পঁচিশ তারিখ রাত দশটার দিকে মেইলটা চেক করতে গিয়েই চোখটা আমার আটকে গেল, হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি মেইলের প্রেরককে ঠিকানা খুঁজলাম। কিন্তু না পাওয়া গেল না। ভারী আশ্চর্য ! এটা কিভাবে সম্ভব ?' আমার এতটুকু কথা শোনার পরই সাইক্রিয়াটিষ্ট তার মোটা লেন্সের চশমার ভেতর দিয়ে আমার দিকে তাকালেন; বললেন, _' তা মেইলে কি ঐ কথাই লেখা ছিল ? কি যেন কথাটি ? '
মোটা লেন্স পড়া মানুষকে আমার কেমন লাগে তা বলতে চাচ্ছি না। কিন্তু এই সাইক্রিয়াটিস্টকে দেখে আমার পরম শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী ডারউইনকে এবং চিরিয়াখানার গাছের ডালে ডালে ঝুলে থাকা আমার জ্ঞাতী প্রানীটির প্রখর প্রশ্নবোধক চোখটি মনে পড়ে গেল। এই চোখটি আমার রোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে, অথচ আমার কোন রোগ নেই, আমি একদম সত্যি কথা বলছি। আমি বললাম,_' হঁ্যা, একটি কথাই বলেছে। আর তা হল, কথা দুটো মনে আছে কি?'
_' আচ্ছা কে পাঠাতে পারে এই মেইলটি ? আপনি কি কোন ধারনা করতে পারেন?'
এই বানর মার্কা প্রশ্ন করায় তাকে কষে একটা ধমক দিতে যেই না যাবো তখন মনে হল, ব্যাটা সাইক্রিয়াটিস্টকে একটা তাক লাগানো গল্প বললে কেমন হয়। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম , আমি যদি পুরো কাহিনীটি বলি তা হলে তিনি ঘন্টা দেড়েক সময় দিতে পারবেন কিনা। তিনি সম্মতি দিলেন। আমি তার বানর চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকি বেশ পুরোনো একটি কাহিনী।
তখন আমার বিভিন্ন জায়গা ঘোরার খুব শখ। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া অথবা সুন্দরবন থেকে থেকে পচাগড় সব জায়গায় নিজের পদধুলি ফেলে বেশ ফুরফুরে মেজাজে জাফলং এর পথে যাচ্ছি । পথে শ্রীমঙ্গল চা বাগান থেকেই আকাশ ও আবহাওয়া বেশ খানিকটা ভারী হয়ে এল। বৃষ্টি ঝরতে শুরু করলো। মনে মনে ভাবলাম বেশ ভালই হল এমন বৃষ্টির দিনেই না এমন সবুজ বনানী দেখার আনন্দ। গাড়ীর সহযাত্রীদের জিজ্ঞেস করতেই তারা জানালেন। এখানে এমনই । আমি বললাম , কেমন ? এই রোদ এই বৃষ্টি ? তারা বললেন, 'জি্ব না! এই বৃষ্টি এই বৃষ্টি। এরকমই স্বভাবের। বিশেষ করে আষাঢ় মাসে এমনি।' আমি সবই বুঝলাম এবং আরো ভাল ভাবে বুঝলাম যখন জাফলং এ পেঁৗছুলাম তখন অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখানে সব এরকমই। অন্য কোন জায়গার সাথে এর তুলনা চলে না। অবিশ্বাস্য সবুজ বনের মত পাহাড়ের গা থেকে নেমে আসছে ঝরণা। সে ঝরণা মিশেছে এসে ছোট এক নদের সাথে, পিয়াইন নদ। আচ্ছা ! এখানকার মানুষও কি সব এমনি সবুজ। খুঁজতে লাগলাম। ছোট ছোট নৌকায় চড়ে দেখতে লাগলাম এখানকার মানুষদের। তাদের প্রায় সবাই পাথর তোলা শ্রমিক। কিন্তু গায়ের রঙ সবুজ মনে হল না। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে তামাটে হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখন বৃষ্টি ঝরছে তাই রঙটা তামাটেও দেখা গেল না; কুচকুচে কালো। যা হোক, মানুষের গায়ের রঙ কালো হলেও মনটা তার ভাল হতে পারে , হতে পারে সবুজও। হঁ্যা,বেড়াতে বেড়াতে আর খুঁজতে খুঁজতে পিয়াইনের পুর্ব দিকে যেতেই এক দীর্ঘাকায় কালো বর্ণের প্রৌঢ় ভদ্রলোকের সাথে দেখা হল। ধীরে ধীরে তার সাথে পরিচয়ও হল _ এ কথাটা হয়তো জোর দিয়ে বলা যাবে না। দেখা হলই বলবো। কারন তার সাথে বেশী সময় মেশার বা অন্তরঙ্গতার সুযোগ হল না। তবে কথা বলে বুঝলাম ভদ্রলোক চির তরুণ বা চিরসবুজ।
যে সব গাছ শীতকালে তার শারীরত্বাত্তীক বৈশিস্ট্যের কারনে পাতাগুলোকে ঝরিয়ে দেয় তাদেরকে পত্রঝরা বা ডেসিডুয়াস গাছ বলে। আর যে সব গাছ বছরের কোন সময়ই তাদের পাতাগুলোকে বিবর্ণ করে না , ঝরিয়ে দেয় না তাদেরকে বলে চির সবুজ বা এভারগ্রীণ। এটা আমি জানতাম এবং আমি যত জায়গায় ঘুরেছি সেখানে এই চির সবুজ গাছ, বন,পাহাড়ই দেখেছি বেশী। চিরসবুজ, চিরকুমার,চিরতরুণ মানুষ পাইনি। কেন পাইনি তা জানি না। হয়তো ছিল কিন্তু চোখে পড়েনি। অথবা ছিলই না। আমারতো চোখে পড়ে দেশের পনের কোটি লোকই জোড়াবদ্ধ। অথবা জোড় বাধাঁর স্বপ্নে বিভোর। ভদ্রলোককে দেখে আমার দারুন কৌতুহল হল। এই বর্ষায় প্রায় পর্যটকশুন্য সন্ধ্যায় চারদিক খোলা, শুধু ছাঁদ দেয়া একটি চায়ের দোকানে বসে একান্ত নিরিবিলি তার সাথে আলাপে প্রথমেই আমি বললাম,
_' আমি আপনার মত লোক দেখিনি। '
এতটুকু বলে ঢাকার মশার কামড়ে হবে হয়তো গল্প বলার একাগ্রতা নষ্ট হল, আমি হঠাৎ করেই সেই সাইক্রিয়াটিস্টের চোখের দিকে তাকালাম। দেখি উনি চোখ বুজে আছেন। ঘুমিয়ে পড়েছেন কিনা কে জানে! আমি কথা থামিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম । দেখলাম এগারটা বার বাজে। অনেক রাত হয়ে গেছে আর কথা বাড়াবো না ভাবছি, এমন সময় সাইক্রিয়াটিস্ট চোখ বুঁজেই ভরাট গলায় বললেন,
_' আমি শুনছি। আপনি বলতে থাকুন। তবে ' কথা দু'টি ' কি তা বলুন। আপনার সময় আর মাত্র পনের মিনিট।' আমি ঢোক গিলে সাইক্রিয়াটিস্টের কথায় সায় দিয়ে আবার গল্পটা শুরু করলাম।
হঁ্যা সেই চির সবুজ চিরকুমার ভদ্রলোক বললেন,
_' আমার মত লোক দেখেন নি মানে ?
_' এই যে পিয়াইন নদের কাছে গ্রামে এসে একাকি জীবন যাপন করছেন। অন্য সবার মত সংসার করলেও তো পারতেন। তাতে করে তো আর এই সবুজ গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার মত বাধ্যবাধকতা এসে হাজির হত না।'
_' রহস্যটিতো এখানেই।
_' রহস্য ?'
_' হঁ্যা। শুনুন । আমি যখন দেশে ফিরি। তখন আমার সঙ্গী সাথি সবার চিন্তা ধারা দেখলাম আমার থেকে একেবারেই আলাদা। দেশ নিয়ে , সমাজ নিয়ে, প্রগতি নিয়ে কিছু মতপার্থক্য তাদের নিজেদের মধ্যে থাকলেও আমার থেকে সম্পুর্ন আলাদা। আমার চিন্তার সাথে তাদের চিন্তার বিস্তর পার্থক্য দেখলাম। তারা কেউই যেন আমার কথা বুঝতে পারছে না। অথবা আমিই তাদের কথা বুঝতে পারছিলাম না। এত বিশাল জনসংখ্যা নিয়ে কিভাবে দেশ চলবে ? তারা আমার কথা শুনে সবাই আমার দিকে চোখ তুলে এমনভাবে তাকাতো তাতে করে আমার মনে হত আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি এবং আমার ধারনা তাদেরও তেমনটাই মনে হত। আমি যখন বললাম, এই দেশের এই পৃথিবীর জন্য প্রথম জরুরী কথা হল, বিবাহ বহিভর্ুত নারী-পুরুষ মিলন নিষিদ্ধ করতে হবে এবং দুই নম্বর কথা হল, সংসার প্রতিপালনের আর্থিক সামর্থ্যের একটি সীমারেখা নির্ধারন করতে হবে যে সীমারেখার নীচে বিয়ে বাধ্যতামুলকভাবে নিষিদ্ধ। আমার আশপাশের মানুষ এই দু'টো কথা শুনে আমাকে নিয়ে প্রথমে কস্ট পেত এই ভেবে যে বেচারা পাগল হয়ে যাচ্ছে। পরে অবশ্য সবাই পরামর্শ করে পাবনায় হেমায়েত পুরের মানষিক হাসপাতালে পাঠানোর পক্ষে মত দিল। '
তার কথা শুনে আমি যখন পিয়াইন তীরবর্তী চায়ের দোকানে নড়ে চড়ে সতর্ক হয়ে বসছি। তখন চিরসবুজ ভদ্রলোক বললেন,
_' কি ভয় পা্েচ্ছন নাতো? ভয় পাবেন না ! ভয় পাবেন না ! আমি পাগলা গারদে যাইনি , পাগলও হইনি। চলে এসেছি দেশের চির সবুজ প্রান্তে । নিজের মত করে জীবন যাপন করছি। দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম, হাওড়-বাওড়, বনজঙ্গল ঘুরে এক সময় এই পিয়াইনের পাশেই জীবনের শেষটা কাটাবো বলে মনস্থির করেছি।'
স্টপ! স্টপ! আপনার সময় শেষ। আপনার কথা বুঝতে পেরেছি। আপনি এই ওষুধ গুলি খাবেন । পনের দিন পর দেখা করবেন।' বলেই সেই সাইক্রিয়াটিস্ট আমাকে একটি কাগজ ধরিয়ে দিলেন। আমি জুতো পড়ে যেই প্রেসক্রিপশন হাতে বের হব ওমনি শুনতে পেলাম সাইক্রিয়াটিষ্ট তার সহযোগী একজনকে নিচুগলায় কি যেন একটা কথা বললেন। কিন্তু রোগের নামটা ঠিক ধরতে পারলাম না। শুধু এটুকু শুনলাম তিনি বলছেন, এই একই রকম সমস্যা নিয়ে কয়েকদিনে বেশ কয়েকজন রোগী এলেন। তাদের সবারই এই দু'টি কথা'র সমস্যা। আর কেউবা এই কথা দু'টি ফোনে শুনছেন, কেউ চিঠিতে পাচ্ছেন আবার কেউবা ইন্টারনেটে ইমেইলে। সেটাই বা কিভাবে সম্ভব। সেটা কি শুধুই কাকতালীয়! আমি সাইক্রিয়াটিস্টের রুম থেকে যখন বের হই তখন ঘড়িতে বার টা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। মনে মনে হাঁসলাম, এই ভেবে যে আর একটু হলেই সাইক্রিয়াটিস্টের বারটা বাজিয়ে ছাড়তাম।
২৩ জানুয়ারী - ২০১২
গল্প/কবিতা:
১৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“ ” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ , থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী