এই যে মন্টু নামের লোকটা সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছে, মুখ দিয়ে আওয়াজ করছে আয় চুক... চু... চু... চুক...। তার পেছন পেছন হাটছে একটা বাচ্চা কুত্তা। কয়দিন আগেও একটা ছাল ওঠা নেড়ি কুত্তা ছিল তার সঙ্গি। মিউনিসিপালটির লোকজন তাদের সীমায় না পড়ার পরও ছাল ওঠাটা সহ সব কুত্তাগুলারে মেরে বস্তায় ভরে নিয়ে গেছে। কুত্তার সাথে তার মাখামাখি নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নাই। তবে এই লোকটার জন্যই আমার কমসে কম তিন দিনের জন্য রিমান্ড অফিসার হতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা যারা রিমান্ড কার্যকর করে তাদের কি রিমান্ড অফিসার বলে। এই অফিসার শব্দটার প্রতিই আমার যত দূর্বলতা। ”এই হাবিলদার মন্টু বাইনচোতরে সামনে নিয়া আয়। ডিম গুলা সিদ্ধ হইছে? ভেজলিন কই ভেজলিন। আজ আমি নিজের হাতে মন্টুর পাছায় ডিম রোপন করব”। আচ্ছা ডিম কি রোপন করা হবে না বপন?
গ্রাজুয়েসন কমপ্লিট করেছি অথচ ডিম রোপন হবে না বপন হবে তাও জানি না। আমার বাপটা মনে হয় ঠিকই বলে। পাশ করে বের হবার আগেই আমাকে নিয়ে বসিয়ে দিলেন কম্পিউটার শিখতে। গুনে গুনে পনের দিন পরে ট্রেনিং সেন্টারে আমার পাশে বসলেন। দু ঘন্টার ট্রেনিং সেসনেও যখন দেখলেন আমার একটা দু পৃষ্ঠার দরখাস্ত লেখা শেষ হলো না তখনই শুরু হলো তার চিরাচরিত ”পরিসংখ্যানীয় জ্ঞানদান”। ”ধরো ঘন্টায় তুমি এক পৃষ্ঠা করে টাইপ করলে মানে তোমার অফিস সময়ে মোট ৭পৃষ্ঠা.... আমি বললাম বাবা অফিস তো আট ঘন্টা.... কথা শেষ না হতেই বললেন ”তুমি কি লাঞ্চ করার সময়ও টাইপ করবে? একদিকে তুমি ঘাপুস ঘুপুস খাবে আর তা দেখে কম্পিউটার তোমার দিকে তাকিয়ে লোল ফেলবে?” অকাট্য যুক্তি, আমি চুপ হয়ে গেলাম তিনি আবার বলা শুরু করলেন। ”যা বলছিলাম, পৃষ্ঠা প্রতি ৩০টাকা হলে ৭টা পৃষ্ঠার বাজারদর ২১০টাকা। তুমি অপারেটর, তার উপর সুপারভাইজার, অফিসার, ম্যানেজার, এমডি... এই ২১০টাকায় কি সবার পরিবারের পেট চলবে? কথা যুক্তি সঙ্গত, এই টাকায় এতগুলো পেট চলবে না। আমার পরিবারের কারো ভুড়ি না থাকলেও উপরলাদের নিশ্চয় কম খাবারে চলবে না। আচ্ছা অফিসের কাজও কি পৃষ্ঠার বাজার দর হিসেব করে হয়? একটা শতকোটি টাকার টেন্ডারে কয়টা পৃষ্ঠা লিখতে হবে? হিসাবটা শতকোটি ভাগ ৩০ সমান সমান কত পৃষ্ঠা হতে পারে? বাবা ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন। ”চুপ বেটা ফকিরের পুত, তুই কামলার পোলা কামলার বাজারদর হিসাব কর, তোর টেন্ডারের হিসাব নিতে হইব না”।
তুমি থেকে তুইয়ে নেমে এলেন বাবা তাও ট্রেইনারের সামনে। মান ইজ্জত আর কিছুই বাকি থাকল না। খুব ইচ্ছে করছিল বলি ”ফকির মিয়া ও ফকির মিয়া তুমি যদি তোমার পোলাটারেও তোমার মত ফকির বানাইতে চাও তারে লেখা পড়া শিখাইছ ক্যান? বলো আল্লাহ নবীজির নাম/ আমার দিলে ভরসা / বলো আল্লাহ নবীজির নাম... শিখাইলেইতো হয়” হাজার কোটি মনের কথার মতো এ কথাও মনের ভেতরের তোতা পাখিটাই গাইতে থাকে, কখনোই ঠোটে উঠে আসে না। দাদা চাষী ছিলেন, বাবা লেখা পড়া করে কেরানী, আমি তারচেয়ে একটু বেশিই পড়ে ফেলেছি। আচ্ছা আনুপাতের সূত্রে আমি কি হতে পারি? ”অফিসার”! আমার ভেতরে একটা পুলক বয়ে যায়, আর ভেতরের পাখিটা বলে ”অফিসার সাহেব ও অফিসার সাহেব দেখেন শালারপুত মন্টু ওর বাপের টাকায় কুত্তারে খাওয়ায় আর আপনে সাত পৃষ্ঠা টাইপ করেও বাপেরে কিছু খাওয়ানোর যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন নাই। হাবিলদার ডিম সিদ্ধ হইছে.......”
মেয়েগুলো কত সুন্দর হয়, তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে আর আমার বোনটা হয়েছে ঠিক বাবা মায়ের কুৎসিত চিন্তা চেতনার মতো। কুৎসিত চিন্তা চেতনা যদি দেখা যেতো হয়তো ওর মতোই দেখাতো। দেখতে কালো, যেই সেই কালো না, একেবারে মান্দার গাছ পোড়া কয়লার মতো মিশমিশে কালো, আবার বেটে, যাকে বলে একেবারে বাটকু। আমার চার বছরের বড়, অথচ দেখলে সবাই বলে আমার ছোট। বিয়ে হচ্ছে না ওর। কে করবে বিয়ে? কোন না কোন গুণতো থাকা চাই। ওর কিছুই নেই না পড়ালেখায় ভালো না কোন কাজে কর্মে। আমি মাঝে মাঝেই অবাক হয়ে যাই ও বেঁচে থাকলো কেমনে? যে বাবা মা ছেলের কাজেরই হিসাব করে ফেরে, সেই বাবা-মা জন্মের পর মেয়েটাকে নিয়ে কি করবে সে হিসাব করবে না! ভাববে না এই মেয়ের বিয়ে ইহ জীবনে হবে না, সারা জীবন কোলে বসে খাবে আর পায়খানা ভরে হাগবে!
সূর্য ওঠার আগেই মাসুদাকে ঘুম থেকে উঠতে হয়। ও বলিনি মাসুদাই আমার বোনেটার নাম। উঠেই চুলায় পানি গরম করতে বসিয়ে দেয়। আমার মা আবার কাই করা রুটি ছাড়া খেতে পারেন না। উনি নাকি প্রধান বংশের মেয়ে। আর প্রধান বংশের মেয়েদের স্বামীর বাড়িতে কাজ করতে নেই যতদিন তার শাশুড়ি বেচে ছিলেন কাজের ডিপার্টমেন্ট নিয়ে আর প্রধান বংশের মেয়ের চিন্তা করতে হয় নাই। দাদী মনে হয় একটা যোগ্য উত্তরসূরী হাতে পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। মাসুদা যখন ঘরের কাজ করার উপযুক্ত হলো তখন কামলা ডিপার্টমেন্টটা মাসুদাকে দান করে দাদার হুরেদের সর্দারনী হতে চলে গেছেন। দাদী বেহেশত না পেলে অন্য কেউ পাবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। যে মহিলা তার ছেলের বউয়ের কামলা দিয়ে মরে আল্লাহ নিশ্চয় তার প্রতি অবিচার করবেন না। সমস্যা হলো দাদা কোথায় আছেন। তার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। দোজখের সাথে একটা লাল ফোনের সংযোগ থাকলে নিশ্চিত হওয়া যেত।
অথচ খিলি মুখে মা যখন প্রতিবেশির সাথে আলাপে থাকেন সবাই কত প্রশংসা করে। আপনার মতো বউ পেলে যে কোন শাশুড়ি সুখি হবে। আর মা চোখের পানিতে তার গাল ভিজিয়ে ফেলেন। আমি বলি ”খালাম্মা আর বলবেন না, দাদীর সেবা করতে করতে মায়ের বয়স দশ বছর বেড়ে গেছে, কি রোগা হয়ে গেছেন মা!” সবার চোখ ফাকি দিয়ে মা আমার দিকে নাগীনির মতো তাকান।
গত দশ বছর ধরে রুটি বানিয়েও মাসুদা বৃত্ত জিনিসটা কি তা আবিস্কার করতে পারে নি। ওর বানানো রুটি আয়তক্ষেত্র, রম্বস আর ত্রিভূজ হলেও কখনোই গোলাকৃতি পায়নি। সৃষ্টি কর্তা সব মানুষের ভিতরে কিছু না কিছু অপূর্ণতা রেখে দেন। অন্তত সেই অপূর্ণতার জন্য হলেও যেন মানুষ তাকে স্মরণ করে। মাসুদাকে দিয়েছেন শুধু একটা মাত্র পূর্ণতা। ও যা করে হৃদয় দিয়ে করে। ওর বানানো ত্রিভূজের চেয়ে স্বাদের খাবার আমি বেহেস্তেও পাব বলে মনে করি না। ওর সাথে আমি কখনোই ভাল আচরণ করি না, বাবা-মাও করে না। ওকে আমরা প্রতি পদে পদে বুঝাই ও একটা বোঝা হয়ে চেপে বসে আছে। ও এত রূঢ় আচরণেও কখনো চোখের জল ফেলে না। হয়তো প্রথম প্রথম ফেলতো আমি দেখিনি, অথবা দুঃখ বোধ বলে কিছু ওর ভেতরে কখনোই ছিল না।
আমার যদি অনেক অনেক টাকা থাকতো আমি মাসুদাকে নতুন আকৃতিতে গড়ে তুলতাম। ওর গায়ের রঙ বদলে দিতাম। প্লাস্টিক সার্জনদের ”ব্যারি মূর”কে এনে দেখাতাম এমন রং চাই। দরকার হলে হাড্ডিগুলাও বদলে দিতাম। আজকালতো কত কিছুই হচ্ছে, ছেলে মেয়ে হয়ে যাচ্ছে, মেয়ে হচ্ছে ছেলে। মাসুদা পরীর মতো হয়ে গেলো, হাজার হাজার উৎসুক চোখ সব সময় আমাদের ভাঙ্গাচোরা ঘরের আশে পাশে ঘুরে বেড়াবে। আমি বের হলেই সবাই আমাকে সালাম দিবে... স্লামআলাইকুম ভাইয়া, ভালো আছেন। খালাম্মা খালু ভাল আছে? চলেন এক কাপ চা খাই...। আচ্ছা কত টাকা হলে তাকে অনেক টাকা বলা যায়? আমি জানি না, আমার কাছে কখনোই টাকা থাকে না। দেশে এখন এত রঙের টাকা, কোনটার কত দাম আমি জানি না, চিনিও না। চিনে লাভ কি? ফকিরের পুতের একশ টাকা পর্যন্ত চিনলেই জীবন চলে যায়। বেশি চিনার কোন দাম নাই।
আমার অনেক টাকা হলেও মাসুদার হৃদয়টা কখনো বদলাতাম না। এইটুকু জিনিসইতো ওর নিজস্ব, সারা পৃথিবীর সবার কাছ থেকে আলাদা করে তো এই হৃদয়টুকুর জন্যই ওকে চিনে নেয়া যায়। আমার খুব ইচ্ছে মাসুদা হাসবে, উচ্ছাসে খল খল করে হাসবে, ঠিক খলসে মাছের মতো। হাসতে হাসতে ডুবে যাবে আবার ভেসে উঠবে। ওর হাসির নিচে চাপা পড়ে যাবে আমার ঘন্টায় এক পৃষ্ঠা কম্পোজ করার দুঃসহ স্মৃতি। তখন হয়তো বাবা-মা ওকে আর ত্রিভুজ কাইয়ের রুটি বানাতে বলবে না। কোন এক বেসুরো রাতে মাসুদা আমার মাথার কাছে এসে বসবে। আলতো হাতে মাথায় বিলি কেটে বলবে ”ভাই, তুই আমাকে মানুষের মর্যাদা দিয়েছিস”। খুব সংগোপনে ওর চোখের দুফোটা জল ঝরে পড়বে আমার গালে।
আমার আজ কি হয়েছে? এত উদ্ভট চিন্তা করছি কেন? আমিতো এত ভাল মানুষ না যে টাকা হলেই আমি ঐ কালো ভুতটার পিছনে সব খরচ করে ফেলতাম। সব দোষ রুমার। কি নির্লজ্জ মেয়েরে বাপ। সকাল বেলায় কলপাড়ে জামাকাপড় ধোয়ার মাঝেই ঝাপ খুলে ঢুকে পড়েছে। আর কি বেহায়া আবদার "সুমন তোমার সাথে এক বাথরুমে গোসল করব, তোমার জামা কাপড় কেচে দিব” এটা কোন কথা হলো? আমি কি ওর নতুন জামাই হই যে সে আমার সাথে গোসল করবে!
আমি কখনো হুর দেখিনি। সাইদির ওয়াজে শুনেছি হুরেরা নাকি অনেক সুন্দরী হয়। শরীরের চামড়ার ভিতর দিয়ে হাড়গোড় সব দেখা যায়। পুরুষ মানুষের কাছে এরচেয়ে লোভনীয় আর কি হতে পারে আমার জানা নেই। রুমা হুরের মতো না। ওর হাড়গোড় দেখা যায় না, তবে ধবধবে ফর্সা একটা মেয়ে। শুধু ফর্সাই না একে ধরণীর হুর বলা যাবে কিনা সাইদি সাহেবের কাছে জানতে চাইলে বলতেন ”মাশাল্লাহ্ এরে হুরের মতোই লাগে” আমি কখনো ওর চোখের দিকে তাকাতে পারি না। আমার গলা শুকিয়ে যায় নিঃশ্বাস আটকে আসে, ওর কালো চোখে সময় ভুল পথে এগুতে থাকে। মা বলেছেন ”এই মেয়ের মাথায় নির্ঘাত ছিট আছে, ওর কাছ থেকে দূরে থাকবি”। আগামী সপ্তায় রুমার বিয়ে। ছেলে আমেরিকান সিটিজেন। সেখানে পাঁচটা রেস্টুরেন্ট আছে ওর। বোকা মেয়ে বলে কিনা আমার সাথে...
রুমার কাছ থেকে পালিয়ে সেই যে ভিজে কাপড়ে বেরিয়েছি...। মাসুদার ত্রিভুজ রুটি এখনো আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে। রুমা কি এখনো আমার ভাঙ্গা ঘরে বসে আছে আমার ফিরে যাওয়ার আশায়? আচ্ছা একটা হুরের মতো বউ পালতে কত টাকা লাগে? স্নো পাউডার ছাড়া কি রুমা মাসুদার মতো কয়লা হয়ে যাবে? তখন কি সে মাসুদার মতোই তিন কোনাইচ্চা রুটি বানাবে? ওর দিকে কি তখন আমিও তাকাব না? আমার ভেতরের তোতা পাখিটা শুধুই আবোল তাবোল বকে যাচ্ছে। আমার কোন টাকা নেই। কেরানী বাপের তো সংসার চালাতেই বাত্তি নিভে যায়। অথচ মন্টু গত কালইতো থানায় দুলাখ টাকা দিয়ে এলো মাগীবাজী করে ধরা খাওয়ার পর। রিমান্ডে ডিম থেরাপী দেয়ার কথা শুনেই টাকা দিয়ে দিল।
মানুষের কত টাকা! একটু ভয়েই দিয়ে দিতে পারে। আর আমি নিজে খাবার টাকা রোজগার করতে পারি না। এত সুন্দর একটা মেয়েকে আপন ভাবতে পারি না। তাকে বলতেও পারি না ”এই পাগলের সংসারে আরেকটা পাগলের জায়গা হবে নারে রুমা”।
এখন অবশ্য কাপড় শুকিয়ে গেছে। তবে যা শুকোবার খুব দরকার ছিল সেটা এখনো ভিজে আছে। আমার মন ভালো নেই। আমি আকাশের দিকে চেয়ে থাকি, ভেতরে একটা পাখি গায়
কোন এক মায়াবী জোছনায়
ছল ছল বৃষ্টির ভরা বরষায়
তুমি আমি হাতে রেখে হাত
অজর ঝরে ভিজব সারারাত...
২৬ আগষ্ট - ২০১২
গল্প/কবিতা:
১০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪