রতন দেখেছে তার বাবাকে--মার সঙ্গে তার মোটেও বনি বনা ছিল না।ছোট বেলার একদিনের কথা মনে পড়ে।তখন রতন ক্লাস ফাইভে পড়ে।ভালো রেজাল্টের জন্যে রাত জেগে পড়তে হত।ও তখন শোবার ঘরে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত।এমনি সময় বাবা মার ঘরে কিছু পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে যাবার শব্দ হল--নিশ্চয় কাঁচের গ্লাস হবে!ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে চারদিকে ছিটে পড়ার মত শব্দ হয়েছিল।রতন গা করে নি,ও গ্লাস মা তুলে নিয়ে পরিষ্কার করে ফেলবে।তারপর দু তিন মিনিট যেতে না যেতেই মা গুঙিয়ে কেঁদে উঠলেন।কি ব্যাপার!মার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ হতে লাগলো। আজও তা হলে বাবা মাকে মারছেন!
জীবনে এমনটা প্রথম বার নয়—রতন মা বাবার ঝগড়া অনেকবার দেখেছে।ও সামনে থাকলে বা কোন কারণে পাশে এসে গেলে সামান্য তর্কের পর থেমে যায় ঝগড়া।অন্তত রতনের সামনে তা থেমে থাকে তবে সে রেশ যে রয়েছে--তা মা বাবা উভয়ের মুখে স্পষ্ট চিহ্নিত হয়ে থাকে--ওদের থমথমে মুখ দেখে তা সহজেই আন্দাজ করা যায়।ক্লাস ফোর পাস করে যাবার পর রতন আলাদা ঘরে শোয়।মা আপত্তি করেছিলেন,কিন্তু বাবা বলে ছিলেন,থাক ও আলাদা,স্বাবলম্বী হতে শিখুক।তারপর থেকেই ও আলাদা ঘরে থাকে।মাঝে মধ্যে রাতে বাবা মার ঝগড়ার আলাপ পায়।কিন্তু রতনের এর মধ্যে কি ই বা করার থাকে !
কিন্তু আজ মার চাপা কান্না থামতে চাইছিল না।রতনের পড়ার বড় ডিস্টার্ব হচ্ছিল।মার জন্যে চিন্তা হচ্ছিল।মা মাঝে মাঝে আচমকা কেঁদে কেঁদে উঠছিলেন।মনে হল বাবা আবার মার গায়ে হাত তুলছেন!বাবা মার ঝগড়া খুব খারাপ লাগে ওর।মার জন্যে দুঃখ হয় খুব!বাবা কেন মাকে মারবেন?বাবাকে শাসন করার মত কেউ কি নেই?এক বার মা চাপা চীৎকার করে থেমে গেলেন।রতন সহ্য করতে পারছিল না।নিজের পড়ার ঘর থেকে ও উঠে এলো--মা বাবার ঘরের কাছে এসে দাঁড়ালো।দরজা ভিতর থেকে বন্ধ।কি করবে ভাবছিল।এমনি সময় মার গলা শুনতে পেল রতন,মা বলে চলেছেন,বদমাশ কোথাকার,আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে--সেই বিয়ের আগে থেকে--রতন শুনল--তারপরের অপেক্ষাকৃত নিচু গলার স্বরের কথাগুলি আর তার কানে এলো না।ও শুনেছে বাবা মা প্রেম করে বিয়ে করেছেন--বিয়ের মাত্র ক মাস আগে থেকেই নাকি উভয়ের মধ্যে ভালোবাসাবাসি হয়! আর বিয়ের এক বছরের মধ্যেই সন্তান,মানে রতন হয়।এ সব পিসিমনির মুখে শুনেছে ও।পিসিমুনি তার বান্ধবীর সঙ্গে যখন গল্প করতে বসতেন তখন মাঝে মধ্যে এ সব কথা আলোচনা হত।রতন কোন কাজে হয় তো গিয়েছে--দেখেছে পিসিমনি তার বান্ধবীর সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত--আর মা বাবাকে নিয়ে গল্প হলে ওর সামনে পিসিমনি চুপ হয়ে যেতেন।পিসি বলছিলেন,আমার দাদাও কম যায় না--সব জাগায় দাদাগিরি--
হ্যাঁ রতন জানে বাবা নেশা করতো খুব--বাজে লোকদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়াত।পাড়ার লোকেরাও নানা কথা বলে--এখন তো বিয়ে করে ধীরু দা পাল্টে গেছে,না হলে কত কেলোর কিত্তি যে করেছে!লোকেরা যখন এমনি বলত--রতনের কানে যেন কিছুই যায় নি এমনি ভান করে সে দুরে সরে যেত।
রতনের সন্দেহ হয়--বাবা মার সম্পর্কের মধ্যে কিছু একটা আছে--কোন গোপন কথা--গোপন রহস্য কিছু যেন লুকিয়ে আছে--যা আজও ও জানে না,কিন্তু সে যাক,বাবা মাকে ঝগড়া করতে বা মাকে কাঁদতে শুনলে ওর খুব খারাপ লাগে—ওর বুক ঠেলে কান্না বেরিয়ে আসে। মার জন্যে খুব,খুব দুঃখ হয় ওর।
বাবা মার ঘরে ঝগড়া চলছিল।মার গলা শোনা যাচ্ছিল,আমার বরবাদ তো তুমি করেছ--তুমিই তো--
--বেশ করেছি--আর সেই জন্যেই তো আমি ভালো মানুষ বলে বিয়ে করেছি তোকে!
রতন এবার মার গলা শুনতে পেল,দেখলে কেস হয়ে যাবে--সারা জীবন জেলে পচে মরতে হবে—তাই—
--চাইলে আমি বিয়ে না করে পালিয়ে যেতে পারতাম --
--পালাবে কেন!শ্বশুর বাড়ির পয়সা খাবার লোভে--
--চুপ হারামজাদী!বাবার চাপা চীৎকার পাওয়া গেল আর তার
পরক্ষণেই ঠাস করে শব্দ হল,মা চীৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলেন।
--মা!মা!মনে মনে রতন মাকে ডেকে উঠলো,একবার মনে হল দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলিয়ে মাকে বাবার কবল থেকে বাঁচিয়ে নিই।
আবার মার চীৎকার শোনা গেল,মা খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন, কাঁদতে কাঁদতে বলে চলেছেন,চরিত্রহীন,একটা চরিত্রহীন আমার স্বামী!একটা জন্তু--আমার হাড়মাস চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে নিলো লোকটা...
--তোকে বিয়ে করেছি এটাই বেশী মনে করবি--
--হ্যাঁ,বিয়ের আগে ধর্ষণ করে ছিলে তুমি--তারপর ভয়ে...
--আমি করে ছিলাম তুই কি করে জানিস,মাগী !
--আমি তোমাকে চিনে ফেলেছিলাম,ভয়ে তুমি আমায় বিয়ে করেছ।
রতনের কানে ধর্ষণ,কথাটা বড় হয়ে লাগল।ও কথার অর্থ ও এখন জানে।ওর কেমন যেন লাগছিল--মনে অস্বাভাবিক একটা ভাব ফুটে উঠছিল।কান দুটো গরম হয়ে গেছে মনে হচ্ছিল।ও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পার ছিল না। বাবার প্রতি বিদ্বেষ ভাব জন্ম নিচ্ছিল।ও ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।পড়ায় বিন্দু মাত্র মন লাগাতে পারছিল না--বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। অনেক রাত পর্যন্ত চোখে ঘুম আসলো না।গলা ঠেলে কান্না আসতে লাগলো–-মা,মাগো বলে,চাপা হাহাকার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
রতনের বাবা ধীরেন।ছোট থেকেই পড়া লেখা ছেড়ে আওয়ারার মত ঘুরে বেড়াত।বাপ মার লারপ্যায়ারের এক মাত্র ছেলে।আদরে বাঁদর --বাঁদর থেকে অসৎ সঙ্গে পড়ে একে বারে বিগড়ে গিয়ে ছিল।অল্প বয়স থেকেই নেশা করা শুরু করে দিয়ে ছিল--বাবার পকেটমার, মার শাড়ির আঁচলের গিঁট থেকে পয়সা চুরি করত।নেশার যোগার করতে গেলে যেনতেন প্রকারেণ পয়সা তো চাই!সঙ্গে পাড়ার দুটো বদ সঙ্গী ছোকরা জুটে গিয়ে ছিল।মাঝে মাঝে রকবাজি--মেয়েদের পেছনে লাগা--এসব কাজ করত।সে দিন পকেট মেরে ক হাজার টাকা জুটে গিয়ে ছিল।এখন খরচ তো করতে হবে--তিন জনে মিলে চলে গেল পিকনিকে--মাংস আর মদ এই তো হবে খাওয়া। পারলে মেয়ে মানুষ একটা নিয়ে যেত--কিন্তু তা আর যোগার হল না।
রেলের লাইন ধরে দেড় কিলো মিটার গেলেই ফরেস্ট।পিকনিক স্পট কি না জানে না ওরা।দরকার নেই—জঙ্গল,ব্যাস,তাতেই হবে। মদ আর মাংস খাওয়া নিয়ে কথা!
বেলা বারটায় গিয়ে হাজির হল ফরেস্টে।সঙ্গে থাকলো হোটেলের ক প্লেট মাংস আর দেশী বিদেশী মিলিয়ে তিন লিটার তিন ব্র্যান্ডের মদের বোতল।আর কি চাই!জঙ্গলের বড় এক গাছের তলায় শতরঞ্চি পেতে বসে পড়ল তিন জন।তাসের প্যাকেট বের হল।মদ টানা,মাংস খাওয়া ,আর সেই সঙ্গে চলতে থাকলো জুয়া খেলা।
নেশা জমে গিয়ে ছিল।মদ মাংস শেষ হয়ে গেল এক সময়।এ দিকে বেলা পড়ে আসছিল।ঠিক এমনি সময় একটি মেয়ে হন্ত দন্ত হয়ে সেখানে উপস্থিত হল।বেশ বোঝা যাচ্ছে,সে যেন খুব বিপদে পড়েছে।মেয়েটি ধীরেনের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো,দাদা ! জঙ্গলের হিজুলি গ্রামের সাইডটা কোন দিকে বলতে পারেন?মেয়েটিকে দেখে তিন বন্ধুর চোখগুলি যেন জ্বলে উঠলো।ওদের মধ্যে থেকে নেতাই তাড়াতাড়ি করে বলে উঠলো, হ্যাঁ,হ্যাঁ,হিজুলির দিকটা তো আমরা চিনি।
তিন জনে পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওই করছিল।মেয়েটার কেমন যেন লাগলো--ওদের হাব ভাব ভালো বলে মনে হল না তার।মদের উৎকট গন্ধ ওর নাকেও পৌঁছল।ওদের লাল লাল চোখগুলি দেখে ও বুঝে গেল যে ও ঠিক জাগায় সাহায্য চাইতে আসে নি!
--চলুন আমরা আপনাকে পৌঁছে দেব,ধীরেন আগ্রহী হয়ে বলে উঠলো।
মেয়েটি আর কথা না বাড়িয়ে নিজেই চলে যাবার জন্যে পা বাড়াল। নাড়ু বলে উঠলো,কোথায় যাচ্ছেন?দাঁড়ান।
মেয়েটি ততক্ষণে জঙ্গলের দিকে ছুটতে লেগেছে।
ধীরেন,নেতাই,নাড়ু ওরা তখন দিশা হারা--নেশায় জ্ঞান শূন্য প্রায়। শরীরে সবে মাত্র ওদের রং ধরছিল।পিকনিক যতই জমুক-- একটা কিসের কমি ওরা মাঝে মাঝেই অনুভব করছিল।সেটা হল সুখ,অতৃপ্ত এক না পাওয়ার তৃষ্ণা ওদের তাড়িত করছিল।নেশা নিয়ে ওরা অনেকটা জঙ্গলের ভিতরে ছুটে গেল।নেই সেই উদ্ধত মেয়েটা নেই। ধরা ছোঁয়া না দিয়ে যেন বনের ভিতরে হারিয়ে গেল।
--না,চাই,ওকে চাই,নাড়ু বলে উঠলো।
ওরা তিন জন তিনদিকের জঙ্গল বেড় দিয়ে খুঁজে ফিরল, ধরতেই হবে ওকে--ওদের তখন নেশা--উন্মত্ত নেশা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল—রঙ পিপাসার জর্জর শরীর আর কোন মত শান্ত হচ্ছিল না।
ওরা জঙ্গলের তিন দিকে ধেয়ে গেল।হন্যে হয়ে অনেক সময় ধরে ধীরেন মেয়েকে খুঁজে ফিরছিল।কে জানে নাড়ু নিতাই ওরা হয় তো এত সময়ে ঘরে ফিরে গেছে।ও গাছ তলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। এমনি সময় সামান্য দুরে মনে হল শুকনো পাতার খস খস আওয়াজ হল--ধীরেনের দেখল সেই মেয়েটি--ও এদিক ওদিক ভয়ের দৃষ্টি নিয়ে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ধীরেনের চোখ দুটো চক চক করে উঠলো।মন উৎফুল্ল হয়ে উঠলো।শরীরে উজাগর একটা ভাব এসে গেল।যে করে হোক ধরতে হবে--ওই তো হরিণ ছুটে চলেছে।আসছি আমি--ওরে তোর বাঘ তোর ঠিক পেছনেই রে!বাঁচতে তুই আর পারবি না।ধীরেন কোন কথা বলল না--মেয়েটি যখন ধীরেনকে দেখল,তখন মাত্র দু হাত দুরে সে।আর পালাতে পারল না।ধীরেন কোন কথা বলল না --ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত দু হাতের থাবা নিয়ে জাপটে ধরল মেয়েটিকে।
--আঃ,চীৎকার করে কিছু বলতে চাই ছিল মেয়েটি।কিন্তু তার আগেই ধীরেন চেপে ধরল তার মুখ,সমস্ত শক্তি নিয়ে মেয়েটির হরিণের মত নরম দেহটা থেকে ছাল ছাড়ানোর মত পোশাকগুলিকে টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে নিলো।মেয়েটির শরীর ক্রমশ: মুচড়ে দুমড়ে যেতে লাগলো।কিন্তু ধীরেন তখন মানুষ নেই--পশুর মত দু হাত দু পা দিয়ে দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে চেপে ধরেছে...।চারিদিকে বাতাসের সা সা শব্দ শোনা যাচ্ছিল...গাছের ডালপালার ঘেঁষা ঘেঁষির আওয়াজ,শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনিতে গুপ্ত ঘাতকের কথা কেউ জানতে পারল না...
স্তব্ধতা নেমে এলো চারি দিকে।ধীরেনের ক্লান্ত দেহ সমস্ত
অনুরাগের স্খলন শেষে উঠে দাঁড়ালো।তাকাল না সে মেয়েটির দিকে।এবার পালাতে হবে।বড় অপরাধ থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে।ছুটতে লাগলো সে...মাত্র ক পা এগিয়েছে পেছন থেকে মেয়েটির তীব্র কর্কশ গলা শুনতে পেল,কোথায় পালাচ্ছ তুমি? তোমায় আমি চিনে নিয়েছি।সত্যি নয়না নাম্নী মেয়েটি ধীরেনকে দেখে নিয়ে ছিল।সে মনে মনে ঠিক করে নিয়ে ছিল,না কোন মতেই এই বলাতকারীকে সে ছাড়বে না।মুহূর্তের মত মুখ ফেরালো ধীরেন নয়নার দিকে,ভাবল দেব নাকি সাক্ষী সাবুত মিটিয়ে--কিন্তু সে তখন বড় ক্লান্ত--আর সে একা--কাজেই ইটা সম্ভব নয়।
ইতিমধ্যে নয়না নিজেকে বাঁচিয়ে বনের মধ্যে কথাও লুকিয়ে পড়েছিল।
ত্বরিতে ধীরেন ছুটতে থাকলো...ছুটতে থাকলো...নিতাই নাড়ু কারো সাথে ওর দেখা হল না।
নয়না পালিয়ে নিজের সাজ সজ্জা কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে বন থেকে বেরিয়ে এলো।মনে তার জমে থাকলো পাহাড় প্রমাণ গ্লানি।
বাড়ির কেউ জানতে পারল না নয়নার কথা।জোর করে সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে চলল।নয়না দেখেছে ধীরেনকে,এ শহরেরই ছেলে হবে।তাকে যে করে হোক খুঁজে বের করতে হবে।নিজের শরীরের কলঙ্কের কথা বলে সে নিজেকে আর ছোট করতে চাইল না।শরীর ও মনের ক্ষত নিয়ে ঘুরে বেড়াল শহরের এখানে সেখানে--এ পাড়ায় সে পাড়ায়--এ গলি থেকে অন্য গলিতে।
সে দিন সন্ধ্যে হয় হয়,ধীরেন দিবা ঘুম সেরে নিয়ে আড্ডায় বের হচ্ছিল।আড্ডা বলতে নিতাই,নাড়ু,এমনি সব সাগরেদদের দল।সে দিনের কথা সে নিতাই নাড়ু কাউকে বলেনি।ও বুঝেছে, বলাৎকারের মত বড় অপরাধ সে করেছে।আর সেই মেয়েটা তাকে চিনে নিয়েছে।নিশ্চয় ও এত বড় ঘটনার প্রতিশোধ নেবে। ইতিমধ্যে পুলিশে রিপোর্ট হয়ে গিয়ে থাকবে।তাই তো সন্ধ্যের পরে ঘরের বাইরে বেরোনো ও শ্রেয় মনে করে।ও মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে যে পুলিশের আনাগোনা দেখলেই সটকে পড়বে।এ ছাড়া মেয়েটা যদি ওকে দেখে ফেলে নির্ঘাত সঙ্গে সঙ্গে পুলিসে খবর দেবে!
শেষ বিকেলের রক্তিম আলো চারি দিকে লেগে ছিল।অতি সন্তর্পণে হাঁটছিল ধীরেন।বড় বাজারের মোড়ের মাথায় পৌঁছেছে ঠিক এমনি সময় সেই মেয়েটি পথ আগলে দাঁড়ালো—বলে উঠলো,চিনে নিয়েছি আপনাকে,পালাবেন না যেন,আপনার সঙ্গে কথা আছে। মেয়েটির দৃঢ় গলা শুনে থমকাল ধীরেন--বলল,আপনাকে চিনি না।
--এই রাস্তার মোড়ে অনেক লোক আছে--কেবল একটা চিৎকার করলেই—
ধীরেন কি ভাবে পালাবে ভাবছিল।নয়না গম্ভীর ভাবে বলে চলেছে শুধু একটা পথ আছে আপনার বাঁচার,এবার ধীরেন অসহায়ের মত তাকাল নয়নার দিকে।নয়না বলে চলেছে,বিয়ে করতে হবে আপনার!তা হলে আমার কলঙ্ক ঘুচবে আর আপনি ফাঁসিতে ঝোলা থেকে বাঁচবেন।
ধীরেন ভাবতে পারছিল না কিছু --সে বলে উঠলো,কিন্তু--
--এর মধ্যে কোন কিন্তু নেই--একটা দিন সময় দিচ্ছি আপনাকে পালাবার চেষ্টা করলে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনবেন আপনি।আর কথা বলল না নয়না।সামনের রাস্তা দিয়ে দ্রুত পদে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ধীরেন কি করবে ভাবতে থাকে।দু দিকেই বিপদ--এক নিরুদ্দেশ হওয়া বা ফাঁসিতে চড়া,দুই নয়তো অচেনা এক মেয়েকে বিয়ে করা।ঘরে ওর মা আর ছোট বন আছে--বাবা ছোট বেলাতেই মারা গেছে।মা অনেক কষ্টে ওদের ভাই বোনকে বড় করেছে।অবশ্য ছেলেকে মানুষ করতে পারে নি।মা এখন শয্যাশায়িনী।এ মত অবস্থায় সে কি করবে ভাবছিল।মেয়েটি দেখতে মন্দ নয়!কথা বার্তায় দৃঢ় হলেও কোথায় যেন নম্র ভাব রয়ে গেছে ওর মধ্যে। বাকি,নিজের বাঁচতে হলে ওর প্রস্তাব মেনে নেওয়া কি তার পক্ষে খুবই অসম্ভব!স্বাভাবিক হয়ে ধীরেন যখন ব্যাপারটা ভাবতে যায় তখন নিজের মহা ভুলটা ধরা পড়ে।নেশার বশে--বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ও লালায়িত হয়েছিল।নেশা তার শরীরে জোয়ারের টান অনুভব করিয়ে দিচ্ছিল,তবু আসলে তো ও সত্যি সমাজের কাছে বড় অপরাধ করেছে !
এক সপ্তাহ পরের ঘটনা--নয়না তার দুই বান্ধবীকে নিয়ে এসে ছিল,আর ধীরেন নিয়ে এসেছিল সেই নেতাই আর নাড়ুকে। সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে নয়না ও ধীরেন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হল। মন্দিরের বিবাহ বন্ধনী রেজিস্টারে স্বামী স্ত্রী হিসাবে নাম লেখা হল।সে সঙ্গে সাক্ষী হয়ে থাকলো ছেলে মেয়ে উভয় পক্ষের সাথীরা।
ধীরেন দাম্পত্য জীবনে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলো।বিয়ের পর আট মাস যেতে না যেতে ওদের সন্তান হল।সন্তানের নাম রাখা হল,রতন।নয়না ও ধীরেনের জীবন বিয়ের পর থেকে পাঁচ ছটা বছর ঠিক ঠাকই চলছিল।আর্থিক অবস্থা অনেক ফিরে গিয়ে ছিল। শ্বশুরের ব্যবসায়ে মন দিয়ে ছিল ধীরেন।নয়না ছিল বাবা মার এক মাত্র মেয়ে।
কিন্তু জীবনে নেশা দোষ কাটানো বড় মুশকিলের ব্যাপার।নয়নার সংসার ধরে রাখার গুনে বেশ কিছু বছর কেটে যাবার পর ধীরেন আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।নেশাখোর কিছু সাথীও জুটে গেল। ও ধীরে ধীরে সেই আগের দশাতে নেমে আসছিল।প্রায় রাতেই ধীরেন ও নয়নার মধ্যে ঝগড়া লেগে থাকত।ধীরেন তার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলত।
নয়না ও ধীরেনের প্রাক বিবাহের কথা পাড়া পড়শির চর্চার বিষয় ছিল।তবে ওরা এটুকু জানত--বিয়ের আগে ওদের মধ্যে ফষ্টিনষ্টি ছিল!
ধীরেন ও নয়নার ছেলে রতন।ও ক্লাস নাইনে পড়ছে।রতন দেখেছে,বাবা সব সময় খেঁকিয়ে থাকেন,রতনকে অনেকবার মেরেছেন তিনি,সে মারের আঘাত অমানুষিক ছিল।মনে হত হাতের কাছে যদি কিছু থাকত তা দিয়ে বাবার মাথায় বাড়ি দিয়ে দিত।
রতনের চিন্তা করেই কান দুটো লাল হয়ে উঠছিল--বাবা তার মাকে ধর্ষণ...আর চিন্তা করতে পার ছিল না ও।এমনি সময় আবার মার চীৎকার শোনা গেল।তার মানে,আবার বাবা মাকে মারছেন! আজ
ক দিন ধরে বেশী করে নেশা কর ছিল ধীরেন।
রতন তাকাল বাবা মার শোয়ার ঘরের চারদিকে--ওর শরীর যেন রাগে ফুঁসছিল।না তেমন কিছুই দেখল না--ও বারান্দায় বেরিয়ে এলো।বারান্দার কোনায় শক্ত পোক্ত একটা লাঠি রাখা ছিল।মনে হয় বাগানে ঢুকে যাওয়া গরু ছাগল তাড়াবার সময় এটার সদ ব্যবহার হয়।ও হাতে তুলে নিলো লাঠি।তখনও মার কান্না ওর কানে আসছিল।জোর পায়ে ও বাবা মার শোয়ার ঘরের দিকে পা বাড়াল।
রতন দেখল,দরজা খুলে বাবা,মাকে দু তিনটে থাপ্পড় দিয়ে ঘরের বাইরে বের করে দিচ্ছেন।আবছা অন্ধকার আলোয় রতন লাঠি হাতে বাবার দিকে ছুটে গেল আর বাবার মাথায় সে মেরে বসলো মোক্ষম এক বাড়ি।সঙ্গে সঙ্গে বড় একটা চীৎকার করে ওর বাবা,ধীরেন লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।জ্ঞান শূন্য ধীরেন পড়ে ছিল বারান্দার মেঝেতে।
ধীরেনকে হসপিটালে ভর্তি করা হল।বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে তার জ্ঞান ফিরল।ডাক্তার বললেন,হেড ইনজুরি,ইন্টারনাল হ্যামারেজ।
দশ দিন পর হাসপাতাল থেকে ছুটি হয়ে গেল রতনের বাবার। সম্পূর্ণ সুস্থ সে কোন দিন হতে পারবে না।ওর শরীরের সেন্সেসন স্বাভাবিক থেকে অনেক কম।কথা বলতে পারে না --সামান্য চলা ফেরা করতে পারে মাত্র।হাতের ইশারায় নয়নাকে ডাকে--নয়নার দিকে স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে।রতন কাছে এলে তার দিকে তাকিয়ে থেকে চিনতে চেষ্টা করে !
রতন মনে মনে ভাবে এটাই ঠিক হয়েছে,বাবা আর মাকে মারতে পারবেন না।