টুলু

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী (সেপ্টেম্বর ২০১৪)

রিয়াদুল রিয়াদ
  • ১৬
- তুমি কোন মেয়ের সাথে কোথায় দেখা কর, সময় কাটাও ভেবেছ আমি জানি না?
- কি বলছ এসব?
- কি বলছি? আমার কাছে সব খবর আছে, কোন বান্ধবীর সাথে, কোন কলিগের সাথে, কোথায় যাও। কাকে কি কিনে দাও।
- আজে বাজে কথা বলবে না।

দুই মোবাইলের দুই পাশে এসব কথা হচ্ছে। কান একদম ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। এসব শুনতে ভাল লাগছে না। মেয়েটা বকে যাচ্ছে। ছেলেটা শুনে যাচ্ছে। একটু পর অবস্থা আরও বেগতিক হবে। পারলে মোবাইলের ওপাশ দিয়ে গলা টিপে ধরবে।
এবার অন্য কিছু শোনা যাক। নাহ এদের কথা বার্তা অনেক শান্ত। মনে হচ্ছে এদের মধ্যে সম্পর্ক অনেক ভাল।

- হ্যাঁ শোন, কাল কিন্তু আমরা আবার দেখা করব ঠিক আছে?
- আচ্ছা।
- তোমার সময় হবে তো?
- কি যে বল, তোমার জন্য সারাদিন সময় আছে।
- বাদামে চলবে না কাল। আমরা দুজন সারাদিন ঘুরে বেড়াবো আর দুপুরে ভারী খাবার খাব।
- তোমার যা ইচ্ছা।
- রেস্টুরেন্টের খাবার অত ভাল না। একটা মুরগীর পিস দিয়ে কারি কারি টাকা নিয়ে নেয়। আমি তার চেয়ে রান্না করে নিয়ে আসব তোমার জন্য। খাবারের ব্যাগ টানতে তোমার কোন অসুবিধা নেই তো?

এদের কথা শুনতে খারাপ লাগছে না। বাহ কি সুন্দর কথা বার্তা। কথা গুলো শুনছে একটা ছয় তলা বিল্ডিঙের ছাদে বসে বসে। যে শুনছে তার নাম ER821. নামের অনেক বড় মর্মার্থ আছে। E হল স্টেশনের ব্লকের নাম। R হল রোড নং , 8 হল বাড়ির নাম্বার আর 21 হল বাড়িতে বাস করাদের মধ্যে ওর সদস্য নাম্বার। নাম বললেই যে কেউ ঠিকানা খুঁজে পেতে পারে। আর এখানকার মানুষদের নাম বড় অদ্ভুত। এক মেয়েকে শোনা গেল, তার পাশে বসা ছেলেটাকে ডাকছে কিলটু সোনা। অতি দ্রুত ER821 , কিলটু সোনা লিখে ডিকশনারিতে সার্চ দিল। কোন ফলাফল নেই। বাংলা ডিকশনারিতে সোনার অর্থ পাওয়া গেলেও, কিলটুর কোন অর্থ নেই। কি আজব অবস্থা। একটা তিন চাকার যানবাহন চালাচ্ছেন এক লোক। সেই লোকের নাম আবার মামা। সবাই তার নাম জানে। মামা অর্থ যে জন্ম দিয়েছেন তার ভাই। এটাও একটা অদ্ভুত নাম। তবে ঘুরতে ঘুরতে ER821 সবচেয়ে বেশী এই নামের লোকই দেখল। এক লোক ঠাণ্ডা সরবত বিক্রি করেন তার নাম মামা, গরম চা বিক্রি করেন তার নাম মামা, এক লোক ইঞ্জিন যুক্ত গাড়ি চালান তার নাম মামা, যে ভাড়া তুলেন তার নামও মামা। কি যে অবস্থা। পুরো শহর জুড়ে শুধু মামা নামের লোকজন। এর চেয়ে ER821 এর এলাকাই কত ভাল। এক নামের দুইজন নেই। ER821 থাকে যেখানে সেখানটাকে স্টেশন বলে। এখানে আবার অনেক স্টেশন। বাস স্টেশন, ট্রেন স্টেশন, লেগুনা স্টেশন। এসব স্টেশনে শুধু গাড়ি। ER821 দের মত সাজানো গুছানো এলাকা না। ER821 কে স্কুল বন্ধ কালীন সময়ে ভ্রমণে পাঠানো হয়েছে। ওর ইচ্ছা মতই পৃথিবীতে এসেছে। পৃথিবী সম্পর্কে অনেক কিছু পড়েছে অনলাইন বই গুলোতে। সেই থেকে আগ্রহ জন্মানো। কোথাও কোথাও লেখা মানুষ সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। কোথাও লেখা এরা মাথা মোটা। বুদ্ধি বলতে কিছু নেই। ER821 এর কোন প্রাণ নেই। প্রাণ থাকা মানুষদের জরুরী। এদের প্রাণ হুট করে হারিয়ে যায়। এরা মরে যায়। ER821 এর ক্ষেত্রে তেমন কিছুই ঘটে না। পৃথিবীতে আসার আগে শরীর থেকে মেটালের ফ্রেম সরিয়ে পরিয়ে দেয়া হয়েছে মানুষের মত জামা কাপড়। এখন দেখতে একদম মানুষের মত লাগছে। বার বার করে বলে দেয়া হয়েছে কোন মানুষ যদি পরিচয় জিজ্ঞেস করে যেন না বলা হয়। নাম জিজ্ঞেস করলে বলতে বলা হয়েছে, টুলু। এই নামেরও কোন অর্থ নেই। এই নাম কি করে স্টেশনের প্রধান রেকানের মাথায় আসল, চিন্তার বিষয়। তাই এখানে ER821 বলা যাবে না। বলতে হবে টুলু। যে কেউ মাইন্ড রিডার দিয়ে মনের কথা বুঝে ফেলতে পারে। টুলুর এই মুহূর্তে অনেক ভাল লাগছে। ওর কাছে থাকা নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি এবসর্বার দিয়ে নানা জনের মোবাইলে কথা বার্তা শুনে। ইচ্ছা মত, যে কোন নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সিতে ঢুকে, কথা গুলো এবসর্ব করে শুনে নিচ্ছে। কেউ কেউ অবশ্য, অন্য রকম কথা বার্তা বলে। সেসব শুনে না টুলু। একটা প্রাইভেসির ব্যাপারও আছে। একটু আগে শুনল দুজন ঝগড়া করছে, তুমুল ঝগড়া। তার পরেই শুনল অন্য দুজন বেশ নরম ভাবে ভাল ভাল কথা বলছে। এই কথা গুলো বলতে পারার পিছনে কারণ টুলুর পিছনের মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার। সেখানের চার কোণা সাদা বক্স গুলোর কাজ, নেটওয়ার্ক এ কানেকশন দেয়া। আর গোল গোল বক্স গুলোর কাজ, এক নেটওয়ার্ক থেকে অন্য নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সিতে সংযোগ দেয়া। টুলুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। মোবাইল নেটওয়ার্ক এর ঐ গোল বক্সটার সাহায্যে একটা কাজ করে ফেলল। যে চারজনের ফোনে কথা শুনছিল টুলু। তাদের নেটওয়ার্ক এর ফ্রিকোয়েন্সি চেঞ্জ করে দিল। উলটপালট করে, অন্য জনের সাথে সংযোগ দিয়ে দিল। যারা ঝগড়া করছিল, আর যারা খুব সুন্দর করে কথা বলছিল। তাদের মধ্যে উলটপালট করে ফ্রিকোয়েন্সিতে সংযোগ দিল। এবার তাদের কথা শুনছে।

- আচ্ছা তুমি কি কি রান্না করতে পার? মাছ রান্না করা মনে হয় ঝামেলা। কাল এক কাজ কর, চিংড়ি মাছ নিয়ে আসো, রান্না করে। আমার অনেক পছন্দ। দুজন খাব আর পার্কে বসে গল্প করব।
- এর ভিতর চিংড়ি আসল কোথা থেকে? আমার সাথে একদম ফাজলামি করবে না। তুমি ধরা পড়ে গেছ। তুমি গতকালও তোমার কলিগকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গেছ।
- তুমি এমন কর্কশ করে কথা বলছ কেন? এমন লাগছে কেন তোমার কণ্ঠ? আর কিসের কলিগ? কিসের রেস্টুরেন্ট? তুমি কাল চিংড়ি রান্না করবে না? চিংড়ি রান্না করা ঝামেলা লাগলে, তুমি চিংড়ি ভর্তা করে নিয়ে এসো। আচ্ছা?
- কিসের কলিগ না? চিংড়ি ভর্তা খাবে? চিংড়ি ভর্তা কেন? বাসায় আসো তোমাকেই ভর্তা বানাব আজ আমি।

টুলু শুনে মজা পাচ্ছে। নিজে নিজেই হাসছে। এমন করে কি আগে কখনও হেসেছে? মানুষের পৃথিবীতে এসে নিজের ভিতর মানুষের কিছু গুণ খুঁজে পাচ্ছে। অন্য জায়গায় কথা হচ্ছে।

- দেখো এসব একদম ঠিক না। তুমি উল্টাপাল্টা কথা বলছ।
- কই উল্টাপাল্টা কথা বলছি? সত্যি কথা বললাম তো কাল রান্না করে খাওয়াব।
- না মানে? কিসের রান্নার কথা বলছ?
- গাধা ছেলে একটু আগে বললাম না? আর তোমার কণ্ঠ এতো মোটা লাগছে কেন হঠাৎ করে? ঠাণ্ডা বাঁধিয়েছ আবার? কতবার করে বলি এসব করবে না। ওষুধ খেয়ে নাও দ্রুত।
- আচ্ছা খাব। কিন্তু......
- কিন্তু টিন্তু বাদ। কাল ঘুরতে যাবার সময় কিন্তু পাঞ্জাবী পরবে।
- ঘুরতে যাওয়া মানে? কই ঘুরব?
- এখন কিন্তু মাথার মধ্যে একটা বারি দিব। কালকে আমরা সারাদিন ঘুরব সেসব ভুলে গেছ?
- না মানে...।

টুলু এখনও হাসছে। কেমন যেন ভাল লাগছে। এই ভাল লাগটার নাম কি? এমন আগে কখনও লাগে নি কেন? রেকান বলেছিলেন, হাসি কান্না এসব মানুষদের কাজ। আমাদের না। টুলু তাহলে হাসছে যে? এই পরিবর্তন সত্যি ভাবায় টুলুকে। এরপর আরও অনেকটা সময় এমন করে কাটায়। বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সিতে ঢুকে, কথা শোনা। মাঝে মাঝে পরিবর্তন করে দেয়া। কথার মাধ্যমে বুঝতে চেষ্টা করে কার সাথে কেমন সম্পর্ক। যারা কথা বলছে, তাদের পেশা কি। এসব জানতে সহায়তা করছে নিজের ডিটেকশন মিটার টা। এটার কাজ কাউকে টার্গেট করে একটা আলোর রশ্মি ফেললে, তার সম্পর্কে সব তথ্য চলে আসে ডিটেকশন মিটারের স্ক্রিনে। সমস্যা একটাই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই কোন নাম প্রদর্শন করে না। নামের জায়গায় লেখা থাকে, N/A(not available). এবার স্টেশনে ফিরে গিয়ে রেকানকে বলতে হবে এই যন্ত্রটা আপডেট করতে।
এখন দুজনের কথা শোনা যাচ্ছে। এরা খুব একটা ভাল বিষয় নিয়ে কথা বলছে বলে মনে হয় না। দুজনেই ছেলে। একজন অনেক কিছু বলছে, আর একজন গম্ভীর গলায়।

- হ্যাঁ কত দূর?
- আমাদের প্রায় শেষ কাজ। আজকেই স্যার আমরা ওদের বাসায় যাব।
- আজকের মধ্যে কিন্তু কাজটা শেষ করতে হবে।
- অবশ্যই স্যার। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমরা প্রোফেশনাল। কোন চিহ্ন থাকবে না খুন যে করব। পুলিশ কেন, তাদের বাপ এসেও কিছু খুঁজে পাবে না।
- কথা কম বল। পুলিশের বাপকে লাগবে না। পুলিশ না বুঝলেই হল।

টুলু এখন অন্য একটা ফ্রিকোয়েন্সি খুঁজছে। যেখানে পুলিশ কথা বলছে। এইতো পাওয়া গেছে।

- হ্যালো, রামপুরা থানা।
- ও রামপুরা থানা? আমি ভাবছিলাম মহাখালী কলেরা হাসপাতাল। আচ্ছা আপনাদের কাছে মহাখালী কলেরা হাসপাতালের নাম্বার আছে?

হ্যাঁ এখানেই কাজ হবে। শুধু একটু ওলট পালট করে দেয়া। গম্ভীর লোকটার সাথে কথা বলিয়ে দিতে হবে, কলেরা হাসপাতাল খোঁজা মানুষটার। আর পুলিশের সাথে প্রোফেশনাল খুনিটার।

- আপনারা কি? একটা কলেরা হাসপাতালের নাম্বার জানেন না।
- কিসের কলেরা হাসপাতাল?
- কলেরা চিনেন না? কলেরা। ডাইরিয়ার উপরের টা।
- তুমি এসব এলোমেলো কথা বলছ কেন? খুন খুব সাবধানে করবে।
- কি বললেন? খুন? কলেরা হইছে বলে মরে যাবে? ফোন নাম্বার দিবেন না ভাল । তাই আপনি এভাবে বদ দোয়া করবেন।

এটা লাইন লাগাতে পারলেও খুনিটার সাথে লাগাতে পারছে না টিলু। এটা খুব সাবধানে করতে হবে। পুলিশটা বিরক্ত হয়ে ফোন রাখার আগেই। পুলিশ যখন চুপ থাকবে তখন। যাহ্‌ হয়ে গেছে।

- স্যার। ঠিকানা এটাই তো? ধানমন্ডি ১২ এ, বাসা নং ৩৮, সাংবাদিক রেজা তালুকদার। একেই তো খুন করতে হবে? আপনি নিশ্চিত থাকুন। আজ রাতেই কাজ হয়ে যাবে। পুলিশ কিছুই টের পাবেনা। আপনি টাকাটা ঠিক রাইখেন। টাকা নিয়ে উলটপালট কিছু করলে কিন্তু সমস্যা হবে।

কথা গুলো শুনে একটু নড়ে চড়ে বসলেন, রামপুরা থানার কানে ফোন ধরে রাখা পুলিশটা। চুপ করে শুনলেন। কিছুই বললেন না। ঠিকানাটা টুকে রাখলেন। কোথা থেকে হঠাৎ করে কল আসল মোবাইলে। কি কি বলল। তবুও ব্যাপারটা দেখতে হবে। ধানমন্ডি থানায় ফোন দিয়ে তখনই জানিয়ে দেয়া হল, ডিবি পুলিশ যেন সাংবাদিক রেজা তালুকদারের বাসার দিকে কড়া নজর রাখে।

খুনটা আর হচ্ছে না। এটা ভেবে টুলু খুশি। একটা দিন মাত্র, পৃথিবীতে থাকবে। এর ভিতর কত রকম মানুষ দেখছে। অথচ ওদের স্টেশনে সবাই এক রকম। রেকান যা বলেন তাই চলে সেখানে। সবার কাজ কর্ম অনেক গুছান। একটা হাসপাতাল দেখা যাচ্ছে, এখানে অসুস্থ, বা শরীরে গোলযোগ থাকা মানুষদের ঠিক করা হয়। ঠিক তেমন ওদের স্টেশনে, ওয়ার্ক শপে করা হয় এসব। শরীর খুলে, যন্ত্রপাতি বের করে, আবার তা লাগিয়ে ঠিক করে দেয়। তবে টুলুর কখনও ওয়ার্ক শপে যেতে হয় নি। টুলুর অনেক কিছুই করতে হয় না, যা অন্য রোবটরা ওখানে করে। টুলু ওখানে রেকানের আশেপাশেই থাকে। খুব কম বাসা থেকে বের হয়। রেকানের অনুমতি খুব কমই মিলে। মাঝে মাঝে মনে হয় টুলুর, ওকে একটু আলাদা করে রাখা হচ্ছে। অন্য সবার সাথে ঠিক যাচ্ছে না ওর। ওখানে স্কুলে পড়াশুনা করে মাত্র কয়েকজন। বাকি সবাই স্টেশনের কাজ করে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কিছু একটার সাথে আঘাত খেল টুলু। পায়ের কাছে। ব্যথা করছে। আঘাত খেয়ে কান থেকে ভয়েস কনভার্টরটা খুলে পড়ে গেল। আশেপাশের মানুষদের কথা এখন কিছুই বুঝতে পারছে না টুলু। এই কনভার্টরটার কাজ, যে কোন ভাষা কাঙ্ক্ষিত ভাষায় পরিবর্তন করে নেয়া। এই এলাকার মানুষ গুলোর ভাষা বুঝতে পারে না টুলু। টুলুরা এই ভাষায় কথা বলে না। এই কনভার্টরের কারণেই বুঝতে পারে। একটা লোক পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টুলুর পাশে।

- ভাই কি কিছু খুঁজছেন?

টুলু হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। কি বলছে লোকটা। লোকটার কথা বুঝতে পারছে না। বুঝবার কথাও না। লোকটা একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, শহরে নতুন নাকি? সাথে আছে টাছে কিছু?

টুলু তাও চুপ। বলে না কিছু।
- i can't understand.

লোকটা একটু সরে গিয়ে বলে, এইটা দেখি বিদেশী। ইংলিশ কয়।

টুলুর কাছে এসে বলে, আমার লগে আসেন। এক জায়গায় লইয়া যাইতেছি।
টুলু ইশারায় বুঝতে পারে, লোকটা ওর সাথে যেতে বলছে। কনভার্টর খুঁজে না পেয়ে, লোকটার সাথেই হাঁটতে লাগল।
- বুঝলেন ভাই। এইটা হইল বাংলাদেশ। সেই কবে থেকে শুনি এইটা এমেরিকার মতন হইবে। এমেরিকা আর হয় না। খালি রাস্তা ঘাটে মুত। মুত চিনেন তো?

বলে লোকটা প্যান্টের চেইন ধরে টানাটানি করে কিছু বুঝাবার চেষ্টা করল। টুলু বুঝতে পারে না। লোকটাকে নীরবে অনুসরণ করে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে আসছে চারপাশ। একটু নির্জন জায়গায় গিয়েই লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ল। পকেট থেকে ধাতুর কিছু একটা বের করে টুলুর গলার কাছে ধরল। বলল, যা আছে সাথে দে। নয়ত গলা কাইটা ফালাইয়া দিমু।

টুলু ভাব ভঙ্গিতে বুঝতে পারছে, লোকটা জোর করে টুলুর কাছ থেকে কিছু চাচ্ছে। এমন কিছু পড়েছিল বইয়ে। মানুষ নাকি মানুষকে এভাবে মাঝে মাঝে মেরে ফেলে। টুলুর বড় হাসি পাচ্ছে। টুলুর কিছুই হবে না, এই লোকটা জানে না। টুলু মানুষ না। টুলু অতি উন্নত রোবট। এই ধাতুর আঘাতে ওর কিছুই হবে না। টুলুর হাসি দেখে, লোকটা চমকে উঠল। একটু দূরে সরে সূক্ষ্ম চোখে তাকাল। না ভয় পেলে হবে না। টুলুর দিকে চাকুটা নিয়ে তেড়ে আসল। এখনি বিদায় করে দিবে পৃথিবী থেকে বিদেশীটাকে। চাকুটা টুলুর গলায় কাছাকাছি আসতেই থেমে গেল লোকটা। শরীর হঠাৎ অবশ হয়ে গেছে। চোখ লেগে আসছে। টুলুর সামনে মাটিতে ঢলে পড়ল লোকটা। টুলু আশেপাশে তাকাল। কেউ নেই। এটা কি করে হল? লোকটা হঠাৎ করে এমন মাটিতে পড়ে গেল কেন? লোকটার ঠিক পিছনে কিছু একটা পড়ে আছে। কালো করে। একটু কাছে যেতেই পরিষ্কার। একদম পরিষ্কার। টুলুর কনভার্টরটা। টুলু তুলে নিল কনভার্টর। কানে পরে নিল। লোকটা এখনও অসাড়। ডিটেকশন মিটার বলছে, লোকটা মৃত। কিভাবে মারা গেল, সেটা একটা ভাবনার বিষয়। হয়ত টুলু লোকটার চেয়ে শক্তিধর, তাই আঘাত করার আগেই মরে গেছে। এসব নিয়ে আর এতো ভাবতে চাচ্ছে না। সময় দেখল টুলু, সময় বাকি আর ৬ ঘণ্টা। ছয় ঘণ্টা পর টুলু ER821 হয়ে চলে যাবে। নিজের স্টেশনে।

কতদূর যেতেই টুলু শুনল একটা ছেলে কাঁদছে। কান্না, মানুষের খুব বাজে একটা বদ গুণ। রেকান প্রায়ই বলতেন, আবেগ একটা জিনিস, যেটা শুধু পৃথিবীর মানুষদের আছে। এই জিনিসটা না থাকলে, ওরা এতো দিনে আমাদের চেয়ে অনেক উপরে থাকত। আবেগ আছে বলেই এরা পিছিয়ে পড়ছে। আবেগ আছে বলেই, এরা ক্ষুদ্র জিনিসে কষ্ট পাচ্ছে। কাঁদছে। আর জীবনের অনেকটা ধাপ পিছিয়ে যাচ্ছে।

টুলুর এই বাজে জিনিস দেখবার কোন ইচ্ছা নেই। পাশ কাটিয়ে চলে গেল। পিছন ফিরে আর একবার দেখল কেন যেন। আর একটা ছেলে ঐ ছেলেটার সামনে। এবার ছেলেটার চোখ চিকচিক করছে। হাতে কিছু কাগজ ধরিয়ে দিল। তাই নিয়েই মনে হল ছেলেটা খুশি। কাগজ গুলো কিসের জানতে ইচ্ছা করছে। ডিটেকশন মিটার বলছে এটা money,এই দেশে বলে টাকা। এটার ব্যাপারেও জানে টুলু। এখানে সবকিছু হয় এটার বিনিময়ে। এটা যার যত বেশী সে তত ক্ষমতাবান। যার নেই সে অসহায়। স্টেশনে তেমন কিছু নেই। ওখানে প্রায় সবাইকে এক দৃষ্টিতে দেখা হয়। রেকান সবার সব চাহিদা পূরণ করে দেন। এখানে যে কোন চাহিদা পূরণের জন্য এটা দরকার। এখানে মানুষ গুলোর কোন দাম নেই। তার চেয়েও বেশী এই কাগজগুলোর দাম। টুলু হাঁটতে শুরু করল, ডিটেকশন মিটার দিয়ে ছেলেটার ব্যাপারে জানা যায়। তবে জানতে ইচ্ছা করছে না। টুলু হাঁটতে লাগল, সোজা সামনের দিকে। পিছন থেকে মোবাইল ফোন বেজে ওঠার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ছেলেটার ফোন এসেছে। নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি এবসর্বার দিয়ে ছেলেটার কথা শুনছে , কেন শুনছে জানে না। অপ্রয়োজনীয় কাজ একটা। অপ্রয়োজনীয় কাজ করে মানুষ, টুলু একটা রোবট। টুলুও তাই করছে তবুও। মানুষের পৃথিবীতে এসে মানুষের অনেক কিছু নিজের ভিতর আঁকড়ে ধরছে। এসব ঠিক না। ছেলেটাকে একটা মেয়ে ফোন দিয়েছে।

- ভাইয়া, মায়ের অবস্থা সত্যি খুব খারাপ রে। তুই কখন আসবি?
- আসতেছি আমি।
- টাকা যোগাড় হইছে? মায়ের ওষুধ কিনতে পারছি না। ঘরে টাকা নেই একটাও। ওষুধের দোকান তো বন্ধ হয়ে যাবে।
- হ্যাঁ মাত্র এক বন্ধুর থেকে ধার করলাম। আমি আসছি। কাঁদিস কেন পাগলী তুই? মায়ের কিছু হবে না। তোর ভাই আছে? মায়ের ছেলে আছে না?
- আমার অনেক ভয় করছে। মা একটু পর পর কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। ডাক্তার বলছে, তিনদিন ইঞ্জেকশন দিতে হবে। প্রথমটা ফ্রিতে উনি দিছেন। আজ অন্যটা দিতে হবে। বাসায় আয় ভাইয়া তাড়াতাড়ি।
- এইতো আসছি। আর তুই কাঁদবি না একদম। মা কাঁদতে দেখলে আরও ভেঙে পড়বে। মায়ের পাশে থাক।

মোবাইল রেখে দিল ছেলেটা। রেখে নিজেই কাঁদছে। কি আজব অবস্থা, অন্যকে একটা কাজ করতে মানা করে, নিজেই সেটা করা। ছেলেটা একটা তিন চাকার যানে চরল। এটার নাম রিকশা। টুলুর হঠাৎ করে কেন যেন মন খারাপ হয়ে গেল। খুব খারাপ লক্ষ্মণ। মন খারাপের বীজও টুলুর ভিতর ঢুকে গেছে। ছেলেটা বলল রিকশা চালককে, মামা, কাওরান বাজার।
এই রিকশা চালকের নামও মামা। রিকশা চলতে লাগল। রিকশা কাওরান বাজার যাচ্ছে। এই রিকশার সাথে যেতে ইচ্ছা করছে টুলুর। তবে যেতে পারবে না। টুলুর কাছেও একটা স্লিম রানার আছে। পায়ে পড়লে এটা, পৃথিবীর যে কোন বাহনের চেয়ে দ্রুত যাবে। তবে এটা ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিষেধ আছে রেকানের। এটা ব্যবহার করলে সবাই বুঝে যাবে, টুলু মানুষ নয়। রোবট। তবে ছেলেটার ব্যাপারটা মাথা থেকে তাড়াতে পারছে না টুলু। মাথা থেকে কোন ভাবেই যাচ্ছে না। একবার ভাবল, ব্রেন স্ক্রানার দিয়ে একটু আগের ঘটনাটা মাথা থেকে মুছে ফেলবে। তবে সেটাও সায় দিচ্ছে না, কে যেন। কে যেন কানের কাছে বলছে, না এটা মাথা থেকে তাড়িও না। লেগে থাকো। লেগে থাকো। টুলু লেগে রইল। নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি এবসর্বার দিয়ে ছেলেটার মোবাইলের নেটওয়ার্ক এর সাথে লেগে রইল। কোথায় কোথায় যাচ্ছে সেসব ওখানে উঠছে। যখন গন্তব্যে চলে যাবে তখন হুট করে টুলু সেখানে চলে যাবে। দেখবে কি করে।

টুলু সেখানেই বসে রইল। অন্য কিছু করতে ইচ্ছা করছে না। মাথার ভিতর ঐ ছেলেটার চিন্তা। বার বার নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি এবসর্বারের দিকে তাকাচ্ছে। ছেলেটা এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে থেমে গেল। কাওরান বাজার? না এটা তো কাওরান বাজার না। অনেকটা সময় চলে গেল। ছেলেটার নেটওয়ার্ক ওখান থেকে নড়ছে না। টুলু আর অপেক্ষা করতে পারছে না। দরকার হলে টুলু গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবে। তাও এভাবে থেমে থাকা যাবে না। একটা মানুষ মারা যাচ্ছে, আর ছেলেটা ওখানে থেমে আছে। টুলু স্লিম রানারটা বের করল। রাস্তা দিয়ে যাওয়া সমস্যা। গিজিগিজি বাড়িঘর। এর চেয়ে ফ্লো অপশন চালু করে উড়ে যাওয়া ভাল। সাই করে ছেলেটার নেটওয়ার্ক এর জায়গায় চলে গেল। একি এতো নির্জন জায়গা। ছেলেটা যে রিকশায় বসে ছিল সেটা নেই আশেপাশে। ছেলেটাকেও দেখা যাচ্ছে না। একটা আলো জ্বালল টুলু। ছেলেটা এই তো। মাটিতে শুয়ে আছে। শরীরে লাল লাল কি সব। ডিটেকশন মিটার বলছে ছেলেটা মৃত। কি করে সম্ভব? মোবাইলটা ছেলেটার কাছে না। আশেপাশে কারও কাছে। ঐ তো দেয়ালের ওপাশে কয়েকটা ছেলে। ওদের কাছেই মোবাইলটা। নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি এবসর্বার তাই বলছে। তার মানে টুলুর সাথে যা করতে চেয়েছিল, চাকু বের করে ঐ লোকটা। এই ছেলেটার সাথেও তাই করেছে, ঐ দেয়ালের পাশের ছেলেগুলো। ছেলেটাকে মেরে, মোবাইল আর টাকা ছিনিয়ে নিয়ে নিয়েছে। টুলুর শরীর কাঁপছে। কেন কাঁপছে জানে না। পিছনের ব্যাগ থেকে, সাইলেন্ট এটম পুশার বের করল টুলু। এটা ব্যবহারেও নিষেধাজ্ঞা রেকানের, খুব বিপদে না পড়লে। এটার ভিতর সবচেয়ে বিষাক্ত পরমাণু গুলো সেট করা। একটা পুশ করলে টার্গেট করে, তাহলেই শেষ। টুলু সাইলেণ্ট এটম পুশার, পুশ করল। এক এক করে চারজনই মাটিতে পড়ে গেল মুহূর্তে। মোবাইলটা নিল, টুলু। নিয়ে নিল খুঁজে টাকা গুলো। এখন টাকা গুলো দিয়ে আসতে হবে ছেলেটার মায়ের কাছে। ছেলেটার মা সুস্থ হবে। আর একটা অপ্রয়োজনীয় কাজ করার জন্য উঠে পড়ে লাগল টুলু। কিন্তু টুলু কাওরান বাজার চিনে না। কোনদিক দিয়ে যেতে হয় তাও জানে না। সাথে এমন কোন যন্ত্রও নেই যেটা ধরে যেতে পারে। বসে বসে উপায় খুঁজতে খুঁজতেই, টুলুর সামনে এসে দুজন দাঁড়াল। ঠিক ভাবে চেনা যাচ্ছে না। অন্ধকারে। আলো ধরতেই দেখা গেল, TY567 আর TY587, দুজন রোবট। নিশ্চয় রেকান এদের পাঠিয়েছে টুলুকে সাহায্য করতে। কাওরান বাজার খুঁজে বের করতে। টুলু ওদের দিকে হাসি মুখে এগিয়ে যেতেই এরা গম্ভীর গলায় একসাথে বলল, রেকান আমাদের পাঠিয়েছেন। আপনাকে স্টেশনে ফেরত নিয়ে যেতে। আপনার এখন আমাদের সাথে যেতে হবে।
- অসম্ভব। এখনও সাড়ে চার ঘণ্টা বাকি। রেকান এটা বলতে পারেন না।
- আমাদের যেটা বলা হয়েছে, আমরা সেটাই করছি। আমরা প্রথম থেকেই আপনার পাশে ছিলাম। ইনভিসিবল রে এর ভিতর। আপনি যখন বিপদে পড়েছিলেন, রেকানের নির্দেশে আপনার শত্রুকে আমরাই মেরেছিলাম। তবে তখন ইনভিসবল রে থেকে বের হবার নির্দেশ ছিল না। এখন রেকনের নির্দেশ, আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে। আপনি আমাদের সাথে ইনভিসিবল রে এর ভিতর আসুন।

টুলু বুঝতে পারল, সেই সময়টায় যখন লোকটা চাকু হাতে নিয়ে টুলুকে আঘাত করতে আসছিল এরাই তাকে মেরেছে। এরা প্রথম থেকেই আশেপাশে। অদৃশ্যমান রশ্মির ভেতর থাকাতে টুলু এদের অস্তিত্ব বুঝতে পারে নি। রেকান টুলু কে একা ছাড়েন নি পৃথিবীতে। সাথে করে দুজনকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু টুলু এখন যাবে না। টুলু টাকাটা সেই মায়ের কাছে দিয়ে তারপরই যাবে।
- আমার কিছু কাজ বাকি আছে। একটু সেরে তোমাদের সাথে যাচ্ছি।
- রেকানের আদেশ আমরা অমান্য করতে পারি না। আপনি এখন আমাদের সাথে যাবেন।
- অসম্ভব।

TY567 আর TY587 ইনভিসিবল রে এর মধ্যে টুলুকে নেবার আগেই টুলু নিজের স্লিম রানারের ফ্লো অপশন চালু করে ছুটতে লাগল এলোমেলো। পিছনে পিছনে ধরার জন্য TY567 আর TY587. টুলু এলোমেলো ছুটছে, আর বারবার খেয়াল করছে কোথাও কাওরান বাজার লেখা আছে কিনা। কাওরান বাজার লেখা থাকলেও ছেলেটার মা কে খুঁজে পাওয়া কষ্ট সাধ্য। কিভাবে পাবে? টুলু যে চিনে না তাদের কাউকে। একটা রোবট হয়ে মানুষের জন্য মায়া, সত্যি অবাক করা। মাথার ভিতর সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এসব ভাবছে একদিকে, অন্য দিকে নিজেকে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে, পালিয়ে বেড়াচ্ছে TY567 আর TY587 এর থেকে। এরা ছুটেই চলছে, টুলুর পিছনে। টুলু কিছু ভাবতে পারছে না। মানুষটাকে বাঁচাতে হবে যেভাবে হোক। কিন্তু পথ নেই। সব পথ বন্ধ। হঠাৎ করেই হাতের মোবাইলটা বেজে উঠল। আলো ঝলমলে স্ক্রিনে ভাসছে, একটা নাম্বার। টুলু কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কান্না জড়ানো গলা, ভাইয়া তুই আসবি না? সত্যি কথা বল? টাকাটা যোগাড় করতে পারিস নাই, তাই না? মায়ের অবস্থা আরও খারাপ। ওষুধ লাগবে না। তুই আয়, মা এর শেষ সময়ে পাশে থাক। ভাইয়া কথা বল।

মেয়েটা কেঁদে যাচ্ছে। কান্না শুনে টুলুর ভিতর কি যেন হয়ে গেল। বুকের বাম পাশে চিনচিনে একটা ব্যথা হচ্ছে। মনে হচ্ছে ভিতর থেকে কোন তার ছিঁড়ে যাচ্ছে। কিছুই করতে পারছে না টুলু। মেয়েটা ভাইয়ের আশায়, মা ছেলের আশায় বসে আসে। তবে সবই মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে। টুলু কান থেকে মোবাইলটা রাখতে যাবে, তখনই মাথার ভিতর কি যেন খেলে গেল। নিজের নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি এবসর্বার একবার দেখল। এটাই দরকার। নিজের কানে মোবাইল রেখে, বলল, আমি আসছি।
নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি এবসর্বার দিয়ে, ফ্রিকোয়েন্সিতে ঢুকল, নিজের হাতের মোবাইল আর ওপাশের মোবাইলের নেটওয়ার্ক এর। এইতো নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি এবসর্বারে লোকেশন দেখাচ্ছে। টুলু অতি দ্রুত, স্লিম রানার চালিয়ে চলে গেল, কাওরান বাজার ঐ জায়গায়। যেখানে মোবাইল দিয়ে টুলুর সাথে কথা বলা হচ্ছে। যেখানে একটা বোন ভাইয়ের অপেক্ষা করছে। যেখানে একটা মা ছেলের। যেখানে একটা জীবন মরণের কাছাকাছি কিছু কাগজের জন্য। টুলু চলে এসেছে। একটা ভাঙা বাড়িতে এরা থাকে। রাস্তার পাশে জীর্ণশীর্ণ। আশেপাশে অনেক বিল্ডিং। সেসব অনেক সুন্দর। তবে এটা তেমন না। টুলু নেটওয়ার্ক সোর্স পেয়েছে। দরজায় টোকা দিল টুলু। ভাঙা দরজার ভিতর থেকে শব্দ চলে আসছে ভিতরে কি বলছে। একটা মেয়ে বলছে, মা ভাইয়া আসছে। টাকা নিয়ে আসছে। ওষুধ কেনা হবে। তুমি সুস্থ হবে।
মেয়েটা দৌড়ে চলে আসল দরজা খুলতে। টুলুর অনেক ভাল লাগছে। টাকাটা হাতে। মেয়েটাকে টাকা দিয়ে ওষুধ কিনতে বলবে। তার আগে একটু দেখা যায়, মায়ের কি অসুখ। দরজার ফোঁকর দিয়ে ডিটেকশন মিটারের আলো ফেলল, বিছানায় শুয়ে থাকা মহিলার উপর। সব এসেছে তথ্য। নাম জানা নেই। রোগের কোন বর্ণনা নেই। তবে সবসময় unknown আসা একটা অপশনে, কিছু লেখা দেখা যাচ্ছে। টুলু অবাক হয়ে লেখা গুলো পড়ছে। সেখানে লেখা,
Relation- mother( according to DNA)
টুলু একটু সময় নিল ব্যাপারটা বুঝতে পারার। mother বা মা এর ব্যাপারে ডিকশনারিতে লেখা ছিল, যার দ্বারা জন্ম হয়েছে। তার মানে......

মেয়েটা হাসি মুখে দরজা খুলেই একটু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। হাসি মুখ হঠাৎ মলিন হয়ে গেল। টুলু টাকাটা বাড়িয়ে দিল মেয়েটার দিকে। মেয়েটা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে এখনও। টুলুর দিকে তাকাচ্ছে না। মেয়েটাকে ডাকল টুলু, এই যে মেয়ে, টাকা নাও।
মেয়েটা তাও তাকাল না টুলুর দিকে। কি ব্যাপার? মেয়েটা অন্ধ নাকি? অন্ধ হলেও কথা তো শুনবে। তাও শুনছে না। টুলু হঠাৎ পাশে কারও অস্তিত্ব অনুভব করল। দুই পাশে TY567 আর TY587. ওরা বলে যাচ্ছে, আপনি এখন ইনভিসবল রে এর ভিতর আছেন। আমরা এখন স্টেশনের দিকে রওয়ানা দিচ্ছি।

টুলু বুঝতে পারল, কেন মেয়েটা এতক্ষণ টুলুকে দেখেনি। টুলু দুজনকে বলছে, আমি টাকাটা দিয়েই চলে আসছি। আমাকে যেতে দাও।
- আমরা দুঃখিত। রেকান আমাদের বার বার মেসেজ পাঠাচ্ছেন, আপনাকে এই মুহূর্তে নিয়ে যাবার জন্য।

টুলুর কষ্ট হচ্ছে। টুলুর টাকাটা ছুড়ে দিয়ে বলছে, এই মেয়ে টাকা নাও। মা কে বাঁচাও।
কিন্তু টাকাগুলো ইনভিসিবল রে এর গণ্ডি পেরুচ্ছে না। টুলুকে দু পাশ দিয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, TY567 আর TY587. মেয়েটার থেকে অনেক দূরে, ঐ মায়ের থেকে অনেক দূরে। মেয়েটা দরজার ধারে বসে বিষণ্ণ হয়ে পথের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। বিছানায় শুয়ে থাকা মহিলাটা কাঁদছেন। টুলু টাকা গুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে যাচ্ছে না। টুলুর মনে হচ্ছে বুকের বাম পাশের তার গুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে। খুব ব্যথা হচ্ছে। খুব কষ্ট। চোখটা হঠাৎ ভেজা ভেজা লাগছে। টুলু কাঁদছে। কি আশ্চর্য, টুলু কাঁদছে। টুলু কেন কাঁদবে? টুলু হল রোবট। কান্না মানুষের বদ গুণ। কান্না মানুষের বাজে আবেগ। টুলু কেঁদে যাচ্ছে। কিছু হারিয়ে কাঁদছে, অসহায় হয়ে কাঁদছে। টাকার জন্য ধুঁকতে থাকা মহিলাটা দেখে কাঁদছে। তার মানে কি? টুলু মানুষ? আবেগ গুলো মানুষের থাকে, আর কারও থাকে না। তাহলে টুলুর আবেগ আসবে কেন? টুলু মানুষ। টুলু হাসতে জানে, ভাল লাগাতে জানে, ঐ মেয়েটা, ঐ মা কে ভালবাসতে জানে। টুলু কষ্টে কাঁদতে জানে। টুলু রোবট না। টুলু ER821 না। টুলু শুধুই টুলু। আর এই টুলুর মা ঐ মহিলাটা। অসুস্থ মহিলাটা। উনি মা। টুলুর মা। টুলুকে যে কোন ভাবে হোক, রেকান নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। রেকান নিজেও মানুষ। তাই সব বুঝতে পারে, বুদ্ধি খাটিয়ে এতো গুলো রোবটকে বশ মানাতে পারে। রেকান এতো দিন টুলুকে রোবট বানিয়ে রেখেছে, টুলু রোবট না। টুলুর শরীর তুলতুলে, পাশের দুই জনের শক্ত। টুলুর জীবন আছে, মৃত্যু আছে। টুলুর মা আছে, বাবা আছে, ভাই আছে, বোন আছে। টুলুর মা কে বাঁচাতে হবে। টুলু প্রাণ পণ চেষ্টা করছে, এই দুইজনের হাত থেকে বাঁচার। বার বার বলছে কেউ একজন তুমি পারবে, ঠিক পারবে। টুলু ধস্তাধস্তির মধ্যে সাইলেন্ট এটম পুশার বের করল। দুইজনকে দুইটা পুশ করে, কার্যকারিতা নষ্ট করে দিল দুজনের। এবার নামছে, অনেক দ্রুত নামছে, মায়ের কাছে যাবার জন্য, বোনের কাছে যাবার জন্য। মা কে বাঁচাতে হবে। বোনকে হাসি খুশি রাখতে হবে। পিছন ফিরে দেখল, অনেক রোবট পাঠিয়েছে রেকান, টুলুকে নেবার জন্য। তবুও টুলুর মাকে বাঁচাতে হবে। নিজের শেষ নিঃশ্বাসের বিনিময়ে হলেও। টুলু মানুষ। ওদের থেকে অনেক বুদ্ধিমান। অনেক উপরের। শুধু এই আবেগ জিনিসটার জন্য। আবেগ একটা শক্তি। এটা অন্য কারও নেই। টুলু কাঁদতে কাঁদতেই বোনের কান্না মুছতে যাচ্ছে, আর মায়ের জীবন বাঁচাতে। হাতে কিছু কাগজ নিয়ে। আর পিছনে ছুটে আসা কিছু, রোবট। টুলু কাঁদতে থাকা বলতে বলছে, কাঁদিস কেন পাগলী তুই? মায়ের কিছু হবে না। তোর ভাই আছে। মায়ের ছেলে আছে না?
টুলু একবার চিৎকার করে ডাকল, মা।
এই ডাকে অনেক শক্তি। এই ডাকে অনেক আবেগ।

মানুষ গুলোর আবেগ সস্তা জিনিস। হাসি সস্তা জিনিস, কান্না সস্তা জিনিস। তবুও এই গুণ গুলো বা বদ গুণগুলো প্রকাশ পায় ই। যতই আবেগহীন জীবন কাটাক, যতই রোবট হয়ে থাকতে চাক। এক সময় ঠিকই হাসে, ঠিকই কাঁদে, ঠিক প্রিয় মানুষকে ভালবাসে। সাময়িক আবেগ ধমিয়ে রাখার, ব্যর্থ চেষ্টায় মানুষ গুলো পরাজিত। আর পরাজিত হয়েই, ভাললাগা পায়, ভালবাসা পায়, কান্না পায়, প্রিয় জনের হাসি মুখ পায়। সব গুলো আবেগ ঘিরেই।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ওয়াহিদ মামুন লাভলু টুলুর অনুভুতিগুলো দারুনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। খুব ভাল লাগল। শ্রদ্ধা জানবেন।
ভালো লাগেনি ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪
অনেক ধন্যবাদ :)
ভালো লাগেনি ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪
সহিদুল হক golpoti jothartho kolpokahini hoyeche, khub valo laga aar suvo kamona janai,amar kobitay amontron
ভালো লাগেনি ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪
ধন্যবাদ। ভালো লাগলো শুনে। অবশ্যই পড়ে আসব।
ভালো লাগেনি ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪
শামীম খান বাহ , বেশ খাসা । টুলুর জন্য শুভেচ্ছা । ভাল থাকবেন ।
ভালো লাগেনি ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪
ধন্যবাদ, আপনিও ভালো থাকবেন।
ভালো লাগেনি ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

১৪ এপ্রিল - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ১০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী