মিনু মামা! আমার মিনু মামা। যার গায়ে মায়ের গন্ধ লেগে থাকতো। যার নাকে লেগে থাকতো আমার গন্ধ। মিনু মামা আজ জিজ্ঞেস করে জেনে নেন কে আমি। “কে? সুমন রে বাবা!”
জীবনের প্রথম থেকেই অতৃপ্তি নিয়ে বড় হয়েছি। প্রাইমারী স্কুলের গ্রীষ্মের বন্ধে বন্ধুরা যখন খুব আমোদে নানু বাড়ি যেত বেড়াতে, সেখানে আমার মুখটা সব সময়ই মলিন হয়ে থাকতো। ফিরে এসে ওরা মামা বাড়ীর গল্প শোনাতো। বড় মামা, মেঝ মামা ছোট মামা...। আমি চুপ করে হুশ হারিয়ে সে গল্প শুনতাম। আমার মামা বাড়ীর কোন গল্প হতো না। আমার গল্প হতো দীর্ঘশ্বাসের গল্প, না থাকার কষ্টের গল্প।
যে সময় থেকে স্মৃতি আমার সঙ্গী হয়েছে সে সময় আমরা নানু বাড়ীতেই থাকতাম। আমার মামাবাড়ীর আ¶েপের মতো নানারও বোধ হয় একটা ছেলের খুব ইচ্ছে ছিল। আর তাতেই মা সহ নানুর কোল অন্ধকার করে করে সাতটা মেয়ে এসেছে দুনিয়ার আলোয়। মা বলেছিল “তোর যখন দুই মাস হইল হেইদিনই বাজানে তোর হাতে শেষ পানিটুক খাইসিল। তার পরে আর কোন দিন বাজান ডাকতে পারি নাই” বলতে বলতে মার চোখে পানি চলে আসতো। মা কাঁদবেন এই ভয়েই নানার কথা আর জানতে চাইতাম না।
সে আবদ্ধ সময় থেকে আমাকে উদ্ধার করে ¯^প্নময় করে তুললেন মিনু মামা। দুপুর বেলায় খাবার শেষে সবাই যখন ভাত ঘুম যেতো, আমার তখন দস্যুতা করার সময়। ছোট্ট করে ডাকতাম “মিনু মামা”। উনি যেন তৈরি হয়েই থাকতেন। কখনো তরতর করে গাছের মগডালে উঠে ঝাকুনি দিয়ে পাকা কৎবেল পেড়ে লবন পোড়া মরিচ দিয়ে ভর্তা বানিয়ে খাওয়া। আবার কখনো অন্যের গাছের কাঁচা পাকা আম ঢিল ছুড়ে পেড়ে নিয়ে ভো দৌড়ে আমাদের জুড়িদার আর কেউ ছিল না।
বর্ষার নতুন পানিতে সদ্যতোলা পাটের ¶েত ডুবে যেত। জাক দেয়া পাটের নিচে অথবা ¶েতের আইলে ঠেলা জাল নিয়ে কুচো চিংড়ি আর নুনতি বাইলা মাছ আমাদের চেয়ে বেশি ধরেছে কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। হাটবার এলে মিনু মামা বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিতেন আর আমাকে তুলে নিতেন কাঁধে। আধা মাইল কাঁধে বয়ে নিয়ে কিনে দিতেন মনোহরী কত্ত কিছু। বাড়ীর বাজার সদাই থেকে সব কাজ কত অনায়াসেই করে দিতেন।
নানা মরে গিয়ে বেঁচেই গিয়েছিলেন। বড় মেয়ের জামাই হওয়ায় বাবার উপর ছয় খালার দায় এসে পড়ল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠক হিসেবে অনেককে নিয়ে ট্রেনিং করিয়েছেন গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনা করেছেন। খুব বেশি মনে নেই বাবা চাকুরীর সাথে রাজনীতির সাথেও জড়িয়ে ছিলেন। জিয়া প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বাবার চাকুরী চলে যায়, তাকে প্রায়ই পালিয়ে থাকতে হয়। রাতের বেলায় বাড়িতে পুলিশ আসে, বাবাকে খোঁজে। সেই তখন এতটুকু আমিও বুঝতে শিখে গিয়েছি আমাদের সামনে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কোন আয় নেই চেয়ে চিšে— সংসার চলে।
মা নকশী কাঁথা সেলাই আর সুতোর টুপি বানাতেন। বড় খালা পড়াশোনায় ভাল ছিলেন বলে বাবা-মা উনাকে কোন কাজ করতে দিতেন না। মেঝ খালা উপায় না দেখে গার্মেন্টে কাজে লেগে গেলেন। গ্রামের মানুষজন মুখে খাবার দেয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলেও ফাও হিসাবে সমালোচনা জুড়ে দিতে ভুললেন না। এ অভাব আমার মিনু মামাকেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নিলো। এখন আর মিনু মামা আমাকে কাঁধে চড়িয়ে হাটে নিয়ে যায় না, কুচো চিংড়ি ধরা হয় না।
একদিন কানা মাছি খেলার সময় আমার চোখ বাধতে গিয়ে মিনু মামা আমার চোখে গুতো দিয়ে দিলেন। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে আর আমার কান্না। সেদিন মনে হয় মিনু মামা আমার চেয়ে বেশি কেদেছিলেন। “আমি মনে হয় তোর চোখটা নষ্ট করে দিলামরে, আলাহ আমার চোখটা নষ্ট করে দাও তবু আমার বাবার চোখটা ভাল করে দাও”। মিনু মামার কান্নায় আমি চোখ ব্যথার কষ্ট ভুলেছিলাম।
বিধাতার রাজ্যে ভয়ানক ¯^প্নের শেষেও ভোর হয়। আমাদেরও দিন চলতে লাগল। মেঝ খালার বিয়ে হলো। খালুও একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাবার কথাও খালুও নানু বাড়ীতে থাকতে লাগলেন। আমরা সবাই একটা সুখি পরিবার হয়েই দিন কাটাতে লাগলাম। দেখতে দেখতে মেঝ খালারও বিয়ে হল। একটা কথা আছে যে কষ্ট বোঝে তার নাকি কষ্টও হয় বেশি। মেঝ খালার বেলায়ও সেটা সত্য হলো। খালু কদিন কাজ করেন তো মাসের বাকি দিনগুলো বসে খেতে লাগলেন। খালার ভাগ্য বদলালো না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তাপসকিরণ রায়
গল্পটি আরও একটু বড় হলে ভাল হত--গল্পের চরিত্রগুলি আরও সামান্য ফুটে উঠত--তবু বলব ভাল হাত আপনার--লেখার ভঙ্গিমা সুন্দর।অনেক শব্দ দেখলাম পরিষ্কার হয়ে প্রিন্ট হয় নি--টেকনিক্যাল মিস্টেক আছে।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।