মধ্যরাত কবি একা হেঁটে যাচ্ছে। হইজনের বাঁশ বাগানের মাঝদিয়ে। বাঁশ বাগানের ছোট নালার উপরে একটি ছাতিম গাছ। বহুদিন ধরে এই ছাতিম গাছের পাশে মানুষের মাথার একটি খুলি পড়েছিল। মাথার কপালের উপর অাঁাকা বাঁকা বিভিন্ন ধরনের লেখা ছিল।
কবি মাথা দেখে ভাবতো মানুষটি খুব পাপি ছিল। কারণ ছোট বেলায় গরুজনেরা বলতেন পাপিদের মাথার কপালে তার পাপের কথা লিখা থাকে। রাতের নিঝুম হালকা বাতাসে বাঁশ বাগানের ভেতর থেকে শন শন শব্দ শুনা যাচ্ছিল।
কবি থমকে দাঁড়ায়। একটি রূপসী সাদা শাড়ি পরা মেয়ে আস্তে আস্তে কবির দিকে হেঁটে আসছে, তারপর ধীরে ধীরে কবির পাশে এসে দাঁড়ালো সে। মেয়েটি কবিকে বললো ভয় পেয়োনা, তুমি তো কবি, তোমার জীবনের সামনেই তো সব ঘটনা এসে দাঁড়াবে।
আমার নাম সুলতানা। বহুকাল পূর্বে থেকে আমি এখানে বাস করি। এই ছাতিম গাছই আমাকে ছায়া দেয়। ছাতিম গাছটি হয়তো বেশিদিন বাঁচবে না তাই আমাকেও হয়তো কিছুদিরে মধ্যে অন্যত্র চলে যেতে হবে।
জানো কবি আজ রাতে তেমন ঘুম হচ্ছেনা শুধু এপাশ ওপাশ করতে এতোটা রাত কেটে গেলো। আশ পাশের বাড়ি গুলোতে ক্ষীণ আলো জ্বলছিল, অসুস্থ মানুষের কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ইছামতি নদীর তীরে মনে হচ্ছে এই বুঝি আলো জ্বলে উঠলো আবার এই বুঝি আলো নিভে গেলো।
গভীর রাত্রির এই জীবন গুলোর রূপ দেখে আমার মৃতু্যর কথা মনে হলো। জীবন আসে ঘুরে বেড়ায় রূপ বদলায় আবার চলে যায় এ এক বিস্ময় মর্মভেদ অচিন ঈশ্বরের খেলা। মনে হয় সমগ্র বিশ্ব জগত সৃষ্টি কর্তার কিন্তু সৃষ্টি কর্তা বিশ্বজগতের নয়।
চিন্তা করছিলাম আমার জীবনের সব কথা গুলো মানুষের জানা দরকার। তাই তোমাকে দেখে ছুটে এলাম। জানো কবি এই মাথার খুলিটি কার? যে খুলিটি বহুদিন ধরে এই ছাতিম গাছের নীচে পড়ে আছে। সে এক মমর্ান্তিক ঘটনা। অনেক অনেক দিন আগের কথা। আমি তখন সপ্তম শ্রেণীতে লেখা পড়া করতাম। মা বাবা আমাকে খুব ভালো বাসতো। ভেবেছিলাম লেখা পড়া শেষ করে বড় কোন চাকুরি করবো। আমার ছোট একটি ভাই ছিল তাকে মানুষ করবো। সামর্থ হলে গরীব প্রতিবেশীদেরকে দেখবো। দিন যায় রাত যায় আমি হাঁটতে থাকি আর ভাবতে থাকি জীবন নিয়ে। এরই মাঝে দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। একদিন আমি স্কুল থেকে আসার আগেই কারা যেন বাবা মাকে ধরে নিয়ে গেছে। ছোট ভাইটির মৃত দেহ বাড়ির ভেতরে পড়ে ছিল। আমি পাগলের মতো নিজ বাড়িতে ছুটোছুটি করতে লাগলাম। বাবা মাকে খুঁজতে লাগলাম। গ্রামে কোন লোকজন নেই।
কার কাছে সাহায্যে নিবো। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় এই বাঁশ বাগানে ছাতিম তলায় এসে পেঁৗছাই। হঠাৎ এই পথে কারা যেন পাকিস্থান জিন্দাবাদ, পাকিস্থান জিন্দাবাদ, বলে শ্লোগান দিতে দিতে আমার দিকে আসলো এবং আমাকে বলল তুই এখনো বেঁচে আছিস? মরিসনি শালি! তোর বাবা মা ভাইকে খুন করেছি আর তুই এখনো বেঁচে আছিস এই বলে ওরা আমার গলা টিপে ধরলো আর আমি তখন জ্ঞান হারালাম।
তার পরে আমি এই ভাবে বেঁচে আছি। কবি তুমি এই পথ দিয়ে আসার কিছুক্ষণ পূর্বে আমিন প্রামানিক, আবু প্রামানিক, আলো রায়, আবু কামার সহ অনেকেই হেঁটে গেছে। ওরা সবাই অনেক বয়সি তাই আমার কথা গুলো ওদেরকে বলিনি। আবুল কাশেম আর নুরুল ইসলাম সামাজিক বিষয় নিয়ে উচ্চস্বরে কথা বলতে বলতে একজন পাল পাড়ার দিকে এবং একজন সিংগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে চলে গেল। ওদেরকে কিছু বলিনি। তুমি তরুণ কবি তাই তোমাকে সব ইতিহাস জানানো দরকার। মাঝ রাত ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে নতুন সকালের দিকে। অতীন্দ্রিয় দৃষ্টিতে সৃষ্টি কর্তার রূপের মধ্যে দিয়ে মহাবিশ্বের রূপ বিরাজ করছে এক অশেষ, অক্ষয় ও অফুরন্ত প্রেমের চিরন্তন পথে। পরম সত্তা স্বয়ং একাধারে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়বস্তু, সব কিছু মিলে এক। চিরন্তন চেতনার সৃষ্টি প্রক্রিযার কাজ অবিরাম ও অবিরত ভাবে চলছে।
কবি দাঁড়িয়ে আছে অশরীরী অাঁধারের বুকে। কিছুক্ষণ পরেই সুলতানা অাঁধারের সাথে মিশে যাবে। জীবনের ব্যর্থতা বুকে নিয়ে সুলতানা কবিকে বলে এই কষ্টের জীবন ইতিহাস তুমি জাতিকে জানিয়ে দিও। প্রিয়তম স্বদেশের বুকে যেন আমাদের নাম লিখা হয়। বালু চরের প্রিয় নদটি আমাকে এখনো ডাকে, আমার স্বপ্নেরা এখনো কথা বলে। নিদ্রাহীন চোখের তারায় এখনো কষ্টরা ঘুরে বেড়ায়। ব্যথিত জীবনের ব্যর্থতা বুকে নিয়ে আমার কথা গুলো তোমাকে বলছি।
কবি বলে, ভালোবাসা আকড়ে ধরে তুমি বেঁচে থাকবে এই তোমার প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। বন ভূমি ফসলের মাঠ তোমার মমতায় চেয়ে থাকবে। শ্যামল এক কিষাণ তোমার অপেক্ষায় মাটিতে আবাদের বীজ ছড়াবে। তুমি বেঁচে থাকবে আমাদের মাঝে তোমার প্রিয় মাটিতে। কথাগুলো শুনে ভাবতে ভাবতে কবি নিজ বাড়ির পথে হেঁটে যায় এবং বাড়ি পেঁৗছে খাওয়া দাওয়া শেষে কিছু লেখার কাজ করে ঘুমাতে যায়। গভীর ঘুমে কবি মগ্ন। শেষ রাতে কবি স্বপ্নের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে ছাতিম গাছের নীচে যায় এবং দেখতে পায় যে সুলতানা এক অপরূপ সাজে দাঁড়িয়ে আছে।
তার কষ্টের দেহ থেকে চন্দ্রণের ঘ্রাণ ভেসে যাচ্ছে। শ্রীমতি সরল সুন্দর পথে। তখন কবির স্বপ্ন ভরা দুটি চোখের তারায় ইতিহাস ঘুরে বেড়াচ্ছে। কবি চেয়ে চেয়ে দেখছে সুলতানাকে। হঠাৎ কারা যেন সাদা কাপড়ে আকাশ থেকে নেমে এলো। মনে হচ্ছে একজন নারী একজন পুরুষ সাথে একজন কিশোর। সুলতানা কবিকে দেখে হেসে ওঠে এবং বলে এরা আমার একাত্তুরে হারিয়ে যাওয়া বাবা মা আর ছোট ভাই। আমাকে নিয়ে যেতে এসছে। কবি তুমি যাবে আমাদের সাথে?
কবির খুব ইচ্ছে সুলতানার সাথে যাওয়ার। ভালোবাসা আকড়ে ধরে কবি সুলতানার কাছাকাছি যেতে চায়। বনভূমি ফসলের মাঠ নদীর ঢেউ বসন্তের দক্ষিণ বাতাস কবিকে স্বাগত জানায়।
জীবনের স্বপ্ন সুখে কবি যেন এক নতুন কিষাণ। মাটিতে ঘুরে ঘুরে কিষাণীকে খুঁজছে। তৃষ্ণার অাঁধারে ক্ষত বিক্ষত মন হঠাৎ নড়ে ওঠে আদীম গন্দমের ভুলে। কিশোরী সুলতানার সরল চোখ দূরে সরে যেতে থাকে। তখন কবির বুকের ভেতর হাহাকার জাগে।
ক্ষুধাকাতর স্বপ্নহারা মানুষের আহাজারীতে। সে জেগে ওঠে এক জীর্ণ সকালে এবং হাঁটতে হাঁটতে ছাতিম গাছের নীচে যায় এবং চোখ মিলে দেখে, মাথার খুলিটি পড়ে আছে। কবি সযত্নে মাথার খুলিটি নিয়ে যায় নদীর তীরে এবং সেখানে ভালো করে ধুয়ে পবিত্র এই মাটির মমতায় মাথার খুলিটিকে মৃত্তিকার নীচে ধর্ম মোতাবেক ঘুমিয়ে দেয়...।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সূর্য
অশরীরি একটা ঘ্রাণ ভেসে আসছে তবু ভয় জাপ্টে ধরছে না। একটা মমতা একটা ভালবাসা জড়িয়ে নিচ্ছিল। গল্পের বুনন এবং সবকিছুই ভাল লাগলো। অনেক সুন্দর একটা গল্প।
আহমেদ সাবের
অতিপ্রাকৃত ঘটনা। একাত্তরে সুলতানা বাবা, মা আর ভাইকে হারিয়ে নিজেও একদিন নিহত হয়। ছাতিম তলায় পড়ে থাকা তার মাথার খুলি কবিকে বলে যায় তার জীবনের গল্প। লেখার ষ্টাইল বেশ সুন্দর আর সাবলীল। ভালো লাগলো গল্প।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।