‘তোমার ছেলেকে সামলাও বলে দিচ্ছি হারাধন। বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। শুধু যে গ্রামের ছেলেপুলেগুলোকে খেপাচ্ছে তা নয় ভিন গাঁয়ের কতগুলো ছেলে জুটিয়ে বিজ্ঞান মঞ্চ না কি তৈরী করে যত সব আজেবাজে কথা প্রচার করে বেড়াচ্ছে। বাপ ঠাকুর্দা তো গয়লা, পড়াশোনা করে নিজেকে কি না কি ভাবছে। শোনো হারাধন তুমি যদি ছেলেকে বোঝাতে না পারো তাহলে বাধ্য হয়ে আমাকেই বোঝাতে হবে, বুঝেছ? এসব ছেলেদের বাগে আনার কায়দা আমার জানা আছে। এই শেষবার বললাম, এরপর আর তোমাকে কিছু বলব না, যা করার করব, বুঝেছ?’ প্রায় হুমকির সুরে কথাগুলো বলে হনহন করে হাঁটা লাগালেন কমলাকান্ত হালদার।
পেছন পেছন দৌড়ল হারাধন, ‘ও বাবু শোনেন, বাবু শোনেন, আমার কথাটা শোনেন। প্রদীপকে আমি বোঝাই বাবু, রোজই বোঝাই। কিন্তু বোঝেন তো এখনকার জোয়ান ছেলে, পড়ালেখা জানা ছেলে, বাপের কথা মানে না।’
কিন্তু কমলাকান্ত এসব কথায় কর্ণপাত না করেই চলে গেলেন। কদমগাছি গ্রামের সবচেয়ে বড়ো মুরুব্বি। তাঁর বাবারও প্রবল প্রতাপ ছিল। তাঁর অবর্তমানে কমলাকান্তই কদমগাছির হর্তা কর্তা বিধাতা। তাঁর কথার ওপর কথা বলা বা তাঁর আদেশ অমান্য করার কথা এখানকার কেউ ভাবতেই পারে না। কিন্তু সম্প্রতি একজন সেই সাহস দেখাচ্ছে। বড়ো বেশী দেখাচ্ছে। হঠাৎ করে যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে ছেলেটা। তাও যদি কোনো উঁচু বংশের ছেলে হত। তাও নয়, ওই হারাধন গোয়ালার ছেলে। চোদ্দ পুরুষ ধরে যারা দুধ দুইয়ে আর বিক্রি করে এসেছে। তার ছেলের কিনা এত স্পর্ধা!
এর জন্যে হারাধন আর তার বউই দায়ী। তিন মেয়ের পর এই ছেলে, আহ্লাদে একেবারে অস্থির। ছেলেকে নিয়ে কি করবে ভেবে পায় না।
প্রাইমারী স্কুল শেষ করে যখন হাই স্কুলে ভর্তি হল তখনই কমলাকান্ত হারাধনকে ডেকে বলেছিলেন, ‘ওরে ব্যাটা ছেলেও তো তোর দুধই বিক্রি করবে, জজ ম্যাজিস্ট্রেট তো আর হবে না। হাই স্কুলে কি করতে ভর্তি করেছিস?’
হারাধন কাঁচুমাচু হয়ে জবাব দিয়েছিল, ‘আজ্ঞে বাবু ছেলেটার বড়ো পড়ার ইচ্ছে, তাই’
এই পড়ার ইচ্ছেই কাল হল। ছেলে হাই স্কুল শেষ করেই সন্তুষ্ট রইলেন না, শহরে গেলেন কলেজে পড়তে। তারপর পাশটাশ করে পাশের গ্রামের স্কুলে পড়াতে শুরু করলেন। গোয়ালার পো হলেন মাস্টার! এই পর্যন্তও মানতে রাজী ছিলেন কমলাকান্ত, মন থেকে না হলেও। কিন্তু এরপরই বাড়াবাড়ির শুরু। কতগুলো ছেলে জুটিয়ে তিনি বিজ্ঞান মঞ্চ খুললেন, কি না গ্রামের মানুষের মন থেকে কুসংস্কার দূর করবেন। পুজো আচ্চা, লোকাচার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সবই এদের কাছে কুসংস্কার। এ হেন কুলাঙ্গার ছেলের নাম হল প্রদীপ!
এত দিন শুধু প্রচার চলছিল কিন্তু কদিন আগে যা করল তা একেবারে সাংঘাতিক।
তাঁতীপাড়ার সুবলের ছেলেকে সাপে কামড়াল। সুবলরা ছেলে তারককে মায়ের থানে এনে শুইয়ে দিল, লক্ষ্মণ ওঝাকে আনতে লোকও গেল। আশেপাশে দশটা গ্রামে লক্ষ্মণের নামডাক। লোকে বলে লক্ষ্মণ ওঝার নাম শুনলেই বিষ আদ্ধেক নেমে যায়, ভূত প্রেত পালায়। যদি লক্ষ্মণ কিছু করতে না পারে তাহলে বুঝতে হবে বিধাতা তাকে আর পৃথিবীতে রাখতে চান না। সেদিন একটা যেন কিসের ছুটি ছিল। কোত্থেকে খবর পেয়ে প্রদীপ তার দলবল নিয়ে এসে হাজির। ছেলেটাকে একেবারে ছিনিয়ে নিয়ে ভ্যানে তুলে নিয়ে গেল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই তো থ! কয়েক ঘন্টা পরে সুস্থ করে আবার ফিরিয়েও নিয়ে এল। কমলাকান্ত তখন সেখানে উপস্থিত।
মায়ের থান থেকে তারককে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাপ কেন সে করল – এই প্রশ্নের উত্তরে সোজা কমলাকান্তর মুখের ওপর প্রদীপ বলল, ‘পাপ কেন হবে? আমি কোনো পাপ করি নি। সাপে কামড়ালে তার চিকিৎসার দরকার, আমি তাই করেছি।’
কমলাকান্তর সামনে মাথা তুলে কথা বলা! এত স্পর্ধা! রাগে সারা শরীর রিরি করে উঠল তাঁর।
‘মায়ের থান থেকে ওরকম ভাবে তারককে তুলে নিয়ে গিয়ে তুমি মাকে অপমান করেছ। আর চিকিৎসার ব্যবস্থা? সে তোমার না ভাবলেও চলত। লক্ষ্মণকে খবর দেওয়া হয়েছিল।’
‘আপনি ভুল করছেন,’ প্রদীপ দৃঢ় গলায় বলল, ‘সাপে কামড়ালে চিকিৎসার প্রয়োজন, ওঝা ডেকে ঝাড়ফুঁকের নয়। সেই জন্যেই ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।’
প্রদীপের সাহস দেখে কমলাকান্ত অবাক হলেন, সমানে তাঁর মুখে মুখে তর্ক করে যাচ্ছে!
‘বটে! খুব যে হাসপাতাল দেখাচ্ছ। লক্ষ্মণ আজ এত বছর ধরে ওর ঝাড়ফুঁকের জোরে কত লোককে বাঁচিয়েছে জানো? ক’দিনের তো ছোকরা তুমি, জানো কি? মার থানে শুইয়ে রেখে মার চরণামৃত খাইয়ে কত রোগী ভালো হয়েছে তার খবর রাখো? আজ কোত্থেকে উদয় হয়ে হাসপাতাল দেখাচ্ছো!’
‘ঝাড়ফুঁক, জল পড়া এসব বুজরুকি ছাড়া আর কিছুই নয়। ওঝার ভরসায় ফেলে রেখে, সময় মতো ওষুধ না খাইয়ে মন্দিরে শুইয়ে রেখে কত লোক যে মারা গেছে সেটা তো বলছেন না?’
‘এত বড়ো আস্পর্ধা! ঝাড়ফুঁক, মন্ত্রতন্ত্র বুজরুকি? অত জাগ্রত মা, তাঁর পুজো বুজরুকি?’ কমলাকান্ত চেঁচিয়ে উঠলেন।
‘পুজো বুজরুকি তো বলি নি। কিন্তু ঠাকুর দেবতার নাম করে রোগী নিয়ে ছেলেখেলা করা অবশ্যই বুজরুকি,’ প্রদীপ কিন্তু উত্তেজিত হয় না, তার গলার স্বর আগের মতই শান্ত, ‘কারুর বিশ্বাসে আঘাত করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। পুজো করুন কিন্তু চিকিৎসা না করিয়ে নয়।’
কমলাকান্তকে হতবাক করে রেখে প্রদীপ তার দলবল নিয়ে চলে গেল।
কমলাকান্ত হালদার, পাঁচটা গ্রামের লোক যাকে মানে, সমীহ করে চলে, নানা ব্যাপারে তাঁর পরামর্শ নেয়, সেই তাঁকে কিনা এই দুদিনের ফচকে ছোঁড়াটা একদম উড়িয়ে দিয়ে চলে গেল! নাঃ এর একটা বিহিত করা দরকার। এরকম চলতে দিলে দুদিন বাদে গ্রামের অন্য ছেলেপিলেরাও গোল্লায় যাবে। প্রদীপের বাবা হারাধনের সঙ্গে কথা বলার কারণও এই। যদিও মনে হচ্ছে না লাভ কিছু হবে বলে। যে ছেলে কমলাকান্তর মুখের ওপর কথা বলে সে যে ওই মুখ্যু হারাধনকে পাত্তাই দেবে না তার আর আশ্চর্য কি?
গ্রামের সবার সব কিছুতে নাক গলাচ্ছে এই প্রদীপ। বাচ্ছাদের পড়াশোনা করাতে হবে, স্কুলে ভর্তি করতে করতে হবে, ছেলে মেয়ের মধ্যে তফাৎ করা চলবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন কি নতুন ফরমান জারি করেছে যে মাঝপথে স্কুল ছাড়ানো চলবে না আর স্কুল ছাড়িয়ে কোনো মেয়ের আঠারো বয়েসের আগে বিয়ে দেওয়া যাবে না। দেওয়ার চেষ্টা হলে নাকি সে রুখবে। বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। নেহাত সামনেই কমলাকান্তর বাড়িতে অনুষ্ঠান, এখন গ্রামে কোনো ঝামেলা চাইছেন না, তাই বেশী কিছু বলছেন না। একবার মিটুক সব কিছু তারপর দেখবেন ব্যাটাকে।
কমলাকান্তর ছোটো নাতির পৈতে, সারা গ্রাম নিমন্ত্রিত। অতিথি আপ্যায়নের এলাহি আয়োজন। খাওয়াদাওয়া, আদর আপ্যায়নের বহর দেখে সবাই একেবারে ধন্যি ধন্যি করছে। অনুষ্ঠান সুষ্ঠু ভাবেই মিটল। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন তখনো অনেকেই রয়েছে, কাণ্ডটা তখনই ঘটল। কমলাকান্ত বৈঠকখানায় বসে গল্প করছেন এমন সময় গ্রামেরই একজন, জীবন দৌড়তে দৌড়তে এসে বলল, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে, অনত্থ হয়েছ!’
‘হাঁফাচ্ছিস কেন? কি হয়েছে বলবি তো?’ কমলাকান্ত বললেন।
জীবন আমতা আমতা করে বার দুই ‘প্রদীপ প্রদীপ’ বলে চুপ করা গেল।
যা হয়েছে তা মুখে উচ্চারণ করার সাহস তার নেই।
‘আবার কি করল প্রদীপ? না বড়ো জ্বালাচ্ছে দেখছি ছোঁড়াটা। কি করেছে বল পরিষ্কার করে।’
‘প্রদীপ মল্লিকাকে মল্লিকাকে…….’
কমলাকান্ত এক লাফে আরাম কেদারা থেকে উঠে পড়ে জীবনের কাঁধদুটো ধরে এক ঝাঁকানি দিয়ে বললেন, ‘কি করেছে প্রদীপ মল্লিকাকে?’
আর না বলে উপায় নেই। জীবন কোনো রকমে ‘প্রদীপ মল্লিকাকে শহরে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে,’ বলেই ভয় চোখ বন্ধ করল।
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকেই কমলাকান্ত গর্জে উঠলেন, ‘কি বলছিস সে জ্ঞান আছে? মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলি কি করে এ কথা? জিভ উপড়ে নেব।’
জীবনের আর কথা বলার ক্ষমতাই নেই, সে থরথর করে কাঁপছে। কমলাকান্ত তাকে ছেড়ে দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন। মল্লিকা কমলাকান্তর ভাগ্নী, কমলাকান্তর সবচেয়ে ছোটো বোনের মেয়ে। শহরে থাকে, শহরে থেকে থেকে শহুরেআনার ষোলো আনাই শিখেছে। মেয়ে নিয়ে বোন আর ভগ্নীপতির আদিখ্যেতায় বরাবরই বিরক্ত ছিলেন কমলাকান্ত। মেয়েকে তারা পড়াশোনা শিখিয়ে বড়ো করেছে। শুধু তাই নয় সেই মেয়ে এখন শহরের স্কুলে পড়ায়।
ভেতরে গিয়েই কমলাকান্ত তাঁর বোনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মল্লিকা কোথায়?’
‘মল্লিকা তো স্কুলে গেছে, এখান থেকেই। বলেছে ফিরতে দেরী হতে পারে, কি কাজ আছে।’
কমলাকান্তর কপালে ভাঁজ পড়ল। দলবল নিয়ে সোজা গেলেন হারাধনের বাড়িতে। বাড়ির সামনে ভিড় দেখে বুঝলেন জীবনের কথাই ঠিক। এত বড়ো আস্পর্ধা! বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়ানো! কমলাকান্তকে দেখে জড়ো হওয়া লোকজন সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিল। দরজা খোলাই ছিল। ঢুকে দেখলেন ঘরের ভেতর প্রদীপ আর মল্লিকা। মল্লিকার সিঁথির সিঁদুর সহজেই চোখে পড়ল। দুজনেরই চোখেমুখে খুশীর ছাপ।
কমলাকান্তকে দেখে হারাধন দৌড়ে এসে পাদুটো জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বাবু আমি কিছুই জানতাম না আগে বাবু, মা কালীর দিব্যি বাবু।’
‘বাবা,’ প্রদীপ বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘এত ভয় পাচ্ছ কেন তুমি? মল্লিকা আর আমি দুজন দুজনের পূর্ণ সম্মতিতে বিয়ে করেছি। এতে ভয় পাওয়ার মতো কিছু হয় নি।’
মল্লিকাও কিছু বলতে চাইল কিন্তু কমলাকান্ত হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে একবার সবার ওপর চোখ বুলিয়ে একটা কথাও না বলে চলে গেলেন।
কমলাকান্তর বৈঠকখানায় গ্রামের সব মুরুব্বিদের সভা বসেছে। আস্তে আস্তে জানা গেল সবই। কোনো এক সময় মামার বাড়িতে এসেই প্রদীপের সঙ্গে পরিচয় মল্লিকার। তারপর যা হয়। দুজনেই চাকরী করে। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক দেখা করাটা খুব একটা অসম্ভব ছিল না। তাছাড়া মোবাইল ফোন তো আছেই। ধীরে ধীরে পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা জন্মায় যার পরিণাম আজকের ঘটনা। গ্রামেও নাকি দু একজন আগে প্রদীপ আর মল্লিকাকে কথা বলতে দেখেছ কিন্তু ভয়ে কেউই কমলাকান্তকে জানায় নি।
বৈঠকে প্রায় সবারই মত যে এই বিয়ে কিছুতেই মানা যায় না। সম্ভবই নয় এই বিয়ে, তা সে শহরে গিয়ে যতই সই সাবুদ করে হোক না কেন। কোনো মূল্যেই এক ব্রাক্ষ্মণ মেয়ের সঙ্গে এক গোয়ালার ছেলের বিয়ে কদমগাছি গ্রামের মানুষ মেনে নেবে না।
‘হালদারপুকুরের জল এখনো এত কমে যায় নি যে তাতে দুটো লাশ ডুববে না। আজ রাতেই সব শেষ করে দিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ কখনো এরকম কিছু করতে সাহস না পায়,’ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন কমলাকান্ত।
সবাই সহমত। কিন্তু মুশকিল হল অন্যখানে। মল্লিকার মা বাবা যদিও এই বিয়েতে অত্যন্ত বিরক্ত, অসন্তুষ্ট কিন্তু তাই বলে মল্লিকার কোনো ক্ষতিও তাঁরা কোনো ভাবেই মেনে নিতে নারাজ। তাঁরা প্রদীপ, মল্লিকাকে নিয়ে সেই রাতেই শহরে চলে যাতে চান। শুধু তাই নয় প্রদীপ, মল্লিকার বিয়ের কথা কমলাকান্তরা জানতেন না ঠিকই কিন্তু প্রদীপের দলবল জানত। শুধু কদমগাছি গ্রামের নয়, আশেপাশের গ্রামের প্রচুর ছেলে জড়ো হয়েছে ওদের সুরক্ষার জন্যে। কারণ এরকম অসবর্ণ বিবাহে পরিবারের সম্মান রক্ষার অজুহাতে নব্দম্পতিকে মেরে ফেলার ঘটনা গ্রামেগঞ্জে এমন কিছু বিরল নয়। থানায়ও নাকি খবর দেওয়া হয়েছে গন্ডগোলের আশঙ্কায়। ভেতর বাইরের চাপে আর শুভানুধ্যায়ীদের প্রামর্শে কমলাকান্তকে সে যাত্রা পিছু হটতে হল।
প্রদীপ, মল্লিকার ঠাঁই হল গ্রামে। না, প্রদীপের বাড়িতে নয়। হারাধনের অত সাহস নেই। প্রদীপেরই এক পরিচিতর বাড়ি, যেটা বন্ধই পড়ে থাকে তারা না থাকায়, সেখানেই নতুন সংসার পাতল তারা। মল্লিকার যদিও গ্রামে থাকার ইচ্ছে একেবারেই ছিল না, সে সব সময় ভয় পেত, মাথার ওপর যেন খাঁড়া ঝুলছেই তার মনে হত।
কিন্তু প্রদীপ বলত, ‘না, গ্রাম ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। পালাব কেন ভয়ে? দেখি কি করে ওরা? কত ক্ষমতা ওদের?’
●
দেখতে দেখতে প্রায় বছর দুয়েক কাটল। ইতিমধ্যে গ্রামে প্রদীপের প্রভাব বেড়েছে বলেই যেন মনে হয়। মল্লিকার ভয়ও গেছে। আর কোনো বিপদের আশঙ্কা তারও ছিল না।
সেদিন প্রদীপের শরীরটা ভালো ছিল না, জ্বর জ্বর লাগছিল।
মল্লিকা রাগারাগি করছিল, ‘কি যে করো তুমি। ছুটির দিনেও সারাক্ষণ রোদে জলে ঘুরে বেড়াচ্ছ। দেখো কি হল, জ্বর বাধিয়ে বসলে। কোনো যত্ন নাও না তুমি শরীরের।’
‘বেশ তো, আজ সারাদিন তো বাড়িতেই আছি। করো খুব সেবা যত্ন আমার,’ প্রদীপ হেসে বলল।
‘না সে হবে না। একে তো স্কুলে পরীক্ষা চলছে। যেতেই হবে। তারপরে আমাদের এক কলিগ অসুস্থ। স্কুল ফেরত তাকে দেখে ফিরতে হবে। সন্ধ্যে হয়ে যাবে।’
প্রদীপ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘না গেলে হয় না আজকে?’
‘না আজ যেতেই হবে। কিন্তু আমি যত তাড়াতাড়ি পারি ফেরার চেষ্টা করব। তুমি কিন্তু কোথাও বেরোবে না আজ। বাড়িতেই বিশ্রাম করবে। আসছি আমি,’ মল্লিকা বেরিয়ে গেল।
প্রদীপ দেখল মল্লিকাকে যতক্ষণ দেখা যায়। তারপর দরজাটা বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়ল। চোখদুটো বন্ধ করল। মাথাটা বড্ড ধরেছে। একটু পরে উঠে খাবে, মল্লিকা খাবার ঢাকা দিয়ে গেছে।
সেদিন মল্লিকারও স্কুলে ছটফট করেই কাটল। মনে হচ্ছিল না এলেই যেন ভালো হত। প্রদীপকে ফোন করার চেষ্টাও করল, কিন্তু গ্রামে বাড়ির ভেতর প্রায়ই নেটওয়ার্ক থাকে না, তাই কথাও হল না। স্কুল ফেরত অসুস্থ কলিগকে দেখতেও গেল না। সোজা স্টেশনে দৌড়ল। কিন্তু সেদিনই ট্রেনের গণ্ডগোল। কারেন্ট না থাকায় অনেকক্ষণ ট্রেন বন্ধ। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যখন গ্রামে পৌঁছল তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে।
আজ সব কেমন যেন নিস্তব্ধ। রাস্তায় দু একজনের সঙ্গে দেখা হল, কেমন অদ্ভুত চোখে ওকে দেখছে ওরা। মল্লিকার বুকটা কিরকম ছ্যাঁৎ করে উঠল।
একটা ছেলে কোত্থেকে দৌড়ে এসে কান্নাভেজা গলায় বলল, ‘এতক্ষণে এলে বৌদি! এদিকে যে সর্বনাশ হয়ে গেল!’
মল্লিকা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ছেলেটা ওকে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল নদীর ধারে। সারা গ্রাম সেখানে তখন ভেঙে পড়েছে। কোনোরকম ভিড়ের মধ্যে দিয়ে মল্লিকাকে নিয়ে গেল জলের একদম ধারে।
দূর দিয়ে ভেসে চলা একটা ভেলার দিক আঙুল তুলে দেখিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় কোনো রকম বলল, ‘প্রদীপদা।’
অস্ফূট একটা আওয়াজ করে মল্লিকা সেখানেই জ্ঞান হারাল। দু বছর আগে এক সন্ধ্যেয় প্রদীপের হাত ধরে সে এই গ্রামে প্রবেশ করেছিল এক নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে আর আজ সন্ধ্যেয় তাকে এখানে একা ফেলে রেখে প্রদীপ কোথায় চলে গেল!
কয়েক দিন কাটল, সব কাজকর্ম মিটল। জ্ঞান ফিরে আসার পর মল্লিকা একেবারে পাথরের মূর্তির মতো হয়ে গেছে। একটা কথাও বলে নি তারপর থেকে। চুপ করে বসে থাকে। মল্লিকার মা আছেন মেয়ের কাছে। এবার ওকে এখান থেকে নিয়ে চলে যাবেন।
সন্ধ্যেবেলা ঘরে ঢুকে দেখলেন মল্লিকা সেরকমই চুপচাপ খাটের ওপর বসে আছে।
মল্লিকার মা মেয়ের পাশে বসলেন।
আস্তে আস্তে বললেন, ‘দেখ যা হবার তা তো হয়ে গেছে। এ বিয়ের পরিণাম যে ভালো হবে না তা তো জানাই ছিল। কারুর মত ছিল না। আমাদেরও তুই আগে কিচ্ছু জানাস নি। কম ঝামেলা হয়েছে বিয়ের পর। এখন মনকে শক্ত কর। এখান থেকে চল। কি আর করা যাবে। কি অদ্ভুত ভাগ্যের পরিহাস! যে ছেলে কাউকে সাপে কামড়েছে শুনলেই জোর করে হাসপাতালে নিয়ে যেত চিকিৎসা করাতে, তাকেই যখন সাপে কামড়াল তখন আর কিছু করার সুযোগ পাওয়া গেল না, বাড়িতেই সব শেষ হয়ে গেল।’
মল্লিকা মার দিকে তাকাল, তার চোখের দৃষ্টিতে অনেক কিছু ছিল, কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
‘কখন থেকে এই এক ভাবে বসে আছিস। একটু ওঠ, না কি একটু শুবি? আলোটা নিভিয়ে দেব?’
‘আলো কোথায় দেখছ তুমি? চারদিকে তো অন্ধকার, শুধুই অন্ধকার,’ এতক্ষণে মল্লিকা মুখ খুলল।
মল্লিকার মা হকচকিয়ে গেলেন, কি বলছে রে বাবা মেয়েটা! ঘরে এত বড়ো একটা টিউব লাইট জ্বলছে আর বলে কিনা চার দিক অন্ধকার! এত বড়ো একটা ঘটনার পরেও একটু কাঁদে নি, একটা কথাও বলে নি, মাথার গোলমাল হল না তো?
‘তুমি কি ভাবছ মা? আমি কিছু বলছি না মানে আমি কিছুই বুঝি নি?’ বলল মল্লিকা, ‘এ গ্রামের কিছু লোকের উল্লাস কি আমার চোখে পড়ে নি? দুবছর আগে যা ঘটাতে পারে নি ক’দিন আগে তাই ঘটানোর আনন্দ কি আমি তাদের চোখেমুখে দেখি নি? আমি কি জানি না কার ইশারায় এসব কিছু হয়েছে? জানলার বাইরে পড়ে থাকা সাপের ঝাঁপিটাও আমি দেখেছি, তাড়াহুড়োয় পালাতে গিয়ে বোধহয় হাত থেকে পড়ে গেছিল। লক্ষ্মণ ওঝার শাকরেদটাকে ইদানীং মাঝে মাঝেই বাড়ির চারপাশে ঘুরঘুর করতে দেখতাম। ওকে বলেওছিলাম। কিন্তু আমায় পাত্তাই দিল না, বলল যে এই সময় নাকি ওরা ঝোপঝাড় থেকে সাপ ধরে বেড়ায়।
কি বললে তুমি তখন? চিকিৎসার কোনো সুযোগ পাওয়া যায় নি? সুযোগ পাওয়া যায় নি না কি যাতে চিকিৎসা না হয় তার জন্যে বাড়ির ভেতরই ফেলে রাখা হয়েছিল। ঠিক ততক্ষণই যতক্ষণ একটা মানুষের মরতে সময় লাগে। তারপরই পেছনের দরজা ভেঙে ওকে বার করে নিয়ে ভাসিয়ে দিল। এত তাড়া ছিল যে আমার ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করা গেল না। দু বছর আগে কাউকে না জানিয়ে আমরা বিয়ে করে গ্রামে এসেছিলাম। খুব রাগ ছিল সেজন্যে আমাদের ওপর। বংশের সম্মান রক্ষার জন্যে তখনই আমাদের মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু পারে নি। ওর ওপর তো অনেক আগে থেকেই খেপে আছে। দু বছর পরে তার শোধ নিল। কাকপক্ষীও টের পেল না, বাড়ির ভেতরেই ওকে শেষ করে দিল।
গ্রাম ছেড়ে যেতে চাইত না ও। বলত, যা হয় হোক, গ্রামেই থাকব। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, অশিক্ষার হাত থেকে সবাইকে বার করতে চেয়েছিল। আলো জ্বালাতে চেয়েছিল। পারল না। এখন তো আরো অন্ধকার, ঘন অন্ধকার। মানুষের মনের অন্ধকারের মতো ঘন কালো আর কিছু হয় না কি? কিন্ত হোক অন্ধকার, তাও আমি যাব না এখান থেকে। থাকব এই অন্ধকারেই, দেখব ঘোচে কি না তা। এক প্রদীপ নিভে গেছে, কিন্তু আরেকজনের অস্তিত্ব আমি অনুভব করেছি আমার ভেতরে। আমি থাকব তাকে নিয়েই, বাঁচব এই অন্ধকারেই আলো জ্বলার অপেক্ষায়।’