লোকটি যে চোর তা ভাবতে পারে নি, এমন কি কল্পনাও করতে পারেনি রায়হান, গনি, মানিক নামের বন্ধুত্রয়। তারা তিন বন্ধু রতন রায়হান, গফুর গনি, মদন মানিক স্কুলের পড়াটা কঠিন মনে হওয়ায় আজ ক্লাস ছেড়ে যখন ধানমন্ডি লেকের পাশে কৃষ্ণচুড়ার তল দিয়ে হাটছিল তখন এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা। একটি কংক্রিটের বেঞ্চের উপর ভদ্র লোক বসে আছেন। তিনি নীচের পাকা ফ্লোরের উপর একটি লাল টেনিস বল ছুড়ে ফেলে আবার ড্রপ উঠলে ধরছেন। রায়হান, গনি, মানিক নামের তিন বন্ধু যখন তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছিলো তখন হঠাৎ করেই তারা শুনতে পেল,
_' গনি ! তোমরা তিন বন্ধু এদিকে এস , শোনা মনি।'
ওরা তিন জন প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলো না। ওদেরকেই ডাকছে ? নাকি অন্য কাউকে ডাকছে ? তা' ছাড়া কে ডাকছে ? এ ভদ্র লোককে ওরা তিন জনের কেউই চিনে না। তাই তারা বিষয়টা নিছকই শোনার ভুল মনে করে নিজেদের পথে পা বাড়ালো। কিন্তু পা বাড়াতে না বাড়াতেই আবার শুনলো,
_' মানিক ! তোমরা তিন জনই এদিকে এসো তো খানিক।'
এবার তিন বন্ধু বেশ খানিকটা আশ্চর্য হলেও নিশ্চিত হল যে তাদের তিন জনকেই ডাকা হচ্ছে। কিন্তু একজন অপরিচিত ভদ্র লোক তাদের নামই বা জানলো কিভাবে আর তাদের তিনজনকে ডাকবেই বা কেন ? ওরা কিছুটা ভয়ও পেল বৈ কি । তারপরও ঝকঝকে একটি বসন্তের সকালে দিনের আলোতে ঢাকা শহরের জলজ্যান্ত তিন তিনটি বালক একজন ভদ্র লোককে দেখে ভয় পাবে সেটা হতে পারে না। আর তাছাড়া সত্যি সত্যি যদি ভয় পেয়েও থাকে তা হলে তাদের হাতে দুটি পথ খোলা আছে ; এক হল ভয় উপেক্ষা করে তাঁর কাছে এগিয়ে যাওয়া এবং অন্যটি হল তিন বন্ধু মিলে ঝেড়ে দৌড় দেওয়া। তবে দৌড়ে পালানোটা ভাল দেখায় না। তাই এ ধরনের লজ্জাজনক কাজ তারা করলো না। বরং কোন রকমে বুকে সাহস চেপে ধরে ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে বললো,
_' আপনি কি আমাদের ডাকছেন ? '
ভদ্রলোক মাথা নিচু করেই বললেন,
_' হঁ্যা, ।
_' আপনি কে ?
ভদ্রলোক বললেন,
_' আমি চোর ।'
ভারী অবাক করা জবাব। এধরনের কথা কেউ বলতে পারে এটা ভাবতেও তাদের কেমন যেন লাগছে। তারা শুনেছে চোরকে ধরে পিটালেও নাকি সে স্বীকার করে না যে সে চোর। কোন ঘুষখোরই স্বীকার করে না সে ঘুষ খেয়েছে ? চোর এবং ঘুষখোরদের কথা শুনলে মনে হবে এ দুনিয়ায় এ দুটি শব্দ অযথাই ডিকশনারীতে ঢুকানো হয়েছে। এ সব জিনিস পৃথিবীর বুকে আছে নাকি ? তারপরও এই ভদ্র লোকের কথা শুনে মনে হচ্ছে দুনিয়াতে এক_আধজন হলেও এই জাতীয় জিনিস আছে। তিন বন্ধু আশ্চর্য হয়ে বললো,
_'আপনি কি চুরি করেন ?'
_'অনেক কিছু । বলে শেষ করা যাবে না। '
এমন সময় তিন বন্ধুর মধ্যে মানিকের মনে হল পার্কে অনেক সময় শিশুদের কিডন্যাপ করা লোক থাকে । এদেরকে ছেলেধরা বলে। এরা অবশ্য শুধু ছেলেদের ধরে না । মেয়েদেরকেও ধরে , কিন্তু কেউ এদেরকে মেয়ে ধরা বলে না। আসলে এদের নাম হওয়া উচিৎ ছেলে_মেয়ে ধরা। এ লোকটি কি ছেলে_মেয়ে ধরা চোর নাকি ?'সে কানে কানে তার দু' বন্ধুকে শিশু পাচারকারী হতে পারে বলে সাবধান করে দিল। গনির মনে হল আগেই দৌড়ে পালালে মন্দ হত না, বড় জোর নিজেরা কিছুটা লজ্জায় পড়তো। কিন্তু তাও ভাল ছিল। তা হলে আর যাই হোক কোন শিশু পাচারকারীর হাতে অন্তত পড়তে হত না। আসলেও লজ্জারও একটা অপমুল্য আছে, এখন মনে হল গনির কাছে।
যাই হোক অতীতের ভুল নিয়ে চিন্তা করে আর কি লাভ। তাই সাহস কলে রায়হান যেইমাত্র কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, সাথে সাথে ভদ্র লোক বললেন,
_' রায়হান ! গাও তুমি জয়গান।'
_'আপনি এসব কি বলছেন ? আমরা জয় গান গাব কেন ?'
_' কারন তোমরা যে সব ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করছো। তোমাদের সে ব্যাপারে ভীত হওয়ার কিছু নেই। তাই তোমরা জয়গান করতে পারো ।'
_' সে না হয় করলাম , কিন্তু আপনি আমাদের নাম জানলেন কিভাবে ? '
_' কেন ? তোমাদের কাছ থেকে ? ' তোমরা যখন এই লেকের পার দিয়ে গল্প করতে করতে হাটছিলে তখনই শুনেছি। তা ছাড়া আমি তোমাদের তিন জনেরই পুরো নাম জানি , একদম আসল নাম। তোমাদের তিন জনের নাম হল রতন রায়হান, গফুর গনি, মদন মানিক। '
_' আশ্চর্য তো!'
_' কিছুই আশ্চর্য নয় । তোমাদের হাতের বইয়ের মলাটে লেখা আছে। যদিও দুর থেকে পড়তে আমার একটু অসুবিধা হচ্ছে । তারপরও বলতে পারছি। কেন ? জান ? আজকালকার ছেলেদের নাম এরকমই হয় । দুই শব্দের এবং দুই শব্দেরই প্রথম অক্ষর হয় একই বর্ণ। যেমন ধর ! গোবর গনেশ, মজিদ মামুন, শরীফ শাকিল, বাদর বাদল, কোদলা কোদল, মদন মোহন, কালিয়া কোপতা, পাভেল পারুল, কাঞ্জু কাসেম, মগা মঞ্জু' বলতে বলতে হো হো করে হাসলেন হাসলেন; বললেন ,
_' আরো শুনবে ?
ওরা তিন বন্ধু বললো,
_' না আমরা এ সব পচা নাম শুনতে চাই না। আপনি কি চুরি করেন ? তা শুনতে চাই। '
_' শোন ! আমি সামনে যা পাই তাই চুরি করি । '
_' কেন ?'
_' কারন পৃথিবীর প্রায় সব মানুষই চোর। তারা কিছু না কিছু চুরি করে। কেউ আম , কেউ কাঁঠাল, কেউ বই ,কেউ দই, কেউ টাকা, কেউ সোনা, কেউ তেনা, কেউ চাল, কেউ ডাল, কেউ বই, কেউ মই, কেউ কথা, কেউ খাতা ,কেউ পাতা, কেউ বল, কেউ মল। কেউ ছিচকে চুরি করে , কেউ নিজকে চুরি করে। ' একটু থেমে ভদ্রলোক বললো,
_'তোমরা ভাবছো লোকটি তো ভারী অদ্ভুত কিসিমের । সে কথা ঠিক । তাই তোমাদেরকে আমি চিনতে পেরেছি। তোমরাও চোর ,আমিও চোর । তাই তোমাদের সাথে আমি বন্ধুত্ব করতে চাই । তোমাদের সাথে আমি একটি লাল টেনিস বল আর তক্তা মার্কা কাঠের ব্যাট দিয়ে ক্রিকেট খেলতে চাই। খেলবে ?'
তিন বন্ধু লোকটির কথায় এবং লাল বলটির প্রতি এতটাই আকর্ষন অনুভব করলো, যে তারা তখনই তাদের বইখাতা গুলো বেঞ্চের উপর রেখে খেলার প্রস্তুতি নিল। ভদ্র লোক বললেন,
_' তোমরা কি খেলতে রাজি আছো?'
_'জ্বী ।'
কিন্তু লোকটি তাদের তিন জনকে আশ্চর্য করে দিয়ে বললো,
_' তা হলে আজকে তোমরা তোমাদের ক্লাসে যাও। অন্যদিন তোমাদের সাথে লাল বল দিয়ে ক্রিকেট খেলবো। '
ভদ্র লোকের কথা শুনে ওরা তিন বন্ধু যখন হতাশ হয়ে ফিরে আসতে শুরু করেছে। তখন ভদ্রলোক ওদের ডেকে বললেন,
_' তোমাদেরকে যে চোর বললাম , তা কেন বললাম শুললে না ! বলি ,শোন ! তোমরা চোর একারনে যে তোমরা নিজেরাই নিজেদেও সম্পদকে চুরি করছো, তোমাদের সময়কে চুরি করছো। তাই এক হিসেবে তোমরাও চোর। আর আমার কথা মত তোমাদের সাথে অর্থাৎ চোরের সাথে চোরের খেলা করা উচিৎ। প্রবাদ বাক্য আছে না ! চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। কিন্তু আজ খেলতে পারছি না। একটি ছোট্ট সমস্যা হয়ে গেছে, এই বলটি নিয়ে।'
তিন বন্ধু বললো,
_' কি সমস্যা ? বলটি তো দেখতে ঠিকই দেখা যাচ্ছে। '
_' তা ঠিক দেখা গেলেও সমস্যাটি অন্যখানে। একটা সৎ ছেলের বল এটি। সে আমাকে বলেছে এই বলটি সে কুড়িয়ে পেয়েছে। বলটির মালিককে আমি যেন বলটি উপযুক্ত প্রমান পেলে ফেরৎ দেই।
_' ছেলেটি নিজে ফেরৎ না দিয়ে সে আপনার কাছে রেখে গেছে কেন ?'
_' কারন সে চোর নয়। সে নিজের সময় চুরি করে না। সে এতক্ষন স্কুলে ক্লাস করছে। বিকেলে সে স্কুল থেকে ফেরার পথে খোঁজ নিবে। বলটি প্রকৃত মালিক পেয়েছে কিনা। আমি প্রকৃত মালিককে পেলে বলটি ফেরৎ দেব। তোমরা এখন তোমাদের স্কুলে গিয়ে ক্লাস করতে থাকো। আমি নিজে যেদিন একটি লাল বল চুরি করতে পারবো সেদিন তোমাদের সাথে এখানে ক্রিকেট খেলবো।'
সেদিন তারা তিন বন্ধু রতন রায়হান, গফুর গনি, মদন মানিক চোর লোকটির কাছে যার পর নেই লজ্জা পেয়ে এরপর থেকে স্কুলে নিয়মিত হল। তারা এরপর আর স্কুল ফাঁকি দিয়ে পার্কে বেড়াতে যায় না। তাদের পড়াশুনা নিয়ে তারা এতই ব্যস্ত যে পার্কের সেই চোর লোকটির সাথে আর তাদের ক্রিকেট খেলার সময়ই হয়ে ওঠে না। যদিও মাঝে মধ্যে লোকটির কথা মনে হয়। তাদের চোখে তখন ভেসে ওঠে মাঝ বয়সী একজন চোর (!) একটি লাল বল মাটিতে ছুড়ে মারছে এবং পরক্ষনেই লাফিয়ে ওঠা বলটাকে তার তালুবন্দী করছে। বলটির মালিককে এতদিনে সে খুঁজে পেয়েছে কিনা কে জানে।