মনে পড়ে ছোট বেলায় ইচ্ছে মত ঘুরে বেড়াতাম।একবার নদীর পার দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে দেখে ছিলাম,মাছ ধরার অনেকগুলি জাল রোদ্দুরে শুকোতে দেওয়া। মাছ ধরার পরে হয়তো ওগুলো ধুয়ে টুয়ে মেলে দিয়েছে নদীর পারেই।হঠাৎ নজরে পড়েছিল,জালের ফাঁসে ছোট একটা মাছ তখনও আটকে রয়েছে।বেচারা গলা ফাঁসিয়ে আকাশের দিকে মুখ উঁচিয়ে তাকিয়ে আছে। আরে,মাছটা কি বেঁচে আছে না কি?না,নড়ছে চড়ছে না যখন,তখন নিশ্চয় অক্কা পেয়েছে।
জেলেদের কাউকে কাছে ভিতে দেখলাম না,শূন্যে ঝোলা,জালে ফাঁসা মাছের দিকে এগিয়ে গেলাম।মনে মনে আনন্দ হল,মাছটাকে আমি চিনি,পুঁটি মাছ!রোদ্দুরে সিটকে প্রায় সুটকো হয়ে আছে--শুঁটকি যাকে বলে--নাক কাছে নিয়ে শুঁকতে গেলাম,হ্যাঁ,গন্ধ তৈরি হচ্ছে--দূর থেকে শুটকি মাছের বাজার থেকে যেমনটা গন্ধ পাই।
বড় হয়ে বিয়ে হওয়ার কিছু দিন গড়িয়ে যাওয়ার পর ওই মাছটার কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ত--শ্বশুর বাড়ি আর নিজের বাড়িতে কখনও মিল খাওয়াতে পারতাম না।মাঝে মাঝে মনে হত যে আমার অবস্থাও ওই ঝুলে থাকা মাছটার মতই হয়েছে--মাকে ডান দিকে ফেরাই তো বৌ বাম দিকে ফেরে।শ্বশুর বাড়ির কথা টানলে নিজের বাড়ির লোকেরা গোঁত খায়।এও দেখি এক ফ্যাসাদ!প্রতি নিয়ত এমনি ধরণের ঘটনায় যেন বেতাল হয়ে পড়ছিলাম।আমার ইচ্ছে দেখি পদে পদে ঝাড় খাচ্ছিল।মাছটা তো মরে সব ল্যাঠা চুকিয়ে দিয়ে শুঁটকি হয়ে ছিল--টাল মাটাল ভাবনার তার বালাই ছিল না,সুখ দুঃখের নজরিয়া কোথায় থাকবে তার!কি সুন্দর গলায় ফাঁস নিয়ে আকাশ মুখো হয়ে ঝুলে ছিল!চিন্তা নেই,ভাবনা নেই, বোধগম্য নেই,বাধা বিঘ্নের ধার ধারা নেই--কেমন নিশ্চল নিশ্চিন্ত!আমাদের জ্যান্ত মানুষদের হয়েছে যত পদে পদে জালা! কখনও মনে হয়,মরে গিয়ে পঞ্চত্ব প্রাপ্তিতে অনেক লাভ আছে--অন্তত সমস্ত জাগতিক ফ্যাঁকড়াগুলি ছুটে যায়।
অবশ্য গভীরে ভাবতে গেলে এটাও খারাপ লাগে--আমি নেই--কিছু নেই...অস্তিত্বহীন,এই জল স্থল নভ: কিছু নেই—সব অন্তহীন!ধূত ছাই,এ সব হল কাব্যিক ভাবনা।এখন বলে আমার আবস্থাটা এক মুড়ো ঝাঁটার ডাস্টবিনে পড়ে থাকার মত—শুষ্কম কাঠ্যম তিষ্ঠতি অগ্রে--সমস্ত ভাব ভঙ্গিমা গুয়ে গোবরে ঘুঁটে যাওয়ার মত।না,না,ওই মরা মাছের মত,মুড়ো ঝাঁটার মত পড়ে থাকা যাবে না--তার চে তো সংসারের কোন্দল ভালো--হাস খেল গান গাও ...
যদিও জানি সবটা ভালো জিনিস লাগাতার হয় না--দিনের মনোব্যথা তাই রাত্রির বিবরে মেখে রাখতে হয়।আর রাতের সুখালাপ দিনের প্রলাপে ভাঙি--ইচ্ছে করছে তবু চলুক সংসার। লালে ঝোলে মেখে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে--দাঁড়িয়ে বসে গড়িয়ে তবু হোক না দিনপাত।
আবার এক দিন মনটা খারাপ হয়ে গেল।আরে দুর--কর্তব্যের কাঁথায় আগুন!রাগের মাথায় বলে ফেললাম বটে,প্রকাশ্যে বললে ঝামেলার আর অন্ত নেই।
এক দিন দেখি বৌ আমার ঘরের কোনে বলে কেঁদে ভাসাচ্ছে! উদ্বেগ নিয়ে উঠে গেলাম ওর পাশে--চোখের সামনে কান্না দেখলে অনিচ্ছাতেও নিজের কান্না কোথা থেকে যেন ছুটে আসে--মনের কোন্ জাগা গলে যে চোখে জল আসে কে জানে ! তবে এক দিকে ভালো,আমার ধরা গলা আর বাষ্প চোখ দেখে বৌয়ের চোখের জল পড়া থামে,গাল বাওয়া জল দু হাতে মুছে বড় করুণ সুর নিয়ে বলে ওঠে,ওগো ! তুমি কাঁদছ কেন?
তাই তো,কারণ তো খুঁজে দেখি নি!মুহূর্তের মধ্যে আমার ভেতর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ঘটে গেল,ঝোপ বুঝে ঠিক কোপটা মারতে পারলাম,ন্যাকা ন্যাকা সেজে বললাম,তোমার কান্না আমি দেখতে পারি না,গো !
আপাতত ইচ্ছে পূরণ হল,বৌ আমার গলে গলে স্বামীর দুঃখের সহভাগিনী হয়ে আঁচল দিয়ে ঘষে নিলো আমার চোখ গলা গালের শুকনো জলটুকু।
যাক,আপাতত ঠেলা সামলানো গেল,ভাই ! রাতের বিছানায় তারপর দেখবো ঠেকা দেবার যন্ত্রপাতি কি কি আছে !
মা,বৌ ছাড়া আমায় নিরালায় পেয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, তপন,বৌ তোর কানে কিছু লাগিয়েছে নাকি রে?
--কৈ,না তো!নির্বিকার বলে উঠলাম আমি।
মা আমার মুখের চেহারা পরখ করে নিলেন,সন্দেহের মেঘ তাঁর চোখে মুখে ঘনীভূত দেখে আমি আমার মুখটাকে প্রাণপণে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম।
--বৌমাকে বুঝিয়ে বলিস,আমি যা বলি,তা তোদের ভালোর জন্যেই বলি!সংসারে একটা রীতি-নিয়ম তো আছে!ঠিক এমনি সময় দেখলাম ঘরের বাইরে বৌয়ের ছায়া শরীর নড়ে উঠলো,নিশ্চয় আড় চোখে কোনা খামচি ধরে মার আর আমার সম্মিলিত ব্যাপারটা অনুধাবন করার চেষ্টা চালাচ্ছিল—ওর কান দুটোও কি তখন প্রকৃতির নিয়মে খাড়া ও সজাগ হয়ে ছিল!
মাঝের এই হৃদয় নামক বস্তুটা বড় ছ্যাঁচ কাঁদুনে গায়—বলি,তোর এত নরম,দ্রবীভূত হবার কি দরকার রে?থাক না হাঁট্টাগাঁট্টা--নিটোল ক্রিকেটের দিউস বলের মত!মার কাট করে বেরিয়ে আয় নিজের স্থানটিতে।
ধুর,ইচ্ছে মত দেখি কিছুই হয় না,রাতে বউ বিছানায় এসে শুরু করলো তার শাশুড়ির গায়ন--শাশুড়ি নাকি বলেছে,বৌমার বাপের বাড়ির কোন আক্কেল নেই--দু দিন পরে জামাই ষষ্টি--এখনও নেমন্তন্ন করে যায় নি--কোনও আচার নিয়ম নেই কি তোমাদের বাড়ির !...
বৌ,বেশী দিনের পুরনো হতে পারে নি তো,প্রতিবাদ করে কিছুই বলে নি--ফ্যাঁচ করে নাকে গলায় সর্দি টানার মত শব্দ করে শাশুড়ির সামনে থেকে বেরিয়ে এসেছে,তবে নাকি আসার সময় শরীরে একটা ঝটকা দিয়ে এসে ছিল,এটা অবশ্য পরে মার কাছে শোনা।
এ সব গায়ে মাখতে নেই--আকাশের দিকে তাকাবার ভাব নিয়ে চুপ করে সব কিছু শুন ছিলাম।জানি,কোথাও বেশী একটা গেরো মারা যাবে না--এ সব প্রতিদিনের ঘটনার স্থায়ী মীমাংসা—পন্ডিতবিজ্ঞের ডিকশেনারীতে নেই।তার চে এই ভালো--উপস্থিত জনের কথা চুপ্পা হয়ে শোন--তুমি তোমার মনোরাজ্যে বিরাজ কর--কেউ যেন বুঝতে না পারে তোমার ধ্যান ভঙ্গের কথা !
সব ছেড়ে এবার এসো ব্যাটেল ফিল্ডে--বিছানায়। যন্ত্রণার কুমন্ত্রণার সন্ধির প্রস্তাব রাখো।একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি,জীবনে বিছানার মহত্ব কিন্তু যারপরনাই।বড় নরম কোমল একটা শব্দ--যার অর্থ হল,শয্যা!আহা শুনলেই কেমন কেমন মনে একটা ভাব যোগায় না?এমন একটা জাগা যেখানে দিনের শেষের সমস্ত ঝগড়া ঝাটি,রাগ-দ্বেষ,ঝড়ঝাপটার আপাত পরিসমাপ্তি ঘটে।এখানে এসে সব কিছু নরম পরে যায়।বিছানায় বার্তা হয়,সমস্ত দিবসের রিপোর্ট পাস হয়। বিচারের অন্ধিসন্ধি ঘাঁটা ঘাঁটির পর ক্লান্ত শরীর ঢলে পড়ার আগের খেলায় প্রবুদ্ধ হই।তারপর রাতের ছ সাত ঘণ্টা পরম শান্তির রে বাবা!
বিছানার কথা আরও একটু মনে ধরে আছে,না বলতে পারলে পেট না আবার গুড় গুড় করে!সত্যি,বিছানা কি জিনিস! শয্যা আমাদের জন্মভূমি,শয্যা আমাদের মৃত্যু ভূমি।বিছানা আমাদের শান্তির নীড়--স্বপ্নের মাঠ,সুখ দুঃখ মনোবেদনা সমস্ত কিছুর প্রকাশ এই খানে।যুদ্ধ,সন্ধির লড়াই ক্ষেত্রও যে আমাদের এই বিছানা!
আরও যখন বয়স হল,ইচ্ছাগুলি ভাবনাগুলি রং চটা হতে লাগলো ক্রমশ।বৌটা আগের চে অনেক বেশী সেয়ানা হয়ে গেছে।যেমনটি বোঝাও তেমনটি তখন সে থোড়ি বুঝবে!বরং তোমায় উল্টো বোঝাবে--তুমি তখন তার ঘেরা বন্দী যাকে বলে,নজর বন্দীও বলা যেতে পারে।তোমাকে তখন তার বশ্যতা স্বীকার করতে হয়েছে--এবং কিছু সন্ধি চুক্তির মনোব্যবস্থা হয়েছে। ঘরের শান্তি বর্জন কে চায়।তার চে কিছু কিছু ত্যাগ!
শালা,ত্যাগের তেস মেরেছে।শব্দের গুষ্টির তুষ্টি করা যাকে বলে। কথা প্রসঙ্গে আগের কথা আবার মনে হল,ত্যাগের কথা,জালের ফাঁসে গলা আটকে আছে আমার,মরিনি--সূর্যের আগুন হলকায় বাপের নাম গুলিয়ে বসেছি--আকাশ বাতাস,নদী তীরের সৌন্দর্য সব কিছুর ইয়ে মারা গেছে--জ্যান্ত জন্তুর শূন্যে ঝুলে থাকার মত আর কি!এর চে যদি ওই পুঁটি মাছটার মত মরে থাকতাম! এমনটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল যেন আমার ঘিলু আর হৃদয় সংযোগ থেকে ক্যাঁৎ ক্যুঁৎ হয়ে কতগুলি শব্দ বেরিয়ে এসে আমাকেই বলল—মর,মর,তুই!
আমিও রাগের মাথায় বলে উঠলাম—তুই মর,মরুক তোর চোদ্দ গুষ্টি--অমন কথা বললে এ অবস্থাতেই মুখে নুড়ো জেলে দেব।আমি মরলে কি হবে জানিস?
--কি হবে রে মরা!তুই দেখতে না পেলেও সব কিছু এমনটাই চলবে--তুই কি ভেবেছিস পৃথিবীর ঘোরা বন্ধ হয়ে যাবে?
--মরলে কি আর হবে।এমনি মাছের মত শূন্যে ঝুলে থাকব—আকাশ দেখব,উড়ন্ত পাখী দেখব,সূর্যের ...
--তুই কাঁচা কলা দেখবি!তোর মরার একদিন পরেই দুর্গন্ধ বেরুবে।লোকে নাক টিপে হাঁটবে।আর বেশী হলে দ্বিতীয় দিন তোকে নিয়ে ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসবে।
-- আমি মরালে কেউ কাঁদবেও না?
--কে কাঁদবে বল,কার এত সময় আছে—আজকাল কাঁদার অবস্থায় আছেটা কে?সব কিছুর টাইট অবস্থা।হ্যাঁ,কান্না কিছু উঠে আসে বটে,শারীরিক নিয়মে--মন নামক বস্তুটা যেটা আছে শরীরে কিছু রাসায়নিক প্রক্রিয়া নিয়ে জেগে ওঠে ওটা,তখন মনের জমা হওয়া মেঘ স্মৃতি হয়ে জড় হয়--সেগুলি জমে জমে স্থিত্যভারের বাইরে এসে বৃষ্টি নামায়,সে বৃষ্টি এট কেটস এন্ড ডগসের মত হলে তা বাইরে ঠেলে আসে--প্রথমে কুয়াশার মত,তারপর আর একটু ঘন--শিশিরের মত,অবশেষে চোখের দু কুল বেয়ে শ্বাসনালী বাঁধো বাঁধো হয়ে একাধারে ছিঁচকানি ও চোখের জল বেরিয়ে আসে!
চোখের জল বের হয়--খুব দুঃখ হয় বলে?
দুঃখটাও তো শারীরিক মার প্যাচেরই নামান্তর রে--ওই যে বললাম,ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ঘর্ষণে দুঃখ নামক সিস্টেম সক্রিয় হয়ে ওঠে মানুষের!
--তবুও তো আমার জন্যে কেউ কাঁদবে?
--তা আর ক দিন,রে!দু দিন পরেই দেখবি ঠোঁটের বোটম খুলে ঝকঝকে দাঁত পাটি বেরিয়ে গেছে,যেমনটি--আগে ছিল তেমনটি বন বন পৃথিবী ঘুরে চলেছে।
--এর পর সব আগের মত হয়ে যাবে?
--তবে তুই কি ভাবছিস,তোকে নিয়ে ঘরের সবাই জীবন ভর কাঁদতে থাকবে।খুব বেশী হলে তোর ফটো ঝুলবে দেওয়ালে। ফটোর নীচে টিকটিকি বাসা বাঁধবে।তোর মরার পরে দু দিন ফুল চন্দন পেতে পারিস।তারপর থ হয়ে দেওয়াল সেঁটে পড়ে থাকবি। অবশ্য যে বউ জীবনকালে স্বামীকে দুচোখে দেখতে পারত না--সে স্বামী মরার পরে তার ছবি নিয়ে অনেক চিন্তন মনন করে, তার ফটোর ওপরে ফুল চন্দনের কত ঘন পরিপাটি দেখবি!
খুব রাগ হল আমার--বললাম,গুলি মারো ফুল চন্দন,দেখি এতক্ষণের জাল ফাঁসের স্বপ্ন ছিঁড়ে আমি বেরিয়ে এলাম।বিছানায় আমার পাশে সোয়া বউ আমায় কনুইয়ের গুঁত মারল।ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে উঠে বসলাম।
ঘুমের মধ্যেও লোকে ঘুমায় না কি?ঘুমের মধ্যে বিবেক কথা বলে?ব্যঙ্গ করে?স্বপ্নের মধ্যে আমি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখলাম!জাগ্রত মানুষ সরলতা দেখে,বাস্তবতা দেখে,কঠোর বাস্তবতায় পুড়ে যেতে থাকে --আর এক সময় সে জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে।ওই জালে ঝুলে থাকা নির্জীব প্রাণীর মতই মনে হয় সে আকাশের দিকে নিশ্চল তাকিয়ে থাকে!আসলে সে তো স্মৃতি--সে তো জীবন্মৃত !
--রাতে আমায় ঘুমাতে দেবে না দেখছি,বৌয়ের ঝাল-ঝাঁজ গলা পেলাম।
--এই একটা স্বপ্ন দেখছিলাম।
ঘুম জড়ানো বিরক্তি কণ্ঠে বউ আমার আবার বলে উঠলো,কত সুখে আছো বল--স্বপন বিলাসিতা এখনও যায় নি দেখছি।
--বুঝলাম লক্ষণ ভাল না--এত রাতে বউ আমার কাব্যি করছে না।
--বলি,কাকে নিয়ে বিলাসিতায় ঢলে ছিলে,তুমি?
বুঝতে পারলাম,শান্তি রক্ষার্থে এখন নিজেকে গুটিয়ে রাখা শ্রেয়,নেকা চিকন গলায় বলে উঠলাম,এই,এখন এসব ভালো লাগছে না বলে দিচ্ছি !
--কেন,মন্দ লাগার আছে কি?কালই তো ঘুরে এলে কমলার বাড়ি।
চকিত হলাম আমি,কমলার বাড়ি?বন্ধু বিকাশের বাড়ি,বল।
--কিন্তু জানি,কমলাকে নিয়েই আজের স্বপন তোমার।
এ সব ঝকমারিতে আর যেতে চাইলাম না--চুপ করে মাগুর মাছের ঝিম নিয়ে পড়ে রইলাম।
আজ মেঘে মেঘে বেলা কম হল না--বিয়ের পর অনেকগুলি বছর টালমাটাল কোথা দিয়ে যে দৌড়ে চলে গেল!এ সব স্মৃতি মনে পড়লে শরীরে যেন পিন ফুটতে থাকে!
সখী ভাবনা কাহারে কয়...সখী যাতনা কাহারে কয়...ভালবাসা, ভালবাসা...গানের কথাগুলি সঠিক জাগায় না পড়ারই কথা—তবে,যাতনা কাহারে কয়,হাড়ে হাড়ে তা টের পাচ্ছি।মাঝে মধ্যে অস্বাধীন ভাবনাগুলি কিলবিল করে ঠেলা দিয়ে ওঠে।মনে মনে ভাবি,স্বাধীনতার কতই না রকম ফের আছে!এখন আমি প্রকারান্তরে চার দেওয়ালের বন্দী—ইচ্ছে মত ঘোরা ফেরায় অসুবিধা বোধ করি।ঘেরা পাঁচিল বাগানে সামান্য পায়চারী করি--বন্ধু বান্ধব পরিচিত জন যেন ক্রমশ অপরিচিত হতে চলেছে!
লক্ষ্য করেছি যে বয়সের ভারে আজকাল হঠাৎ হঠাৎ ওলটপালট ভাবনারা আমায় খেপিয়ে তোলে--কখনও ইচ্ছে হয়,সজোরে শ্বাস টেনে নিতে,মাঝে মাঝে মনে হয় ধুত্তোর মানামানি জানাজানি কানাকানি এ সবের নিকুচি করি--ডালপালা ছিঁড়ে ভেঙে এখনি বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে--কিন্তু ওই পরক্ষণেই মনে হয়—আর কি দরকার এ সব প্যাঁচাল ক্যাচালের—মেঘে মেঘে বেলা দুপুর তো গড়িয়ে গেল--ইচ্ছে অনিচ্ছা তাই দুরে ছুঁড়ে ফেলে এখন তা হলে--ওম শান্তি--ওম শান্তি...
সমাপ্ত
পুনশ্চঃ
বউয়ের আমার পড়ার অভ্যেস নেই,তবু বোধহয় কৌতূহল বশে গল্পটা পড়ে নিয়ে ছিল। সারা দিন শেষে বিছানায় এসেই আমার ওপর তেলে বেগুনে জলে ওঠার মত বলে উঠলো,অসভ্য,আমার বিরুদ্ধে যাচ্ছেতাই লিখেছ!তোমার তলে তলে বুঝি এ সব ভাবনা!তুমি ভীষণ স্বার্থপর!নিজেকে সাধু সাজিয়ে নিজের মত করে সব গুছিয়ে লিখেছ!দাঁড়াও আমিও গল্প লিখবো,তোমার অসভ্যতামির কথা সব ফাঁস করে দেবো--আমিও তোমার বিরুদ্ধে এই একই কথা বলবো।
বৌয়ের কথা শুনে মাথা আমার চড়ে যাচ্ছিল,কষ্ট করে নিজেকে সামলালাম।মনে হল সামলাবার পেছনে এই আরামদায়ক বিছানার আর মাথার কাছের খোলা জানলা দিয়ে ফুর ফুর মলয় বাতাসের ছোঁয়ার সম্মিলিত যোগদান ছিল!কলহ দুরে রাখতে চুপচাপ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকলাম।একটু সময় পরেই সারা দিনের খাটা খাটনির ভারে হবে বউ আমার ঘুমিয়ে গেলো।চারিদিক নিঃশব্দ শান্ত—রাতও যেন ক্রমশ থিতিয়ে নিথর হয়ে যাচ্ছিল।মনে হল আমার মস্তিষ্ক এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও শান্ত হয়ে এসেছে।ভাবছিলাম,আমার লেখার ওপর বউয়ের রাগ করা একেবারে অযৌক্তিক নয়—তাঁর রাগান্বিত কথাগুলির জোরাল কোন প্রতিবাদ কি সম্ভব?