তমসাচ্ছন্ন নিস্তব্ধ রাত। স্টেশনে শুনশান নীরবতা। একমাত্র প্রাণচাঞ্চল্যের উৎস ট্রেনটাও দিগন্তের সীমায় শেষ আলোকবিন্দুর মত হারিয়ে যাচ্ছে।
আনিস সাহেব সবে মাত্র স্টেশনে নেমেছেন। অথচ মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, পারলে আবার চলতি ট্রেনেই উঠে পড়তেন। তিনি প্ল্যাটফর্মের এদিক ওদিক চাইলেন। আজব স্টেশনটা একদমই অন্ধকারাচ্ছন্ন। অমাবস্যার অন্ধকার চিরে একটি ঘরই সামান্য আলোকিত মনে হল। ওটাই বোধ হয় মাস্টার মশাইয়ের ঘর।
আনিস সাহেব নিম্ন আয়ের মানুষ। খুব জরুরী কাজ ছাড়া বের হন না। কিন্তু আর্থিক সঙ্কট বলে কথা! তাই তো এই মধ্যরাতে তাঁকে স্টেশনে দেখা যাচ্ছে। পকেট থেকে ডাবল পেন্সিল ব্যাটারির টর্চ বের করলেন। জীবনে এই প্রথমবার মনে হল, শ’খানেক টাকা না বাঁচালে টর্চের আলোটা জুতসই হত। যা হোক, মনে অত খেদ নেই, ওই টাকায় কেনা বাঁহাতের ঘড়িটা কানের কাছে আনতেই টিক টিক জানান দিল দিব্যি চলছে! খুব প্রশান্তির একগাল হাসি দেখা যায় আনিস সাহেবের মুখে। বেচাকেনায় একটু অঙ্ক না কষলে কি হয়?
রেলের মাস্টার মশাইয়ের ঘরে এসে আনিস সাহেব একটু দমে গেলেন। ভেবেছিলেন অন্তত জনাকয়েক লোকের সঙ্গ পাবেন। লোক তো দূরে থাক, টেবিলের ওপর একমাত্র জীবনপ্রদীপ হ্যারিকেনটাও নিভতে বসেছে। আনিস সাহেব টর্চটা নিভিয়ে ঘরে ঢুকলেন। সবার আগে হ্যারিকেনের সলতে তুলে আলো বাড়ালেন। অতঃপর দেয়ালের পাশের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলেন।
মনে হয় যাত্রাপথের ক্লান্তির জন্যই হবে, আনিস সাহেব একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলেন। অস্পষ্ট একটা শব্দ হতেই চমকে উঠলেন। দেখলেন ভ্যাঁপসা গরম সত্ত্বেও চোখমুখ চাদরে পেঁচানো, ময়লা কোর্তা গায়ে শীর্ণকায় এক লোক চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। পরনে ধুতি এতটাই ঝোলান যে বোঝার উপায় নেই পায়ে জুতো না চটি। মুখটা দেখা না গেলেও ঘাড়ের ভঙ্গী বলে দিচ্ছে একদৃষ্টে আনিস সাহেবের দিকেই চেয়ে আছে। তিনি বিব্রত বোধ করলেন, তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন,
“আপনিই বুঝি মাস্টার মশাই?”
“কেন, দেখে কি মনে হচ্ছে?” দাড়িয়ে দাড়িয়েই হাতে ধরা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে লোকটা।
উত্তরের ঢঙ শুনে আনিস সাহেবের অস্বস্তি আরও বাড়ল। বুঝলেন তেজী লোক। তবু জিজ্ঞেস করলেন,
“পরের ট্রেন আসতে কি দেরী আছে?”
“দেরী মানে!” ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর হাতের কাপটা ঝনঝন করে নামিয়ে রাখলেন,“জীবনে কখনও শুনেছেন ট্রেন সময়মত আসে? বলি, এটা কি বিলেতের ট্রেন পেয়েছেন? আবার দেরী হলে তো আপনারা ছেড়ে কথা বলেন না। এখন বুঝুন, আমার দোষ?”
“না-না...! তা কেন, তা কেন!” আনিস সাহেব আমতা আমতা করেন।
“সে কি! হ্যারিকেনটা বাড়াল কে?” হঠাৎ করেই যেন লোকটার নজর পড়েছে। এদিকে ভয়ে আনিস সাহেব প্রমাদ গোনেন আর কি!
“দেখ কাণ্ড, এই দূর্মুল্যের বাজারে কেরোসিনের দামটা কোথা থেকে আসবে শুনি? যতসব আপদ!” আপনমনেই বকে উঠল লোকটা।
লোকটা আলো এতটাই কমিয়ে দিল যে আনিস সাহেবের মনে হল অন্ধকার বুঝি ঘরটাকে গিলে খেল! একেই রাতের বেলা তার ওপর আলোর স্বল্পতায় লোকটা যেন ছায়ার মাঝে তলিয়ে গেল। শুধু চায়ের কাপে চুমুকের শব্দটা ভেসে আসছে, শুড়ুৎ... শুড়ুৎ, শুড়ুৎ... শুড়ুৎ,...।
অন্ধকার-নিরবতা-আর ঐ অস্বস্তিকর শব্দ! আর থাকা যায় না। কেমন যেন শিরশিরে অনুভূতি। তাই আনিস সাহেব আবার ভাব জমানোর চেষ্টা করেন।
“ইয়ে, অন্য যাত্রীদের দেখছি না যে?”
“কেন, অবাক হচ্ছেন?” চুমুকের শব্দ থেমে গেল আর টেবিলে কাপ-পিরিচের ঝনঝন শব্দ হল। বিরক্তির বহিঃপ্রকাশই ধরে নেয়া যায়।
এ আবার কেমন কথা রে বাবা। স্টেশনে যাত্রী না থাকলে অবাকও হওয়া যাবে না? আনিস সাহেব আকাশ থেকে পড়লেন। যদিও মুখে বললেন,
“না মানে বলছিলাম যে, স্টেশনের অন্য যাত্রীরা...!”
“আরে মশাই, আমি তো আপনাকে দেখেই অবাক হচ্ছি। এখনকার সময়ে অনেকদিন কোন যাত্রী দেখি না। তার ওপর এই মধ্য রাতে...?”
“সে কি কথা! এখন তাহলে কোন ট্রেন নেই?”
“এখন ট্রেন... । আরে মশাই মহারানীর সেদিন কি আর আছে! তবে যদি না ভুল করে...।”
“ভুল করে মানে?”
“নাহঃ, মশাই তো বড্ড জ্বালালেন দেখছি! যাবেন কোথায়? অনেক দূর নিশ্চয়ই? কষে একটা ঘুম দিন তো!”
“ট্রেনের জন্য বসে থেকে ঘুম দেব? তা আবার এই গরমের মধ্যে!”
“কেন ভয় পাচ্ছেন নাকি? কালীঘাটের কালরাত বলে কথা! হু,গরম পড়েছে কিছুটা। তা খাবার-টাবার কিছু সঙ্গে আনা হয়েছে?”
“মানে...?”
“বলছি, পিঠে-টিঠেও কিছু আনেন নি? তেলে ভাঁজা...”
“বারে, পিঠে আনতে যাব কেন?”
“সে কি, পিঠেও আনেন নি? ঝড়-বৃষ্টির রাত বলে কথা! চা খেয়েই থাকতে হবে। দেখি ব্যবস্থা করা যায় কিনা।” বলেই লোকটা নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। আনিস সাহেব খুশিই হলেন। এতক্ষণ সামনে বসে বসে একটা লোক শব্দ করে চা খাচ্ছিল - ভাবতেই অস্বস্তি লাগে! নিজ থেকেই যখন বলছে তো মন্দ কি? নিয়ে আসুক। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টির রাত বলতে কি বোঝাল তা আনিস সাহেব ভেবে পেল না। বাইরে তো পানির ফোঁটাও পড়ছে না। কথাবার্তা বড়ই খাপছাড়া লোকটার।
যাওয়ার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই লোকটা ফিরে এল। হাতে দুটো কাপ। সেই আগের মতই চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ঠায় চেয়ে রইল। আনিস সাহেব আবার অস্বস্তি বোধ করলেন। তাই নিজেই বললেন,
“ইয়ে এত জলদি চা পেয়ে গেলেন?”
“অ্যাঁ? হ্যাঁ, পেয়েছি বৈকি।” মুখে বললেও লোকটা কাপ হাতে চৌকাঠেই দাড়িয়ে রইল।
“আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব...।” আনিস সাহেব বিনীতভাবে চায়ের কাপের উদ্দেশে হাত বাড়ালেন।
“ও চা খাবেন? তা বললেই পারেন!”
আনিস সাহেব চায়ের কাপ নিতে গিয়ে খেয়াল করলেন লোকটার আস্তিন এত লম্বা যে হাত দেখাই যায় না। আশ্চর্যান্বিত হলেন লোকটার ব্যবহারেও। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আরও অবাক হলেন। কোথায় চা? শুকনো খটখটে কাপ! ওপাশে মাস্টার মশাই শুড়ুৎ... শুড়ুৎ করেই চলেছেন।
এই মধ্যরাতে ঘর্মাক্ত গরমে এতক্ষণ স্টেশনে বসে থেকে এমনিতেই বিরক্ত। তার ওপর এরকম ব্যবহারে আনিস সাহেবের রাগটাও দলা পাকিয়ে ওঠে।
“মাস্টার মশাই আপনি কি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছেন?”
ওদিকে ছায়ার মধ্যে দুলে দুলে কে যেন হেঁসে ওঠে।
“মশাই ভাল হবে না বলে দিচ্ছি......!” আনিস সাহেব উঠে দাঁড়ায়।
ঠিক এমনই সময় বজ্রপাত বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে দরজা গলে পুরো ঘর ধাধিয়ে দেয়। ক্ষণিকের হলেও আনিস সাহেবের জন্য ওটুকুই যথেষ্ট ছিল। তিনি দেখলেন মাস্টার মশাই বলে দাবি করা লোকটার মুখের পেঁচানো চাদরের ফাঁকে কোন চোখ তো নেই বরং দুটো গহ্বর। খুলে আসা চামড়ার ভিতর থেকে বেরিয়ে আছে দাঁতসহ চোয়ালের পাটি। বীভৎস সেই দৃশ্য মুখের যে কতটা শ্রীবৃদ্ধি করেছে তা আর না বললেও চলে। আর ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠা সেই দাঁতকপাটিতে রক্ত হিম করা অট্টহাসি।
পরের কয়েকটা মুহূর্ত আর আনিস সাহেবের ভাল মনে পড়ে না। পেছনের পিলে চমকানো অট্টহাসি উপেক্ষা করে তিনি কোনমতে প্ল্যাটফর্মে উঠে আসেন। ঝড়ো হাওয়া ছাপিয়ে বৃষ্টির তখন মুষলধারা। তবু ভাগ্য তাঁর নেহাত খারাপ বলা যায় না। ট্রেন একটা কেবল স্টেশনে থামছে। তাই দেখে আনিস সাহেব যথা সম্ভব হাত-পা ছুড়তে লাগলেন। যদিও কিছুক্ষণ বাদেই ট্রেনের অনেকগুলো অবাক দৃষ্টির সামনে তিনি নিজেকে অসহায় ভাবে আবিষ্কার করেন।
“এই যে সাহেব শুনতে পাচ্ছেন?” অস্পষ্ট একটা কণ্ঠ।
আনিস সাহেবের চোখে মুখে পানির ঝাপটা এল। কারা যেন ঠেলছে তাঁকে। চোখ মেলতেই দেখলেন মেঝের ওপর তাঁকে ঘিরে কম্পার্টমেন্টের ভেতর ভীর জমে গেছে। ট্রেনের জানালার অপাশে তখন অন্ধকারও ছুটছে জোরসে।
“অমন করে দৌড়াচ্ছিলেন কেন?” কে যেন বলল।
“আরে না, ব্যাটা চুরি-টুরি করে পালাচ্ছিল।” অন্যজন বলে।
“তা কেন, তা কেন, দেখে তো সেরকম মনে হয় না?” আরেকজনের মন্তব্য।
এমন সময় সবাইকে ঠেলে একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এল।
“কই, দেখি দেখি!”
বৃদ্ধ এসে আনিস সাহেবের চোয়াল টেনে চোখদুটো দেখলেন। তারপর মুখ হা করিয়ে দাঁতের পাটি দেখলেন। তারপর বললেন,
“হ্যাঁ, ঠিক আছে, মানুষই।”
বলেই বৃদ্ধ উঠে চলে যাচ্ছিলেন, আনিস সাহেব খপ্ করে বৃদ্ধের হাত চেপে ধরলেন।
“আপনি জানেন! আপনি নিশ্চয়ই কিছু জানেন! দয়া করে বলুন কি জানেন।”
“দেখ বাছা, বয়স হয়েছে। অভিজ্ঞতাও কম না। জীবনে অনেক কিছুই দেখেছি। তাই কালীঘাটের স্টেশনে এলেই চেন টেনে দিই। যদি কারও সাহায্যে লাগতে পারি মন্দ কি?”
“তাঁর মানে? এটা বনপাড়া স্টেশন না? কি স্টেশন এটা?”
“না বনপাড়া স্টেশন এর পরেরটা। এটা কালীঘাট।”
“কি আশ্চর্য! আপনি বলতে চাইছেন আগের ট্রেন আমাকে ভুল করে কালীঘাটের স্টেশনে নামিয়ে দিয়েছে!”
“এত অন্ধকার যে ট্রেনের ভুল করা স্বাভাবিক। তা না হলে মহারানীর আমলের অভিশপ্ত কালীঘাটের স্টেশনে কি আর জেনে বুঝে কেউ থামে? তবে তোমার প্রতি একটা অনুরধ থাকবে। যদি কখনও এমন সময়ে এ লাইনে আস, তবে চেন টানতে তুমিও ভুল কর না। তোমার মত যদি কেউ রক্ষে পায়!”
এতুকু বলেই বৃদ্ধ ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়। স্তম্ভিত আনিস সাহেবও চান ঘটনাটা স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাক। কিন্তু চাইলেই কি কালীঘাটের স্টেশনের স্মৃতি ভোলা যায়!
০৭ মে - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
১২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪