মুক্তিযোদ্ধা

মুক্তিযোদ্ধা (ডিসেম্বর ২০১২)

অভিমন্যু সোহম
  • ১০
  • 0
  • ২৮
তিনদিক থেকে খানসেনারা ঘিরে ফেলেছে। একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। সব রকম হিসেবই বলছে মৃত্যু নিশ্চিত। তাও আজ কেন যেন তার ভয় লাগছেনা।
মায়ের সাথে শেষ যেদিন দেখা হল সেদিনের কথা মনে পড়ছে। সেদিন কিছু বলেনি সে। লজ্জায় মাথা নিচু করে চলে এসেছিল। আহা, আজ যদি মার সাথে একবার দেখা হতো।
---------------------
জীবনে কোনদিনই সাহসী ছিল না শফিক। নিয়ম মেনে সবকিছু করত। ভীষণ ভয় পেতো সবকিছুকে – অন্ধকার রাত, কবরস্থানের ভুত, ছেলেধরা, পাশের বাড়ির জয়নাল চাচা। সবচেয়ে বেশি ভয় পেত মৃত্যুর। আগরবাতির গন্ধ, আতরের সুবাস সহ্য করতে পারতোনা।
মা তাকে শেখাতে চেয়েছিল মাথা উঁচু করে বাঁচতে। জীবন তাকে শিখিয়েছিল মাথা নিচু করে গা বাঁচাতে। মুক্তিযোদ্ধা হতে কখনো ইচ্ছে করেনি শফিকের। ইউনিভারসিটির হাসান, সাদেক, খোকন যখন পালিয়ে যেতে চাইলো, হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল ওদের কথা। দু-লক্ষ সশস্ত্র প্রশিক্ষিত সৈনিক একদিকে, অন্যদিকে থ্রি-নট-থ্রি হাতে একদল আনাড়ি তরুণ। হিসেব মিললে তো যাবে মুক্তিযুদ্ধে!
পাশের বাড়ির হরিকাকুকে যখন মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছিলো, তখন শফিকের কোন অবিচারের কথা মনে হয়নি। খুশি হয়েছিল বাবাকে নিয়ে যায়নি বলে। মিলাদ মুনশি যখন পরি আপা আর পারুলকে মিলিটারিদের জিপে তুলে দিল, তখনও ভয়ে কিছু বলতে পারেনি সে। ছোট বোন তুলি তো বেঁচে গিয়েছিল।যশোরের বাস থেকে যখন করিম চাচাকে নামিয়ে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলল, তখন সবাই কেঁদেছিলও। কিন্তু কেউ বাধা দেয়নি। রাস্তার মোড়ে যখন ফুলপ্যান্ট খুলতে হয়েছিলো, খানসেনাদের প্রতি কোন ঘৃণা হয়নি তখনো, নিজের ওপরই লজ্জা হয়েছিল।
কিন্তু যখন যশোরের কাছে সেই অন্ধকার গ্রামে তুলি ম্যালেরিয়ায় ভুগে কাপতে কাপতে মারা গেলো, তখন বুকের ভেতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছিল প্রথমবারের মত। বাবা ওষুধ আনতে গেলো বাজারে, আর ফিরল না। কি এক গভীর হীনমন্যতার তোড়ে শফিক ঘর থেকে পালিয়ে গেলো সেদিন, সে নিজেও জানে না। দুলাইনের একটা চিঠি লিখে গেছিলো সেদিন, “মুক্তিযোদ্ধা হবো।“
লজ্জা, ঘৃণা আর ক্ষোভের একটা মিশেল ধীরে ধীরে কবে যে প্রতিশোধের আগুন হয়ে জ্বলে উঠেছিলো, তা সে নিজেও জানে না।
কিভাবে বর্ডার পার হয়ে ট্রেনিং নিল, সে আরেক ইতিহাস। শফিক সাহসী না হতে পারে, কিন্তু সাহসী মানুষ চিনতে ভুল করেনি।
হাসান – ঢাকা ইউনিভারসিটিতে পড়ত। বাইরে কোথায় যেন স্কলারশিপ পেয়েছিলো। অনায়াসে চলে যেতে পারতো। কিসের টানে যুদ্ধে চলে এলো। যুদ্ধ শেষ হলে নাকি সে নারায়ণগঞ্জে তার বাড়ির কাছে একটা স্কুল দেবে।
হারুন। করতোয়ায় মাছ ধরত। বউকে বাপের বাড়িতে রেখে পালিয়ে এলো যুদ্ধ করতে। যুদ্ধ শেষ হলে সে নাকি বউকে নিয়ে ঢাকা দেখতে যাবে।
মকবুল, বয়স মাত্র বারো। প্রাণ হাতে করে প্রতিদিন পাকিস্তানি বাঙ্কার রেকি করে আসে।
মধু কমান্ডার বলতেন প্রতিদিন, “সব বাঙ্গালির ভেতরেই একটা বাঘ আছে, সেই বাঘ একদিন জাগলে, পাকি কুকুরেরা পালানোর পথ পাবেনা।“ মধু কমান্ডার। বাঘের মত দ্যুতি ছিল চোখের ভেতর।
শফিক কোনদিন তাদের চোখের দিকে তাকাতে পারেনি সরাসরি। সেই চোখের ভেতরে যে অসীম বিশ্বাসটুকু ছিলো, তার ছিটেফোঁটাও তার মনে ছিলনা। শফিক জানতো, এ যুদ্ধে জয় সম্ভব নয়। কিন্তু তাতে কোন যায় আসে না। কিছু পাকিস্তানির মৃত্যু তার হাতে লেখা ছিল। আর বেশি কিছু সে চাইতনা। খুব সাবধানে যুদ্ধ করতো সে। বিপদ বুঝে পিছু হতে আসতো। যতদিন বাঁচবে, আরও কিছু হানাদার মারতে পারবে।
কীর্তিনাশা অপারেশনের দিন সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসে গেছিলো। জ্বর একটু সারতেই মায়ের কথা মনে পরছিল বারবার। গ্রামের খুব কাছেই ক্যাম্প পরেছিল। কমান্ডারের পারমিশন নিয়ে রাতের অন্ধকারে গেছিল মার সাথে দেখা করতে।
শত চেষ্টা করেও সে ভুলতে পারেনা সেই দিনের কথা।
বারান্দায় বসে ছিলেন মা একা একা। শফিক দাঁড়িয়ে ছিল উঠনের এক কোনে। দূর থেকেও মার গায়ের থেকে বকুল ফুলের মত একটা গন্ধ ভেসে আসছিলো। মা’র প্রায় প্রাণহীন চোখে একটা আলো ফুটে উঠেছিল যখন বলেছিলেন, “মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিস তুই? দেশ স্বাধীন হবে?”
মাথা নিচু করে পালিয়ে গেছিল শফিক। সত্যিই তো, কিসের মুক্তিযোদ্ধা সে? প্রতিশোধের নেশায় গেছিলো যুদ্ধ করতে। যুদ্ধ করেছে তাতো নিজের জন্য। কোন মুখে সে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে? মুক্তিযোদ্ধা হবার কোন যোগ্যতা ছিল তার কাছে? সাহস? স্বপ্ন? মধু কমান্ডার বলে, সব বাঙ্গালির ভেতরেই একটা বাঘ লুকিয়ে আছে। তার বাঘ কবে জেগে উঠবে?
-----------
কিছুক্ষণ আগেও ক্যাম্পে মেঝেতে শুয়ে কথাগুলো ভাবছিল শফিক। হঠাৎ মকবুল দৌড়াতে দৌড়াতে এলো। মিলিটারি ক্যাম্পের খবর পেয়ে গেছে। মিনিট ত্রিশেকের মধ্যেই ধরে ফেলবে তাদের। কভার দেবার জন্য দরকার কাউকে। নয়তো কেউ পালাতে পারবেনা।
“কেউ কি সুইসাইড মিশন এর জন্য ভলান্টিয়ার করতে চায়?” মধু কমান্ডার জিজ্ঞাসা করলেন।
আশ্চর্য হয়ে শফিক লক্ষ্য করলো, ওর হাত আপনাআপনিই উঠে গেছে।
“তুমি সত্যিই থাকতে চাও?”
দৃপ্ত কন্ঠে উত্তর এলো, “হ্যাঁ চাই।“
“রাস্তার পাশে ঘাসের ভিতর লুকায় থাকবা। চোখের সাদা না দেখা পর্যন্ত গুলি করবা না। বারস্ট ফায়ার করবা। আধা ঘণ্টা আটকায় রাখতে পারলেই হবে”।
হাসান, রাশেদ, হারুন, একে একে জড়িয়ে ধরে তাকে।
“মাকে আমার খবরটা দিবেন।“ কমান্ডারের চোখে প্রথমবারের মত চোখ রেখে বলে সে।
কমান্ডার একবার মাথা নাড়ে। রাতের অন্ধকারে মিশে যায় সবাই।
ওরা আসছে। খাকি রঙের পোশাকে একদল বুনো কুকুর। শফিক অপেক্ষা করে। আজ আর তার ভয় লাগছেনা।
কোত্থেকে যেন বকুল ফুলের গন্ধ ভেসে আসে। ফিসফিস করে কে যেন তাঁকে জিগ্যেস করে, তুই কি মুক্তিযোদ্ধা হতে পেরেছিস?
শফিক হাসে। স্টেনগানের গুলির মুহুর্মুহু শব্দের মাঝে প্রতিধ্বনিত হয় একটি গর্জন – “জয় বাংলা।“
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তাপসকিরণ রায় ভাই অদ্ভুত সুন্দর লাগলো গল্পটি আমার.নায়কের চরিত্রটি আপনি সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে ওঠাতে পেরেছেন.তবে মাত্র নয়টি মন্তব্য দেখলে খুব খারাপ লাগে.লেখক পাঠকদের সঙ্গে পরিচিত হলে তবেই আপনার পরিচয় সবাই পাবে.ধন্যবাদ,শুভেচ্ছা রইলো.
আহমেদ সাবের সবাই কি সাহসী হয়? একজন ভীতু শফিক, যে "স্কলারশিপ পেয়েছিলো। অনায়াসে চলে যেতে পারতো।", কিন্তু "সব বাঙ্গালির ভেতরেই একটা বাঘ আছে" তাই হয়তো একদিন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেল। তারই অনন্য উপাখ্যান চমৎকার একটা গল্প। বেশ ভালো লাগলো।
Lutful Bari Panna সোহম আনি একটা গল্প লিখেছেন, আমারটা কবিতা বলা যায় কিনা সন্দেহ আছে। পদ্য বলাটা জুৎসই হবে। তবু একবার পড়ে দেখে বলবেন, কোন মিল পান কিনা? সে যাক মুখে কিছু না বলে এমন আবেগী লেখায় কাজের কাজটুকুই করে যাচ্ছি।
মিলন বনিক সুন্দর..চমত্কার গল্প...অল্প কথা আর বুনন গল্পটিকে অসাধারনত্ব এনে দিয়েছে...অনেক ভালো লাগলো....
বশির আহমেদ অসাধারণ ! শুভ কামনা রইল ।
শাহ আকরাম রিয়াদ শেষ দিকটায় আবেগে ডুবে গেলাম.... খুব ভাল লাগল। শুভকামনা রইল। (অফ লাইনে পঠিত)
সূর্য এত এত সাহসী হাসান হারুন মকবুল আর মধু কমান্ডারের প্রভাব ছাড়িয়ে গল্প আমাকে টেনে নিয়ে গেল শফিকের ভেতরে। একেবারে আত্মাটা যেখানে থাকে। একটা চরিত্রের দোষগুন বলে কয়ে তাকে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় তার ষোল আনাই শফিকের বেলায় সফল। গল্পটা অনেক ভাল লাগলো।
আজিম হোসেন আকাশ ভাল লাগল। ধন্যবাদ আপনাকে।
এশরার লতিফ ভালো লাগলো গল্পটি...শুভেচ্ছা...
অনেক তাড়াহুড়ো করে লেখা। আপনার ভালো লেগেছে বলে আমারও ভাল লাগলো।

০৪ অক্টোবর - ২০১২ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪