যে সময়ের কথা বলছি তখন আমার বয়স বছর বারো হয়ে গিয়েছে।
আমি তো কাকুর কাছেই থাকি সেই ছোট্টবেলা থেকেই। বাপী তো পুলিশের চাকরী নিয়ে সব সময়ই থাকে বাইরে বাইরে। আর মা তো আমাকে কাকুর ঘাড়ে গছিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তি। কাকু কিছু বললেই মা কাকুকে বলে—‘তোমার পরী ছেলে নিয়ে তুমি থাকো আর সামলাও ঠাকুরপো। ওই দুষ্টু ছেলেকে মানুষ করা আমার কর্ম নয়’।
বোঝ ঠ্যালা….আমি পরী ও আবার দুষ্টু ও…..মা যেন কি?’
আমি তাই কাকুর ছেলে হয়ে গেছি সেই কথা না ফোটা বেলা থেকেই। কি করবো? তখন তো আমি কাকুর কোলে চড়েই থাকতাম, বেড়াতাম ….সব করতাম। এমন কি রাতে কাকু আমাকে দুধ খাইয়ে দিয়ে কোলে তুলে নিয়ে পায়চারী করে গান গেয়ে ঘুম ও পাড়াতো।
তারপরে আমি একটু বড় যখন হ’লাম মানে কথা টথা বলতে ও বুঝতে শিখলাম, তখন কাকু তার এই আদরের একমাত্র ভাইপোকে রাতে ঘুম পাড়াতে গানের বদলে গল্প শোনাতে শুরু করলো। আর কি বলবো? আমার কাকু যা সব দারুণ সুন্দর সুন্দর মজাদার গল্প জানে না । বেশ অনেক কিছু শেখাও যায় সেই সব গল্প শুনে। এখন ও আমার সেই অভ্যাসটি যায় নি, আর মনে হয় কোন কালে যাবে ও না।
তা এখন অবশ্য আমি আর কাকুর কোলে উঠি না গল্প শুনতে, তা ঠিক। বিছানায় শুয়ে বা সোফায় বসে গল্প শুনি।
আমার কাকু যে খুব ইমোশনাল ছেলে একটা, তবে কাকুর খুব বুদ্ধি আছে। বাদলের
মতন। বাপীর তো অনেক কেসেই কাকুর সাহায্য না হ’লে চলেই না। আর বাদলের তো বাপী নাম দিয়েছে মাষ্টার বন্ড। শুধু আমাকেই বলে গাধা আর গঙ্গারাম। সে বলুক গিয়ে বাপী। কার বাপী আর কবে নিজের ছেলেকে বুদ্ধিমান বলে?
কিন্তু রাতে কাকুর কাছে রোজ গল্প না শুনলে আমার ঘুমই আসে না। সেই জ্বালায় তো আরো আমার মায়ের কাছে গিয়ে আর রাতে থাকা ও হয় না । মা তো গল্প বলার বেলায় একটি আস্ত ঢ্যাঁড়স………..
এ মা ছিঃ….ছিঃ……..সত্যি …আমি ও যেন কি? মাকে কেউ কখনো ঢ্যাঁড়স বলে না কী ছেলে হয়ে? ঠাকুর পাপ দেবেন না? যাঃ…..
আমি যে চঞ্চল সে’কথা হয়তো আর নতুন করে বলতে হবে না।
আমার একমাত্র বন্ধু জিনিয়াস ছেলে বাদল আদর করে আমার আবার নাম দিয়েছে পরীর দেশের রাজকুমার, আমি নাকি দেখতে খুব খুব সুন্দর ছেলে, সেইজন্য।
আমি তো সুন্দর অসুন্দরের কিছু অত শত ছাই বুঝি ও না। তবে আমি যে খুব ফরসা দুধের বরণ ছেলে সেটা এখন বুঝি বেশ। তা এই দেশে কি আর ফরসা ছেলের অভাব আছে? কাকু ও বাদলের যত্তো সব আদিখ্যেতার কথা আর কি? সে কথা যাক।
তা রোজকার মতন সে’দিন ও আমি বাদলের সাথে বিকেলে ছাদে গিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলেছি। তারপরে বাদল একটু জলখাবার খেয়েই বাড়ী চলে গেল আর সন্ধ্যা হ’তে কাকু আমাকে পড়তে বসিয়ে কিচেনে গিয়ে ঢুকলো রাতের খাবার মানে কি বলে…….ডিনার তৈরী করতে।
আমি বসে পড়ছি আর যেখানে বুঝতে পারছি না সে সব খাতায় নোট করে রাখছি। কাকু ঘন্টা তিন পরে রাত ন’টা বাজলে সব কাজ সেরে তখন খবর শুনে নিয়ে রাত সোয়া ন’টায় সেই পয়েন্ট গুলো আমাকে সব বোঝাতে বসবে। তখন একঘন্টা আর ও পড়তে হবে আমাকে । সাত ক্লাশের পড়ার এই ঠ্যালায় আমি তো জেরবার। এক রবিবার ছাড়া টি০ভি০তে বসে একটু কার্টুন শো ও তো ছাই দেখতে পাই না সময় করে।
তারপরে কাকু উঠে গিয়ে বেশ সুন্দর পরিপাটি করে ডাইনিং টেবিল সাজিয়ে নিয়ে আমাকে খেতে ডাকবে। সেও লাগবে একঘন্টা। তবে কাকুর সব কাজই দেখি ঝকঝকে সুন্দর আর নিয়ম ধরে।
তারপরে সব ওয়াশ করা আছে না? আজকাল আমি আর সেই ডিস ওয়াশিংটা কাকুকে করতেই দিই না। নিজেই বেসিনে সব নিয়ে গিয়ে করি। কি আর করা?
কাকু তো আর তার আদরের ছেলেকে দিয়ে কিচ্ছুটি করাবে না। তাই বলে আমার আক্কেল শরম বলে কি কিছু নেই আর লজ্জা করে না । আমি একটা এতো বড়ো ধাড়ী ছেলে হয়ে ঘরে সোফায় আরাম করে বসে টি০ভি০ দেখব, আর একলা হাতে কাকু সব করবে? ছিঃ….
তাই কাকু তখন বসে কাগজ বা পত্রিকা যা হয় পড়ে বা টি০ভি০ দেখে।
তবে সব সারতে আমার সময় লাগে আর বেশ রাত হয়। জলের কাজ করতে গেলেই তো আমার জামা টামা সব ভিজে ও যায় যতই সাবধানে করি না কেন। তার পরে ঘরে এসে বিছানার বেড কভার তুলে রেখে মশারী ফেলে শুয়ে পড়বার তোড়জোড় করতে ও হয় আমাকে। যা মশা। আবার পরদিন সকালে স্কুল আছে না?
তা সে’রাতে সব কাজ শেষ করে সে’দিন মানে সে’রাতে আমি এসে দেখি যে কাকু চুপটি করে বসে আছে। বই টই ও পড়ছে না।
আমি আমার আধ ভিজে গোলাপী শার্টের বোতামগুলো বাঁ হাত দিয়ে একে একে খুলতে খুলতে বললুম—‘ও কাকু, তুমি আজ বই পড়লে না? কি হয়েছে?...’
‘কিছু না’।
‘তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে,কাকু?’
‘নাঃ…’
‘তবে? তোমার কি মন খারাপ হয়েছে?’
‘কে জানে? তাই হবে হয়তো। কিছু ভালো লাগছে না।‘
এই বলে কাকু আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলো।
আমি ততক্ষণে আমার দামী শার্টটা খুলে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রেখে এসে পরনের ব্রাউন রঙের ভেলভেট কাপড়ের দামী প্যান্টের বোতামগুলো খুলছি। কাকু আমাকে ঘরে ও এখন দেখি বেশ দামী দামী সুন্দর সব বিদেশী ইম্পোর্টেড ড্রেস ও অন্তঃবাস পরায়।
ফলে কাকুর কাজ বেড়েছে। অনেক জামাকাপড় কাচতে আর বাইরের ড্রেস গুলো সব আয়রণ ও করতে হয় কাকুকে।
এর কি কারণ তা কে জানে? আমি একটু বেশী সুন্দর হয়েছি না বড় হয়েছি দেখে এখন এই ব্যবস্থা করেছে আমার কাকু, তা কে জানে? তবে কাকু ভীষণ খুঁতখুতে ছেলে একটা, আমার পোষাক আর তার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে। রোজ পরিষ্কার কাচা স্কুল ড্রেস পরিয়ে তবে আমাকে স্কুলে পাঠায়, কাকু। ঘরের ড্রেস ও খেলা ধূলো সেরে আমি এলে বিকেলে তখন চেঞ্জ করে দেয়। ।
আজ অন্তঃবাস হিসেবে আমার পরনে ছিলো একটা আকাশী রঙের নরম জাঙিয়া আর হাল্কা সবুজ রঙের গেঞ্জী। দু’টোই বিদেশী মানে দামী ইজিপসিয়ান কটনের কাপড়ে তৈরী……….কাকুর এই একটা ছেলের জন্যে মাসে যা খরচ করতে হয় না, সে আর কি বলবো?
আমি প্যান্টটা ও খুলে রেখে আসতে কাকু আমার বুকে হাত দিয়ে বললো—‘এ’টা ও তো দেখছি ভিজেছে। নাঃ এই ছেলে নিয়ে আমার হয়েছে খুব মুশ্কিল। কাজ করে উল্টে যায় আর কি?’
আমি লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি নিজের নরম দামী গেঞ্জিটাও টেনে খুলে ফেলতে কাকু তখন উঠে এসে আমাকে ডান হাত দিয়ে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে নিলো আর বাঁ হাত আমার কোমরের নীচে দিয়ে ধরে ব্যালান্স ঠিক করে নিয়ে একটানে আমাকে ঠিক দু’বছরের বাচ্ছা বয়সের মতন করে নিজের কোলে তুলে নিয়ে ঘরেই পায়চারী করতে লাগলো।
আমার তখন বেশ একটু লজ্জা করলে ও ঘরে তো আর তখন কেউ নেই আর দেখছে ও না যে আমি এতোবড় একটা ছেলে হয়ে আজ এখন আবার কাকুর কোলে উঠেছি। তাই কাকুকে একটু ও বারণ করলুম না। বাদল থাকলে অবশ্য ….এ্যাই ছিঃ…..
কাকু তখন আমাকে নিজের বুকে চেপে ধরে রেখে আমার গালে আদর করে চুমু খেতে শুরু করেছে।
খানিকক্ষণ কাকুর আদরে আদরে অস্থির হয়ে আমি তখন বললুম—‘আচ্ছা কাকুউ,… আমি তো এখন আর তোমার সেই ছোট্ট বাচ্ছা ছেলেটি নেই যে এইভাবে আমাকে তুমি আদর করছো…..এত্তো বড় একটা ছেলে হয়ে গেছি এখন দেখতেই পাচ্ছ। সাত ক্লাশে পড়ছি ও….তা আমি তোমার কাছে আমি অপরূপ সুন্দর ছেলে তো তাই আদর করছো কিন্তু তাই বলে কি আমার ওজন ও বাড়েনি, কাকু? তোমার কাছে ভারী লাগছি না আমি একটু ও? তুমি আমাকে সেই ছোট্টবেলার মতন কোলে নিয়ে এখন পায়চারী করলে হাঁফিয়ে যাবে না, কাকু?’
কাকু আমার এই কথা শুনে হেসে ফেলে বললো-‘সে তো তুমি আরো বড় হয়ে গেলে ও আমি আদর করবো আর সুন্দর না হয়ে তুমি একটা বিদিকিচ্ছিরী দেখতে আর কালো কুচকুচে কাফ্রী ছেলে হ’লে ও আমার ভারী লাগতো না, চঞ্চল। সুন্দর দিয়ে কি হবে? ইতিহাসে ও কোনকালে তেমনটি যে কারো ভারী লেগেছে তার কোনই নজির নেই। বরং উল্টোটাই তো আছে…..’
‘ইসসসসস……….তাই বুঝি? আর তার মানে, কাকু? ইতিহাসের কোন গল্প আছে তোমার ঝুলিতে? ’
‘হুম…তবে ঠিক ইতিহাস বলা চলে না। গল্প ইজ গল্প……….’
‘তবে তুমি তাই এখন বলে ফেলো তো, কাকু। সে না শুনলে আজ আমার চোখে ঘুম নাস্তি। হিঃ…..হিঃ…..হিঃ…..হিঃ….’
‘বলছি শোন। সে অনেক দিন আগেকার কথা। ……………’
কাকুর নতুন গল্প শুরু হ’লো আমার আব্দারে। কি আর করবে, কাকু? যেমন ছেলে তৈরী করেছে একটা যাচ্ছেতাই ধরনের, তেমনি তো হবে তার ফল।
আমি মনে মনে বললুম—‘তা আমি বাপু এখন গল্পটি শুনে তারপরে না হয় কাকুর
সাথে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়বো। কেননা তার পরক্ষণেই তো আমি ঘুমিয়ে কাদা।
তার চেয়ে বরং কাকুর আদর ও গল্প দুটোই চলুক। .সুন্দর ছেলেদের ভাগ্যে তো আদর একটু বেশীই জোটে, তা জানি আমি। তবে কাকু আবার বলে কি না কাফ্রীর ছেলে হ’লে ও ….হুঁ, যত্তো সব বাজে কথা কাকুর……………….’
কাকু বললো--‘শোন, আরব দেশের রাজধানী বাগদাদে তখন খলিফা হারুণ অল রসীদের রাজত্বকাল চলছে, যে দেশের নাম এখন হয়েছে ইরাক। সে’দেশের ভাষা আরবী আর পাশেই পারস্য দেশ বা ইরান । ভাষা ফারসী। আরব্য উপন্যাস বা অ্যারেবিয়ান নাইটসের গল্প ও পারস্য উপন্যাসের কথা তো সবাই জানে। তুমি ও শুনেছ…………. .’
‘একদিন খলিফা সিংহাসনে বসে আছেন আমীর ওমরাহ সমেত। দরবার চলছে। হঠাৎ নকীব এসে কুর্ণিস করে বললে—‘জাঁহাপনা, একজন আমীর নফর সাথে নিয়ে এসেছেন আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী………….হুকুম হয় তো.’
‘খলিফার দরবার ছিল অবারিত দ্বার। এখনকার ভি ভি আই পি দের মতন অবস্থা তো আর ছিল না। তাই বললেন-‘হুকুম হ্যায়…নিয়ে এসে হাজির করা হোক.’
‘ব্যস, একজন বেশ বড় মানে ধনী শেঠ অর্থাৎ আমীর আর তার নফর এসে খলিফাকে কুর্ণিস করে দাড়ালো। সে তাঁর অনুমতি নিয়ে বলতে শুরু কো-হুজুর জাঁহাপনা, আপনার এই গোলামের নাম নাসীর আর এই আমার নফর হোসেন। লোকটা ভালো কিন্তু এক্কেবারে কুড়ের বাদশা। হাত নাড়তে হ’লেই ওর কষ্ট হয়। কাজ করতেই চায় না আর কোন বোঝা বইতে হ’লে তো কথাই নেই। অথচ আমি ও যেমনটি চেয়েছিলো ঠিক সেই হিসেবে ওকে পুরো বেতন তো দিই। খাবার দাবার পোষাক আষাক ছাড়া ও উল্টে দরকার পড়লেই ওকে বিশ পঞ্চাস দীনার ও দিতে হয় আমাকে। কিন্তু আমি যতো যাই করি হুজুর ও তো কুত্তার দুম, মালিক….কিছুতেই তো শোধরায় না, হুজুর। কাল কি হয়েছিল শুনলেই আপনি বুঝতে পারবেন যে আমি কি ফ্যাসাদেই পড়েছি এই নফরকে নিয়ে। আমি গেছিলাম আব্দুল সলীমের খামার বাড়িতে। ঘরে আনাজ ছিলো না, তাই’।
‘তা আমার কথা শুনে সলীম বললো যে একদিন পরে ও নিজেই দশ বস্তা আনাজ আমার বাড়িতে এনে পৌঁছে দিয়ে যাবে। তাই তখন সে একদিনের মতন আনাজ আমাকে একটা বস্তায় ভরে এনে দিয়ে দিলো । বড়জোর বারো তেরো সের হবে। আমি সেটা হোসেনকে নিয়ে আসতে বললুম আমার সাথে, হুজুর’।
‘কিন্তু ও বস্তা ঘাড়ে নিয়ে তিন কোশ তো দূরের কথা হুজুর, তিরিশ গজ ও হাঁটলো না। দুম করে কাঁধ থেকে বস্তাটা মাটিতে ফেলে দিয়ে বললো—ইয়া আল্লা, উঃ কি ভারী? এই হিন্দুকুশ পর্বতকে বয়ে নিয়ে যাওয়া আমার সাধ্যাতীত। আমার কাঁধ ব্যথা হয়ে গেছে। আপনি অন্য ব্যবস্থা দেখুন, মালিক’।
‘আমি তো এক্কেবারে হতভম্ব, অসহায় অবস্থায় হুজুর। কিন্তু কি করি তখন মাঝপথে? বাধ্য হয়ে এক খচ্চরওয়ালাকে ডেকে বস্তা নিয়ে বাড়ী আসতে হ’লো আর বিশ দীনার দন্ড ও দিতে হ’লো। আপনিই বলুন হুজুর, এইভাবে কি কাজ চলে?’
‘হুম….কিন্তু তোমার এইজন্য কষ্ট পা’বার তো কোন কারণ আমি দেখছি না, নাসীর । আরে, তোমার এই নফর যদি বদ্ধ কুড়ে হয় আর কাজ না করতে চায় তো সে না হয় না করবে। তোমার কি? তুমি একে বরখাস্ত করে দিয়ে অন্য একজন নফর রাখো। ঝামেলা চুকে গেলো। বাগদাদে কি নফরের অভাব আছে?’
‘না জাঁহাপনা। সে অভাব তো সত্যিই নেই হুজুরের রাজ্যে। কিন্তু কথা কি জানেন, হুজুর? এই লোকটা কুড়ে হ’তে পারে কিন্তু ঈমানদার। ঘরের খবর বাইরে নিয়ে যায় না। চুরি টুরি ও করে না আর কথায় কথায় মেজাজ গরম করে না অন্যদের মতন আর নফরগিরী ছেড়ে দেবে ও বলে না, হুজুর। তাই আমি একে বরখাস্ত করতে পারছি না. মালিক আর সেই সুযোগে এ আমাকে………….। হুজুর তো এই দীন দুনিয়ার মালিক। ইচ্ছে করলেই এর স্বভাব আপনি যে বদলে মানে শুধরে দিতে পারেন তা আমি জানি। গোস্তাকি মাফ হয় হুজুর আর যদি এই গোলামকে দয়া করেন..’
‘আমিরের কথার প্যাঁচে পড়ে খলিফার মতন বিছক্ষন ও ক্ষুরধার বুদ্ধির মানুষ ও চুপ। করেন কি? কথায় বলে স্বভাব না যায় ম’লে……….হোসেনের সেই স্বভাব এখন তিনি বদলাবেন কি করে? এ তো এক ভালো আপদ হ’লো যা হোক। অসহায়ভাবে খানিক ক্ষণ নিজের লম্বা দাড়িতে হাত টাত বুলিয়ে নিয়ে শেষে বললেন---হুম, বুঝেছি…তা তখন তুমি কি টাকা পয়সা আগাম চাইবার কথা বলছিলে যেন?’
‘জী মালিক, পরবরদিগার,,,হোসেন মাঝে মাঝেই বেশ কিছু টাকা আমার কাছ থেকে আগাম চেয়ে নেয় আর বলে পগার মানে মাইনে থেকে কেটে নেবেন আর আমি তাই করলে সে পরের মাসেই আবার……’
‘হুম, তা বাপু হোসেন…. গতবার তুমি কতো টাকা আগাম নিয়েছিলে আর কেনই বা? বলো তো শুমি’।
‘জাঁহাপনাহ…….আমি গরীব মানুষ…নিত্যি আনি নিত্যি খাই অবস্থা…..তার ওপরে বিবির হুকুম কি এক মানতের জন্য শীরের দরগায় তিনি মেওয়া, গুলাব, সিন্নী না চাদর কি সব চড়াবার মানত করেছিলেন তাই আমাকে পঞ্চাশ দীনার চাইতেই হ’লো………. তার আগে চল্লিশ দীনার আমাকে নিতে হয়েছিলো ছেলেকে এক মক্তবে ভর্তি করতে…’
‘হুম, তা বেশ করেছো, কিন্তু নাসীর………..তুমি তোমার নফরকে নিয়ে এখন যেতে পারো। আমি একটু ভেবে দেখি কি করা যায় আর আবার যখন তোমার নফর কিছু টাকা আগাম চাইবে তোমার কাছে, তখন তুমি ওকে টাকা না দিয়ে আমার কাছে নিয়ে চলে আসবে। তখন আমি ওকে শোধরাবার জন্য চেষ্টা করবো। আর এই মাসের ওর তনখাহ থেকে তুমি বিশ দীনার কেটে নিও। বুঝেছো?’
‘জী, জাঁহাপনাহ………………..কুর্নিশ করতে করতে পিছু হেঁটে তারা বিদায় হ’লো।
অসহায় ভাবে খলিফা বললেন—উজির সাহেব, এই সমস্যার সমাধান কি বলো তো’।
‘গোস্তাকি মাফ হয় হুজুর…..সত্যিই এ হচ্ছে আমার অসাধ্য কাজ, আলমপনাহ.’
শুনে বিরক্তিভরে তিনি বললেন—আজকের মতন দরবার বরখাস্ত করা হ’লো…..এই বলে উঠে চলে গেলেন।
কাকু থামলো।
‘তারপরে, কাকু?’ আমি প্রশ্ন করলুম।
কাকু আমার বড় বড় টানা টানা চোখের দিকে খানিক চেয়ে থেকে বললো—‘মন্ত্রী পারলেন না, তুমি চেষ্টা করে দেখ তো, চঞ্চল। যদি কোন সমাধান বা উপায় বলতে পারো’।
‘কাকু, আমি কি বাদলের মতন সুপার জিনিয়াস ছেলে? আমি পারবো না….তুমি বলো না, ও কাকু..’
‘অনেক রাত হয়েছে। চলো গিয়ে শুয়ে পড়া যাক, চঞ্চল’….. এই বলে কাকু টিউব
লাইট অফ করে দিয়ে সবুজ নাইট বাল্ব অন করে মশারির মধ্যে ঢুকে পড়লো। অবশ্য তার আগে আমাকে এনে বিছানায় বসিয়ে দিয়েছিলো, কাকু।
আমি ও গিয়ে কাকুকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে কাকুর বুকের ওপরে উঠে শুয়ে পড়ে আব্দার করে বললুম—তুমি গল্পটা শেষ করো নইলে আমি তোমাকে ঘুমোতে দিলে তো? বলো না….ও কাকুউউ…..’
‘হুঁ, বলছি………………এই ঘটনার পরে কয়েক মাস কেটে গেছে। শীত পড়তে শুরু হয়েছে। তখন একদিন খলিফার বিশ্ববিখ্যাত দরবারে আবার সেই নাসীর নামের আমীর তার নফর হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে এসে হাজির হ’লো ও কুর্ণিস করে বললো-‘হুজুর গরীর নওয়াজ, বান্দা হাজির’।
‘তখন সব মনে পড়ে গেলো খলিফার। ভাবলেন…এই রে….খেয়েছে…তিনি তো ঘটনাটির কথা বেমালুম ভূলে মেরে দিয়ে ছিলেন। বিচার করবেন কি? যাঃ চ্চলে।
মুখে বললেন—‘তা বেশ। কিন্তু কেন বলো তো?’
‘হুজুরের যে হুকুম হয়ে ছিলো যে আবার যেদিন আমার এই নফর হোসেন আমার কাছে আগাম টাকা চাইবে সেইদিন টাকা না দিয়ে হুজুরের দরবারে তাকে হাজির করতে হবে। এতোদিন পরে আজ সে আমার কাছে আবার একশো দীনার চেয়েছে….তাই…’
‘হুম….তা ওহে হোসেন, বলো তো আজ আবার তোমার টাকার দরকারই বা পড়লো কেন হঠাৎ করে?’
তিনবার কুর্ণিশ করে হোসেন বললো—‘জাঁহাপনাহ, আমি তো চেষ্টা করছিলাম যাতে উধার না চাইতে হয় কিন্তু আমার নসীব খুব খারাপ হুজুর। সকালে ছেলেটার হঠাৎ করে বুখার এসে গেলো। এখন তো হাকিমকে ডাকতেই হবে, দাওয়াই কিনতে হবে। পথ্যি ও চাই। সুতরাং………..’
‘হু, তা তোমার ছেলের বয়স কতো হয়েছে, হোসেন?’
‘বেশী নয় আলমপনাহ, বারো বছর পুরো হতে চলছে..সামনের মাসে তেরোয় পড়বে।’
‘তা বেশ। কিন্তু তোমার ছেলে যে সত্যি বিমার হয়েছে, তুমি মিথ্যা কথা বলে টাকা চাইছো না তার কি প্রমাণ?’
‘সে কি আমি কখনো বলতে পারি, হুজুর?’
‘তা আমি জানি না। প্রমাণ কি? তাই তুমি এখনি তোমার ছেলেকে আমার দরবারে এনে হাজির করো। আমি যদি দেখি যে সত্যিই সে বিমার হয়েছে, তবেই তুমি টাকা পাবে’।
‘জো হুকুম দীন দুনিয়ার মালিক। আমি ছেলেকে নিয়ে আসছি’।
‘বেশ, আমীর নাসীর, তুমি অপেক্ষা করো ততক্ষন ‘।
হোসেন চলে গেল।
প্রায় দু’ঘন্টা পরে সে আবার ফিরে এলো দরবারে। সঙ্গে একটি বছর বারো তেরো বয়সের রোগামতন বেশ কালো ছেলে। ছেলেটির মুখশ্রী ও একদম ভালো নয়, তায় মনে হয় বেশ জ্বরতপ্ত আর সে শীতে বা জ্বরে কাঁপছে।
খলিফা তাই দেখেই তালি দিলেন হাতে-‘শাহী হাকিম কো তলব দিয়া যায়, তুরন্ত’।
তখনি হাকিম এলেন।
‘হাকিম সাহেব, আপনি এই ছেলেটিকে এখনি পরীক্ষা করুন …দেখে বলুন এই ছেলেটি কি সুস্থ?’
‘না হুজুর। ছলেটি খুবই বিমার…’
‘এই ছেলেটিকে এখনই শাহী ইলাজখানায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করা হোক। শাহী খাজানা থেকে সব খরচ দেওয়া হবে। প্রথমে ছেলেটিকে গরম পোষাক দেওয়া হোক। সামান্য যা বস্ত্র ওর পরনে আছে তা খুবই অপ্রচুর ও অপর্যাপ্ত। ছেলেটি কাঁপছে। উজির সাহেব, আপনি নিজে গিয়ে দেখুন… আমি ও যাব চিকিৎসার তদারক করতে একঘন্টা পরে….’ খলিফা হুকুম দিলেন।
‘যো হুকুম জাঁহাপনাহ…..’
‘হ্যাঁ, হোসেন এ’বার তুমি বলো তো দেখি যে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসতে এতো সময় লাগলো কেন তোমার?’
‘কি বলবো হুজুর? আমার বাড়ী অনেকটা দূরে আর আমার কাছে তো পয়সা ও ছিলো না যে উটের গাড়ী চড়ে আসবো…তাই….’
‘তা তুমি তোমার এই রুগ্ন ছেলেকে নিয়ে এলে কি করে? হঁটিয়ে আনলে ছেলেকে এতোটা পথ?’
‘না হুজুর। অসুস্থ ছেলে বুখার নিয়ে কি করে পায়দল আসবে এতো পথ?’
‘তবে?’
‘আমি তকে উঠিয়ে নিজের কাঁধে বসিয়ে নিয়ে চলে এসেছি, হুজুর…’
‘বলো কি হোসেন?…সর্বনাশ…তোমার কাঁধে ব্যথা করলো না। তোমার ভারী ও লাগলো না?’
বলেই খলিফা হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলেন।
শুনে মুখ ভার করে হোসেন বললো-‘হজুর, গোস্তাকি মাফ হয়। হুজুর কি যে বলছেন আমি তো তাই বুঝে উঠতে পারছি না। এ কী একটা পরের আনাজের বস্তা নাকি যে আমার কষ্ট হবে আর কাঁধে ব্যথা করবে? ও আমার ছেলে…নিজের ছেলে …ও কী আমার কাছে কখনো ভার বোঝা হয়ে উঠতে পারে, হুজুর?’
‘আমি ও তো তোমাকে তাই বলছি হোসেন। না বুঝতে পারবার তো কিছু নেই। খুব সহজ কথা আর তুমি তা নিজেই তো বললে যে ছেলে তোমার নিজের। অপরের নয়। তাই সে ভার বোঝা ও বলে তোমার মনে হয় না। কিন্তু যে কাজ করে তুমি সেই ছেলে ও নিজেদের সবাইকার গ্রাসাচ্ছাদন করছো, ছেলেকে মানুষ করছো, সেই কাজ বা তার দায় তোমার নিজের বলে মনে হয় না। সে কাজ তোমার নিজের নয় ।মালিকের, মানে পরের। তাই মালিকের দশ সেরের বোঝা বইতে হ’লে ও তোমার কাঁধ ব্যথা করে দশ গজ গিয়েই। কি? আমি ঠিক বলছি তো?’
‘অ্যাঁ,…………. না…মানে হ্যাঁ…………..হুজুর…’
‘কি না? বেতন নিয়ে যে কাজই করা হয় তার দায় ও নিজের হয় হোসেন, সেই কাজটা নিজের কাজ কেননা সেই বেতনে তোমার নিজের ও পরিবারের ভরণ পোষণ চলে। সুতরাং সেটা পরের কাজ হয় না কেননা তুমি তোমার শ্রম তো বিক্রী করছো। এখন তুমি যদি শ্রমই না করো তবে পারিশ্রমিক নেবে কোন অধিকারে আর পরিবার চালাবে কি ভাবে? তুমি বুঝতে পারছো আমার কথা?’
‘হ্যাঁ হুজুর…আমি বুঝতে পারছি। নিজের বলে ছেলের ভার হাল্কা মনে হয়েছে আমার কাছে আর পরের মানে মালিকের সামান্য ভার ও বেশী মনে হয়েছে। আপনি আজ আমার চোখ খুলে দিয়েছেন, মালিক। আমি আর এমন অন্যায় কাজ কখনো করবো না কেননা আমি কাজ করি না বলে মালিক সত্যিই আমাকে বরখাস্ত করলে আমার তো বদনাম হবে আর তখন আমি তো কোথাও কোন কাজই পাবো না। আার তখন তো আমার পরিবারের সবাই না খেয়ে মরবে, হুজুর’।
‘এই নফর হোসেন কে এখন তিন হাজার দীনার বখশিষ দিয়ে তার ছেলের কাছে নিয়ে যাওয়া হোক। আর আজকের মতন দরবার বরখাস্ত করা হ’লো…।’
কাকুর গল্প শেষ। শুনে আমি চুপ।
মিটি মিটি হেসে কাকু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো---‘আমার ছেলে…………’।
আমি কাকুর বুকে মুখ লুকিয়ে নিলুম।