাবরই গল্পের ভেতর থাকি | গল্পটা লিখতে গিয়ে নিজের চোখে জল এসেছিল তাই পাঠকের চোখের জলের মাঝে গল্পের সার্থকতা খুজি | আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ |
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।