সেদিন ফেয়ার থেকে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল আনন্দীর। রাত মানে ন’টা। কলকাতা শহরে সেটা কোনো রাতই নয় যদিও। কিন্তু আনন্দীর কাছে অনেক, তাও আবার একলা ফেরার পক্ষে। ফিরে হাত মুখ ধুয়ে নিজের বিছানায় সবে একটু গা এলিয়েছেন, এমন সময় দরজায় ঠকঠক। দরজা বন্ধ ছিল না, পর্দা টানা ছিল। সরিয়ে ঘরে ঢুকল শঙ্খ, শঙ্খশুভ্র সরকার, বছর তেত্রিশ বয়স, এক বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মী।
ঘরে ঢুকে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করল, ‘মা তুমি কোথায় গেছিলে? এত দেরীতে ফিরলে?’
‘কেন অমৃতা বলে নি? আমি হ্যাণ্ডিক্রাফটস ফেয়ারে গেছিলাম। আমাদের স্টল ছিল,’ আনন্দী উত্তর দিলেন।
‘আবার ফেয়ার! আবার তুমি এইসব শুরু করেছ মা? আগের ফেয়ারটার সময় তোমায় এত করে বোঝানো হল। দিদি পর্যন্ত দিল্লী থেকে এল এই জন্যে। কিন্তু তোমার কানে কোনো কথা গেলে তো! আমার সন্দেহ ছিল, তুমি তখন একটা কথাও বলো নি, হ্যাঁ না কিচ্ছু না। আমি তখনই দিদিকে বলেছিলাম, লাভ কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে না। উফ্ কি করে যে তোমাকে বোঝানো যায়!’
‘কেন কি এমন অপরাধ করেছি আমি?’
‘জাস্ট ডিসগাস্টিং,’ শঙ্খ বিরক্ত হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় অমৃতা ঘরে ঢুকল।
‘এখন এসব কথা থাক না। রাত হয়ে গেছে খেতে চলো। মা এসো,’ অমৃতা বাধা দিয়ে বলল।
খাবার টেবিলেও আবহাওয়া গুমোটই রইল। শঙ্খ অফিসিয়াল ট্যুরে কয়েকদিন বাইরে ছিল। ফিরে যেই শুনেছে অমৃতার কাছে যে মা হ্যাণ্ডিক্রাফটস ফেয়ারে গেছে ওমনি মেজাজ সপ্তমে। অমৃতা এতদিনে এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পাঁচ বছর হল সে বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এসেছে। প্রথম প্রথম শাশুড়িকে এত বেরোতে দেখত না এখনকার মতো। অদ্ভুত একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে যে শঙ্খ যতই রাগারাগি করুক, আনন্দীকে আটকানো যায় না। শঙ্খ একতরফা বলে যায়, বেশীর ভাগ সময় আনন্দী পালটা উত্তরও দেন না।, কিন্তু যা করবেন মনে করেন তা ঠিকই করেন। আশ্চর্য জেদ বাবা, অমৃতা ভেবেছে অনেকবার। কিন্তু অমৃতার সঙ্গে আনন্দীর সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো। তিনি কখনোই অমৃতার কোনো ইচ্ছেতে বাধা দেন না, বরং যেন প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ই আছে। তিন বছরের নাতির যাবতীয় আবদারও মেটান। অমৃতা তো সকালে স্কুলে বেরিয়ে যায়, ফেরে বিকালে। রোহনের দেখাশোনা করার জন্যে একটি মেয়ে আছে, শোভা। তার ওপরেও আনন্দীর নজর আছে, সব কাজকর্ম ঠিকঠাক করছে কি না। কিন্তু এসবের মাঝখানেও নিজের কাজের জন্যে সময় আনন্দী ঠিক বার করে নেন।
আনন্দী দুঃস্থ মেয়েদের একটি প্রতিষ্ঠান নন্দিনীর সঙ্গে যুক্ত। তিনি সেখানে মেয়েদের সেলাই, উলবোনা এসব শেখান। শুধু তাই নয় এদের তৈরী জিনিসপত্র বিক্রি করতেও সাহায্য করেন। হস্তশিল্পের মেলাগুলোতে এরা স্টল দেয়, স্বভাবতই আনন্দী সেখানে নিয়মিত যান। নন্দিনী তাঁর দ্বিতীয় বাড়ি হয়ে গেছে এতদিনে, মেয়েগুলো যেন আত্মীয়র বাড়া। এদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বছর ছয়েক আগে এরকমই এক মেলায়। এক ননদের সঙ্গে গিয়েছিলেন মেলায়। ঘুরতে ঘুরতে নন্দিনী স্টলের সামনে এসেছিলেন। ওদের তৈরী জিনিসগুলো বেশ ভালো লেগেছিল, কিনেওছিলেন। স্টলে বসে বসেই একটি মেয়ে সোয়েটার বুনছিল, কিন্তু একটা ডিজাইন কিছুতেই তুলতে পারছিল না। আনন্দী নিজেকে আটকাতে পারেন নি, তুলে দিয়েছিলেন ডিজাইনটা। নন্দিনীর কর্ণধার মালবিকা বসু সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আনন্দীর এরকম স্বেচ্ছায় সাহায্য করা দেখে অবাক হয়েছিলেন। নন্দিনীর কার্যালয়ে আসতে অনুরোধ করেছিলেন।
শঙ্খ সব শুনে বলেছিল, ‘যাও, গিয়ে কিছু ডোনেশন দিয়ে এসো। খালি হাতে যাওয়া তোমার পক্ষে শোভনীয় নয়। আফটার অল আমাদের ফ্যামিলির একটা প্রেস্টিজ আছে।’
আনন্দীর ভালো লাগে নি কথাটা। গিয়েছিলেন, কিছু জিনিসও কিনেছিলেন, কিন্তু নিজের পরিবারের প্রেস্টিজ রক্ষার্থে ডোনেশন দেন নি। মালবিকা সেই সময় নানা ধরণের হাতের কাজ শেখাবার জন্যে শিক্ষিকা খুঁজছিলেন। আনন্দীর কাছে সে প্রস্তাব তিনিই রাখেন। আনন্দী পরে জানাব বলে চলে এসেছিলেন। হ্যাঁ করাটা সহজ ছিল না তাঁর পক্ষে। আঠারো বছর হতে না হতেই বিয়ে হয়ে এসেছিলেন এই সরকার পরিবারে। সেই সঙ্গে ছোটোবড়ো সব ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার বিসর্জন দিতে হয়েছিল। সব কিছুই শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী ঠিক করে দিতেন। তাঁরা গত হলে সে দায়িত্ব এখন শঙ্খর। ফিরে এসে সারা সন্ধ্যে ভাবলেন কি করবেন। শঙ্খকে না জিজ্ঞেস করে রাজী হওয়াটা ঠিক হবে কিনা সেটাও ভাবলেন। আসলে অভ্যেসই তো তাই, সব কাজ জিজ্ঞেস করে করার। কিন্তু সেদিন যেন মন বিদ্রোহ করে বসেছিল। ভেতরের আনন্দী প্রশ্ন তুলেছিল, ‘কতকাল, আর কতকাল এভাবে সব কাজ অন্যের অনুমতি নিয়ে করতে হবে? জীবনের আসল সময়ই তো কেটে গেল এই করতে করতে, আর কেন? কেন আমি আমার ইচ্ছেকে প্রাধাণ্য দিতে পারব না? আর কতদিন আমার সমস্ত ইচ্ছেকে ছেলের অনুমতির যূপকাষ্ঠে বলি দিতে হবে?’
শঙ্খকে না জানিয়েই মালবিকাকে ফোন করেছিলেন, নিজের সম্মতি জানিয়েছিলেন। পরেরদিন থেকেই যেতে শুরু করেছিলেন। আসলে বাড়ির চার দেওয়ালের বাইরে তিনিও একটু ফাঁকা হাওয়া খুঁজছিলেন। অফিসে বেরোনোর সময়ে শঙ্খ জানতে পারল। তার মা একটা দুঃস্থ মেয়েদের প্রতিষ্ঠানে সেলাই শেখাতে যাবে এটা শুনে সে প্রথমে বাকশক্তিরহিত হয়ে গেল। তারপর যাবতীয় ক্ষোভ, রাগ উগরে দিয়ে বলল, ‘তোমার কাছে এটা এক্সপেক্টেড ছিল না মা। সরকার ফ্যামিলির প্রেস্টিজ তুমি এভাবে নষ্ট করছ।’
আনন্দী উত্তর দেন নি, জানতেন বোঝানোর চেষ্টা বৃথা। এত বছরে যা করে উঠতে পারেন নি তা আজও পারবেন না। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তও বদলান নি। তারপর থেকে এই অশান্তি লেগেই আছে। শঙ্খর পছন্দ না হলেও আনন্দী যান। না, সাংসারিক কর্তব্যে কোনো অবহেলা না করেই। এর কিছুদিনের মধ্যে শঙ্খর বিয়ে হল। বলা বাহুল্য এতেও আনন্দীর কোনো পছন্দের ব্যাপার ছিল না। শঙ্খই একদিন অমৃতাকে বাড়িতে নিয়ে এসে মার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। অমৃতা আসার পর আনন্দী আরো বেশী করে নিজেকে নন্দিনীর কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত করেন। বছর দুয়েকের মাথায় রোহন এল। শঙ্খ রোহনের দেখাশোনা করার অজুহাতে আনন্দীকে আটকাতে চাইল, কিন্তু পারল না। এ ব্যাপারে অবশ্য অমৃতাও সায় দেয় নি। সে চায় নি যে তাদের ছেলের জন্যে আনন্দী একদম আটকে পড়ুন। শঙ্খ মার এসব কাজকর্ম বন্ধ করার জন্যে কম চেষ্টা করে নি। দিদি শ্রীমন্তিকে ডাকিয়ে এনেছে দিল্লী থেকে। ভাইবোন মিলে মাকে অনেক বুঝিয়েছে যে এসব করে কোনো লাভ নেই, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো হচ্ছে। উপরন্তু পরিবারের, শঙ্খর মান সম্মান নষ্ট হচ্ছে, নিজেরও শরীর খারাপ হবে। আনন্দী চুপ করে থেকেছেন, কিন্তু নন্দিনীতে যাওয়া বন্ধ করেন নি।
আনন্দী বোঝাবেন কি করে যে নন্দিনীতে গিয়ে তিনি যেন খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে পারেন, স্বাধীনভাবে বাঁচার সুখ অনুভব করেন। যে মেয়েগুলো এত বাধা, প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করে নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজের বাঁচাকেও সার্থক মনে হয়। মজাও কি কম লাগে ওদের কথা শুনে! একদিন যেমন একটি মেয়ে বলল, ‘আপনার নামটা খুব সুন্দর দিদি, একদম পুরোনো দিনের মতো নয়। আমি তো আনন্দী নাম শুধু ওই বালিকা বধূ সিরিয়ালেই শুনেছি।’
আনন্দী শুনে হেসে ফেললেন, বললেন, ‘নামটা আমার ঠাকুমা রেখেছিলেন। ভাইবোনেদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো আমি। প্রথম নাতনীর নাম দুর্গার নামে রেখেছিলেন। বালিকা বধূ সিরিয়াল তখন কোথায়! তবে মিল একটা আছে। ঠাকুমার ইচ্ছে পূরণ করতেই আমার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল আঠারো বছর হওয়ারও আগে। এখনকার তুলনায় বালিকা বধূই বটে।’
এইরকম ভাবে কখন যেন ওরা আনন্দীর ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল, নিজেদের সুখ দুঃখ ভাগ করে নেয় আনন্দীর সঙ্গে।
●
পরেরদিন শঙ্খ অফিস থেকে অপেক্ষাকৃত তাড়াতাড়ি ফিরল। ফিরেই প্রশ্ন, ‘মা কোথায়?’
‘মা তো ফেয়ারে। ফিরতে দেরী হতে পারে বলে গেছে,’ অমৃতা উত্তর দেয়।
শঙ্খ গুম হয়ে গেল, খাবার অবধি খেল না। অমৃতা বেশ বুঝতে পারে যে আনন্দী ফিরিলে আজ বড়োসড়ো ঝড় উঠবে। তার আশঙ্কাই সত্যি হল। আনন্দী ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই শঙ্খ বিনা ভণিতায় বলে উঠল, ‘তুমি কি আমার মান সম্মান সব নষ্ট না করে থামবে না?’
আনন্দী ছেলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি তোমার বা সরকার পরিবারের মান সম্মান নষ্ট করার মতো কোনো কাজ আমি করি নি।’
‘তাতো তুমি বলবেই। তোমার নিজের জেদ বজায় রাখতে হবে তো। আজ অফিসে সবার সামনে আমার বস মিস্টার রায় বললেন, ‘শঙ্খ তুমি বলো নি তো তোমার মা নন্দিনী বলে একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। ওখানে সেলাই শেখান। কাল ফেয়ারে দেখলাম নন্দিনীর স্টলে।’ একগাদা লোকের সামনে আমার মাথা কাটা গেল আর তুমি বলছ যে আমার মান সম্মান নষ্ট করার মতো কোনো কাজ তুমি করো নি! এখন আমার আফশোস হচ্ছে কেন যে তোমার সঙ্গে মিস্টার রায়ের আলাপ করে দিয়াছিলাম,’ শঙ্খ ফুঁসছে।
‘আমি তোমার বসকে দেখতেও পাই নি। উনিই আমাকে দেখতে পেয়ে কথা বলেছেন, স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন।’
‘দেখলে যখন উনি তোমাকে চিনতে পেরেছেন তখন কি দরকার ছিল বলার যে তুমি নন্দিনীর সঙ্গে যুক্ত? সেলাই শেখাও? বললেই হত যে মেলা ঘুরতে এসেছ।’
‘শুধু শুধু এরকম মিথ্যে কথা বলার প্রয়োজন আমি বুঝি নি তাই। কোথায় কি বলতে হবে সে বোঝার মতো ক্ষমতা আমার আছে,’ আনন্দীর গলা কঠিন শোনায়।
‘কবে থেকে হল মা তোমার এই ক্ষমতা?’ শঙ্খর গলায় ব্যঙ্গ, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর? জন্মে থেকে তো তোমায় নিজে থেকে কিছু করতে দেখি নি। কোনো ফাংশান অ্যাটেণ্ড করতে হলেও কি শাড়ি পরে যাবে সেটা অবধি ঠাম্মা ঠিক করে দিত। তুমি ট্যাঁফো করতে না। ঠাম্মা, দাদু মারা যাবার পরও তোমার এই পরিবর্তন হয় নি, বাবা যা বলত তুমি মেনে নিতে। আজ বাবা থাকলে পারতে তুমি বাড়ির বাইরে গিয়ে ওই লোয়ার ক্লাসের মেয়েগুলোকে সেলাই শেখাতে? বাবা মারা যাবার পর তুমি হঠাৎ একেবারে পালটে গেলে। উইডো পেনশন তোমাকে এতো স্বাধীন করে দিল যে তুমি যা খুশী তাই করতে শুরু করেছ।’
অমৃতা চমকে উঠল, শঙ্খ বেশী বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে মনে হল। কিন্তু শঙ্খকে কিছু বলার আগেই সে দুমদুম করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আনন্দীও কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরে চলে গেলেন। অমৃতা লক্ষ্য করল চোখের কোনে জল চিকচিক করছে। সেদিন আর আনন্দী ডাইনিং টেবিলে খেতে এলেন না, অমৃতা ঘরে খাবার দিয়ে এল। কিছু বলব বলব করেও বলল না, ভাবল এখন ওনাকে একা থাকতে দেওয়াই ভালো।
রোহনকে ঘুম পাড়িয়ে অমৃতাও শুয়ে পড়ল। শঙ্খও ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু অমৃতার ঘুম এল না। তার মাথায় শঙ্খর কথাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছিল। শঙ্খ যা বলল তা কি সত্যি? তার শাশুড়ি এরকম জীবন কাটিয়েছেন? নিজের কোনো স্বাধীনতাই ছিল না? আনন্দীর জায়গায় নিজেকে ভাবতে গিয়েই তার দম বন্ধ হয়ে এল। সে উঠে পড়ল বিছানা থেকে। ঘর থেকে বেরোল। ডাইনিং স্পেসে গিয়ে জল খেল। কিছুক্ষণ এঘর ওঘর ঘুরঘুর করে কি মনে করে আনন্দীর ঘরের সামনে গেল। দরজা বন্ধ, বন্ধ দরজার তলা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। তার মানে মা জেগে আছে, ভাবল সে। আস্তে করে দরজায় টোকা দিল।
‘ভেতরে এসো, দরজা খোলাই আছে,’ আনন্দীর গলা ভেসে এল।
দেখল বালিশে ঠেসান দিয়ে আনন্দী বিছানায় বসে আছেন। অমৃতা কাছে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘শঙ্খর ওসব কথা বলা উচিত হয় নি। তুমি বাইরে কোথাও একা বেরোলেই যে কি হয় ওর! জানোই তো ওকে, আমার চেয়ে অনেক ভালোই জানো তুমি। আমি ওকে কাল সকালে বোঝাব।’
‘কোনো লাভ নেই, ও চেষ্টা ভুলেও করতে যেও না। তোমার থেকে ভালো জানি বলেই বলছি,’ আস্তে আস্তে বললেন আনন্দী।
‘আসলে তোমাকে আগে কোনোদিন এরকম একা কাজে বেরোতে দেখে নি তো, তাই বোধহয়…….,’ অমৃতা আর কি বলবে ভেবে পায় না।
আনন্দী ম্লান হাসলেন, বললেন, ‘আমার বাবা ছিলেন আমার ঠাকুমার একমাত্র ছেলে, তাও আবার চার মেয়ের পর। তাঁর প্রথম সন্তান আমি। ঠাকুমার খুব আদরের। একটু বড়ো হতে না হতেই জানতে পারলাম ঠাকুমার ইচ্ছের কথা, কি না নাতজামাই দেখে যাওয়া। আমার অন্য ভাইবোনেরা অনেক ছোটো, তাদের বিয়ে দেখার সৌভাগ্য ঠাকুমার হবে না, তাই অন্তত আমার জন্যে চেষ্টা করা হোক। ওদিকে আমার শ্বশুর, শাশুড়ি তাঁদের একমাত্র ছেলের জন্যে সুন্দরী, সুশীল বউ খুঁজছিলেন। আমাকে পছন্দ হয়ে গেল, বিয়েও হয়ে গেল। যখন বউ হয়ে এবাড়িতে এলাম আঠারো বছর হতে তখনো তিন মাস বাকী। স্কুলে পড়তাম, পড়া ছাড়িয়ে দেওয়া হল। মা, ঠাকুমা বোঝালেন শ্বশুরবাড়ি গিয়ে যেন লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকি, সবার কথা শুনি, সবার সেবাযত্ন করি, বাবা মার সম্মান যেন নষ্ট না হয়। প্রথমদিনই শাশুড়ি বললেন, ‘এতো বড়ো বনেদি পরিবারে বউ হয়ে এসেছো, এমন কিছু কখনো কোরো না যাতে এই সরকার পরিবারের মান মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়।’ সেই শুরু। সবার মান সম্মান রক্ষা করতে করতে নিজের মান সম্মানের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
বিয়ের জন্যে পড়া ছাড়তে হয়েছিল, কিন্তু পড়ার ইচ্ছে ছিল খুব। কয়েক মাস পরে শঙ্খর বাবাকে একদিন সে ইচ্ছের কথা জানিয়েছিলাম। শুনে তিনি এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন যে মনে হয়েছিল যেন আকাশের চাঁদ পেড়ে আনতে বলেছি। তারপর বললেন, ‘কি হবে পড়াশোনা করে? আমাদের কি এমন দুর্গতি হয়েছে যে তোমাকে চাকরি করতে বেরোতে হবে? কি কাজে লাগবে তোমার পড়াশোনা? সুক্তোতে কি কি মশলা দিতে হয় তা শেখাবে তোমার স্কুল কলেজে? ওসব চিন্তা ছেড়ে বরং মার কাছ থেকে ভালো করে রান্নাবান্না, সেলাই ফোঁড়াই শেখো। সংসারের কাজে আসবে।’
ব্যাস সেই শেষ। আর কোনোদিন পড়াশোনার কথা মনেও আনি নি। শুধু চুপচাপ বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে কাজ করে গেছি, যে যা হুকুম করেছে তামিল করে গেছি। ঠিকই বলেছে শঙ্খ, ট্যাঁফো করার ক্ষমতা ছিল না। কোনো বিয়েবাড়িতে যাব, শাশুড়ি বেছে দিয়েছেন শাড়ি, গয়না। আমি বাছলে যদি বাইরের লোকের সামনে ঠাটবাট ঠিকঠাক বজায় না থাকে। আমি কিছু বললেই বলতেন, ‘বাপের বাড়ির কথা ভুলে যাও বউমা। এখন এই পরিবারের আদবকায়দায় অভ্যস্ত হও।’ করতেই হল অভ্যেস - নিজের পছন্দ অপছন্দ, চাওয়া না চাওয়াকে বিসর্জন দেওয়ার অভ্যেস। খারাপ লাগত কিন্তু প্রতিবাদ করি নি কোনোদিন। আসলে জন্ম থেকেই আমাদের মনে গেঁথে দেওয়া হত শ্বশুর বাড়িই মেয়েদের আসল বাড়ি, সেখানে শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী সবার কথা মেনে চলতে হয়।’
‘কিন্তু আমার ব্যাপারে তো শঙ্খ কিছু বলে না। আমি যে স্কুলে পড়াই তাতেও শঙ্খর কোনো আপত্তি নেই,’ অমৃতা আনন্দীর কথার মাঝেই বলে উঠল, ‘বরং ও বিয়ের আগে বরাবর বলত যে ও চায় না ওর স্ত্রী কিছু না করে শুধুমাত্র হাউসওয়াইফ হয়ে থাকুক।’
‘তুমি পড়াশোনা করেছ, নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াও, তাতে কেন ও আপত্তি করবে? বরং এতে ওর স্ট্যাটাস বজায় থাকে। আর আমি তো সেলাই শেখাই, তাও আবার লোয়ার ক্লাসের মেয়েদের, নন্দিনীর মতো ছোটোখাটো জায়গায় যাদের নিজেদেরই নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা! কিন্তু আমি কি করি বলো তো? পড়াশোনা শেখার তো সুযোগই পাই নি। চিরকাল তো শুধু রান্নাবান্না, সেলাই এসবই করে এসেছি। যা জানি তা শেখালে যদি কারুর উপকার হয়, সে কি অন্যায়? বলো তুমিই বলো?’
অমৃতা চুপ করে থাকে, তার খুব খারাপ লাগে।
আনন্দী বলেই চলেন, ‘শ্বশুর, শাশুড়ি মারা গেলেন। ছেলেমেয়েরা বড়ো হল। কিন্তু আমার অবস্থা বদলালো না। ছেলেমেয়েরা কোনোদিনই আমাকে বিশেষ পাত্তা দিত না। আমার দরকার পড়ত শুধু কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হলে বা নতুন সোয়াটার পরার ইচ্ছে হলে। এসবের মধ্যেই মেয়ের বিয়ে হল, শঙ্খ চাকরীতে ঢুকল। সাত বছর আগে হঠাৎ একদিন শঙ্খর বাবাও চলে গেলেন। শোকের মধ্যেও অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম বাবার জায়গাটা ছেলে কখন যেন নিয়ে নিয়েছে। শুধু আমিই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, কোনো নড়নচড়ন নেই। কেউ মারা গেলে যা হয় নানা রকম দরকারে নানান অফিস কাছারিতে দৌড়োদৌড়ি করতে হয়। শঙ্খ প্রথম দু তিন দিন সঙ্গে গেল। তারপর দেখলাম খুব বিরক্ত। সেদিন ছেলে আমাকে উপদেশ দিল, ‘মা তুমি একটু স্মার্ট হও। এসব কাজকর্ম নিজে নিজে করো। আমার যেখানে না গেলে হবে না সেখানে তো আমি যাবোই। কিন্তু বাদবাকী কাজ তুমি করো। আজকাল মেয়েরা কি না করছে আর এই এক তুমি শুধু বাড়ির মধ্যে সেলাই আর রান্না করেই জীবন কাটিয়ে দিলে।’
খুব লজ্জা করেছিল সেদিন জানো তো? নিজের ওপর লজ্জা ঘেন্নায় মাটিতে মিশিয়ে গেছিলাম। সত্যিই তো, ও ক’দিন অফিসে ছুটি নিয়ে এসব করবে। সেই থেকে একটু একটু করে একা বাইরে বেরোনোর শুরু। একদিন ব্যাংকে গেছি। আমার কাজটা হল না কিন্তু লাঞ্চ আওয়ার্স হয়ে গেল। যে ভদ্রলোক কাজটা দেখছিলেন বললেন, ‘আমি চট করে খেয়ে আসছি, আপনি ত্রিশ চল্লিশ মিনিট পরে আসুন।’
খিদে আমারো খুব পেয়েছিল। সামনেই ফুটপাথে নানান খাবার বিক্রি হচ্ছিল। আমিও ফুটপাথে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা আর একটা দোসা খেয়ে নিলাম। মিথ্যে কথা বলব না, সেদিন খুব ভালো লেগেছিল। চারপাশে কোনো রক্তচক্ষু নেই, নিষেধাজ্ঞা নেই, অনুমতি নেওয়ার প্রশ্ন নেই। প্রথম স্বাধীনতার আনন্দ ভোগ করলাম। এরপর থেকে বাইরের কাজ কিছু কিছু আমি করতে শুরু করলাম। ভালো লাগত, খাঁচার পাখি যেন খোলা হাওয়ায় উড়ত। শঙ্খরও আপত্তি ছিল না। ছুটির দিনে ওর জন্যে বিশেষ কোনো কাজ থাকত না। ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় কাটাতে পারত।
কিন্তু আপত্তি করল যখন আমি নন্দিনীতে যোগ দিলাম তখনই। কারণ এটা যে আমার নিজের ইচ্ছেয়, এটা যে আমার নিজের চাওয়া। এতদিন শুধু অন্যের ইচ্ছে পূরণ করে এসেছি। শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী, ছেলে, মেয়ে যে যা বলেছে করেছি, ওদের জন্যে বেঁচেছি। আজ যখন নিজের ভালো লাগার জন্যে কিছু করছি, নিজের বেঁচে থাকার মানে খোঁজার চেষ্টা করছি তখনই রাগ, তখনই আপত্তি, তখনই মান মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়ার ওজুহাতে আটকানোর চেষ্টা। সত্যিই জানতে ইচ্ছে করে এই যুগে যখন মেয়েরা কি না কি করছে, কোথায় না কোথায় যাচ্ছে, সব রকম অধিকার তাদের আছে তখন আমার এইটুকু স্বাধীনতা ভোগ করা অন্যায় কেন?’
উত্তর দেবার মতো কিছু অমৃতা এখনো কিছু পেল না। একই বাড়িতে একই সময় যখন সে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে তখন আরেকজনের ওপর এতো নিষেধাজ্ঞার কি কারণ থাকতে পারে তারও বোধগম্য হল না। শুধুমাত্র তথাকথিত স্ট্যাটাস, মান সম্মান রক্ষার্থে? যা এতই ঠুনকো যে রক্ষা করার জন্যে একজনের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে হয়?
-----X-----