০১
সাগরের বিশাল জলরাশির পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সজনী মানসী। তার সাথে রজনী মানসী। চাচাত বোন এবং বাল্যবন্ধু। কিছু দিনের বড়। প্রায় সমবয়সীই বলা চলে। চোখের সামনে সে কী মনোহর দৃশ্য! মাথার উপর সুনীল আকাশ। কোথাও একরত্তি মেঘও নেই। আকাশের নীল আর সাগরের নীল জলরাশি যেনো আজন্মের গভীর মিতালি। এ বন্ধন কেউ কোনোদিন চিহ্ন করতে পারবে না। সাগরের ছোট ছোট ঢেউ কূলে এসে কিছুক্ষণ পর পর আছড়ে পড়ছে। এ যেনো সঙ্গীতের সুর মূর্ছনা! এমন দৃশ্য কার না ভালো লাগে? কিন্তু এই মুহূর্তে সজনীর ভালো লাগছে না। সজনী কেবল জানে, তার সমস্ত মন প্রাণ জুড়ে এখন একটি বাংলাদেশ!
এই সজনীর একটা পৃথিবী আছে। সে পৃথিবী বাংলাদেশে থাকে। ব্যাস –এতোটুকুই। সজনী এর বেশি কিছু জানে না। বাংলাদেশের কোন্ শহর? কোন্ গ্রাম? এ সবকিছুই তার অজানা। তার সে পৃথিবী কি করে তাও জানে না। কেবল জানে তিনি কবিতা লিখেন। বাংলা কবিতা। ইংরেজি কবিতা। ফেসবুকে এই কবিতার সূত্র ধরেই সজনীর সাথে তার পরিচয় । পরিচয় থেকে ভালো লাগা। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা। আরও একটি বিষয় সজনীকে আকৃষ্ট করেছিলো। তিনি ভালো ইংরেজি জানেন। অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। একেবারে মাতৃভাষার মতো সাবলীল। সজনীও ইংলিশ মিডিয়ামে ও লেভেল পর্যন্ত পড়েছে। তবুও সে তার মতো এতোটা সাবলীল নয়; যতোটা সাবলীল রাশেদ। সেই রাশেদই সজনীর পৃথিবীর নাম। চমৎকার সুরেলা কন্ঠ।
আবৃত্তির মতো টানাটানা। দীর্ঘক্ষণ একটানা কথা বলতে পারেন। এতোটুকু ক্লান্ত হন না। সজনীর সবচেয়ে ভালো লেগেছিলো রাশেদের স্পষ্টবাদিতা, কাটকাট কথা বলা, সরল অথচ দৃঢ়, বলিষ্ঠ উচ্চারণ। সজনী জানে এই টাইপের মানুষ সাধারণত ভুল মানুষ হয় না। এরা সত্যের জন্য, সুন্দরের জন্য, মানুষের জন্য নিজের জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হন না। আর ভুল মানুষ নির্বাচনের খেসারৎও তার অজানা নয়। তার সাথে বসা রজনীই এর জ্বলন্ত উদাহরণ। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতোই জ্বলন্ত। এক কুলাঙ্গার, প্রতারক তার ফুলের মতো পবিত্র জীবনটাকে কয়েকদিন ছিঁড়ে-কুরে খেয়ে এখন ছুঁড়ে ফেলেছে। রজনী এখন সমাজের কাছে একটি দুর্গন্ধ যুক্ত নাম। অনেকেই তাকে দেখে ঘিনঘিন করে, অস্পৃশ্য ভাবে। অথচ কী তার অপরাধ? সে তার সমস্ত শরীর-মন দিয়ে একজনকে ভালোবেসে ছিলো---।। সারাজীবন তাকে নিয়ে পথ চলতে চেয়েছিলো। কি পেয়েছে সে এর বিনিময়ে---- ? এই প্রশ্নের উত্তর বড়ো দুর্বোধ্য কবিতার মতো। উপমা, অলংকার আর রূপক শব্দের প্রয়োগে যা আজ মানব সমাজে অচ্ছুৎ, অপাংত্তেয়।। এখন ছেঁড়া কাগজের মতোই তার লাইফ স্টাইল। এদিক থেকে বাতাস এসে ওদিকে উড়িয়ে নেয় আবার ওদিক থেকে বাতাস এসে এদিকে তাড়িয়ে দেয়!! সজনী জানে, এই সমাজ তাকেও কলার বাঁকলের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিতে এতোটুকু দ্বিধা করবে না। পথের ধুলো থেকে শুরু করে রাজপ্রাসাদের প্রতিটি ইট পর্যন্ত সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ---- কখন সে কক্ষ চ্যুত নক্ষত্রের মতো সজোরে ভেঙে পড়বে!!
অনেকক্ষণ হয় কেউ কিছু বলছে না। না সজনী। না রজনী। দু’জনেই চুপচাপ। রজনীই প্রথম এই অসহ্য নীরবতা ভংগ করলো। অনেকটা আনমনে সাগরের নীল জলের দিকে চোখ রেখে সজনীর উদ্দেশ্যে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। অনেকটা অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ার মতো। হয়ত সজনী শুনতে পাবে, হয়ত পাবে না।
কিরে শেষ পর্যন্ত কি সিদ্ধান্ত নিলি?
সজনীর আত্মা যেনো বাংলাদেশ থেকে ফিরে এলো। সে অনেকটা হকচকিয়ে গেলো। অতঃপর একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করার বৃথা চেষ্টা করতে করতে বললো, আমার তো দ্বিতীয় কোনো সিদ্ধান্ত নেই দিদি।
তাহলে কি তুই আমার জীবন থেকেও কোনো শিক্ষা নিবি না?
এভাবে কথা বলছো কেনো? তোমার জীবন তোমার। আমার জীবন আমার। তুমিও তো তোমার মতো করে সুখী হতে কম চেষ্টা করোনি। তাহলে আমি করলে দোষ কী?
আমি দোষ-গুণের কথা বলছি না। আমি বলছি, ইতিহাস থেকে যারা শিক্ষা নেয় না, তারাই বারবার ঠকে। আমি চাই না তোর জীবনটা আমার মতো ময়লা,আবর্জনার একটা স্তূপ হউক--।সজনী চট করে রজনীর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো- সে আমি জানি দিদি। তুমি কোনো টেনশন নিও না। রাশেদ অমন ছেলেই না। উপল চন্দনাও তেমন ছেলে ছিলো না সজনী। কতো মিষ্টি করে কথা বলতো। কতো স্বপ্ন দেখাতো। একদিন আমাকে না দেখলে পাগল হয়ে যেতো। এরপরের কাহিনী তো সব তোর জানা---। সে আমি জানি দিদি। তবে আমার ভরসার জায়গাটি হলো, রাশেদ এতো মিষ্টি করে ছেলে-ভুলানো কথা বলে না। ও মাপা মাপা কথা বলে। তিনি অত্যন্ত বাস্তববাদী একজন মানুষ। কল্পনার ফানুশ উড়াতে একদমই পছন্দ করেন না। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, তিনি একজন কবি। কবিরা কোনোদিন অমানুষ হতে পারে দিদি? আজকাল কবিরাও সব পারে সজনী। কাউকে বিশ্বাস নেই।
আমি অস্বীকার করছি না দিদি। কেউ কেউ পারে। তবে সবাই নয়। তোমাকে মনে রাখতে হবে, রাশেদ কবি হয়েও একজন বাস্তববাদী।।
চল্ উঠা যাক। আমার আর এখানে ভালো লাগছে না।
তুমি রাগ করেছো দিদি?
না রাগ করিনি। আমি তোর সাথে রাগ করার কে? শেষ দিকে রজনী তার অভিমানটাকে আর লুকিয়ে রাখতে পারলো না। সজনী শক্ত করে রজনীর হাত আঁকড়ে ধরে বললো, দিদি, তুমি আমাকে এ যাত্রায় একটু সহায়তা করো। তুমিও যদি আমাকে শক্তি, সাহস এবং সমর্থন না দাও --- তাহলে এই সাগরের জলে ডুবে মরা ছাড়া আমার আর কোনো উপায়ান্তর থাকবে না।
এই কথা শোনে রজনীর দু’চোখ তার অজান্তেই ভিজে উঠলো।। সে মুখে কিছুই বলতে পারলো না। সজনীর হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই তো--- হাত দুয়েক দুরে। ইচ্ছে করলেই বুঝি ছুঁয়ে দেয়া যায় সূর্যের শরীর। সজনীর মনে হতে লাগলো, এই সূর্যটাই হলো তার রাশেদ। এখানে হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে না। শান্ত, স্নিগ্ধ, সৌম্য।। এর উপর আস্থা রাখা যায়। এর উপর ভরসা করা যায়।
০২
রাশেদ কোনোভাবেই কিছু বুঝতে পারছে না। সদ্য মাস্টার্সের রিজাল্ট হয়েছে। অন্তত আরও দুইটি বছর তার প্রয়োজন। চাকুরি যুদ্ধের জন্য সে মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কিন্তু তার সমস্ত কিছু তালগোল বাঁধিয়ে দিয়েছে সজনী। কিন্তু কিভাবে এটা সম্ভব? তাছাড়া গোটা একটা রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আছে। একচুল এদিক সেদিক হলে এই সমাজ, রাষ্ট্র তাকে টেনে-হিঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলতে এতোটুকু দ্বিধা করবে না। বিদেশী মেয়েকে বিয়ে করার অপরাধে তার চাকুরি হবে না। বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশি সবাই তাকে সিনেমা-থিয়েটারের হাতির মতো মজা করে দেখবে। পরিবার থেকে তাকে সাপোর্ট দেয়া বন্ধ করে দিবে। এতোসব প্রতিকূল স্রোতের বিরুদ্ধে কিভাবে সে একা লড়াই যাবে? তার উপর সজনী সম্পর্কেও সে তেমন কিছুই জানে না। কেবল ফোনে কথা বলা এবং ফেসবুকে চ্যাট করা। ওতেই কি একজন মানুষের মূল্যায়ন সম্ভব? রাশেদ জানে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিশেষ করে সে যদি মেয়ে মানুষ হয় তাহলে তো কোনো কথাই নেই! ঈশ্বর নিজেই যেখানে নীরব, সেখানে রাশেদটা আবার কে?
এখন বেলা পড়ে আসছে। প্রায় তিনটা বাজে। রাশেদ লাঞ্চ করেনি। খাওয়ার কোনো ইচ্ছাই তার এখন নেই। প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে। তবুও সে নিরুদ্দেশ হাঁটতে লাগলো। এক সময় আর হাঁটতে ভালো লাগছে না। তবুও হাঁটা থামালো না সে। পুরাতন ঢাকার আগামাসি লেন থেকে এখন নীলক্ষেত। রাস্তার পাশে পুরাতন বইয়ের অসংখ্য দোকান। আর রাশেদ চিরদিনই বই প্রেমিক। সবাই বলে বইয়ের পোকা। এক সময় সে নিজেও গর্ব করে বলতো, একটা বই হাতে থাকলে তার আর কোনোকিছু প্রয়োজন নেই। না নাওয়া। না খাওয়া। না প্রেমিকা। সেই রাশেদ আজকাল আর খুব –একটা বইয়ের ধারে কাছে ঘেঁষে না। তার বন্ধুরা অনেকেই রাজনীতি করে। এখন রাজনীতির মাঠটাও খুব উর্বর। কোনোরকমে তেল আর অর্থ অথবা অর্থ আর তেল দিয়ে একবার কমিটিতে নাম লেখাতে পারলেই হলো। বেশ। তারপর তাকে সবাই তেলও দিবে, অর্থও দিবে। উন্নতির এই সিঁড়িটা বড়ো সস্তা। হাত বাড়ালেই আকাশ ছোঁয়া যায়। বিদ্যা লাগে না। কেবল বুদ্ধির বিশেষ করে কুটবুদ্ধির জোর থাকলেই হলো। কিন্তু বরাবরই রাশেদের এসব ভালো লাগে না। সে কবিতা লিখে। কবিতায় জীবনের কথা লিখে। প্রাণের স্পন্দন শোনে। রাশেদকে কেউ বলে কবি। কেউ বলে বোদ্ধা কবি। আবার কেউ কেউ তাকে মহাকবি বলে মশকারা করতেও ছাড়ে না। তবে মশকরাও একরকম প্রাপ্তি বৈকি! তাতেও একবারে কিছু নেই তা কিন্তু নয় । দু’একজন শ্রদ্ধা-ভক্তিও করে। সামাজিক চরম অবক্ষয়ের সময়ে ইহাই বা কম কিসে?
পুরাতন বইয়ের দোকানগুলোতে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ রাশেদের চোখে পড়ে একটা বই। নাম ডাম্বুলার প্রেম। মুহূর্তেই রাশেদের সমস্ত মন-প্রাণে একটা বিদ্যুৎ খেলে যায়। এই ডাম্বুলা শহরেই তার সজনী থাকে। সজনীরা দুই ভাই-বোন।সজনী বড়। সজনীর বাবা একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। মা স্কুল শিক্ষিকা। সুন্দর, ছিমছাম সুখী পরিবার। সজনীও অত্যন্ত মেধাবী। মেডিকেল কলেজে পড়ে। এ বছরেই ফাইনাল ইয়ার। তারপর শুধু ইন্টার্নীশিপ। সজনীর গায়ের রঙ সাধারণ শ্রীলংকান মেয়েদের তুলনায় একটু বেশিই ফর্সা। টিভিতে শ্রীলংকার ক্রিকেট খেলা দেখতে দেখতে লংকান মেয়েদের শরীরের কালার অনেকটা নিজের অজান্তেই রাশেদের অবচেতন মনে ঠায় করে নেয়। যা রাশেদ বুঝতে পারে সজনীর সাথে পরিচয় হওয়ার পর। প্রথম দিনেই রাশেদের মনে হয়েছিলো সজনী তার জন্ম-জন্মান্তরের চেনা। এমন কারো ধ্যান সে আজন্ম করে আসছে।
কিন্তু এভাবে পরিচয় থেকে পরিণয় হতে যাবে – এমনটি রাশেদ কোনোদিন ঘূর্ণাক্ষরেও চিন্তা করেনি। পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে, যাদেরকে দূর থেকে সারাজীবন ভালোবাসা যায়; কাছে গেলেই ভয় করে। কি জানি ভালোবাসা হারিয়ে যায়! সজনী সম্পর্কেও রাশেদের এই একটাই ভয়!!
রাশেদ বিশ টাকা দিয়ে ডাম্বুলার প্রেম বইটি কিনে টি এস সির দিকে হাঁটা দিলো। এমন সময় এই রাশেদ ভাই – এই রাশেদ ভাই ডাক শোনে পেছনে ফিরে থাকালো। খুব মিহি সুরেলা একটা কণ্ঠস্বর। কোকিলের মতো। অনেকদিন রাশেদ কোকিলের ডাক শোনে না। তাকিয়েই দেখে শিলা। হন্ত-দন্ত হয়ে ছুটে আসছে। এই শিলা নামটি রাশেদের একেবারেই পছন্দ নয়। পাথর পাথর লাগে। কিন্তু এই শিলা মেয়েটি অসম্ভব রকমের সুন্দরী। সেই সাথে তুখোড় মেধাবি। রাশেদের এক ইয়ার জুনিয়র। ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র, জুনিয়র অনেকেই শিলা বলতে উন্মাদ। কিন্তু শিলা শিলার মতোই খুব কঠিন একজন মেয়ে মানুষ। একেবারের গ্রানাইটের মতো। কারো প্রেমে পড়েনি। এই সেই শিলা। রাশেদের কাছে এসেই হাঁপাতে লাগলো। বললো, কয়টি ডাক দিয়েছি বলুন দেখি রাশেদ ভাই?
কি জানি---।।
আচ্ছা, আপনার হয়েছে টা কি?
কই কিছুই তো হয়নি।
আপনি যতোই বলুন কিছুই হয়নি – সে আমি মানবো কেনো? আমি ঠিক ঠিক জানি, আপনার কিছু একটা হয়েছে! কি ঠিক বলিনি? না, না তুমি বুঝতে পারছো না। আমার কিছুই হয়নি।
আপনি বললেই আমি মানবো কেনো? আপনি কি জানেন---- আমি আপনাকে আগামাসি লেন থেকে ফলো করছি! বলে কি এই মেয়ে--? রাশেদ যেনো সাত তালা আকাশ থেকে লাফ দিয়ে হঠাৎ নিচে পড়ে গেলো। এই মেয়ের কি মাথা ঠিক আছে? নাকি পুরোটাই গেছে। রাশেদকে চুপ থাকতে দেখে শিলাই আবার কথা বললো, এইভাবে হেঁটে হেঁটে কথা বলবেন? চলুন কোথাও বসি। আপনার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে।
রাশেদ ভেতরে ভেতরে চিন্তায় পড়ে গেলো। তার সাথে শিলার এমন কী কথা থাকতে পারে। তবুও সে মুখের মানচিত্রের কোনোরকম পরিবর্তন না করেই বলল, ঠিক আছে। চলো বসি। কোথায় বসতে চাও?
টি এস সিতেই চলেন।
ওকে। তাই চলো-----।।
০৩
তারা দু’জন ঘাসের বিছানায় বসে পড়লো। শিলা ভাবছে কিভাবে শুরু করা যায় দীর্ঘদিন ধরে বুকের ভেতরে জমাট বাঁধা লাভার বিস্ফোরণ! এই মুহূর্তে দু’জনেই চুপচাপ। রাশেদ ঘাসের গায়ে পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আপন সন্তানের মতো। আর শিলার ভেতরে ঝড় বইছে। কিভাবে কি করা যায়? তা না হলে নিজের সাথে একটা যুদ্ধের কোনোভাবেই অবসান হবে না তার। কোনোদিন নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারবে না। কিছুতেই না। এমন সময় রাশেদ কথা বলে উঠলো, কি জানি বলতে চেয়েছিলে শিলা?
হুম, বলতেই তো চাই। কিন্তু বলতেই তো পারছি না।
আরে--- ঢাক ঢাক গুড় গুড় না করে বলেই ফেলো না।
আচ্ছা, ইদানিং পত্রিকায় আপনার কবিতা খুব কম দেখছি। ব্যাপারটি কি বলুন তো?
ও এই ব্যাপার।। তেমন কিছু না। ইদানিং আমার খুব খারাপ সময় যাচ্ছে। কবিতা লিখছি না। আর পত্রিকা অফিসে কবিতা পাঠানোও হচ্ছে না।
খারাপ সময় কেনো বলছেন?
সে তুমি বুঝবে না শিলা। তোমার বাবা শিল্পপতি। আর আমাদের টানাফোঁড়নের সংসার।আমাদের জীবনে শিল্প ও নেই। সাহিত্যও নেই। সদ্য মাস্টার্স পাস করে বেরিয়েছি। আমার জন্য কেউ চাকুরি নিয়ে বসে নেই।
কে বললো বসে নেই? আমি আজই বাবার সাথে কথা বলবো।
এই কথা শোনেও রাশেদের কোনো ভাবান্তর নেই। সে ভাবছে অন্যকিছু? কী বলতে চায় ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে সুন্দরী এবং স্মার্ট মেয়েটি? এই মেয়ের জন্য শুধু ছাত্র নয়, বেশ কয়েকজন শিক্ষকও সমান তালে লড়ে গেছে।
রাশেদ কিছু বলছে না দেখে শিলাই আবার কথা বললো, কিছু বললেন না যে?
রাশেদ কথা ঘুরিয়ে বললো, আর কি জানি বলতে চেয়েছিলে শিলা?
হুম। সেটাই তো বলতে পারছি না।
কোনো সমস্যা নেই। তুমি বলে ফেলো। আমি প্রস্তুত আছি। হয়ত কিছুটা আঁচ বুঝতে পারছি। তাহলে আপনিই বলুন।
না অনুমান নির্ভর কিছু বলা উচিত নয়। তুমিই ঝটপট বলে ফেলো।
শিলা আর কোনো ভণিতা না করেই বললো, আমি আপনাকে ভালোবাসি। বিশ্বাস করেন রাশেদ ভাই আমি কাউকে বিন্দু পরিমাণ মনে ঠাই দেইনি। আর বলতে পারে না শিলা। তার গলা ধরে আসে। শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়ে।
শিলার কান্না দেখে এতোক্ষণ ধরে প্রস্তুত রাশেদও মুহূর্তেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। রাস্তায় গাড়ির হর্ন শোনা যাচ্ছে। আশেপাশে আরও কয়েকটি জুটি। হাসছে। হাসতে হাসতে বাদামের খোসা ছাড়িয়ে একজন আরেকজনের মুখে তুলে দিচ্ছে। কেউ কেউ জামার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে আঙুল দিয়ে খেলা করছে। আর রাশেদ রাস্তার মাঝখানে ফুয়েল শেষ হয়ে যাওয়া গাড়ির মতো স্থবির। শিলার মতো কেউ তাকে ভালোবাসতে পারে --- এ কথা অবিশ্বাস্য। কিন্তু এই মুহূর্তে এরচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য কথা তার কাছে আর নেই। কী করবে এখন সে? কীভাবে সান্ত্বনা দিবে শিশুর মতো কোমলমতি শিলাকে। রাশেদ সব কিছু সইতে পারে, সইতে পারে না কেবল কারো চোখের জল। একদিকে সজনী আর একদিকে শিলা। কী চমৎকার দেখতে দু’জন। একজন ‘স’ আর একজন ‘শ’। একজন পূর্ণমাত্রা। আরেকজন অর্ধমাত্রা। একজন তাকে ভালোবেসে আত্নীয়-স্বজন, সমাজ, দেশ, সংস্কৃতি সবকিছু ছাড়তে প্রস্তুত। আরেকজন নীরবে-নিভৃতে অন্তরাল থেকে ভালোবেসে গেছে এতোটা বছর। যদিও মহাকালের হিসাবে তা মাত্র ছয় বছর।
অনেকক্ষণ নীরবতার পর রাশেদ আস্তে আস্তে শিলার হাত দুটি টেনে নিয়ে বললো, তোমার ভালোবাসা পাওয়া যে কারো জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়। ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে। একদিকে রাতের অন্ধকার। আরেক দিকে রাশেদের জীবনের অন্ধকার। এই অন্ধকারে শিলা রাশেদের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো। রাশেদের খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো শিলার চোখের জল নিজ হাতে মুছে দেয়। আলতো করে তার দুই গালে দুটি চুমু দেয়। কিন্তু পারে না। সজনীর মুখ এসে তার সামনে চীনের মহাপ্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ থাকার পর অবশেষে শিলাই প্রথম কথা বললো, সে সব নিয়ে আপনার কোনো ভাবনা নেই। আপনি তো জানেন আমি বাবার একমাত্র সন্তান। বাবার অঢেল সম্পত্তি ভোগ তো দূরের কথা দেখাশোনা করার মতোই তেমন আর কেউ নেই।
আমি কতোটা স্বাধীন চেতা তাতো তুমি জানো না শিলা। পরনির্ভরশীলতা আমার একদম পছন্দ নয়—রাশেদ বললো।
সে আমার চেয়ে বেশি হয়ত আর কেউ জানে না।
না আরও একজন জানে। আর সেটাই আমার সবচেয়ে বড়ো সমস্যা। তুমি এতোদিন কিছুই বলোনি কেনো?
আমার লজ্জা লাগছিলো। জানেনই তো মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না। তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম হয়ত আপনিই বলবেন। এখন তো আমি নিরুপায় হয়ে বলতে বাধ্য হয়েছি। আপনার মাস্টার্স শেষ। আমারও শেষ হওয়ার পথে।
সব ঠিক আছে শিলা। কিন্তু তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছো-----। আমি সজনীকে নিয়ে খুব বিপদে আছি। সে হয়ত যে কোনোদিন বাংলাদেশে চলে আসবে। আমি এখন কি করবো তুমিই বলে দাও শিলা।
শিলা যেনো আকাশ থেকে পড়লো। কে এই সজনী? কোনোদিন তো কারো কাছে তার নাম শোনেনি। বাংলাদেশে আসবে? তার মানে সে বাংলাদেশে থাকে না। এমনি হাজার খানেক প্রশ্ন এসে শিলার মনে ভিড় করেছে। অনেকটা নিজের অজান্তেই একটা কালো ছায়া এসে শিলার সমস্ত মুখ ছেয়ে গেছে। রাশেদ ভাইকে নিয়ে এমনি কোনো সন্দেহ শিলা কোনোদিন মনে ঠায় দেয়নি। অথচ শিলা যা কোনোদিন ভাবেনি আজ সেটাই সত্যি হলো। এসব ভাবতে ভাবতে শিলা জিজ্ঞেস করলো, কে এই সজনী?
রাশেদ কোনোরকম রাখ ঢাক না করে সোজা কথায় বললো, সজনী শ্রীলংকান মেয়ে। ওর সাথে আমার বছর দুয়েক আগে ফেসবুকে পরিচয়। মেডিকেল কলেজে পড়ে। ফাইনাল ইয়ার। ওকে আমি কোনোভাবেই বুঝাতে পারছি না জীবনটা ছেলেখেলা নয়। ওর সাথে আমার মিল কেবল একটি জায়গায়। ও একজন মানুষ। আমিও একজন মানুষ। এ ছাড়া আর কোনো মিল নেই। সংস্কৃতি, ধর্ম, দেশ –কোনো কিছুতেই। কিন্তু ও কোনোকিছুই আমলে নিতে চাইছে না। সজনী শ্রীলংকান ----এই কথা শোনে শিলা মনে কিছুটা শক্তি পেলো। বললো, এ কি করে সম্ভব?
আমিও জানি সে কিছুতেই সম্ভব নয়। তবুও সে যদি বাংলাদেশে চলেই আসে তবে আমি তাকে সাগরে ভাসিয়ে দিতে পারবো না শিলা। আর সে কথাও সত্যি আমি সজনীকে ভালোবাসি। কিন্তু সেটা বিয়ে করে ঘর-সংসার করার জন্য নয়।
তাহলে আপনি তাকে না করে দেন।
না করার মতো কোনো কারণ তো ঘটেনি শিলা। চলো উঠা যাক। তোমাকে হলে দিয়ে আসি। জানতো আমি হল আগেই ছেড়ে দিয়েছি। রাত প্রায় আটটা বাজে। চলুন।
দু’জনে পাশাপাশি হাঁটছে। শিলার মন এখন কিছুটা ভালো। রাশেদেরও। সজনীর ঘটনাটি যদি একটা ফান হতো!!
০৪
আজ সজনীর মন খুব ফুরফুরা। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। সে মনে মনে সমস্ত প্ল্যান ঠিক করে ফেলেছে। আজ সে রজনীকে নিয়ে সমস্ত ডাম্বুলা শহর ঘুরে বেড়াবে। ডাম্বুলা তার সবচেয়ে প্রিয় শহর। সৌন্দর্যের দিক থেকে শহরটি অতুলনীয়। বিশ্বের যে কোনো শহরকে টেক্কা দিতে পারে। শ্রীলংকার অন্যান্য শহরের তুলনায় ডাম্বুলা একটু বেশিই পরিচ্ছন্ন। ডাম্বুলার গুহা মন্দির সে এক অপূর্ব সৃষ্টি। মন্দিরটির উপরিভাগে মহামতি বুদ্ধের ছবি শোভা পাচ্ছে। ভেতরে স্বর্ণময় সুদৃশ্য কারুকাজ। ডাম্বুলার আরেক সন্তান হলো ডাম্বুলা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম। নয়নাভিরাম। দর্শক ধারণ ক্ষমতাও অনেক। এই স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে দেখতেই রাশেদের সাথে সজনীর প্রথম কথা হয়। হাতে খুব একটা সময় নেই। রাশেদের সাথে ফাইনালি কথা বলা জরুরি। যেই ভাবা সেই কাজ। সজনী সাথে সাথে মোবাইলটি হাতে নিয়ে বের গেলো। বাসার অদূরেই একটি চমৎকার লেক। লেকের চারপাশে গাছ। ছায়ার উপর ছায়া। এ যেনো এক মায়া কানন! সজনী একটি দেবদারু গাছের ছায়ায় বসলো। দেবদারু গাছ সাধারণত বাঁকা হয় না। একেবারে সোজা হয়। কিন্তু এই গাছটি বাঁকা। অশীতিপর বৃদ্ধের মেরুদণ্ডের মতো।
সজনী আশেপাশে একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখলো। কোথাও তেমন কেউ নেই। কেবল লেকের যে পাশে সজনী আছে, সেই পাশে দুটি রাজহাঁস। পাশাপাশি সাঁতার কাটছে। একটি হাঁস ঠোঁট দিয়ে অন্যটির ঠোঁট কামড়ে দিচ্ছে। আবার সেও দিচ্ছে। একটা আরেকটার উপরে উঠছে। আবার নামছে। সজনী এ সব দৃশ্য দেখছে আর সে মনে মনে ভাবছে, এই হাঁস দুটিকে এসব কে শিখিয়েছে? নিশ্চয় প্রকৃতি। তাহলে সে-ই সত্য, প্রকৃতির চেয়ে বড়ো শিক্ষক আর কেউ নেই।
দুইবার রিং হয়েছে। রাশেদ রিসিভ করেনি। নিশ্চয় কোনো কারণে ব্যস্ত আছে। এসব ভাবতে ভাবতে সজনী আবার কল দিলো। সাথে সাথে রিসিভ। হ্যালো সজনী ---- হ্যালো রাশেদ। কেমন আছো? আমি খুব ভালো নেই। তুমি কেমন আছো? তোমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে?
হয়েছে। তুমি ভালো নেই কেনো? শরীর খারাপ?
না ।না। তেমন কিছু নয়। তুমি টেনশন করো না। আমি ঠিক আছি।
না, তুমি ঠিক নেই। আমি বুঝতে পারছি, তুমি আমার কাছে কোনো কিছু লুকাতে চাও। শোনো, ডাক্তারের কাছে রোগী যদি সব কথা নাও বলে তবুও ডাক্তার অনেক কিছু বুঝে নেন। আমিও বুঝে গেছি। তুমি মনোযোগ দিয়ে দুই কর্ণে শ্রবণ করো। আর বেশিদিন তোমাকে একা থাকার কষ্ট সহ্য করতে হবে না। আমি খুব শীঘ্রই বাংলাদেশে চলে আসছি।
এই কথা শোনার সাথে সাথে রাশেদের মাথা ঘুরতে লাগলো। বলে কি সজনী? যদি সত্যি সত্যি চলে আসে- তাহলে আর রক্ষে থাকবে না। তার নিজেরই যেখানে থাকা খাওয়ার খুব একটা ব্যবস্থা নেই --- সেখানে!! রাশেদ আর ভাবতে পারছে না। যে করেই হোক সজনীর আসা আপাতত হলেও ঠেকিয়ে রাখতে হবে।
রাশেদ কোনো কথা বলছে না দেখে সজনীই আবার জিজ্ঞেস করলো, কি হলো রাশেদ? কথা বলছো না? তোমার কি শরীর বেশি খারাপ? সজনীর কণ্ঠে অকৃত্রিম উদ্বেগ।
এইবার রাশেদের চোখ ছলছল করতে লাগলো। কেনো সজনী তাকে এতো ভালোবাসে? তবুও ভেতরে ভেতরে কাদা মাটির মতো নরম রাশেদও আজ যেনো একটা পাষাণ স্তূপ। কণ্ঠে যতোটা পারে গাম্ভীর্য এনে বললো, সজনী, তুমি দয়া করে আমার কথা শোনো। তুমি এখন বাংলাদেশে আসবে না। আমার খুব আর্থিক অনটন চলছে। আমি নিজেই যেখানে কোনোরকমে তেলাপোকার মতো টিকে আছি, সেখানে তোমার অসম্মান আমি করতে পারবো না। আমি যেদিন স্বাবলম্বী হবো, সেদিন আমি কোনো আপত্তি করবো না।
ওসব বিষয়ে তোমাকে একদম ভাবতে হবে না। আমি সব কিছু জেনে বুঝেইই আসতে চাইছি। তোমার এই অবস্থায় তোমার পাশে আমার থাকাটা খুব জরুরি। আমি ক্রমেই লক্ষ করছি, তুমি সাহস হারিয়ে ফেলছো। তোমার মনোবল ভেঙে পড়ছে। দেখো, আমি আসলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
সজনীর প্রত্যয়ী বক্তব্যের জবাবে রাশেদ কিছু বলতে পারলো না। শুধু বললো, কিভাবে? আমি ডাক্তার। সে কথা তোমার ভুলে গেলে চলবে না। আমি ঢাকায় যে কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিকে একটা চাকুরি জুটিয়ে নেবো। পাশাপাশি আমি ইন্টার্নিশিপ টাও বাংলাদেশে করতে চাই। তারপর চেম্বার হবে। এফ সি পি এস করবো। আর তুমি শুধু কবিতা লিখবে।। শুধুই কবিতা ------।। এবার বুঝতে পেরেছো?
তা তো বুঝলাম। আরও অনেক প্রবলেম আছে।
মানে?
আমি মুসলিম। তুমি বৌদ্ধ।
এইবার সজনী হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লো। অতঃপর বললো, তুমি রিলিজিয়নের কথা বলছো? তুমি হিন্দু হও, বৌদ্ধ হও, খ্রিশ্চান হও অথবা মুসলিম হও তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি শুধু জানি তুমি একজন মানুষ। আর তুমি সেই মানুষ, যে আমাকে ভালোবাসে। বেশ এতোটুকুই আমার প্রয়োজন। এর বেশি কিছু আমার আর প্রয়োজন নেই। শুধু তাই নয়। তোমার স্বদেশ, তোমার সংস্কৃতি এসব তুমি কিভাবে বিসর্জন দিবে? একবার ভেবে দেখো। আমি চাই না ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে তুমি কোনো ইমোশনাল সিদ্ধান্ত নাও। আজ না হউক কাল যে সিদ্ধান্ত তোমাকে কাঁদাবে।।
প্রথমতঃ আমি ইমোশনালি কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। আমি যা করছি তা সম্পূর্ণ সজ্ঞানে এবং স্বেচ্ছায় করছি।
দ্বিতীয়তঃ আমি একজন মর্ডান কালচারড মেয়ে। সমগ্র বিশ্বই আমার স্বদেশ। যে কোনো কালচারই আমার কালচার। আমার নিজের উপর টোটাল কনফিডেন্স আছে। আমি যে কোনো পরিবেশেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারঙ্গম। বর্তমান গ্লোবাল ভিলেজে বাস করেও তুমি এখনও কমছে কম বিশ বছর পিছিয়েছে আছো!! এই কথা বলে সজনী হা হা হা করে হাসতে লাগলো।
সজনীর সাথে তাল মিলিয়ে রাশেদ হাসতে পারেনি। তবুও অনেক কষ্টে আকুতির মতো করে বললো, তবুও শেষ বারের মতো আর একটি বার ভাবো ---- প্লিজ রাশেদ, এভাবে বলো না। আমার খুব কষ্ট হয়।। রাশেদ মনে মনে ভেবেছিলো, বুঝিয়ে শুনিয়ে সজনীকে সে হয়ত ফিরাতে পারবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার সমস্ত প্রচেষ্টা গুঁড়ে বালি। সে আর কথা না বাড়িয়ে বললো, ঠিক আছে। তুমি যা ভালো মনে করো তাই কর।। ওকে। ভালো থেকো ।। বেস্ট অব লাক। তুমিও ভালো থেকো। গুড লাক----।
০৫ ঘুম ভাঙতেই রাশেদ অনুভব করে তার সব গুলো ইন্দ্রিয় কাজ করছে। পা থেকে শুরু করে মাথা। মনের মাঝে এক ধরনের প্রশান্তি। অনেকদিন ধরে এই প্রশান্তিটা রাশেদ অনুভব করে না। ফ্রেস হওয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকলো। বাথরুমের কার্যক্রম শেষ হওয়ার আগেই রাশেদ শোনতে পেলো মোবাইল বাজছে। কে কল করেছে? হয়ত সজনী নয়ত শিলা। হয়ত শিলা নয়ত সজনী। কিছুটা তড়িঘড়ি করেই রাশেদ বাথরুম থেকে ছাড়পত্র নিলো। শিলার কল। অনেকটাপ্রত্যাশিত। হ্যালো শিলা----
কেমন আছেন রাশেদ ভাই?
তুমি এখনও আমাকে রাশেদ ভাই বলে সম্বোধন করো। আপনি, আপনি করো---- এসব হচ্ছেটা কি শিলা?
আরে বাবা ---আপনি তো আমাকে তুমি বলার লাইসেন্স এখনও দেননি! কী যে বলো না তুমি! লাইসেন্স আবার দিতে হয় নাকি? ওটা কেড়ে নিতে হয়।
আচ্ছা ঠিক আছে বাবা। কেড়ে নিলাম। তুমি এখন কোথায়? এই বলে শিলা আপন মনেই একবার হাসলো।পরম তৃপ্তির সে হাসি। বাসায়। মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম। নাস্তা খাইনি। -- রাশেদ বললো।
তাহলে আর নাস্তা খেতে হবে না। তুমি দশ মিনিটের মধ্যে দোয়েল চত্বরে চলে আসো। আমি তোমার জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছি।
ওকে বাই। বাই-----।
মার্সিডিজ ছুটে চলেছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। মাঝে মাঝে যানজটে গাড়ি থামছে। তখন শিলার হাতে রাশেদের হাত। আঙুলের ভেতর আঙুল। কুসুম কুসুম উষ্ণতা বদলা-বদলি। এরি নাম কি তবে ভালোবাসা? নাকি এই যে শিলা এতোটি বছর তাকে বৃক্ষের মতো ভালোবেসে গেছে সেটা? অথবা সজনী, যে তাকে চর্ম চোখে না দেখেই ---জাত-কুল-মান সবকিছু ছাড়তে প্রস্তুত – সেটাই ভালোবাসা!! শিলা কিছু বলছে না দেখে রাশেদই প্রথম মুখ খুললো, কোথায় যাবেন মেম সাহেব? কোনো প্রকার ভনিতা না করেই শিলা বললো, বোটানিক্যাল গার্ডেন। রাশেদ কিছুই বললো না দেখে শিলাই আবার জিজ্ঞেস করলো, আপনার কোনো আপত্তি আছে প্রিয়কবি?
রাশেদ হাসতে হাসতে বললো, তথাস্তু মেম। আপনি যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারেন। কোনো আপত্তি নেহি।।
তাহলে লক্ষ্মী ছেলের মতো আমার চুলের ব্যান্ডটি লাগিয়ে দাও। এই বলে শিলা মাথা নিচু করতে করতে রাশেদের কোলের উপর শুয়ে পড়লো। রাশেদও খুব কায়দা করে মুখ নামিয়ে আনলো শিলার মুখের কাছে। সাথে সাথে শিলা বুঝে গেছে রাশেদ কি করতে যাচ্ছে। রাশেদ বুঝে উঠার আগেই তার দুই ঠোঁটে শিলার আঙুল চলে এসেছে। রাশেদ মৃদু প্রতিবাদ জানালো, এমন একটা মুহূর্ত তুমি কি চাইছো না শিলা? খুব করে চাইছি সাহেব--- খুব করে চাইছি। কিন্তু দেখছেন না গাড়ি জটে আছে। আশেপাশের গাড়িগুলো থেকে জোড়ায় জোড়ায় তির্যক চোখ তোমাকে-আমাকে গিলে খাচ্ছে! শিলার বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর শুনে রাশেদ মনে মনে খুব খুশি হলো। আর মুখে বললো, সময়েই বুঝা যাবে তুমি আমার কতোটা অত্যাচার সহ্য করতে পারো।
শিলা সাথে সাথে প্রতিবাদ করলো, অত্যাচার বলছো কেনো? বলো, ভালোবাসার অত্যাচার।
শিলার কথা শোনে রাশেদ এবং শিলা দু’জনেই একসঙ্গে হি হি হেসে উঠলো। গাড়ি এখন মিরপুর ১ নম্বর মোড়ে। আর একটু সামনেই সনি সিনেমা হল। বোটানিক্যাল গার্ডেন রোড। এমন সময় রাশেদের মোবাইল বাজতে লাগলো। রাশেদ প্রথমে টের পাইনি। শিলা টের পেয়েছে। রাশেদ প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে আশ্চর্য হয়ে গেলো।। বারোটি কল এসেছে। একই নাম্বার থেকে। রাশেদ কল ব্যাক করতে চাইলো। এমন সময় আবার সেই নাম্বার থেকে কল।।
রাশেদ বললো, হ্যালো---কে বলছেন? আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি শাহজালাল বিমান বন্দরের লাউন্স থেকে বলছি। এটেনডেন্ট। আপনার কাছে শ্রীলংকা থেকে একজন মেম সাহেব এসেছেন। উনার নাম সজনী। উনি আপনার জন্য এখানে অপেক্ষা করছেন।। আপনি কি আসবেন?
দশ তলার উপর থেকে পড়ে গেলেও রাশেদ এতোটা স্তম্ভিত হতো না। যতোটা এখন হয়েছে। তবুও সাথে সাথে শিলাকে ইশারায় গাড়ি ঘুরাতে বললো। আর লোকটিকে বললো, উনাকে একটু অপেক্ষা করতে বলুন। আমি আসছি।
০৬ সজনীর প্লেন প্রায় দুই ঘণ্টা আগেই এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছে। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে কিছুটা সময় লেগেছে। আর সেটা শেষ হওয়ার পরেই সে অনুভব করলো, আমি কাজটি ঠিক করিনি। আজকে আসার কথাটা রাশেদকে আগেই জানানো উচিত ছিলো। কোনো প্রকার কূল-কিনারা না পেয়ে অবশেষে ঠিক করলো, বিমানবন্দর লাউন্সে কারো সাহায্য নিতে হবে। রাশেদের নাম্বার তার কাছে আছে। কেউ যদি অনুগ্রহ করে একটু যোগাযোগ করে দেন।
লাউঞ্জের এটেনডেন্ট লোকটি মাঝ বয়সী। পঞ্চাশের মতো হবে। নাম আব্দুল করিম শেখ। একেবারে সেকেলে নাম। তবুও ভদ্র আচার-আচরণে এবং কর্মদক্ষতায় তিনি সকলের কাছেই প্রিয়ভাজন। সজনীর মতো তারও একটি মেয়ে আছে। ইতিমধ্যেই তিনি সজনীর কাছ থেকে পুরো ঘটনা জেনে গেছেন। সজনীর সৌন্দর্য, স্পষ্ট বাচনভঙ্গি এবং অকপট সরলতায় তিনি বিমোহিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই হিসাব মেলাতে পারছেন না। সিনেমার হিরোইনদের চেয়ে এই মেয়ে কোনো অংশেই কম লাবণ্যময়ী নন। বলা চলে রুপে গুণে অনন্যা। কিন্তু সরল বিশ্বাসে মেয়েটি যে কাজটি করেছে এটি তিনি কোনোভাবেই সমর্থন করতে পারছেন না। তার নিজের মেয়ে হলে তিনি তাকে কচু কাটা করতেন। আজকালকার ছেলে-ছোকরাদের কোনো বিশ্বাস নেই। কে জানে এই অসম্ভব সুন্দরী মেয়েটির কপালে কী আছে?
এমন সময় সজনী তাকে বললো, আংকেল আপনার সময় হলে আমাকে একটু এয়ারপোর্টের বাইরের অংশটা ঘুরে দেখাবেন?
লেটস গো----
সজনী লাউঞ্জ থেকে তার লাগেজ সহ বেরিয়ে পড়লো। সঙ্গে আব্দুল করিম শেখ। তিনি বসকে বলে এক ঘণ্টার ছুটি ম্যানেজ করেছেন। এই মেয়েটির প্রতি উনার কেমন জানি মায়া লেগে গেছে। এতো মিষ্টি এবং নিষ্পাপ চেহারা তিনি জীবনে দেখেননি। জান্নাতের হুরগণ বুঝি এমনি হবেন! মেয়েটির কথা বলার ভঙ্গি অত্যন্ত সহজ-সরল। অথচ কী আশ্চর্য! ব্যক্তিত্বের কোনো ঘাটতি নেই। তারা দু’জন পাশাপাশি হাটছেন। বিমানবন্দরের সামনে সারি সারি গাড়ি। প্রাইভেটকার। মাইক্রোবাস। অ্যাম্বুলেন্স। বিমানবন্দর রোডটির ব্যস্ততা দেখে সজনী অবাক হয়ে গেলো। অদূরেই একটি সুদৃশ্য লেক। মাঝে মাঝে ছায়া সুনিবিড় গাছ। সজনীরা লেকের পাশের ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে এয়ারপোর্ট রোডের দিকে। আব্দুল করিম শেখ একটু অস্থির। তাঁর ছুটির এক ঘণ্টা প্রায় শেষ। মাত্র দশ-এগারো মিনিট মতো বাকি আছে। এরপর আর তার পক্ষে মেয়েটিকে সঙ্গ দেওয়া সম্ভব নয়। এখন তার নিজেরই খারাপ লাগছে। কেনো যে মেয়েটি এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে গেলো?
একটু দূরেই একটা জটলা। মেইন রোডের প্রায় কাছাকাছি। সজনীই প্রথম খেয়াল করেছে। মনে হচ্ছে একজন লোককে চারপাশ থেকে অনেকে ঘিরে আছেন। আব্দুল করিম শেখ কোনো দুর্ঘটনা ভেবে এড়িয়ে যেতে চাইলেন। সজনীর জন্য পারলেন না। ভিড় ঠেলে সজনী এক নজর তাকিয়েই চিৎকার করে উঠলো, আংকেল। দিস ইজ রাশেদ। অ্যাকসিডেন্ট করেছে। ডোন্ট ওরি আংকেল। আই সি। হি ইস নট সিরিয়াস ইনজোরড। যদিও এখন সেন্স নেই। কয়েকজন ধরাধরি করে রাশেদকে ফুটপাতে নিয়ে আসুন। এই বলে সে লাগেজ থেকে ফার্স্ট এইড বক্স বের করে তার ডাক্তার-ই বিদ্যা কাজে লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রাশেদের তেমন কিছু হয়নি। তাড়াহুড়া করে আসতে যেয়ে একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে যায়। ডান পায়ের একটা অংশ কেটে রক্ত বের হচ্ছে। মাথায় কোনো আঘাত লেগেছে বলে মনে হচ্ছে না। হয়ত ভয় এবং আতংকে জ্ঞান হারিয়েছে।
চোখে-মুখে জলের ঝাঁপটা দিতেই রাশেদের জ্ঞান ফিরলো। আস্তে আস্তে চোখ খুললো রাশেদ। সজনীর কোলে মাথা। সজনী একদৃষ্টে রাশেদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। একটু পর পর তার হাত চলে যাচ্ছে রাশেদের মাথায়,মুখে, চোখে। রাশেদ সজনীকে চিনতে পেরেছে। মানুষ এতোটা সুন্দর এবং পবিত্র চেহারার অধিকারী হতে পারে সজনীকে না দেখলে তা বিশ্বাস করাই কঠিন। সজনী যেনো একটি সদ্য ফোটা গোলাপ ফুল। রাশেদ উঠে বসতে চাইলো। সজনী তাকে ইশারায় উঠতে নিষেধ করলো। মুখে বললো, তোমার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। টেক রেস্ট ফর এ মুভমেন্ট। এই বলে তার ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর থেকে একটা ফলের জুস বের করে রাশেদের মুখে একটু একটু করে ঢালতে লাগলো।। দর্শক সারিতে শিলাও দাঁড়িয়ে আছে। রাশেদের ফিরতে দেরি দেখে সে তার খোঁজ করতে এসেছিলো। এখন তার দুই চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে--।।