মানুষের জীবনে কত আজব ঘটনাই-না ঘটে! পাঠকবৃন্দের কি কখনও এমন হয়েছে, যে আপনার নিরেট কঠিন বাস্তবটা অন্যের কাছে নিতান্তই রসিকতা হয়ে ধরা দিয়েছে? অথবা খুব জ্ঞানের বহর জাহির করতে গিয়ে সার্কাসের ভাঁড় বনে গেছেন? কিংবা কখনও নিজের ভাবগম্ভীর কোন বিষয় আপন উৎকর্ষে মহিমান্বিত বলে মনে হওয়া সত্ত্বেও প্রকাশভঙ্গী, বর্ণনশৈলী বা যে কারণেই হোক তা রম্য-রসের আধার হয়ে শ্রোতামণ্ডলীর মস্তিষ্কবিবরে হাসির খোরাক হিসেবে বিশেষভাবে স্থান লাভ করে নিয়েছে? আর এ - সবই হয়েছে শুধুমাত্র নিরীহ একটি আকাঙ্খাকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে! হ্যাঁ, সে অভিজ্ঞতা যদি কারও না হয়ে থাকে তবে এই অভাগার বিরহগাঁথা তো রইলই।
সেদিন ছিল জ্যৈষ্ঠের অসহনীয় গরম। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরছি। সবাই অফিসের গাড়ি ধরল। আমার ইচ্ছে হল, বাসে জানালার পাশে বসে হাওয়া খেতে খেতে বাসায় যাব। এক ঘণ্টারই তো পথ। তাছাড়া অনেক দিন যাবত পাবলিক বাসে না ওঠায় অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সুমধুর এক গভীর টান অনুভূত হচ্ছিল। যাহোক, উঠে পড়লাম সেই তথাকথিত পাবলিক বাসে! উঠেই দেখি বিধি বাম। জানালার পাশের সব সীট দখল! মনটা কেমন তেঁতো হয়ে গেল। বসলাম তিনজনের একটা সীটে। মনটা ভাল করার জন্য ভাব জমানোর চেষ্টা করলাম জানালার পাশে বসা লোকটির সঙ্গে। প্রথমে গরজ না থাকলেও পরে খুব অমায়িক ব্যবহার পেলাম। কিন্তু কি আপদ, অচিরেই বুঝলাম খাল কেটে কুমির এনেছি! রাজনৈতিক গলাবাজী আর গালিগালাজে আমি যে নিতান্তই শিশু, লোকটি আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল। দিনে শ’খানেক খবরের কাগজ পড়লেও সেই লোকটির মত জ্ঞানলাভ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। দেশের নেতাদের পকেট ভর্তির কত যে সুলভ মাধ্যম রয়েছে তা লোকটির সঙ্গে পরিচয় না হলে কস্মিনকালেও আমার জানা সম্ভব হত না। তার ওপর বহির্বিশ্বের কূটনৈতিক চাল পাঠোদ্ধারে লোকটির জ্ঞান যে আন্তর্জাতিক মানের তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল। তাই নীরব শ্রোতা রূপে থাকতে চাইলাম। কিন্তু তাতেও বিপত্তি! প্রতিটা বাক্যের শেষে সমর্থনের আশায় প্রবলভাবে পিড়াপীড়ি সুরু করে দিল। সায় না দিলে আমাকেই বিরোধীদল বানিয়ে দেয় আরকি! তাছাড়া আশেপাশের কজনকে লোকটি ইতিমধ্যেই বেশ দলে বাগিয়ে নিয়েছে। এখন উল্টোপাল্টা কিছু বললে দু’চার ঘা খাওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
এদিকে ভাড়া দিতে গিয়ে টের পেলাম মানিব্যাগটা নেই! কী যে অব্যক্ত এক অনুভূতির জন্ম নিল তা আর বলার নয়। আশেপাশে একবার তাকিয়ে বুকপকেট থেকে কোনমতে ব্যবস্থা করলাম। যদিও ঠিক উপলব্ধি করছি, ব্যাগটা যে সুকৌশলে হাতিয়েছে সে এখন কাছেই কোথাও নিশ্চিন্তে বসে সবার অলক্ষ্যে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। ওদিকে আবার ভাঙতি না থাকায় কন্ট্রাক্টর জানালার পাশে বসা লোকটির এক টাকা রেখে দেয়। এতে লোকটি বেজায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আর আমার কাছে ক্ষেদ প্রকাশ করে কন্ট্রাক্টরের চোদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে। এছাড়াও আমাদের জাতীয় জীবনে অঢেল সম্পত্তি অর্জনে এই বিশেষ একটি টাকার কী যে অসামান্য অবদান তারও প্রকৃত বৃত্তান্ত লোকটি বর্ণনা করে। আমিও অমূল্য সুযোগ পেয়ে তাকে ধৈর্য, সংযম, সহনশীলতা প্রভৃতি শব্দগুলোর যথোপযুক্ত উৎকর্ষ সাধন করে ব্যাপক উপদেশ ঝেড়ে দিলাম। অবস্থা হল কেঁচোর মুখে লবন। লোকটা তো সান্ত্বনা খুঁজে পেলই না, বরঞ্চ ব্যক্তিগত শত্রুতা না থাকা সত্ত্বেও আমি যে তার বিশেষ অসন্তোষটি অর্জন করলাম তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ রইল না। যদিও জানতাম না, কিছুক্ষণ বাদে আমাকেই ওই শব্দগুলোর চরম অনুশীলন করতে হবে!
ধীরে ধীরে বাসে ভীড় বাড়তে থাকল। এমন সময় বাসে উঠল বিশালদেহী এক ভদ্রলোক। মেদসর্বস্ব শরীরটাকে ছোট খাট একটা পাহাড় বললেও বুঝি বাড়িয়ে বলা হবে না। হাঁটছে তো না যেন গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে। আশেপাশে প্রচুর খালি থাকা সত্ত্বেও আমার পাশের সীটটাই যেন তাঁর বেশ মনে ধরল। নাকি শারীরিক আয়তনে নগণ্য বিধায় আমাকে দৃষ্টিভ্রম করল তাই বা কে জানে! যদিও সীট তিনজনের কিন্তু না বললেও পাঠক বুঝবেন, দেশের অনাহারে রোগাক্লিষ্ট মানুষের কথা বিশেষ বিবেচনায় রেখেই পাবলিক বাসের সীটগুলোকে বিশেষভাবে সঙ্কুচিত করা হয়। তার ওপর আবার মরচে ধরা লোহার ফ্রেম। স্থুলদেহী তার দেহধারণ করতেই সীটটা মর্মান্তিক আর্তনাদ করে দেবে গেল। আমার মনে হল, কেউ আমাকে চেপ্টে বোতলে ভরার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। চাপাচাপিতে জানালার পাশের ব্যক্তি এমন রক্তচক্ষু মেলে আমার দিকে তাকাল যে শুকনো কাগজ হলে তখনই ভস্ম হয়ে যেতাম! ভাবটা এমন, সীটটা তার একক ব্যক্তি মালিকানাধীন আর অন্যায়ভাবে আমি তার সম্পদে ভাগ বসিয়েছি। তাছাড়া দোষটা আমার নয়, সদ্য আগত পাহাড় প্রমাণ ব্যক্তিটির। অবশ্য শারীরিক ভাবে উদার হওয়ায় অভিযোগের তীরগুলো তাঁকে খুব একটা ঘায়েল করতে সাহস না পেয়েই কী আশেপাশে এসে পড়ছে কিনা - তাই বা কে জানে! এরই মধ্যে হঠাৎ কোথা থেকে যেন এক উৎকট দুর্গন্ধ এসে ভর করল! পাশে তাকিয়ে দেখি বিশিষ্ট স্থুলদেহীর সারা শরীর ঘামে ভেজা জবজবে। শুধু তাই না, তার দীর্ঘ কেশনিঃসৃত ঘর্মধারা যে ঝরনাধারাকেও হার মানাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। মনে হল উঠে তখনই বাস থেকে নেমে যাই। কিন্তু বাস তখন লোকে লোকারণ্য। ভীড় ঠেলে এক ইঞ্চি এগোনও দুরহ। বুঝলাম লোকাল বাসটি তার অতিপ্রাকৃত মায়ার বাঁধনে আমায় আগলে রাখতে চায়। তারপরই শুনি হড়হড় শব্দ! দেখি জানালার পাশের ব্যক্তি বাইরে গলা বাড়িয়ে দিয়ে হজমকৃত গ্রাস সবেগে নির্গত করছে। এই দেখে আমারও কেমন গা গুলিয়ে ওঠে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে বিশালদেহী আমার ঘাড়ে নিশ্চিন্ত অবলম্বন খুঁজে পায়...।
নতুন যাত্রীরা বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়ান বলা ভুল, চিৎ-কাৎ হয়ে বসা যাত্রীদের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে আরকি! আর যখন পড়েই যাচ্ছে তখন বসা যাত্রীরা এতটাই উত্তেজনা প্রকাশ করছে যতটা তারা পৈতৃক সম্পত্তিতে অন্যের অংশ দেখলে করে থাকে। এমনই দাঁড়ান একজন আমার সীট ঘেঁষে হঠাৎ গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে থাকে। না-না... সেটা কোন সংগীতের সুরধ্বনি নয়। বুঝলাম কিছু একটা গলা থেকে টেনে টেনে মুখে জমাচ্ছে, মুখটাও বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত। এরপরেই থুঃ করে অব্যর্থ লক্ষ্যে মাথার ওপর দিয়ে কিছু একটা জানালার বাইরে চলে গেল। চোখেমুখে ঝাপটা লাগতে টের পেলাম জিনিসটা তরল ছিল! ক্ষোভে রাগে দুঃখে মনে হল নিজের চুল নিজেই মাথা থেকে টেনে টেনে ছিঁড়ি! প্রতিজ্ঞা করলাম জীবনে দরকার হয় তো শত মাইল হাঁটব, হাওয়া খেতে মন চায় তো রিকশায় খাব তবু পাবলিক বাসে আর না!
যাই হোক সব দুর্যোগ দুর্ভোগেরই শেষ থাকে। আমারও ছিল কিন্তু তা বিনা ত্যাগে নয়। গন্তব্যে পৌঁছে নামতে যাব, পেছন থেকে ষাঁড়ের মত গুঁতো মেরে কে যেন বেরিয়ে গেল! আরে বাবা, যাবি তো একটু ধীরে সুস্থে যা! তবু সে নাহয় জামাই আদর ধরে মেনেই নিলাম, কিন্তু এর ঠিক পরপরই অন্ধকারে আমার পায়ে কে যেন কষে এক লাথি হাঁকাল! নিজের অজান্তেই গলা চীরে চিৎকার বেরিয়ে এল। তৃতীয় আঘাতটা এল এক অজ্ঞাত ব্যক্তির কনুই এর নির্ভুল নিশানায়! নিজেকে একটা যুদ্ধক্ষেত্রে আবিষ্কার করলাম। রক্ত চড়ে গেল মাথায়। কী কুক্ষণেই যে উঠেছিলাম পাবলিক বাসে! ধৈর্য আর সংযমের জলাঞ্জলি দিয়ে সামনে যাকে পেলাম তার ওপরই ঝাপিয়ে পড়লাম। তখন বিশিষ্ট কন্ট্রাক্টর ভদ্রমহোদয় আমার মধুর পরিস্থিতি অত্যন্ত সুচারুভাবে অনুধাবন করতে পেরে তার পোকায় খাওয়া দন্ত বিকশিত করে বলে উঠল,
“শিক্ষিত মানুষ হইয়া মারামারি করেন ক্যা? ধৈর্য ধইরা নামতে পারেন না?”
০৭ মে - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
১২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪