চাচাজানের কি শরীর খারাপ? গলায় ঝোলানো ময়লা গামছা দিয়ে মুখ আর গলার ঘাম মুছতে মুছতে চেয়ারে ঝিমুতে থাকা হাসু মিয়াকে জিজ্ঞেস করে মন্টু।
হাসু মিয়া শুনতে পেল কিনা বুঝতে পারল না মন্টু। কোন উত্তর না পেয়ে নিজেই আবার বলল, চাচাজান, শরীর খারাপ লাগলে বাসায় গিয়া একটু জিরাইয়া লন। দোকান আমি সামাল দিমু নে।
হাসু মিয়া এবার একটু নড়ে চড়ে বসে। তন্দ্রা ভাব দূর করতে চোখটা একটু কচলে নিয়ে বলে ,না, শরীর ঠিকই আছে। একটু ঝিমুনি আইছিল আরকি।
মুখে যদিও বলেছে শরীর ঠিক আছে, কিন্তু আসলে যে কিছু একটা ঠিক নেই তা ভালই টের পাচ্ছে হাসু মিয়া। অথচ কতই আর তার বয়স। বয়সের ঠিক মাপ-ঝোঁক না থাকলেও, মায়ের কাছে শুনেছে সংগ্রামের বছর দুয়েক আগে জন্মেছে। সে যে বছর জন্মেছিল সে বছর নাকি তাদের গ্রামে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছিল। গ্রামের সকলের মুখে হাসি ফুটেছিল। তার মা বাপের মুখেও হাসি ফুটেছিল। এক বছরের খোরাকির জন্যে আর ভাবনা নাই। তার বাপ জমির মিয়া বলেছিল, হোন আমিনা বেগম, পোলা আমার গেরামের হগলের মুখে হাসি ফিরাইয়া দিছে। একদিন আমাগো মুখেও হাসি ফিরব তোমার পোলার অছিলায়। তোমার পোলার নাম রাখলাম হাসু মিয়া। হাসু মিয়া তার মা বাপের মুখে হাসি ফোটাতে পারে নি। অভাব অনটন তাদের পিছু ছাড়ে নি। উল্টো তার বয়স যখন ছয় কি সাত তখন হঠাৎ একদিন তার বাপ বজ্রপাতে গেলো মরে। তার মা আমিনা বেগম পড়লেন অথৈ সাগরে। হাসু মিয়াকে নিয়ে শুরু করলেন নতুন সংগ্রাম। বেশি দিন টিকতে পারেন নি। বছরখানেক পরে তিনিও ছেড়ে গেলেন হাসু মিয়াকে। হাসু মিয়ার মুখের হাসি চিরদিনের জন্যে উধাও হয়ে গেলো।
হাসু মিয়া পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। পোশাক-আশাকে একটা ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্য রক্ষা করে চলে। লম্বা দাড়ি। সব সময় ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি পড়ে। চেহারার মধ্যেও একটা গাম্ভীর্য আছে। প্রথম দেখায় যে কেউ তাকে মাওলানা বলে ভূল করবে। আর পরিচয় জেনে হয়তো মনে মনে বলবে, এই লোকেরে মসজিদের ইমামতি করলে ভালো মানাইতো, চেহারার মধ্যে সুফি ভাব আছে।
কিন্তু হাসু মিয়া সুফি নন। সুফিদের মত পোশাক পড়লেই মানুষ সুফি হয়ে যায় না। সেও তেমন কেও নয়, একজন মুদি দোকানদার। মসজিদের ইমামতির পেশায় লাভ ক্ষতির কোন কারবার নাই, পূণ্যটাই মুখ্য। কিন্তু যেহেতু সে দোকানদার, তাকে লাভের কথা ভাবতে হয়। লাভ হলে সংসার চলবে। চলার উপর একটু ভাল করে চালাতে হলে লাভটাও একটু বেশি করতে হবে।
হাসু মিয়া তাই একটু বেশি লাভ করতে চায়।
বেশি লাভ করার জন্যে তাই সে একটা উপায়ও বের করেছে। ওজনে একটু কম দেয়া। তবে সে আর যাই করুক অন্য দোকানদারদের মত চাঊলে কাকর, পাথর মেশায় না, কোন ভেজালও দেয় না। শুধু ওজনে একটু কম দেয়, এই যা।
এই কাজটাও তাকে অত্যন্ত চতুরতার সাথে করতে হয়। পাবলিক আজকাল বড় সেয়ানা। নাটক- সিনেমা দেখে এরা অনেক কিছু শিখে ফেলেছে। হাসু মিয়াকেও তাই এই বিদ্যা আয়ত্ত্ব করতে অনেক মেহনত করতে হয়েছে। রীতিমত সাধনা যাকে বলে। কি সেই সাধনা তা সে এখন বলবে না। পাবলিক বড় সেয়ানা।
প্রতি কিলোতে হাসু মিয়া ১০০ গ্রাম ওজন কম দেয়। যেকোন পরিমানের উপর সে এই অনুপাত ঠিক রাখে। সে হিসেবে প্রতি ১০ কিলোতে তার ১ কিলো লাভ। চাল, ডাল, আটা, ময়দা, চিনি, গুড়, তেল, লবণ, গুড়া মসলা, কেরাসিন সবকিছুই সিস্টেম করা আছে। এই সিস্টেম সে মন্টুকেও শিখিয়ে দিয়েছে। মন্টু বিরাট এক্সপার্ট। অল্পতেই সব কিছু ধরে ফেলেছে। অবশ্য প্যাকেটজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রে তার কিছু করার থাকে না। এজন্যে সে তার দোকানে খোলা জিনিশ বেশি রাখে। এসব জিনিশ এর চাহিদাও বেশি। তার দোকানটা ডেমরা থানার যে এলাকায়, সেখানে নিম্ন আয়ের মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যাই বেশি। সুতরাং হাসু মিয়ার লাভের পরিমাণটাও বেশি।
হাসু মিয়ার চোখের পাতা নাচতে থাকে। হাত সাফাই এ নিজের পারদর্শীতার কথা ভেবে মনে মনে কিছুটা মুগ্ধ হয়। কিন্তু পরক্ষনেই বুঝতে পারে তার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। অজানা অস্বস্তিটা নড়ে চড়ে ওঠে আবার।
গত কয়েকদিন ধরেই এমন হচ্ছে। শরীরে কেমন যেন জোর পাচ্ছে না। কোন কিছু ভালো লাগছে না। সারাক্ষনই কেমন যেন ক্লান্তিতে ছেয়ে থাকে সমস্ত শরীর। দোকানের চেয়ারে বসে যখন ঝিমাতে থাকে তখন নিজেকে ক্যামন যেন রানীক্ষেত ব্যামারে ভোগা মুরগীর মত মনে হয়।
চাচাজান, চাচীআম্মা আপনারে সকাল সকাল বাসায় ফিরা যাইতে বলছে। মন্টু বলে।
ক্যান? হাসু মিয়া নিস্তেজ স্বরে জিজ্ঞেস করে।
দুপুরে খাইতে যাওয়ার সময় বলল, তোমার চাচাজানরে বলবা সকাল সকাল বাসায় চইল্লা আসতে। তার শরীরটা মনে হয় কয়েক দিন ধইরা বেজায় খারাপ করছে। শরীরের দিকে চাওন যায় না। তার নিজের তো শরীরের দিকে কোন খেয়াল নাই, খালি আছে দোকান নিয়া। এত ট্যাকা পয়সা দিয়া কি হইব। কে খাইব?
হাসু মিয়া কিছু বলে না । চুপ করে থাকে। তার ইদানিং কথাও বলতে ইচ্ছে করে না। রানীক্ষেত মুরগীর মত খালি ঝিমাতে ইচ্ছে করে। ভুল বলা হল। মুরগী কেন হবে। সেতো আর জেনানা নয়, সে হল মর্দ মানুষ। রানীক্ষেত মোরগের মত তার খালি ঝিমাতে ইচ্ছে করে।
কিছু একটা যে তার ঠিকঠাক মত চলছে না, এটা তার স্ত্রী হাসনা বানু ও বুঝেছে। বড় লক্ষী বঊ তার। অথচ তার কপালে কিনা জুটল তার মত বদ স্বামী। হাসু মিয়া আফসোস করে মনে মনে।
হ্যা, হাসু মিয়া অত্যন্ত বদ। অত্যন্ত নীচ। রাস্তার যে কুকুরগুলো ঘোরাঘুরি করে, তাদের সাথে তার শুধু একটাই তফাৎ, ওরা কুকুর হয়ে জন্মেছে আর হাসু মিয়া মানুষ হয়ে জন্মেছে। তাইতো হাসনা বানু যখন তাকে কোন সন্তান দিতে পারলো না, সে আরেকটি বিয়ে করলো। মেয়েটার নাম ছিল চামেলী। নামের মতই ছিল তার স্বভাব। তিরিং বিরিং টাইপের মেয়েছেলে। হাসু মিয়ার মত আধ বুড়ো জামাই তার মনে ধরে নি।এক মাসের মধ্যেই তার দোকানের জোয়ান ছেলেটার সাথে গেলো ভেগে। লজ্জায় হাসু মিয়া এক মাস দোকান খুলে নি।
হাসু মিয়ার সন্তান চাই। সে আবারো বিয়ে করল। এইবার চম্পা চামেলি টাইপের কোন মেয়ে না। ন্যাড়া দ্বিতীয় বার বেল তলায় গেলেও যেতে পারে, কিন্তু হাসু মিয়া না। মেয়ের নাম গুল নাহার। রুপবতী, সংসারী টাইপের মেয়ে, কিছু লেখাপড়াও জানে। কিন্তু বছর পেরিয়ে যায়। হাসু মিয়া মিষ্টি বিতরণ করার মত কোন সুসংবাদ পায় না। কিন্তু তার সন্তান চাই ই চাই। আরেকটি বিয়ে করার চিন্তাভাবনা যখন তার মনের মধ্যে উঁকি মারছিল, তখন একদিন দুপুর বেলা খাওয়া শেষে গুল নাহার বলল, আজকে আর দোকানে যাইয়া কাজ নাই।
ক্যান? দোকানে যামুনা ক্যান? দোকানে না গেলে খাইবা কি? খাওন কি আসমান থাইক্যা পড়ব নাকি? নাকি তোমার জন্যে আল্লাহতালা বিশেষ দূত মারফত খাওন পাঠাবে। খাওন কি শুধু তোমার জন্যেই আসবে নাকি আমার জন্যেও ব্যবস্থা থাকবে? হাসু মিয়া উত্তপ্ত কন্ঠে জবাব দেয়।
গুল নাহার ততোধিক ঠান্ডা গলায় বলে, একদিন দোকানে না গেলে দেশে দূর্ভিক্ষ নাইম্মা আসবে না। আপনারে নিয়া ডাক্তারের কাছে যাব।
ক্যান, ডাক্তারের কাছে যামু ক্যান। কি হইসে তোমার?
কি হইসে জানি না। কিছু হইসে কিনা, হইলে কার হইসে -আপনের না আমার, সেইটা জানার জন্যেই যাওয়া লাগবে।
লেখাপড়া জানা মেয়ে। গুল নাহারের বিদ্যার কাছে হাসু মিয়াকে হার মানতে হয়। বিদ্যার জোর সে বড় কঠিন জোর। অবশেষে নিতান্ত অনিচ্ছায় তাকে গুল নাহারের সাথে হাসপাতালে যেতে হয়। গুল নাহার জানতে চায় সন্তান না হওয়ার জন্যে কে দায়ী।
ডাক্তারী রিপোর্ট জানায়, সমস্যা হাসু মিয়ার। হাসু মিয়া যতটা না দুঃখ পেয়েছিল, তার চাইতে বেশি অবাক হয়েছিল। ছেলেদের সমস্যা থাকতে পারে হাসু মিয়ার জানা ছিল না। মেয়েদের সমস্যার করনে সন্তান হয় না, এটাই সে জানতো। অবশ্য এতে তার কোন দোষ সে দেখছে না। সেতো আর গুল নাহারের মত লেখাপড়া জানে না। সে গন্ডমূর্খ মানুষ। গণ্ডমূর্খ মানুষ পৃথিবীর অনেক কিছুই জানবে না এটাই স্বাভাবিক।
অতঃপর গুলনাহারও চলে গেলো। শুধু হাসনা বানু থেকে গেলো।
হাসু মিয়ার মাঝে মাঝে মনে হয় সে হয়তো কখনো কোন বড় ধরনের পুণ্য করেছিল, না হলে হাসনা বানুর মত মেয়ে তার কপালে জুটার কথা না। কিন্তু সেই বড় পুণ্যটা যে কি তা অবশ্য সে মনে করতে পারছে না।
আবার এমনও হতে পারে সে কোন পুণ্যই করে নি, তবু আল্লাহ তাকে এমন ভাল মনের একটি মেয়েকে তার স্ত্রী হিসেবে দিয়েছেন এর কারন তিনি রাহমানুর রাহীম। তার দয়ার কোন শেষ নাই। তিনি তার অতি পাপি বান্দাকেও দয়া করেন। তিনি হাসু মিয়াকে দয়া করেছেন।
আবার এমনো হতে পারে তিনি তার সিস্টেম ঠিক রাখার জন্যেই হাসু মিয়ার মত এক নাদান মানুষের সাথে হাসনা বানুর সাক্ষাৎ করিয়ে দিয়েছেন।
এই পৃথিবী চলে সিস্টেমের উপর। সেই সিস্টেম হল ভাল আর খারাপের মধ্যে বোঝাপড়ার সিস্টেম। হাসু মিয়ার মনে হয়, যদি পৃথিবীর সব ভাল মানুষ এক সাথে থাকে আর সব খারাপ মানুষ এক সাথে থাকে তাহলে সিস্টেমে বিরাট গন্ডগোল হয়ে যাবে। তাই এই সিস্টেম ঠিক রাখার জন্যেই ভালোর সাথে খারাপের আর খারাপের সাথে ভালোর ভাব হওয়াটা জরুরী।। এই জন্যেই বোধ হয় তিনি তার মতন নাদান মানুষের সাথে হাসনা বানুর ভাব জমিয়ে দিয়েছেন।
আল্লাহপাকের সিস্টেম বোঝা মানুষের কাজ না। হাসু মিয়া নিজের চিন্তা ভাবনায় অতিশয় বিরক্ত বোধ করল। জ্ঞানের কথা ভাবা তার মত নাদান লোকের কাজ না।
হঠাৎ তার সামনে একটা কালো ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ায়। হাসু মিয়া দেখে বোরকা পরিহিতা একটি অবয়ব তার সামনে দাঁড়ানো। এক পলক দেখে হাসু মিয়া দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। হয়তো কোন খরিদ্দার, সদাই কিনিতে এসেছে।
আপনার শরীর কি খুব খারাপ? ছায়ামূর্তি প্রশ্ন করে।
মাথা তুলে তাকায় হাসু মিয়া। তার কি হয়েছে। হাসনা বানুকে সে চিনতে পারে নি।
না, তেমুন খারাপ না। এই একটু ঝিমানি আসে আরকি। হাসু মিয়া বলে।
চাচীআম্মা, চাচাজানেরর শরীর খুব খারাপ। উনি মুখে না বললেও আমি বুঝি। আমি হেই সকাল থাইক্কা বলতাছি বাসায় যান, আমি দোকান সামাল দিমু নে। কিন্তু কেডায় শুনে কার কথা। হাসনা বানুকে দেখে মন্টু যেন হঠাৎ সাহসী হয়ে উঠে।
চলেন। হাসনা বানু হাসু মিয়ার হাত ধরে টানে।
কই?
ডাক্তারের কাছে। আইজকা আপনার রিপোর্ট আসব। ডাক্তার সাহেব আইজকা যাইতে বলছিল আপনারে।
হাসু মিয়ার মনে পড়ে। বাজারে এক ডাক্তার বসে। তার কাছে আজকে যাওয়ার কথা। গত এক মাস ধরেই যাচ্ছে। প্রতি বৃহস্পতিবার গিয়ে দেখা করে আসতে হয়। এক মাস ধরে যাচ্ছে। আজকে ষষ্ঠবারের মত যাবে। প্রত্যেক বার গাদা গাদা টেস্ট দিয়ে দেয়। রোগ ধরতে পারে না। হাসু মিয়া এসব বুঝে। প্রতি বার দেখায় ৪০০ করে ভিজিট। আর যত টেস্ট তত কমিশন। সে এসব বুঝে। সে নিজেওতো দোকানদার। সে বেচে চাল ডাল আর এরা বেচে ঔষধ-পত্তর। এই দুনিয়ায় সবাই দোকানদার। সবার একই ফিকির- লাভ, লাভ আর লাভ।
লাভ লোকসানের গোলক-ধাঁধাতেই মানুষের জীবন পার হয়ে যায়। মানুষ বুঝতেও পারে না।
হাসনা বানুর সাথে সাথে তার বেতাল শরীরটাকে কোনরকমে টেনেটুনে নিয়ে চলে হাসু মিয়া।
বাজারের ডাক্তারের চেম্বারের সামনে বিরাট ভিড়। দেশের স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো যাচ্ছে না তা বুঝে নেয় হাসু মিয়া। ভেজাল খেয়ে খেয়ে সবার কাহিল অবস্থা। সব কিছু ভেজাল। ভেজাল খাওন, ভেজাল বাতাস। ভেজাল কারীদের বিরুদ্ধে কিছুটা বিদ্রোহী হয়ে উঠে তার মন। ব্যাটারা মানুষের জীবন নিয়া খেলা করে – হাসু মিয়া মনে মনে বিড় বিড় করে। কিন্তু সেও কি অপরাধী না ? সেও কি মানুষের পরিশ্রমের ঘাম, রক্ত পানি করা উপার্জন নিয়ে খেলা করে না? তাতে কি? সে মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করে না। ওজনে একটু কম দেয় বৈকি। তবে সেটা তেমন কিছু না। এ টি এম শামসুজ্জামানের আক্টিং সে টিভিতে দেখে মাঝে মাঝে। সেখানে তার ডায়বেটিক হয়েছে, তিনি বলেন, খাইয়া মানুষ বাচে না, মরে! সুতরাং ওজনে কম দিয়ে প্রকারান্তরে সে মানুষের উপকারই করছে। নিজের সাথে নিজেই যুক্তি-তর্কের খেলায় সে বেশ আনন্দ পাচ্ছে।
তার আনন্দে ছেদ পড়ে তীব্র চিৎকারে। হাসু মিয়া পরিস্থিতি বুঝতে তৎপর হয়।
এক লোক হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে যাচ্ছে। তার চিৎকারের কারন যতটা না তার হাতের ব্যাথা, তার বেশি বোধ করি, তার সাথে সাথে চলা তার বঊটি। স্বামীর অহেতুক বিচিত্রধর্মী চিৎকারে সে তার হাসি চেপে রাখতে পারছে না। কোথায় স্বামীর দুখে বধু দুখী হবে তা না , উলটো মুখ চাপা দিয়ে হাসছে, ভদ্রলোকের চিৎকারের এটাই কারণ। এবং হাসু মিয়ার কাছে কারণটি যথেষ্টই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে। সে আড়চোখে বঊটির দিকে তাকালো। খুবই বেরসিক বঊ। হাসি তামাশার একটা সময়, সীমা থাকা দরকার। হাসু মিয়া বিরক্ত হয়। এবার হাসু মিয়া হাসনা বানুর দিকে তাকায়। একসময় হাসনা বানুও এরকম কমবয়সি ছিল। এরকম অবস্থায় সেও কি এমন করে হাসত? হাসু মিয়ার মনে হলো, তার যদি এরকম হাত ভেঙ্গে যায়, সে ব্যাথায় কাতর হয়ে থাকে আর হাসনা বানু মুখ চেঁপে হেসে যায়, এক জীবনে সুখের জন্যে এর বেশী আর কি কিছুর দরকার আছে?
দেখতে দেখতে সময় কেমন পেরিয়ে যায়। যেমন করে হাসনা বানুর বয়স বাড়ে , হাসু মিয়ার চুলে পাক ধরে, চামেলি আর গুলনাহার হাসু মিয়ার জীবনে চঞ্চল দোলা দিয়ে চলে যায়, তেমনি করে ডাক্তারের চেম্বারের লম্বা লাইন শেষ হয়ে হাসু মিয়ার সিরিয়ালও চলে আসে। এতক্ষণ ধরে যে সিরিয়ালের জন্যে অপেক্ষা, এখন যেন তার জন্যেই কিছুটা বিরক্তি বোধ করে হাসু মিয়া। ডাক্তরের চেম্বারে বেঞ্চের উপর দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে চারপাশের এই ছোট্ট পৃথিবীটাকে অনুভব করতে খুব একটা খারাপ লাগছিল না। কেমন যেন একটা ঘোর কাজ করছিল। হঠাৎ ঘোর ভেঙ্গে যাওয়ায় কিছুটা বিরক্ত হাসু মিয়া। লক্ষন খুব একটা ভালো না। একবার বিরক্তি লাগা শুরু করলে বিরক্তি বাড়তেই থাকবে। বিরক্তি বিরক্তি আনে।
ডাক্তারের চেহারাই বিরক্তি বাড়ানোর জন্যে যথেষ্ট। মোটাসোটা থলথলে শরীর, খর্বকায় মানুষ, তার উপর মাথা একেবারে সাহারা মরূভূমি। চামেলী হলে নির্ঘাত বলত, ব্যাটার দেখি ছাদে মাল নাই। ভারী বেয়াদপ মেয়ে ছিল চামেলী।
ডাক্তার একটা কাগজে, সম্ভবত প্রেসক্রিপশান, কি যেন লিখতে লিখতে নাম জানতে চাইল, হাসু মিয়া নাম বলল।
-বয়স?
-বয়সের কোন হিসাব নাই। তয় ৪০-৪২ হইব।
ডাক্তার একবার চোখ তুলে তাকালো।
হাসু মিয়া বিব্রত হলো। বলল, ডাক্তার সাহেব, আমার পাকা চুল, মুখ ভরা দাড়ি আর ভাঙ্গা শরীর দেইখা ভিড়মি খায়েন না। চুল পাকসে বাতাসে, আর শরীর ভাঙ্গসে... কেন ভাংসে ভিজিট দিয়া সেইটাই তো জানতে আসছি।
ডাক্তার হাসলেন। তার সেই হাসি তার মোটাসোটা খর্বকায় শরীর আর কেশহীন মাথা ছাপিয়ে কেমন যেন একটা দ্যুতি ছড়ায়, হাসু মিয়ার সব বিরক্তি উধাও হয়ে যায়। একটা মানুষের সকল অপূর্ণতা এত সহজে সামান্য হাসিতে ভুলিয়ে দেয়ার ক্ষমতা শুধু তারই আছে- যিনি সবার থেকে অনেক দূরে বসেও সবার সবচেয়ে কাছে থাকেন। হাসু মিয়ার দৃঢ় বিশ্বাস , ডাক্তারের এই হাসির জন্যেই তার বঊ তার প্রেমে পড়েছিলেন।
-আমি আপনার টেস্টের প্রথম রিপোর্ট দেখেই আপনাকে প্রেসক্রিপশন দিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু দেইনি। এর কারন আসলে তেমন কিছুই না। ২য় টেস্টটা ক্রসচেক করার জন্যে দিয়েছিলাম।
-কি চেক?
-ক্রসচেক। দুটো আলাদা রিপোর্টের রেজাল্ট একি রকম হয় কিনা তা পরীক্ষা করার জন্যে।
-বুঝলাম। আপনাদের নিজেদের রিপোর্টের উপরই আপনার ভরসা নাই। হাসু মিয়ার কন্ঠে তাচ্ছিল্য খেলা করে।
ডাক্তারের মুখে সেই অদ্ভুত দ্যুতি খেলা করে।
-কিন্তু আস্তে আস্তে আমার অবজারভেশান মানে নজর অন্য দিকে ধাবিত হয়। এজন্যে আমি আপনাকে পরের টেস্টগুলি করতে বলি।
এতক্ষনে হাসনা বানুর কথা শোনা যায়। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে, ডাক্তার সাহেব কি হইসে, জটিল কিছু?
-হুম। ডাক্তার সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
হাসনা বানুর মুখ শুকিয়ে আসে। হাসু মিয়া নির্বিকার। একদমই কি নির্বিকার?
ডাক্তার বলতে থাকেন, আপনার শরীরের সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সচল, কিডনী, হার্ট, লিবার, সব ঠিক আছে, কোথাও কোন ডিফেক্ট নেই। কোন সিস্টেমে গন্ডগোল নেই...মেডিকেল সায়েন্স বলছে আপনি শতভাগ সুস্থ.... কিন্তু ...
-কিন্তু কি ? হাসনা বানু বলে।
-আপনার সাথে আগের অ্যাপয়েন্টমেন্টগুলোতে কথা বলে যা বোঝা গেলো, আপনি তেমন কোন মানসিক অস্থিরতা বা পীড়ায়ও ভুগছেন না। আপনাদের সন্তান না হওয়ার জন্যে একটা মানসিক আক্ষেপ হয়তো আছে কিন্তু তার জন্যে হওয়ার কথা না।
হাসু মিয়ার মাথা ধরেছে। ব্যাটা এত বাহানা করছে কেন? বলে দিলেই তো হয়, মিয়া তোমার ক্যান্সার হইসে, আয়ু আছে তিন মাস। যা খাইতে মন চায় খাইয়া লও।
-ডাক্তার সাব, আমার কি মরণঘাতী কোন রোগ হইসে, ক্যান্সার? আয়ু আছে তিন মাস? কচুর লতি দিয়া চিংড়ী মাছ আমার খুব পছন্দের। আমার বিবি খুব ভালো রান্ধে। কাঠালের বিচি দিয়ে মুরগির গোশত, এইটাও মাশাল্লাহ। তারে কখনো বলি নাই। আজকে বললাম। আয়ু আছে তিন মাস। এখন আর গোপন রাইখা লাভ কি ? কি বলেন?
ডাক্তার হাসেন না। তিনি কিছুটা গম্ভীর।
হাসনা বানুর কান্না পাচ্ছে। হাসু মিয়াকে তিনি বড় ভালোবাসেন। তার কিছু হয়ে গেলে সে কেমনে থাকবে?
-আমি আপনাকে একই টেস্ট মোট ছয় বার করতে দিয়েছি । প্রত্যেক বারই আপনার সব কিছুই নরমাল এসেছে। শুধু একটা জিনিসই প্রতিবারই ভিন্ন রকম এসেছে। তবে এর কারণটা আমি খুজে পাচ্ছি না। মেডিকেল সায়েন্স বলছে আপনি শত ভাগ সুস্থ। অথচ.....
-অথচ কি? হাসু মিয়া এবার বিরক্তি আর গোপন রাখতে পারে না।
-প্রতি বারই আপনার ওজন কমেছে। এবং আশ্চর্জনকভাবে আপনার ওজন কমেছে একটা নির্দিষ্ট আনুপাতিক হারে, একটা প্যাটার্ন মেইনটেইন করে।
হাসু মিয়া কিছু বুঝতে পারে না। একবার ডাক্তারের দিকে তাকায়, একবার হাসনা বানুর দিকে।
-ওজন কমাটা যতটা না আশ্চর্জজনক, তার চাইতে বেশি আশ্চর্জজনক ওজন কমার হার। আপনি যখন প্রথম বার আমার কাছে এসেছিলেন তখনকার ওজন আর আজকের ওজন আমি অত্যন্ত সুক্ষভাবে গানিতিক হিসাব নিকাশ করে দেখেছি। অংকের হিসাব বলছে, আপনার ওজন প্রতিদিন একই হারে কমছে।
হাসু মিয়া ঢোক গিলে। তার এক গ্লাস পানি খেতে ইচ্ছে করছে। সে কি ডাক্তারকে বলবে যে তার গলা শুকিয়ে গেছে, সে পানি খেতে চায়? নাকি হাসনা বানুকে বলবে।
ডাক্তার বলে চলে, অথচ আপনার ছয়টি টেস্টের রিপোর্টে কোন পার্থক্য নেই, কোন সমস্যা নেই। এর কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। তবে এভাবে চলতে থাকলেতো আপনি অচিরেই ওজনহীন একটা মানুষে পরিণত হবেন। পদার্থবিদেরা একে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন জানি না। কিন্তু অংকের হিসাব তাই বলছে। আমার কাছে এর কোন ব্যাখ্যা নেই যদিও। আবার আমার ধারনা ঠিক নাও হতে পারে।। পুরো ব্যাপারটাই একটা কাকতালীয় ব্যাপারও হতে পারে। তবে আমি আপনার টেস্টগুলো চালিয়ে যাবো, সব খরচ আমার। আমার এক বন্ধু আছে, বিশাল বড় গণিতবিদ, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগেও এক অধ্যাপক আমার বন্ধু – আমি দুজনের সাথেই কথা বলব। এর ব্যাখ্যা আমার চাই।
হাসু মিয়ার কলিজা নড়ে উঠে। তার কাছে যে ব্যাখ্যা আছে।
সে ওজনহীন মানুষ হয়ে গেলে হাসনা বানুর কি হবে। হাসনা বানুর জন্যে হলেও তাকে বাঁচতে হবে। কাঁপা কাঁপা হাতে সে পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে।
ওপাশ থেকে মন্টুর গলা শোনা যায়।
-হ্যালো
-মন্টু, বেচাকিনি কেমন চলতাছে?
-চাচাজী, সব ঠিক আছে।
-মাপ ঠিক ঠাক মতন দিতাছস তো?
-চাচাজী, আপনের ট্রেইনিং! সব ঠিক আছে। কেজিতে ১০০ গ্রাম কইরা কম। কোন ভূল নাই।
-হোন, কেজিতে ২০০ গ্রাম বাড়ায়া দে।
-কি কন?
-যা কইতাছি কর। প্রচন্ড জোরে মন্টুকে ধমক লাগায় হাসু মিয়া।
সেই ধমকে হাসনা বানু কেপে উঠে, ডাক্তার অবাক হয়।
বাইরে থেকে অপেক্ষমান রোগীরা উঁকি ঝুঁকি মারছে। হাসু মিয়ার সেদিকে তাকানোর সময় নেই । সে হাসনা বানুর হাত ধরে তাকে নিয়ে ছুট লাগায়। মন্টুটা ঠিকঠাক মত দিচ্ছে কিনা দেখতে হবে। হাসনা বানুর জন্যে হলেও তাকে বাচঁতে হবে।