ঘরের ভিতরটা অন্ধকার ।
অথচ বাইরে মৌমিতার জানালা ভরা মোমের আলোর মতন জ্যোৎস্না ।
জোৎস্নার আলোয় ঘরের অন্ধকার অনেকটা ফ্যাকাশে মতন দেখায়। আলোর ছোয়া আছে বটে, কিন্তু আলোকিত নয়। অন্ধকার ঘরে মৌমিতার সাথে আরো একজন থাকে। লোড শেডিং শুরু হলেই ঘর অন্ধকার হয়ে যায়। অন্ধকারের সাথে সাথে সেও আসে মৌমিতার কাছে। কখনো সে মৌমিতার পাশে বসে। কখনো হাত রাখে মৌমিতার মাথায়। মৌমিতার যখন অনেক মাথা ব্যাথা করে, তখন সে আস্তে করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মৌমিতা আবেশে চোখ বুজে। কখনো বা মৌমিতার হাতে হাত চেপে বসে থাকে। কখনো দুই হাতে মৌমিতার দুই গাল আলতো করে ছুয়ে দেয়। কখনো বা সে আরো খেয়ালি হয়, কিছুটা সাহসীও। মৌমিতার কোলে মাথা রেখে হয়তো চুপ করে শুয়ে পড়ে। তার বিড়াল চোখের দৃষ্টি দিয়েও মৌমিতা তাকে দেখতে পায় না। শুধু তার স্পর্শ অনুভব করে।
একটা সময় জ্যোৎস্না মাখা আকাশ ছিলো মৌমিতার স্বপ্ন দেখার ক্যানভাস। জোৎস্না হলেই মৌমিতার মনের ভিতর যেন হাজার হাজার প্রজাপতির ছুটাছুটি শুরু হত আর মৌমিতার চোখের ভিতর স্বপ্ন জ্বালতো শত শত জোনাক। ছাদের উপর বসে আকাশের দিকে তাকালে মনে হতো যেন সে ঐ জোৎস্না ভরা আকাশটার এতটাই কাছে, যে সে চাইলেই কয়েকটা তারা অনায়াসেই তুলে আনতে পারে কিংবা চাইলেই ঐ আকাশের একটা জায়গা লিজ নিয়ে নিজেই নক্ষত্র বনে যেতে পারে। কিংবা কখনো যদি মন খুব বেশী খারাপ হতো জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকা অথবা একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে জ্যোৎস্না অনুভব করা। সেই মন খারাপের দিন গুলোতে জোৎস্না ছিলো মৌমিতার মন খারাপের টনিক।
এখন মৌমিতার কিছু করতে ইচ্ছে করে না। নক্ষত্র হতে ইচ্ছে করে না, নক্ষত্র তুলে আনতে ইচ্ছে করে না।
জ্যোৎস্না সব সময় থাকে না। কিন্তু ঘরের ভেতরের অন্ধকারটা সবসময় থাকে।
লোড শেডিং হলেই মৌমিতার ঘর অন্ধকার হয়ে যায়। ইচ্ছে করেই মৌমিতা কোন আলো জ্বালে না। এই সময়টুকুতে মৌমিতা তার চারপাশের আলো ঝলমলে অন্ধকার ভুবনটাকে ভুলে যেতে চায়। আলোহীন অন্ধকার ঘরে মৌমিতা তার বিড়াল চোখের দৃষ্টি দিয়ে তার আলোয় ভরা ভুবনটাকে মনে করতে চেষ্টা করে। আর সাথে থাকে তার অতি আপন একজন।
প্রতিদিন লোডশেডিং এর সময়টাতে মৌমিতা ঘরে আলো জ্বলে না। আলোতে মৌমিতার চোখ ঝলসে যায়।
এক সময় জ্যোৎস্নার আলোতে মৌমিতা কবিতাও লিখত। জ্যোৎস্না ছাড়াও মৌমিতা কবিতা লিখত। এক সময় মৌমিতা অনেক কিছুই করত। কবিতা লিখত, আবৃত্তি করত, ছবি আঁকত, গান গাইত, নাটকও করত। ইউনিভার্সিটিতে তাদের ছোট্ট একটা নাটকের দলও ছিলো, টিএসসি অডিটরিয়ামে তারা মাঝে মাঝে নাটক মঞ্চস্থ করত। সে দলে রাশেদ নামে একজন ছিলো। মৌমিতা নায়িকার অভিনয় করতো। প্রত্যেক নাটকেই একজন নায়িকা লাগে। মোটামুটি অপরুপা টাইপের হওয়াতে নায়িকার রোল তাকেই করতে হতো। কিন্তু রাশেদের আবার নায়কের রোল ভালো লাগত না। তার মতে চরিত্রে বৈচিত্রে না থাকলে অভিনয় করে মজা হয় না। দেখা গেলো তাকে হয়তো নায়কের রোল দেয়া হয়েছে, আর সে বেছে বেছে নিল দারোয়ানের চরিত্র। মৌমিতার খুব মেজাজ খারাপ হতো। সে চাইত রাশেদ সব সময় নায়কের অভিনয় করুক। নাটকের নায়িকা নায়কের হাতে হাত রাখবে, চোখে চোখ রাখবে, এটাইতো স্বাভাবিক। কিন্তু রাশেদ কি তার চোখের ভাষা বুঝত? বুঝলে কি আর সে দারোয়ান হতে চাইত?
নাটক এখনও করে মৌমিতা। তার জীবনটাই এখন অভিনয়ে ভরা। সকালে ঘুম থেকে উঠে অভিনয়ের শুরু। ঘুমানোর আগ পর্যন্ত চলে অভিনয়। অনেক সময় ঘুম ও আসে না। তখন চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করে মৌমিতা। নিজের সাথে নিজের অভিনয়।
অথচ যখন রাশেদ ছিল, তখন অভিনয়টাকে মনে হতো বাস্তবের মত। সে ছিল নায়িকা, যে নায়িকা চাইলে জোৎস্না রাতে আকাশের তারা হয়ে যেতে পারে, কিংবা চাইলেই আকাশের বুকে তারা হয়ে ঝুলে যেতে পারে। একা নয়, সাথে রাশেদ নামের আরেকটা তারাও থাকবে।
নক্ষত্রও ঝরে যায় একসময়।
রাশেদ চলে গেলো। কিংবা সে নিজেই রাশেদের কাছ থেকে দূরে সরে গেলো। অথবা আকাশের তারাগুলো যেখানে থাকে, তারও উপরে যিনি থাকেন, তিনিই চাইলেন নক্ষত্র যেনো নিভে যায়।
আর তখন থেকেই মৌমিতার সত্যিকারের অভিনয় শুরু। শুরু মৌমিতার পরাজয়ের গল্পও। নক্ষত্র ঝরে গেলো আকাশের বুক থেকে। জন্ম নিলো এক ফুলের। ফুলের নাম পরাজিতা। ফুলের নাম মৌমিতা।
নাহ ভুল বলা হলো। সম্ভবত মৌমিতার পরাজয়ের শুরু তারও আগে। যখন সে অনাহুতের মতো এই পৃথিবীতে এসেছিলো তখন থেকে। পরপর ছয়টি কন্যা সন্তানের পর একটি পুত্র সন্তানের প্রত্যাশায় থাকা তার মা-বাবার মুখে আরো কিছু অন্ধকার একে দিয়ে ষষ্ঠ কন্যা হিসেবে তার এ পৃথিবীতে আগমন। তার পরাজয়টা সম্ভবত সে দিন থেকেই শুরু।
আজ থেকে ২৮ বছর আগে সম্ভবত প্রযুক্তিও এত উন্নত ছিল না। তাহলে হয়তো মৌমিতার এই পৃথিবীতে আসাই হত না। বার বার পরাজয়ের হাত থেকে বেচে যেত মৌমিতা।
লোড শেডিং এর এই অন্ধকার সময়টাতে মৌমিতার এসব কথা মনে পড়ে।
রাশেদ চলে গেলো। তার নায়ক চলে গেলো। আর সে চলে এলো নতুন নায়কের কাছে।
উচ্চতর সুখের সন্ধানে মৌমিতার মা-বাবা যখন তাকে মাকসুদের সংসারে পাঠালো, মৌমিতা ব্যাপারটাকে মেনেই নিয়েছিলো। তার কাছে মনে হয়েছিল পুরো পৃথিবীটা একটা ঘর। আকাশটা সে ঘরের ছাদ। রাশেদতো এই ছাদের নিচেই কোথাও আছে। ঘর করার জন্যে একই সাথে থাকতে হবে, এমন কোন কথা নেই - ‘এক নক্ষত্রের নিচে তবু – একই আলো পৃথিবীর পারে আমরা দুজনে আছি’।
পৃথিবীর মতো বিশাল ঘরে রাশেদকে রাখলেও চার দেয়ালের ছোট্ট ঘরে মাকসুদকে নিয়েই চেয়েছিল বেচে থাকার মতো কিছু একটা তৈরী করতে। তার ছোট ছোট সুখ-দুঃখ, ভালো লাগা, অনুভুতি মাকসুদের সাথে ভাগাভাগি করেই রাশেদকে ভুলে থাকতে চেয়েছিলো। আর তাই মৌমিতা একদিন তার পুরনো খাতা খুলে তার লেখা একটা গল্প দেখিয়েছিল মাকসুদকে। মাকসুদের অভিব্যক্তি ছিল, ‘এসব কি লিখেছো? যখন ছোট ছিলাম, তখন আমিও লিখতাম এসব আবোল তাবোল’।
মৌমিতার খুব খারাপ লেগেছিলো। মাকসুদকে আর বলা হয়নি যে এই গল্পটার জন্যেই সে এক গল্প লেখা প্রতিযগিতায় প্রথম হয়েছিলো। সেটা ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ার এর কথা। কি খুশিই না সে হয়েছিলো সেদিন। আকাশের চাঁদ তার হাতের মুঠোয় মনে হয়েছিল। মাকসুদকে বললে হয়তো বলবে, কত টাকা পেয়েছিলে পুরস্কার হিসেবে? এক হাজার না দুই হাজার টাকা? বলেই হয়তো তাচ্ছিল্যের হাসি শুরু করবে। তার কাছে এক হাজার টাকার হিসাবটাই বড়। কারন টাকা পয়সা তার কাছে কোন ব্যাপার না। এক হাজার টাকার মূল্য মাকসুদের কাছে তাই এক হাজার টাকার মতই।
ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদবী শুনে প্রথমটায় তার খুব হতাশ লেগেছিল। শেষমেষ একটা বুড়ো লোকের ঘর করতে হবে। তবে যতটা বুড়ো ভেবেছিল, ততটা বুড়ো নয়। মা বলেছিল, আজকাল অনেক কম বয়সেই ছেলে-ছোকরা টাইপের লোকজন এমডি-ডিএমডি হয়ে যাচ্ছে। তবে অতটা ছেলে ছোকরাও নয়। বয়স বলেছিল ৪১ বছর। এ আর এমন কি? আজকাল মেয়েরাও ৩৫ এর আগে বিয়ে করে না। আর লোকটি দেখতেও সুদর্শন, বয়সের কোন ছাপই পড়েনি শরীরে।
মৌমিতার বয়স ছিল তখন ২৩ বছর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরীর প্রস্তুতি বিষয়ক কি এক সেমিনার হয়েছিলো। মাকসুদ গিয়েছিল প্রধান অতিথি হিসেবে। সেখানে মৌমিতাও ছিল। বরাবরই চটপটে মৌমিতা সবার নজর কাড়ে সবখানে। সেখানেও কেড়েছিল। মাকসুদের নজর কেড়েছিল।
মাকসুদের ভালোলাগার কাছে, মৌমিতার ভালোলাগার পরাজয় হয়েছিল।
সাত সাত খানা মেয়ের ভবিষ্যতের চিন্তায় অস্থির বানা-মার দুশ্চিন্তার কাছে মৌমিতার পরাজয় হয়েছিল।
মৌমিতার খুব ইচ্ছে ছিল কিছু একটা করবে। কিন্তু তার সেই ইচ্ছে চাকুরীর প্রস্তুতি বিষয়ক সেই সেমিনারেই মুখ থুবরে পড়েছে। যে চাকুরি দেয়, তার ঘরনী কি চাকুরী করে?
মাকসুদের ঘরে এসে মাস্টার্স্টা কমপ্লিট করেছে। ভেবেছিল একটা চাকুরী করবে। খুব শখ ছিল তার শিক্ষকতা করার, কোন একটা কলেজে। ভার্সিটিতে হলেই ভালো হতো, কিন্তু তার রেজাল্ট অতো ভালো না। কিছুই হলো না। মাকসুদকে জানাতেই সে একটা বিদ্রুপের হাসি হেসে বলেছিল, তোমাকে চাকুরী করতে হবে কেন? আমার কি টাকা পয়সার অভাব? মাকসুদের কাছে চাকুরী মানে শুধু টাকা পয়সা উপার্জন ছাড়া আর কিছু না।
মৌমিতার আরো একটা ইচ্ছে ছিল। ইচ্ছে ছিলো সে লেখালেখি করবে। বইমেলায় তার বই বেরোবে। নতুন বইয়ের গন্ধ শুকবে সে, তার নিজের লেখা বই। সে খারাপ লিখতো না। এক সময় দু-একটি জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত না হোক, মাঝে মাঝে তার লেখা আসতো। খুব সুন্দর গল্প লিখতো সে।
মাকসুদকে যেদিন বলেছিল সে বই লিখবে। মাকসুদ বলেছিল, তোমার লেখা কে ছাপবে। টাকা পয়সা দিয়ে বই ছাপবে? এত আদিখ্যেতা আমার নেই। এখন কি আর এসব বই পড়া বা লেখার যুগ আছে?
বই পড়ার আদিখ্যেতা মাকসুদের নেই। মৌমিতারও এখন আর বই পড়া হয় না। লেখা হয় না। তার জীবনেও কিছু কিছু পরিবর্তন এসেছে। নতুন নতুন শব্দ ঢুকেছে তার অভিধানে। স্কচ, হুইস্কি, রেড ওয়াইন, ভদকা এই নাম গুলোর সাথেও পরিচয় হয়ে গেছে তার। মাঝে মাঝে মনে হয় তার গা থেকে স্কচের গন্ধ আসছে, কখনো বা হুইস্কির ঘ্রান। রাশেদ কি দূর থেকে মৌমিতার গায়ে স্কচের ঘ্রান পায়? রাশেদ সিগারেট খেতো। মৌমিতা সিগারেটের গন্ধ একদম পছন্দ করতো না। রাশেদ বলত, গন্ধ নয়, বলো ঘ্রান। মৌমিতা বলেছিলো, আমি তোমার সাথে আর কোনদিন নায়িকার অভিনয় করবো না। তোমার গায়ে গন্ধ।
তারপর থেকে রাশেদ আর সিগারেট খায় নি। রাশেদ কি জানে যে মৌমিতা এখন মাঝে মাঝে হুইস্কির গ্লাস হাতে নিয়ে সিগারেটে দু একটা টানও দেয়? তার হাতের সিগারেট থেকেও এখন গন্ধের বদলে ঘ্রান বের হয়, এটা জানলে রাশেদ নিশ্চয়ই খুশি হতো।
মৌমিতা এখন আর অবাক হয় না কিছুতেই।
মাকসুদ অনেক রাত করে বাসায় আসে, অফিসের কাজ, মিটিং, ডিনার, পার্টি, আরো কতো রকমের এনগেজমেন্ট। সব কিছুতেই সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। একা ঘরে লোড শেডিং এর সময় অন্ধকার ঘরের জানালা দিয়ে চাদের আলোয় মৌমিতার স্বপ্নগুলো, ডানাভাঙ্গা স্বপ্ন গুলো থিয়েটারের ছবির মত আবির্ভুত হয়।
অন্ধকার ঘরে বসে আলো আধারিতে মৌমিতা স্বপ্ন দেখা খেলা খেলে। আর তার সাথে থাকে রাশেদ। দেখা যায় না। কিন্তু মৌমিতা রাশেদের অস্তিত্ব টের পায়, প্রতিটি মূহুর্তে, প্রতিটি অনুভবে।
মৌমিতা রাশেদের সাথে তার ছোট ছোট ভালো লাগা, সুখ-দুঃখ, অনুভুতি ভাগ করে নেয়। রাশেদের খোজ খবর নেয়। এই যেমন রাশেদ এখনো বিয়ে করছে না কেন? কেন সে এখনো তার কল্পনাতে ফিরে ফিরে আসে? রাশেদ তাকে মনে রেখেছে? আর মৌমিতা নিজেই নিজেকে ভুলে গেছে। ভেঙ্গেচুরে নিজেকে কি করেছে সে নিজেই জানে না।
রাশেদের কাছে তার এক হাজার টাকার গল্প, মৌমিতার স্বপ্ন দেখা সব কিছুর আলাদা জায়গা ছিল।
শেষ যেদিন রাশেদের সাথে কথা হয়েছিল, রাশেদ বলেছিলো, লেখালেখিটা চালিয়ে যেও।
মৌমিতা বলেছিল, কি হবে লিখে?
রাশেদ বলেছিল, আমি বলেছি, তাই লিখবে।
লোড শেডিং। ঘর অন্ধকার। মৌমিতার জানালার ফাক দিয়ে আকাশের পর্দায় চাদের আলোয় তার স্বপ্ন গুলো দেখছে।
কি মনে করে হঠাৎ মৌমিতা ঊঠে দাড়ালো। আলো জ্বালবে সে। কড়া আলো নয়। মোমের আলো।
বাইরে জোৎস্নার আলো। আর ভিতরে মোমের আলোয় মৌমিতা তার স্বপ্ন জ্বালবে বলে, রাশেদের কথা রাখবে বলে, তার গল্প লেখার খাতা খুললো। লেখালেখিটা সে আবার শুরু করবে। জীবনটা সে আবার তার মত করেই শুরু করবে।
অনেকবার পরাজিত হয়েছে মৌমিতা। এবার তার বিজয়ীর দলে নাম লেখাবার পালা।