অমীমাংসিত

অন্ধকার (জুন ২০১৩)

নাসরীন
  • ২৬
আজকাল ভোর থাকতে ঘুম ভাঙ্গে মনীশা র। আলো ফোটেনি ভাল মত, আবছা আঁধার , বাইরে দৃষ্টি চলে না।
মধুর আলস্য গা জুড়ে । শীত আসার এই আগ সময় টায় টুপটাপ শিশির পরে, মনিপুরি চাদর টা দিয়ে পা পর্যন্ত
মুড়ে বাইরে পাখি দের অন্তহীন কিচিরমিচির শুনতে বরাবর পছন্দ করে মনীশা। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে মতির মার
ঘুম ভাংলে এক কাপ চা ও জুটে কখনো কখনো।

শুয়ে শুয়ে কত কথা মনে আসে। সুখের কথা, দুঃখের কথা। অতীতের কথা।ভবিষ্যতের ভাবনা। ভাবনার
কোনও মা বাপ নাই। লতা পাতা বেয়ে কত চিন্তা। কোথা থেকে শুরু হয়ে কোথায় চলে যায়। আচ্ছা, মনের
লাগাম টানার কোন উপায় নেই কেন ? কেন যা ভাবতে চাই না তাই ঘুরেফিরে মনে আসে ? মস্তিষ্কের কোন
ইরেজ সিস্টেম নাই ?

অনাহূত ভাবনার বেশিরভাগ জুরে থাকে শাতিল। কেন যে বারবার এই একটা নামকে, একটা কষ্ট কে ,একটা অভিমান কে
হতচ্ছারা মন টা আমন্ত্রন করে আনে কে জানে।

যেখানে একবিন্দু ভালবাসা নেই, একফোঁটা ছাড় দেয়ার মানসিকতা নেই......আছে কেবল অনর্থক জেদ আর
অর্থ হীন দম্ভ......অকারন ভুল বুঝাবুঝি যেখানে অনড় প্রাচীর গড়ে তুলছে তিল তিল করে...কেন তবু আজ ও
পোড়া চোখে জল আসে ?

মায়ের কাছে এসেছে আজ প্রায় অনেকদিন। প্রথম প্রথম ফোনে কথা হত...একেবারে নিরেট নীরবতার চাইতে
ঝগড়া হত তা ও ভাল। এখন তা ও বন্ধ।

মনীশা একটা ব্যাপার বোঝে না, এই মানুষ টা কেই পাবার জন্য এমন ব্যগ্র ব্যকুলতা আর সমস্ত পৃথিবীর
বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস তার এসেছিল কি ভাবে ? সে কি শুধু ভালবাসা ? তাই যদি হবে আজ সে ভালবাসা
কোথায় মরে পরে আছে ? কেন বিয়ের আগে যে ব্যাপার টা মাথায় ই আসে নি আজ সেই সামান্য কারন টাই
দিন এর পর দিন দুজনের মাঝে ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তুলছে নিপুনভাবে ?

এটা কি শাতিল এর Inferiority থেকে হচ্ছে ?

হ্যা, বড় আপা বলতেই পারে। বলতেই পারে যে দুজন কে হানিমুন প্যাকেজ Arrange করে দিচ্ছি। নেপাল
ঘুরে এস। বিয়ের পর ত সত্যি ই কোথাও যাওয়া হয় নি। যাবে কি...প্রথম দু বছর ত শাতিল এর বাসা ভাড়া
করার ই জোগাড় ছিল না। মেসে ত র বউ নিয়ে উঠা যায় না। দু পাটি জুতোর সুখতলি খুইয়ে চাকরি একটা হল ঠিক
......বাসা ও নেয়া গেল একটা...হোক না এঁদো গলির ভিতর কম আলো বাতাসের তিন রুমের ঘর...।নাই হল
টাইলস মোজাইক......না থাকুক এসি ওয়াসিং মেশিন মাইক্রোওয়েভ মারুতি সুজুকি...।তবু এই বাসা নিয়ে
মনীশা র মাত্রাহীন উচ্ছ্বাস দেখে কাজিন রা মুখ টিপে হেসেছিল। খালা মনি ত মুখের উপর বলেই দিল-
"যেই না বাসা...তার আবার কি নাম, নীল কুঞ্জ। যে চিপা গলি গাড়ি ত দুরের কথা, দুটো মানুষ গা বাঁচিয়ে চলতে পারে না
কি রে মনীশা ...প্রান গেলে ও ত এক বার তোকে দেখতে যাওয়া হবে না...এই না তোর বর এর আক্কেল পছন্দ"

তবু নিজেদের, একান্ত তার আর শাতিল এর একটা ছোট নীড় , এতোটুকু বাসা...কম কি ...আজ যে যাই বলুক মনীশা
কিছুতেই রাগ করবে না, চোখ পাকাবে না, অবলীলায় সবাইকে ক্ষমা করে অসীম ঔদার্যে......খালা মনি র
পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিতে ও মানে বাঁধে না।

যার জন্য এতো লজ্জা ত্যাগ, এতো ছোট হওয়া, এতো সম্মানহানি আজ সে আসে তাকে লজ্জা র সবক দিতে,
আত্মসম্মানের ব্যাকরন পরাতে আসে স্বামী হওয়ার ক্ষমতাবলে।

মনীশা বুঝতে পারে শাতিল এর অকারন ক্ষোভের মুল কারন, অক্ষমতার অদৃশ্য আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে আছে
যে বুক......তাতে সহানুভুতির পরশ দিতে কতো ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতে হত তাকে। কতো ইচ্ছের গলা নিজ
হাতে টিপে ধরেছে, কতো প্রলোভন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে আলগোছে, কত নিমন্ত্রন, আয়োজন,
প্রয়োজন উপেক্ষা করেছে ভালবাসার অসীম সাহসে......



নিজে কেও সময় সময় বুঝতে পারে না মনীশা। বোধ হয় দিন এর পর দিন নিজেকে গুটিয়ে রাখতে রাখতে মন টা অগোচরে
বিদ্রোহী হয়ে উঠছিল, পুঞ্জীভুত ক্ষোভ দানা বেঁধে যাচ্ছিল অজান্তে। অসম্ভব কিছু ত না। এটাই তো হওয়ার কথা।
যে সুখবিলাস আজন্ম তাকে ঘিরে রেখেছে তাকে তো মুহূর্তের উন্মাদনায় চাইলেই ছুড়ে ফেলা যায় না
চাইলেই তো সাতাশ বছরের অভ্যস্ত জীবন টাকে রাতারাতি ভালবাসার নিরেট খোলসে নিপুন করে মুড়িয়ে দেয়া যায় না
একটু ফাঁক থেকেই যায়। সেই ফাঁক দিয়ে সরীসৃপ এর মত নিঃশব্দে ঢুকে পরে অপ্রেম, কলহ, জেদ, তিক্ততা র অন্ধকার।

মাঝে মাঝে মনে হয় সেদিন অতটা লোভী না হলে ও পারত মনীশা। এম্নিতেই মায়ের দেয়া নিতান্ত প্রয়োজনীয়
সাংসারিক জিনিসগুলো নিয়ে শাতিল এর বায়নাক্কার শেষ নেই, কথায় কথায় বলে " ওঃ তাইত...... সংসারের সবটুকুই
তো তোমার, জানলার পরদা থেকে কিচেনের বটিটা পর্যন্ত........আমি ত আছি চেয়ার টেবিল গুলোর মত।
ত আমাকেই বা আর ধরে রেখে কষ্ট দেয়া কেন। তুমি ও যেখানে সুখে নেই, আরামে নেই।"

প্রথম প্রথম অনেক বুঝিয়েছে মনীশা, নিজেকেও, শাতিল কেও" আমি কি কখন বলেছি আমি সুখে নেই, কষ্টে
মরে যাচ্ছি। কখনো তমার সাধ্যাতীত কিছু চেয়েছি ? কেন তুমি এসব বলে নিজে কষ্ট পাও, আমাকে ও কষ্ট দাও ? কি লাভ হয় এতে ?"


আজ মনে হয় জীবন কে নিয়ে একরকম জুয়া খেলেছে মনীশা। নইলে বাবা মা আত্মীয় পরিজন বন্ধু বান্ধব
সবাইকে হাসিয়ে কাঁদিয়ে অন্ধের মত অবিবেচকের মত অসম বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। এখনো
মনে আছে মাকে যখন জানালো মনীশা সে শাতিল কে কাজী অফিসে বিয়ে করেছে কাউকে না জানিয়ে----
মা বোকার মত, ব্রজাহতের মত, অবুঝের মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল অনিমেষ, চোখে পাগলাটে দৃষ্টি,
পারলে দৃষ্টির ছুরি তে কুটিকুটি করে ফেলে। শাতিল বাসায় এসেছে কয়েকবার, মা চেনে। এমন একটা ছেলে
কে মনীশা ............কি আছে এই ছেলের, পড়াশোনা শেষ করেছে মাত্র, চাকরি নেই, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা নেই, মাথা গোঁজার
একটুকরো ছাদ নেই.........দুম করে বিয়ে করে ফেলল.........বউ কে খাওয়াবে কি । নিজের মেয়ে টা ও কম যায় না। পেটের
মেয়ে ত, নাড়ী নক্ষত্র চেনা আছে। রোকেয়া বেগম খুব বেশি কিছু বলেন নি মেয়ে কে, যা করার বাপ আসুক, তারপর।

কামাল উদ্দিন সাহেব হিসেবী লোক, দুনিয়ার হালচাল বোঝেন ভাল। বোকার মত মেয়ে-জামাই কে হুমকি ধামকি কিছুই দেন নি
, উলটো সম্মানজনক একটা কিছু, সে চাকরি হোক বা ব্যবসা, করে দিতে চেয়েছিলেন মেয়ের সুখের জন্য। মেয়ে একবার তাকে
ডুবিয়েছে , জামাই টা কে দাঁড় করিয়ে দিতে পারলে যদি ইজ্জত কিছু বাঁচে। তা জামাই টা এমনি গোঁয়ার গোবিন্দ মুখের উপর বলে
দিল সে নিজের যোগ্যতায় যতটুকু পারে করবে।

কি করেছে তা ত দেখাই গেল। বিয়ের পর দু বছর বউ টা কে ফেলে রাখল শ্বশুরের ঘাড়ে। চার বছরের মাথায় মুখ দেখাদেখি বন্ধ।
ডিভোরস, কোর্ট, কাছারি, উকিল, মামলা মকদ্দমা.........।

কখন যে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরেছে কানের পাশ দিয়ে, মনীশা টের পায়নি। আজকাল সকালবেলা ঘুম ভাঙ্গে, একা একা এসব কথা মনে করে
চোখ জলে ভরে যায়। শাতিলের কি তার কথা একটু ও মনে পরে না ? সে কি সত্যি ভালবেসেছিল মনীশা কে ? তার ও দিনান্তে নির্জনে একটা বার
মন পোড়ে না মনীশার জন্য ? চোখের কোনে কখনো একবিন্দু অশ্রু কি জমে না ?

মনের জমাট পরিসরে জমে থাকা কালিগোলা অন্ধকার পারে না নতুন দিনের নতুন সূর্য টা কে স্বাগত জানাতে। ছোট এই জীবন টায়
এত জটিলতা এত ক্ষুদ্রতা এত আত্মম্ভরি তা কেন জন্ম নেয়?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এফ, আই , জুয়েল # অনেক সুন্দর ও শিক্ষনীয় একটি গল্প । বাস্তবে ঘটমান ঘটনা প্রবাহের এক অতি সূক্ষ সূক্ষ বিষয়কে অনেক মনোরমভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে । সবকিছু মিলিয়ে অনেক ইঙ্গিতবাহী একটি লেখা । ধন্যবাদ ।।
সূর্য গল্পের কোন চরিত্রের মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ প্রায়শই বিরস হয়ে থাকে, একঘেয়েমী লাগে। এ গল্পে তা লাগে নি। আসলে ভালবাসার সাথে যখন প্যারালাল ভাবে ভাল থাকার ইচ্ছেটা জাগ্রত থাকে তখন ভালবাসার সতীন হয়ে যায় ভাল থাকা। সেটা তিল তিল করে ভালবাসার জায়গাটা দখল করে নেয়। মনীশার বেলায়ও সেটাই হয়েছে। শাতিলের কিছুই ছিল না এটা জেনেইতো মনীশা তাকে আপন করেছিল......... বাকি গল্পতো ঐ ভাল থাকার চেষ্টর ফসল। খুবই পরিণত হাতের দক্ষ বুননে চমৎকার একটা গল্প হয়েছে। অনেক ভালো লাগলো।
তাপসকিরণ রায় কাহিনী অতি সাধারণ--কিন্তু লেখার গুনে তা হয়ে উঠেছে অসাধারণ।চমৎকার লেখার হাত আপনার।
নাইম ইসলাম গল্পে চরিত্রের নাম যাই হোক বিষয়-বিন্যাস ভালোই । আর একটা প্রশ্ন ছিল-এটা গল্প-কবিতায় আপনার প্রথম লেখা, জীবনের ও কি প্রথম? যদি তাই হয় তবে আপনি স্বার্থক! কিছু ফনেটিক অসম্পূর্ণতা ছিল, ছিল প্রতিভার পূর্ণতাও। শুভো কামনা...
মিলন বনিক কি বলব বুজতে পারছি না ....প্রথম গল্পেই বাজি মাত...এত সুন্দর নিরেট বুনন..আর সংসারের খুটি নাটি বিষয়গুলো চমত্কার ভাবে ফুটে উঠেছে...শুধু বাক্যগুলোর শ্রীবৃদ্ধির জন্য আর একট যত্ন নিতে হবে...সম্ভবত মনীশা (মনীষা) হবে আর শাতিল কি শাকিল হবে ? খুব খুব ভালো লাগলো...নিয়মিত থাকবেন আশা করছি....শুভ কামনা....
ধন্যবাদ দাদা......অনেকদিন পর লিখলাম ত, তাই একটু এদিক সেদিক হল...নিয়মিত থাকার চেষ্টা করব।
Lutful Bari Panna আপনার বর্ণনাভঙ্গী মনোরম। একটা মেয়ের মনের ভেতরে লুকানো কিছু দুঃখবোধ এত নিপূণ দক্ষতায় তুলে এনেছেন। খুবই ভাল লাগল, খু-উ-ব।
আপনার যত টা ভালো লেগেছে আমার নিজের ও বোধয় এত টা লাগে নি। হা হা হা............
নিজের মুখ কী আর আয়না ছাড়া দেখা যায়..। যা দেখা যায় সেটাও একটা উল্টা প্রতিবিম্ব.. :) আসলে নিজের সহজাত গুণগুলো কখনো মানুষের চোখে পড়ে না।
অদিতি ভট্টাচার্য্য বিচ্ছেদের করুণ কাহিনী। ভালোই হয়েছে। মনীষা হবে, তাই না?
আপনার শেষ কথা টা বুঝলাম না দিদি

০৫ মার্চ - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪