মানুষ বয়সে যত বড় হোক। টাকার যত পাহাড় গড়ুক। শৈশবের স্মৃতির ছায়া তলে তাকে আসতেই হয়। পরবর্তী জীবনে, শত ব্যস্ততার মাঝেও মনে পড়ে সেই সু-মধুর ক্ষণ। মনে উঁকি দেয় স্কুল। বন্ধুবান্ধব। শিক্ষকদের ভয়, আদর। পড়া পাড়া না পাড়ার আনন্দ, ভয়। বায়োস্কপের ছবির মতো মনে ভেসে উঠে, সেই দিন গুলি। ভোরের আম কুঁড়ানো থেকে শুরু করে। বৃষ্টি ভেজা। বিলের মাছ ধরা। সন্ধায় চোর পুলিশ খেলা রাতের ঘুম পর্যন্ত । কোন কিছুই বাদ পড়ে না। শৈশবের সব স্মৃতি মনে থাকেনা। মনে করতে চাইলেও অনেক সময় আসে না। আবার হঠাৎ হঠাৎ দুএকটি স্মৃতি, মাটি ফুঁড়ে বেড়িয়ে আসা অঙ্কুরের মতো, হৃদয়ে উঁকি দেয়। তখন নিরব ঝর্ণা হয়ে ঝড়ে হৃদয়ের জল। অথবা খুশিতে নেচে উঠে ধমনি। প্র্রতিটি মানুষের জীবনে শৈশব শিক্ষা লাভের উপযুক্ত সময়। জীবন গঠনের সময়। শৈশব একটি অমূল্য সম্পদ।
ক্লাস সেভেন থেকে শুরু হয় আমাদের সুটিং দেখা। আগে একদিন যেতাম। এখন এইটে। তাই সপ্তাহে দুইদিন যাই। একদিন যাই হলে ছবি দেখতে। প্রতি সপ্তাহে চার পাঁচদিন স্কুল কামাই করি। বৃষ্টির দিনে চকের মাঝ দিয়ে যাওযার সময় একজন আরেক জনকে ভিজিয়ে দেই। অথবা খালের স্রোতে পড়ে যাই। বই গুলো শুকনো মাটিতে রেখে। তারপর বাড়িতে ফিরে আসি। কিরে রফিক তুই স্কুলে যাছনাই। না মা, চক ডুবে গেছে যাওয়া যায় না। মার কথার জাবাব দিতাম জোরে জোরে। আস্তে আস্তে বললে বিশ্বাস করবেনা। তাই মিনমিন করে কোন কথা বলতাম না। আরেক দিন ফিরে এসে বলি, আজ স্কুল বন্ধ। তুই না কালকে স্কুলে গেলি তাইলে জানসনা যে স্কুল বন্ধ ? আমাদের রুমে বন্ধের নোটিশ দেয় নাই। আমরা জানমু কেমনে ? ভাত খাবি ? বারমু ? না খাইতাম না। বলেই ছুট এ পাড়া ও পাড়া।
স্কুলে গিয়ে পড়া না পাড়লে, স্যারের বেত থেতে হয়। ফিরে আসলে বাড়িতে কৈফিয়ত দিতে হয়। ধমক আর মার খেতে হয়। স্কুলে নাগিয়েও বাড়িতে থাকা যায় না। বাড়ি সবাই ক্ষেপে উঠে। স্কুলে গেলেও বিপদ না গেলেও বিপদ। তার চেয়ে ভাল স্কুলেও যাব না, বাড়িতেও আসবনা। যাব অন্য কোথাও। তিন চার পাড়ায় মিলে আমাদের দলের সদস্য বার জন। কপাল গুণে আমরা একি ক্লাসে। সবাই দীঘির পাড়ে একত্র হই। তার পর স্কুলের রাস্তায় হাটি। তখনো আমরা জানিনা আমাদের গন্তব্য। আজ কোথায় যাব। স্কুলে, নদীর পাড়ে, অন্য গ্রামে, হলে না সুটিংএ। যে দিন স্কুলে যাই সেদিন রুম ভরে যায়। যে দিন না যাই সেই দিন রুম ফাঁকা থাকে। স্কুলে গেলে সবাই যাই। না গেলে কেউ না। সবাই একসাথে ছবি দেখতে যাই। সুটিং দেখতে যাই। স্কুলের আরো কয়েকজন ফাঁকিবাজ ছাত্র আমাদের সাথে যোগ দেয়। তখন সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। ফাঁকা ফাঁকা হয়ে হাটি, লম্বা লাইন করে। ক্ষেতের আইল দিয়ে হাটলে আইল ভরে যায়। গাড়ীতে উঠলে গাড়ী ভরে যায়। ঘুরতে গিয়ে আমাদের কেউ না কেউ, কোন না কোন অন্যায় করে। লোক সংখ্যা বেশি আবার স্কুল ড্রেস পড়নে তাই সমবয়সীরা ভয়ে কিছু বলে না। অন্য স্কুলের ছাত্ররাও ভয় পায়। অনেক বয়স্ক লোকও চুপ থাকে। কেউ লাগতে আসে না। হলের গেইটম্যান, লাইটম্যানদোর সাথে ভালো সম্পর্ক। গাড়ীর স্টাবদের কাছে মুখ চেনা হয়ে গেছি। ভাড়া নিয়ে সিট নিয়ে লোকেরা ঝগড়া করলে, আমরা মিট করি। ঘাড় ধরে গাড়ী থেকে ফেলে দিতে চাই। তাই স্টাবরা ভয়ে ভাড়াও নিতে আসেনা। কেউ বা ভাড়া চাইলে, গুণে গুণে জন প্রতি পঞ্চাশ পঁয়সা করে ভাড়া দিয়ে বলি, ন্যাশনাল পার্ক, ছাত্র ভাড়া। জন প্রতি পাঁচ টাকা হলেও ভয়ে, কাঁধে ঝোলানো চামড়ার ব্যাগে রেখে দেয় চুপ করে।
স্কুলে কত কত মিথ্যা কথা বলি। আমাদের কত আত্মীয় স্বজনের মরার দোহাই দিয়ে বেত থেকে বাঁচি। যে বিশ বছর আগে মারা গেছে, তাকে আবার নতুন করে মারি। যারা জীবিত তাদেরকোও মারি। কারো দাদা-দাদীর দুইতিন বার করে মৃত্যু হয়েছে। বাড়িতে এসেও মিথ্যা বলি। উমুক স্যারের মা মারা গেছে। তুমুক স্যারের ভাই মারা গেছে তাই স্কুল বন্ধ। স্কুল আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। পুরোটাই হাটার রাস্তা। ক্ষেতের আইল দিয়ে, চক খাল বিল পেরিয়ে যেতে হয়। তাই বাড়ি থেকেও খবর নিতে পারেনা। কোন দিন স্কুল বন্ধ, কোন দিন স্কুল খোলা।
কিরে অংক শিখে আসিস নি কেন রে ? রাজশাহীর শুদ্ধ ভাষায় প্রশ্ন করে আমাদের রাজ মোহন স্যার। কোন ক্লাসে কি পড়া, আগের দিন স্কুলে নাগেলে পরের দিন জানার কথা নয় । পড়া পাড়া তো দূরের কথা। আমরা রোজকার মতো বাহানা ধরি। যে দিন পড়া কঠিণ মনে হয়। সে দিন স্কুলে যাই না। পরদিন গিয়ে সেই আগের দিনের মতো প্রশ্নের মুখে পড়ি। কিরে অংক শিখে আসিস নি কেন রে ? আমরা পালা করে উত্তর দেই। কারো উত্তরের সাথে যেন কারো উত্তর না মিলে।
স্যার কাল জ্বর ছিল। কেউ বলত স্যার সন্ধা কালে বাড়িতে চোর এসেছিল। সে কি হৈ চৈ ভয়ে আর পড়া হয়নি। তার আগের সপ্তায় বলে ছিলাম, আমার দাদী মারা গেছে। গত কাল তুহিন বলেছিল তার দাদী মারা গেছে। তার আগে বলে ছিলাম দাদা গত কাল রাস্তায় এক্সিডেন্ট হয়েছে, তাই স্কুলে আসতে পারিনি। প্রায় দিনই ঘটত এমন ঘটনা। বানিয়ে বানিয়ে আর কত বলা যায়। আজও আগের মতো বয়ান। স্যার খুব ভাল করেই বুঝে যেতেন আমাদের কাহিনী। আজকেও বুঝতে বাকী রইলনা। শুরু হল কান মলা। প্রথম দুজনের কান লাল করে, বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে পাছা গরম করে নিলেন। তারপর তিন নম্বরের কাছে গেলেন। তার পরই আমার সিরিয়াল। আমি ভয়ে কাচুমাচু। অন্য দিনের মতো আজ বাড়ি থেকে তেল দিয়ে আসেনি সবুর। তেলের বোতল সাথে করেই নিয়ে এসেছে। বাড়ি অনেক দূরে। বাড়ি থেকে তেল দিয়ে আসলে, আসতে আসতে শুকিয়ে যায়। স্যার রুমে আসার আগেই বোতল বের করে ভাল করে দুকানে একবার করে মেখে নিয়েছে। আমিতো তাও দিলাম না। যদিও কোন দিন দেইনি। আজ রক্ষা নেই। পিট্টি খেতেই হবে।
তিন নম্বরকে জিজ্ঞেস করল। কিরে তুই পড়া শিখে আসিসনি কেন রে ? বেতের আগা চোখের সামনে ঘুড়াতে ঘুড়াতে, বাম হাতে কানে মোচর দিয়েই - এ্যাঁ রে কি রে ? বলে স্যার চিললাতে শুরু করলেন। তার পর মুখের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বললেন- কিরে সবুর, তোরা কি কুলু নাকিরে ? কেন স্যার না স্যার - তাহলে কানে এত তেল দিয়েছিস ক্যান রে ? না স্যার আমরা কুলুনা স্যার। আমরা বললাম। না স্যার ও কুলুনা। সমস্ত ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা হাসতে হাসতে দম বন্দ হয়ে যাওয়ার যোগার। কেউ হাতে মুখ চেপে হাসছে। কেউ বেঞ্চের নিচে মাথা দিয়ে হাসছে। মেয়েরা মুখে ওরনা গুজেও রেহাই পাচ্ছেনা। চোখদিয়ে পানি বের হয়ে গেল সবার। স্যারও বেদম হাসতে হাসতে বললেন- তাহলে তুই পড়া শিখে আসিসনি বলেই কানে তেল মালিশ করে এসেসিস না রে। কান মলা থেকে বাঁচতে নাআআআ এ্যাঁ রে। সবুরের পেন্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে কান মোচড়িয়ে মোচড়িয়ে ঘষে ঘষে তেল মুছে নিল। এবার আমরা কারো মুখের দিকে তাকাতে পারছিনা। চোখে চোখ পড়লেই হাসির মাত্রা আরো বেড়ে যায়। দম বন্ধ হয়ে যায়। তাই চোখ বন্ধ করেও কেউ হাসছে। আমরা নাপাড়ার দলেরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি শাস্তির মাত্রা ও ধরন।
এবার, এবার কেমন লাগছে তোর। বল বলরে, পড়া না শিখে আসলে কেমন মজা লাগে। সবুরকে বেঞ্চের উপর না দাঁড় করিয়ে কান ধরে টেনে নিয়ে গেলেন টেবিলের কাছে। বেঞ্চ আর টেবিলের মাঝে দাঁড় করালেন। বাম হাতে ঘাড় ধরে মাথাটা কাঁত করলেন সামনের দিকে। উপর করে ধরে শুরু করলেন বেতের ঝনঝনানি। বাম পাছার মধ্যে ছ্যাত্ ছ্যাত্ কয়েকটা শব্দ করল। ডান পাছায় শুরু করা প্রথম বাড়িতেই, কিছু একটা ভেঙ্গে গেল। ডুপ করে অন্যরকম একটা শব্দ হল। স্যার ঠিকি বুঝলেন। এ তো মাংসে লাগে নাই। হাড়েও লাগে নাই। তাহলে কোথায় লাগল। কোনটা মাংসে লাগে, কোনটা হাঁড়ে। কোনটা পকেটে রাখা রুমাল কিংবা, বেত থেকে রক্ষা পেতে পকেটে রাখা মোড়ানো কাগজে লাগে, এসব কিছু স্যারের এখন জানা। প্রতিদিন পিটাতে পিটাতে এখন তার মুখস্ত। সবাই চুপ হয়ে ভাবছে। আমিও ভাবতে লাগলাম, কিসের শব্দ হল ? সবুর উরে বাবারে উরে বাবারে, বাপরে বাবারে ও স্যার গো ও স্যার গো করে চিল্লাতে শুরু করল। এ অবস্থা দেখে স্যার একটু থেমে গেলেন। সবুর ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছেনা। ছটফট করছে। পাছা নাড়া চাড়া করছে। পেন্টের উপর দিয়ে হাত ঘষে বুঝতে চেষ্টা করছে, কতটুকু ডুকেছে। আর বলছে, ও স্যার গো ও স্যার গো, মাফ কইরা দেন। মাফ কইরা দেন গো স্যার গো। তেল পড়ে ফ্লোর ভরে যাচ্ছে। একজন বলল, স্যার রক্ত পড়ছে। নেভি ব্লু পেন্টে লাল রক্ত বুঝা যায়না। ফুটা ফুটা রক্ত ফ্লোরে পড়ছে। রক্ত দেখে আমরা সবাই নিঃস্তব্ধ হয়ে গেলাম। স্যারও কেমন যেন হয়ে গেলেন। সেভেন ও নাইন টেনের স্যার ও ছাত্ররা সহ সমস্ত স্কুলের ছাত্ররা আসতে শুরু করেছে। কাঁচের বোতল ভেঙ্গে টুকড়া চামড়ার ভিতরে ঢুকে গেছে। হেড স্যার দপ্তরি দপ্তরি, ছেলেটাকে অফিস রুমে নিয়ে আস। জায়গাটা ধুয়ে পরিষ্কার কর, সেভলন লাগাও বলে ডাকছেন। এখন আমার সিরিয়াল। আমার আত্মায় পানি নাই। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। জিহ্বা খসখসা, ঘুরছে না। ঢোক গিলতেও পারছি না। বুকের ভিতর জ্বালা পোড়া শুরু হয়ে গেছে। শারীর কাঁপছে। মনে মনে শুধু বলছি। আল্লাহ আজকে আমারে মাফ কইরা দেও, কাল থেকে আমি সব পড়া মুখস্ত করে আসব। স্যার, জীবনে কোন দিন পড়া না শিখে আসবনা। কাল থেকে আমি সব পড়া শিখে আসব। মুখস্ত করে আসব। আমি স্যারের দিকে সরাসরি না তাকিয়ে আড়চোখে তাকিয়ে দেখছি, স্যার আমার দিকে আসে কিনা। আমার দিকে তাকায় কিনা। আমাকে ডাকে কিনা।
২৫ আগষ্ট - ২০১২
গল্প/কবিতা:
১২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪