স্বপ্নীল-আভা

মুক্তিযোদ্ধা (ডিসেম্বর ২০১২)

শাহ আকরাম রিয়াদ
  • ২০
  • 0
আগে কখনো প্রকৃতি নিয়ে ভাবেনি স্বপ্নীল | প্রকৃতির এত সৌন্দর্য সে উপলব্ধি করেনি। কিন্তু ইদানিং তার চোখে প্রকৃতির নানা বৈচিত্র্যে ভরা সৌন্দর্য চোখে ধরা দিয়েছে। তার পুরো জীবন যেন বদলে যাচ্ছে। আগের মত আর অনিয়মের নিয়মে চলে না জীবন। মায়ের বকুনি কমে গেছে অবিশ্বাস্যহারে। বাবার রাগী চেহারা আর মনে হয় না তার চোখে। তাই আগের মত পালিয়ে থাকে না বাবার কাছ থেকে। বাবা মার একমাত্র সন্তান সে। বড় হয়েছে অনেক আদর যত্নে। বাবা অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক আর মা গৃহিণী। বাবাকে ছোট বেলা থেকে যমের মত ভয় পেত সে। তাই মোটামোটি বাবাকে এড়িয়েই চলতো আর মায়ের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তার। সবকিছু মায়ের সাথেই শেয়ার করে সে। একদিন তার মা তাকে বলেই ফেলল:
-কিরে হঠাৎ এত নিয়মতান্ত্রিক হয়ে গেলি যে? কি কারণ?
মায়ের কথা শুনে স্বপ্নীল অবাক হল। মার চোখেও ধরা পড়েছে তার পরিবর্তন। সে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল: -মা! মানুষ কি সব সময় একভাবে চলে? তার জীবনে পরিবর্তন আসতেই পারে।
মাও নাছোড়বান্দা তাই পুনরায় বলল: -তা তো পরিবর্তন আসতেই পারে। তবে তার কোন না কোন কারণ তো অবশ্যই থাকে। তা তোর কারণ কি?
মায়ের চোখে মুখে দুষ্টুমির হাসি দেখে সে বুঝল পরিস্থিতি সুবিধের মনে হচ্ছে না। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল: -সব কাজের কারণ থাকতে নেই মা। এই যে তুমি যে আমার বন্ধু এর কি কোন কারণ আছে?
- প্রেমে ট্রেমে পড়িসনি তো আবার? আমার কাছে লুকালে তোকে-ই পরে পস্তাতে হবে, বলে রাখলাম।
- মা তুমি যে কি সব উল্টা পাল্টা বল না? লোকে শুনলে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবে । আমার হবে প্রেম, তাও বিশ্বাস করা যায়! আমি যাচ্ছি। তোমার এই বকবকানি আর ভালো লাগছে না।
সে আর কোন কথা শুনার অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বেরিয়ে এলো।
মায়ের চোখে সন্দেহটা মিথ্যে নয়। রাস্তায় বের হয়ে সে আভার কথা ভাবে। আভা তার সহকর্মী। দু’মাস হল বদলী হয়ে তাদের অফিসে এসেছে। স্বপ্নীল নিজেও জানেনা কখন সে আভাকে ভালবেসে ফেলেছে। কর্মক্ষেত্রে স্বপ্নীল আভার সিনিয়র। কাজের প্রয়োজনে দুজনে কাছাকাছি হয়েছে বহুবার। তবু আজও আভাকে বলা হলো না স্বপ্নীলের ভালবাসার কথা। যদি সে ফিরিয়ে দেয়। তারচেয়ে একাকী নীরবে ভালবেসে যাবে সেই ভালো। আভাকে একদিন না দেখলে স্বপ্নীল অস্থির হয়ে উঠে। তার যেন মনে হয় আজ রাতে আকাশে আর চাঁদ আসবে না। বাগানে ফুলেরা ফুটবে না। পাখিরা গাইবে না মিষ্টি সুরে কোন গান। তাকে না দেখলে মনে হয় আকাশটা বেদনায় নীল হয়ে এক সময় কালো হবে, তারপর অঝোর ধারায় কাঁদবে। মাঝে মাঝে অফিসে আভার দিকে তাকিয়ে থাকে সে অন্য সহকর্মীদের আড়াল করে। বহুবার চোখাচোখি ধরাও পড়েছে সে আভার চোখে। আভাও যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব রাখে নিজের মাঝে। তবে মাঝে মাঝে স্বপ্নীল আভাকে দেখে, তার মাথার বা পাশটা চেপে ধরতে। একদিন এরকম ভাব দেখে স্বপ্নীল নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে আভাকে জিজ্ঞাসা করল : কি ব্যাপার আভা তোমার কি শরীর টরীর খারাপ? তাহলে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে যাওনা কেন?
আভা তার মুখে স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়ে বলল : না স্বপ্নীল সাহেব তেমন কিছু না। মাথার বাম দিকটায় একটু ধরেছে। ও ঠিক হয়ে যাবে।
স্বপ্নীল একরকম জোর করে বলল: তা বললে তো হবে না। যাও বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নাও। কোন জরুরী কাজ থাকলে আমার কাছে দিয়ে যাও।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও আভা অফিস থেকে ছুটি নিল।

আজ দুদিন হলো আভাকে অফিসে দেখছে না স্বপ্নীল | খোঁজ খবর নিয়ে যা শুনলো তাতে সে আঁতকে উঠল। আভার ব্রেন হেমোরেজিক স্ট্রোক হয়েছে! তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তার বলছে জরুরী ভাবে অপারেশন করাতে হবে। তা না হলে বড় ধরনের অঘটন ঘটতে পারে। প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকার মত অপারেশন বাবদ খরচ পড়বে বলেছে ডাক্তার। আভাদের পাঁচ সদস্যের পরিবারে একমাত্র অবলম্বন সে । তার বাবা মুক্তিযুদ্ধে স্প্রিন্টারের আঘাতে চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। ১৯৭১ সালে আর সবার মত টগবগে যুবক ছমির খাঁ দেশের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে গেলে ক্যাপ্টেন আহমদ শেখ তাকে দেখেই জিজ্ঞেস করল: কি মিয়া দেশের জন্য জীবন দিতে পারবা তো?
আগ পিছ না ভেবে যুবক ছমির এক বাক্যে বলে ফেলল: হ স্যার পারমু।
যুবকের কথা শুনে ক্যাপ্টেন তার কাঁধে একটা চাপড় দিয়ে বলে উঠল: সাবাস! ব্যাটা।
এরপর ট্রেনিং নিয়ে সক্রিয় ভাবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল যুবক ছমির। মাঝে মাঝে বাড়ির কথা মনে পড়ে তার। মা-বাবা, ভাই-বোনদের কথা মনে পড়ে। আরও মনে পড়ে সায়েরার কথা। সায়েরা? যাকে সে ভালবাসে, যে তাকে ভালবাসে। বাড়ি থেকে আসার দিন দাঁড়িয়ে ছিল সে স্কুলের পুকুরপাড়ে বড় বটগাছটার নিচে। হয়তো এই-ই ছমিরের সাথে তার শেষ দেখা হতে পারে মনের মাঝে সে আশঙ্কা বাজছে। তবুও সে শক্ত হল পাথরের মত। ছমির তার প্রেয়সীকে বুঝে। তাই তাকে বলল: তুমি কোন চিন্তা করো না, যুদ্ধ শেষ হলে আমি ফিরে আসবো। এই দেশটাকে আমাদের স্বাধীন করতে হবে। তারপর স্বাধীন দেশে আমরা ঘর বাঁধবো।
সেদিন বিদায় নিয়ে চলে গেলো ছমির। পেছনে পড়ে রইল সব। তবুও পেছনে একটিবারও চেয়ে দেখেনি আর। জানে সে তাকালে তাকে দেখতে হবে এক জোড়া অশ্রু ভরা চোখ। কারণ সে জানে সায়েরা যত পাথর হোক না তার অগোচরে ঠিকই অশ্রু ঝরবে। দেশের কথা ভেবে তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়েছে সব কিছু। ছমিরদের এই অঞ্চল অন্যান্য অঞ্চল থেকে একটু নিরাপদ ছিল। ছমির চলে যাওয়ার পর মাঝে মাঝে উড়ো খবর আসতো সে মারা গেছে বা তাকে পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে গেছে। সায়েরা কখনও বিশ্বাস করেনি এই সব উড়ো কথা। সে জানে ছমির ফিরে আসবে তার কাছে। সে কথা দিয়েছিলে ফিরে এসে ঘর বাঁধবে স্বাধীন দেশে। দেশ স্বাধীন হলো। ছমির ফিরে এলো একমাস পরে। কিন্তু এ কি! তার চোখ ব্যান্ডেজে বাঁধা। তাঁকে একটি জীপে করে ৪ জন খাকি পোশাক পরা ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়ে এসেছে। সবাই তাকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে বিছানায় শোয়ালো। হারানো মানিক বুকে পেয়ে ছমিরের মা কান্না জুড়ে দেয়। যেন কোন ছোট শিশু কাঁদছে। পাড়া প্রতিবেশী সবার চোখে জল। খবর শুনে পাগলের মত দৌড়ে এলো সায়েরা। এসে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল ব্যান্ডেজ বাঁধা ছমিরের পানে। যুদ্ধে ছমির তার সহযোদ্ধাদের সাথে বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের সাথে এক এক করে বিভিন্ন এলাকা থেকে হানাদার বাহিনীদের পিছু হঠতে বাধ্য করছিলো। এক পর্যায়ে নভেম্বরের ১১ তারিখ ফেনীর বেতিয়ারায় মহাসড়ক অতিক্রম করার সময় আকস্মিকভাবে প্রচণ্ড হামলার মুখে পড়ে ছমির সহ তার অন্যান্য সহযোদ্ধারা। পাকিস্তানী বাহিনীর ছোঁড়া গুলি ও গ্রেনেডের আঘাতে অনেকে মারা পড়ে। একটি গ্রেনেডের হাত থেকে সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে গিয়ে মারাত্মক ভাবে চোখে সিপ্রন্টারের আঘাত পেল ছমির। সে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। তারপর তাকে কাঁধে তুলে সহযোদ্ধারা পিছু হঠতে লাগল। সেখান হতে তাকে সীমান্ত দিয়ে ভারতে নিয়ে যাওয়া হলো। এতদিন সেখানেই ছিল সে। ভারতে প্রায় আড়াই মাস থাকার পর ছমিরের চোখের ব্যান্ডেজ খুলে ডাক্তাররা বুঝল সে আর কোন দিন চোখের দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাবে না। চোখের কন্ডিশন ভাল নয় দেখে আবার তাকে ব্যান্ডেজ করে দেশে পাঠিয়ে দিলো। সায়েরা মাঝে মাঝে এসে ছমিরকে দেখে যায়, কথা বলে ছমিরের সাথে। ছমির একদিন সায়েরাকে অন্য কাউকে বিয়ে করে ঘর সংসারী হওয়ার কথা বলে। কিন্তু সায়েরা কিছুতেই রাজী হয় না। তার এক কথা সে ছমিরকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। সায়েরার জেদের কাছে তার বাবা মাকে হারতে হলো। অবশেষে সে ছমিরকে বিয়ে করল। সে থেকে আজ পর্যন্ত ছমিরের সাথে সে জীবন অতিবাহিত করছে কষ্ট-ক্লেশে, সুখে-দুঃখে। বহু কষ্ট করে সন্তানদের মানুষ করেছেন সায়েরা বানু। সে কষ্টের ভার এখন পুরোটাই তার মেয়ের উপর পড়েছে। সাংসারিক খরচ ছাড়াও ছোট দুই ভাইয়ের পড়ালেখার সব খরচ আভাকেই জোগাতে হয়। সায়েরা বানু মেয়েটার বিয়ে দিতে পারেননি ছেলে পক্ষের দাবী দাওয়ার জন্য। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে। কিন্তু শেষ দিকে এসে ছেলে পক্ষ চাওয়া পাওয়ার কথা তুললে আভা একরকম নির্লজ্জের মত আড়াল থেকে এসে ছেলে পক্ষের সামনে বলে বসল:
-‘আমি আপনাদের কাছে হাতজোড়ে ক্ষমা চাচ্ছি। আমার এই বিয়েতে মত নেই। দয়া করে আপনারা এখন আসুন’।
তারপর আভা তার মাকে তার বিয়ে নিয়ে ভাবতে বারণ করে দিয়েছে। আভার একার রোজগারে এমনিতেই সংসার চালাতে খুব হিম শিম খেতে হয় সায়েরা বানুকে। তার উপর অপারেশনের এতগুলো টাকা কোথায় পাবেন তিনি? এই ভেবে সায়েরা বানু যখন প্রায় দিশেহারা তখন তার পাশে এসে দাঁড়ায় স্বপ্নীল | আভার বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র নিয়ে বিভিন্ন সরকারী দপ্তরে সাহায্যের আবেদন করে সে | মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়েও আবেদন করেছে। কিন্তু সাহায্যের ব্যাপারে কোন আশার আলো সে দেখতে পায়না। সবাই পরে দেখা করার কথা বলে।
ভর্তি হওয়ার চার দিন পরে আভার জোরাজোরিতে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে বাসায় নিয়ে আসা হয়। তবে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকার নির্দেশ দিয়েছে আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করার কথা বলেছে। দু’এক দিন পর পর অফিস শেষে স্বপ্নীল নিয়ম করে আভাকে বাসায় এসে দেখে যায়। আভাও পথ চেয়ে বসে থাকে স্বপ্নীল কখন আসবে। জানে না কেন সে পথ চেয়ে থাকে স্বপ্নীলের | যেন মনে হয় স্বপ্নীল তার বহু যুগের চেনা কোন মানুষ। যে পথ ভুলে এতদিন দুরে ছিল অন্য কোন পথে। এত ভাবনা স্বপ্নীলকে নিয়ে তার, তবুও আভা একদিন হাসতে হাসতে বলে বসলো : স্বপ্নীল সাহেব! আমাকে দেখতে আসা কি আপনার চাকরির অংশ হয়ে গেছে? স্বপ্নীল শুধু মৃদু হাসল কিছুই বলল না।

আজ অফিস থেকে বের হয়ে স্বপ্নীল শাহবাগের মোড়ে ফুলের দোকান থেকে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা নিল। তারপর রিকশা নিয়ে সোজা আভাদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। স্বপ্নীল এসে আভার হাতে ফুলগুলো দিয়ে একটা ছোট খাকি কাগজের খাম তুলে দিল। আভা অবাক হয়ে বললো: আপনি কি করে জানেন রজনীগন্ধা আমার খুব প্রিয় ফুল? স্বপ্নীল বললো : সত্যিকার অর্থে আমি জানি না রজনীগন্ধা তোমার প্রিয় ফুল। হয়তো আমার ভাল লাগে বলেই ভাবলাম তোমারও ভাল লাগবে। এরপর আভা খামটির দিকে তাকিয়ে বললো: -এটা কি?
-খুলে দেখো কি আছে।
আভা খামটি খুলে দেখল তার বেতনের টাকা। সে আশ্চর্য হয়ে বললো: ‘আমার বেতন হলো কিভাবে?’
জবাবে স্বপ্নীল শুধু বললো: ‘সুস্থ হয়ে নাও, তারপর সব জানবে। এখন জেনে কাজ নেই তোমার।’ এমন সময় স্বপ্নীলের সেলফোনটা বেজে উঠল। সে রিসিভ করে কথাবার্তার একপর্যায়ে বলে উঠলো: ‘দেখুন আমি আপনাকে কতবার বলবো আমি এসব করিনা। তারপরও আপনি বারবার আমাকে বিরক্ত করছেন কেন? দয়া করে আপনি আর আমাকে ফোন করবেন না। আমি এখন রাখছি।’ তারপর একরকম উত্তেজিত হয়ে ফোনটা কেটে দিল সে। তাকে খুব অস্থির দেখাচ্ছে দেখে আভা প্রশ্ন করল: ‘কি হয়েছে স্বপ্নীল সাহেব?’
-‘জহির মির্জা ফোন করেছে। তার ফাইলটাতে সাইন করে দেওয়ার জন্য।’
-‘সাবধানে থাকবেন লোকটা বেশী সুবিধের নয়।’
-‘আমি জানি।

স্বপ্নীল আরও কিছুদিন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দৌড়াদৌড়ি করেও আর্থিক সাহায্যের কোন আশা দেখল না। তার মনে পড়ে গেল একদিন আভা তাকে বলেছিলো: ‘আপনি মিছেমিছি কষ্ট করছেন। কোন কিছুই হবে না। এদেশে যেখানে অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা নেই সেখানে একজন অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের চিকিৎসার জন্য কি করবে সরকার। আসলে জানেন কি এই দেশটা কাগজে পত্রেই স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু বাস্তবিক ভাবে এখনো পরাধীন। যারা এই দেশের জন্য রক্ত দিয়েছে, যে উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধ করেছে সেটা আংশিক পূরণ হয়েছে। যে অংশটি হল আমরা পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়েছি। কিন্তু আমরা এখনো বন্দী হয়ে আছি আমাদের চিন্তা চেতনায়।
আশস্ত করেছিলো স্বপ্নীল | বলেছিলো: ‘একটা কিছু তো হবে। তুমি অত ভেবোনা।’
এখন দেখেছে সত্যি সত্যি-ই তো এত এত জায়গায় ছুটোছুটি করে আজ পর্যন্ত কোথাও থেকে কোন সাহায্যের আভাস মেলেনি। সে ভাবনায় পড়ে গেলো।
ফুটপাত ধরে হাঁটছে সে। মাথায় তার অবিশ্রান্ত ভাবনা। ভাবছে তার ভালবাসার কথা। যে আজ প্রায় মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে। বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠে আভার সদা হাস্যোজ্জল পবিত্র মুখ। সে কিছুতেই আর ভাবতে পারছে না। রাস্তার সাই সাই করে ছুটে চলা গাড়ি গুলোর হর্নের আওয়াজ তার কাছে কেমন ভোতা হয়ে গেছে। কোন কিছুতেই তার ভাবনায় চিড় ধরাতে পারছেনা হর্নের আওয়াজ। কি করবে সে এখন। অনেক ভেবে চিন্তে স্বপ্নীল একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো । তার সেল ফোন থেকে রিসিভ কলের একটি নম্বরে কল করল। ওপাশ থেকে বলল: ‘স্যার! আমি জানতাম আপনি ফোন করবেন।’

অবশেষে আভার অপারেশন হলো। প্রতিদিন তাকে দেখে যায় স্বপ্নীল | একটু সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে আভা। বাসায় ফেরার পরও কিছুদিন আসা যাওয়া ছিলো স্বপ্নীলের | পনের দিনের মত যখন আভা কোন ভাবে স্বপ্নীলের খোঁজ পাচ্ছেনা, তার সেলফোনও বন্ধ পাচ্ছে তখন সে অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। মায়ের বাধা স্বত্বেও সে অফিসে গেল। অফিসে সবাইকে দেখছে অথচ স্বপ্নীলকে দেখছেনা। তারপর ভাবলো হয়তো বদলি হয়ে গেছে। স্বপ্নীল সাহেবের বিষয়ে জানতে সে জি.এম বদরুল হায়দার সাহেবের রুমে প্রবেশ করে। কিছুক্ষণ পরে বের হয়ে ওয়াশরুমে গেল। তারপর দরজা বন্ধ করে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। স্বপ্নীল সাহেব ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে এখন কারাগারে! কিছুতেই সে বিশ্বাস করতে পারছেনা। সে নিজে অভিযোগ গঠন করে জি.এম সাহেব বরাবর অভিযোগ-পত্র জমা প্রদান করেছে। জি.এম সাহেব হাস্যরস ভেবে উড়িয়ে দিতে চাইলেও স্বপ্নীল বিষয়টি সিরিয়াসলি নেওয়ার কথা বলে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলো। তারপরও তার সুযোগ ছিল অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার যদি সে ঘুষের টাকা ফিরিয়ে দিতো। কিন্তু কিছুতেই রাজী করানো গেলো না। আদালত তাকে ২ বছরের কারাদণ্ড দেয়। আভা আরও জানতে পারল সে অসুস্থ হওয়ার পর তার উপর অর্পিত সব দায়িত্ব স্বপ্নীল করেছে। সে কারনে আভা কাজ না করেও বেতন পেয়েছে। সব কিছু তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। কোন রকম সরকারী আর্থিক সাহায্যেতে নয় তার চিকিৎসা হয়েছে স্বপ্নীলের দেওয়া টাকা দিয়ে। সে আর ভাবতে পারছেনা। একি করল স্বপ্নীল? কেন করল? এসব ভাবছে আর কাঁদছে। চোখে মুখে পানি দিয়ে তারপর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ছুটি নিয়ে ছুটতে লাগলো কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে। অনেক অনুনয় বিনয় করে দেখা মিলল স্বপ্নীলের | আভাকে দেখে স্বপ্নীল জিজ্ঞেস করল: কেমন আছো আভা? ভালো তো?
আভা পাল্টা প্রশ্ন করল: আপনি কেন এমন করলেন? আপনার নিজের কথা; আপনার মা বাবার কথা একটি বারও কেন ভাবলেন না?
-‘আভা আমি যা করেছি তার পেছনে একটি মাত্র চাওয়া ছিলো। তুমি যেন সুস্থ হয়ে ফিরো।’
-‘আপনি একা কেন আমার জন্য এত কিছু করবেন? আমি তো আপনার আপনজন কেউ নই। সেফ্র সহকর্মী।’
-‘আভা তুমি এখান থেকে চলে যাও। তুমি এখানে আর এসোনা।’
এই বলে স্বপ্নীল চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।
-‘আপনি প্রশ্নের জবাব দিন। আপনি কেন কি কারণে নিজের জীবনটাকে এভাবে নষ্ট করলেন?’
ঘুরে দাঁড়ানো অবস্থায় আবার বলল:
-‘আমি তোমার প্রশ্নের কোন জবাব দেবো না। তুমি চলে যাও।’
-‘তাহলে কি ধরে নেবো আপনি আমাকে করুণা করেছেন?’
এবার আভার মুখোমুখি আবার ফিরে স্বপ্নীল:
-‘আভা, কেউ যদি ভালবাসার জন্য কিছু করে সেটাকে যদি করুণা বলে; তবে তুমি তা ভাবতে পারো। তবে আমি কাউকে করুণা করিনি।’
আভা স্বপ্নীলের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো। স্বপ্নীল একি বলছে। তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
স্বপ্নীল আবার বলে চলল: -‘হ্যাঁ আভা, আমি তোমাকে যেদিন দেখেছি; সেদিন থেকে মনে মনে ভালবেসেছি। কখনো বলতে পারবো ভাবিনি। কিন্তু আজ তুমি আমাকে বাধ্য করে ফেলেছ।’
এবার আভা নীরবতা ভেঙ্গে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল: -‘আমিও যে তোমাকে ভালবাসি সে কথাও তো আমি বলতে পারিনি। আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকবো স্বপ্নীল |
এতক্ষণ দুজনের মাঝে যে লোহার বেড়া ছিলো তা এখন আর নেই। দু’জনের দু’জোড়া হাত এক হয়ে গেছে। দুজনে নিঃশব্দে কাঁদছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এফ, আই , জুয়েল # অনেক সুন্দর গল্প ।
সিয়াম সোহানূর বেশতো কথার শিল্প । মুগ্ধতা রেখে গেলাম ।
তানি হক শুধু একটা কথাই বলি ..অসাধারণ !
ভালো লাগেনি ১৯ ডিসেম্বর, ২০১২
আমারও শুধু একটি কথা... ধন্যবাদ!
ভালো লাগেনি ২০ ডিসেম্বর, ২০১২
তাপসকিরণ রায় তিনটি ভালবাসা মিলে আছে গল্পটিতে--নায়িকার বাবা মার ভালোবাসা--তাদের ছেলে মেয়েদের ভালোবাসা-- সর্বপরি দেশের প্রতি ভালবাসা.ভালো লাগলো গল্প.
ভালো লাগেনি ১৭ ডিসেম্বর, ২০১২
অনেক ধন্যবাদ তাপস দা, আপনার পাঠ অনুভূতি জানান দেওয়ার জন্য।
ভালো লাগেনি ১৮ ডিসেম্বর, ২০১২
রীতা রায় মিঠু রিয়াদ, গল্পে দুটো অংশ আছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সত্যিকারের অবস্থার এমন বাস্তবিক চিত্রায়ণ কীভাবে করলে? অসাধারণ হয়েছে! তবে কারাগারের অংশটুকু কিছুটা বেমানান লেগেছে তোমার গল্পের মূল থীমের সাথে। অনেক বড় লেখক হবে তুমি।
ভালো লাগেনি ১৭ ডিসেম্বর, ২০১২
দিদি, আপনার মূল্যবান সুন্দর একটি কমেন্ট এর জন্য ধন্যবাদ। বেমানান শব্দটির সাথে একমত প্রকাশ করলাম। আর আপনার আশীষ যেন একদিন সত্যি হয় সে চেষ্টায় রত। আবারও ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ১৮ ডিসেম্বর, ২০১২
নিভৃতে স্বপ্নচারী (পিটল) বেশ ভালো লাগলো। শুভ কামনা রইলো।
ভালো লাগেনি ১৭ ডিসেম্বর, ২০১২
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে....
ভালো লাগেনি ১৮ ডিসেম্বর, ২০১২
আহমেদ সাবের মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ছাড়িয়ে আভা এবং স্বপ্নীলের প্রেম বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আভার জন্য স্বপ্নীলের ত্যাগ বাস্তবে কতটুকু ঘটে সেটা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও - কবিগুরু বলে গেছেন, "কবি, তব মনোভূমি, রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।"। গল্প ভালো লেগেছে; তবে আরো ভালো হতে পারতো।
আসলে ঠিক তাই সাবের ভাই.... এটা লিখেছিলাম অনেক আগে একটি ভালবাসার অনুগল্প হিসেবে... এই সংখ্যায় কিছু এডিট করে জমা দিলাম... চেষ্টা করবো আরো ভাল করার... অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে.....
ভালো লাগেনি ১৭ ডিসেম্বর, ২০১২
Lutful Bari Panna রিয়াদ থেমে গেলে তো চলবে না। যে কটা হাতকে এখনে নিজের বৃত্ত ভেঙে ক্রমেই বেরিয়ে আসতে দেখছি তুমি তাদের একজন। স্রোতের সাথে থাকো। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় সামিল হও। সমালোচনা নিয়ে উপস্থিত থাকবো তোমার ভবিষ্যতের জন্যই।
ভালো লাগেনি ১৩ ডিসেম্বর, ২০১২
ঠিক থেমে যাইনি পান্না ভাই.... আজকেও ভেবেছি কিভাবে গল্পটিকে এগিয়ে নেবো... চেষ্টায় থাকি স্রোতের সাথে থাকতে... আপনার সমালোচনা আর কারো জন্য না হোক অন্তত যেন আমার জন্য থাকে... সে কামনা সবসময়... অনেক ধন্যবাদ ।
ভালো লাগেনি ১৪ ডিসেম্বর, ২০১২
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ রিয়াদ ভাই, গল্পের কাহিনীতে খুব সুন্দর একটা গতি আছে ; যা পাঠককে সহজেই আকৃষ্ট করবে । স্বপ্নীল ও আভা দুটি চরিত্র চিত্রণই সুন্দর হয়েছে । অনেক শুভ কামনা ।
ভালো লাগেনি ১৩ ডিসেম্বর, ২০১২
অনেক অনেক ধন্যবাদ জসীম ভাই লেখাটি পাঠ ও সুন্দর একটি মন্তব্যের জন্য....
ভালো লাগেনি ১৩ ডিসেম্বর, ২০১২
Lutful Bari Panna রিয়াদ সত্যি বলতে কি কাহিনীতে একটা যাদু ছিল। যার টানে গল্পটা ধরে আর শেষ না করে উঠতে পারিনি। প্রেমের গল্পের মজটাই এখানে। এবার ত্রুটিগুলো উল্লেখ করি। মুক্তিযোদ্ধার চরিত্র একটা এসেছে ঠিকই কিন্তু সেটা মূল ফোকাসে ছিল না। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের বঞ্চনা তোমার লেখায় ভালভাবেই এসেছে। বাকি যেটুকু সেটা কোথাও কোথাও বর্ণনাগত। আর এ বিষয়টা ঠিক ধরে ধরে বোঝানো যায় না। আশা করব প্রচুর গল্প পড়বে তুমি। বাক্যের গঠন, শব্দচয়ন, উপমার প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করবে। নিজেই শিখে নেবে। ভাল থেকো।
ভালো লাগেনি ১২ ডিসেম্বর, ২০১২
সুপ্রিয় পান্না ভাই শীতের সকালের উষ্ঞ শুভেচ্ছা রইল, আপনার সাথে আমিও একমত মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রটিকে মূল ফোকাস করিনি ঠিকই কিন্তু যে বিষয়টি নিয়ে আসতে চেয়েছি তাহলে বর্তমান পরিস্থিতি.... আর গল্পের দূর্বলতা যে অনেক আছে তা আমিও স্বীকার করি... এই জন্যই আগামী সংখ্যার জন্য লেখা অর্ধেক লিখে আর লিখছিনা। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ১৩ ডিসেম্বর, ২০১২

২১ ফেব্রুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ১৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪