“ছোট বেলায় টিভি কার্টুনে স্পাইডার ম্যান, ব্যাটম্যান, সুপারম্যান দেখেছি, ওদের নিয়ে কত রকমের স্বপ্ন দেখেছি, কল্পনায় নিজেই কতবার স্পাইডারম্যান সজে সুড়সুড় করে ১৫০ তলা দালানের ছাদে উঠে গেছি, মৎসকন্যার গল্প পড়ে কত দিন স্বপ্নে প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল রাজ্য ঘুরে এসেছি, ফেরার সময় মুক্তো ভরা ঝিনুক তুলে এনেছি, গরীব দুঃখীদের মাঝে বিলিয়েছি, ঝিনুকের মুক্তো বেচে কত গরীব ধনী হয়েছে, সকলে আমার জয় জয়কার করেছে, সাগরের তীরে আমার জন্য সুন্দর ঘর বানিয়ে দিয়েছে, আমার যখন মনে হতো, সেই ঘরের পৈঠেয় বসে চিকন সুরে গান করেছি, ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে ইচ্ছেমতন জল খেলা করেছি, সবই কল্পনায় করেছি, তখন কি ছাই জেনেছি, কল্পনা একদিন আমার হাত ধরেই বাস্তবতার রূপ পাবে।
আজ ফেব্রুয়ারীর নয় তারিখ, ২০১৪ সাল, ঘড়িতে সময় রাত্রি এগারোটা বেজে ৫৭ মিনিট, আমার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত! সব কিছুর হিসেব যদি ঠিক মত এগিয়ে যায়, আগামী জুলাই মাসের পঁচিশ তারিখ পৃথিবীর বুকে বিজ্ঞানের নতুন অধ্যায় সূচিত হবে। পৃথিবীর বুকে পক্ষীমানবের জন্ম হবে, মৎসকন্যার অস্তিত্ব আছে কি নেই, তা নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে, কিন্তু পক্ষীমানব শিশুটির অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণা করার কিছু থাকবেনা, পৃথিবীর মানুষ দেখবে বিজ্ঞানের ক্ষমতা। ঊনিশশ আটাত্তর সালের পঁচিশে জুলাই তারিখে গ্রেট ব্রিটেনে প্রথম সফল টেস্ট টিউব মানব সন্তানের জন্ম হয়, ছত্রিশ বছর পর একই দিনে আমাদের এই ছোট্ট সংসারে সফল পক্ষীমানব শিশুর জন্ম হতে যাচ্ছে।”
ডায়েরীতে এই কথাকটি জ্ঞানবাবু লিখে রেখেছিলেন, যেক্ষণে উনার স্ত্রী ‘গিনিপিগ’ উঃ মাগো! আমার পেটের এদিকটায় কি যেন নড়ে উঠলো মনে হচ্ছে, ওগো, এই দেখো, আরেকবার নড়ে উঠলো, কেমন যেনো খোঁচার মত লাগছে” বলে ধড়মর করে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিল।
তার স্ত্রী যতদিন পেটের ভেতর কোন নড়াচড়া অনুভব করেনি, ঐ সময়টাতে জ্ঞান বাবু খুব অস্থিরতায় ভুগতেন, রাতে ঘুম হতো না, বউর পাশে মটকা মেরে পড়ে থাকেন, চোখ- কান খাড়া রাখতেন বউ কখন “ওগো মাগো” বলে চেঁচিয়ে উঠে শোনার জন্য, কখন পেটে হাত দিয়ে চমকে উঠে দেখার জন্য। এক নাগাড়ে পাঁচ মাস জ্ঞান বাবু টেনশনের কারণে ঘুমুতে পারেননি। বউ যে রাতে ‘উঃ মাগো’ বলে চমকে উঠে নিজের পেটে হাত দিয়েছিল, সে রাতে উনার ভাল ঘুম হয়েছিল, বউকে অভয় দিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার ফাঁকে ঘড়িতে সময় দেখে রেখেছিলেন, ডায়েরীর পাতায় সব ঠিক করে লিখে রেখেছিলেন, পরদিন তার গুরু স্যার বিজ্ঞানপ্রসাদ যাদবের কাছে পূর্ব রাতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটুকু পুংখানুপুংখ বর্ণনা করেছিলেন, গুরুজী জ্ঞান বাবুকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন, পিঠ চাপরে দিয়ে বলেছিলেন, “ তোমার এই অমর কীর্তির মাঝে আমি বেঁচে থাকবো, সন্তানের নাম দিও বিজ্ঞানবিস্ময় বাস্তব ” বলে সেই রাতেই বিজ্ঞানপ্রসাদ যাদব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
জ্ঞান বাবুর বউয়ের নাম গিনিপিগ যাদব, বাপের দেয়া নাম। গিনিপিগের পিতা, জ্ঞানবাবুর গু্রু, পরবর্তীতে শ্বশুরমহাশয়, বিজ্ঞানী স্যার বিজ্ঞানপ্রসাদ যাদব জীবনের অনেকটা সময় প্রাণ নিয়ে গবেষণা করেছেন। আমেরিকা, ইউরোপের নামী দামী রিসার্চ স্কলারদের সাথে কাজ করেছেন, প্রথম টেস্ট টিউব বেবী লুইস ব্রাউনের জন্ম হওয়ার সময় উনি ইংল্যান্ডে ডঃ প্যাট্রিকের ল্যাবে কাজ করতেন, ডক্টর প্যাট্রিক স্টেপ্টো’র খুব খাছাকাছি থেকে দেখেছেন, ডক্টর প্যাট্রিকের কাজে সহায়তা করেছেন, ল্যাপরোস্কোপির মাধ্যমে লেসলির ওভারী থেকে ডিম্বানু এবং স্বামী জনের স্পার্ম সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে, ‘ইন ভিট্রো’তে ডিম্বানু নিষিক্তকরণ, ডিম্বানুর কোষ বিভাজন, সেই বিভাজিত কোষ ডিম্বানু লেসলীর ইউটেরাসে প্রতিস্থাপন, এরপর একটানা নয় মাস লেসলিকে নিয়ে ডঃ প্যাট্রিক এবং ডঃ এডওয়ার্ডের গ্রহন করা প্রতিটি পদক্ষেপ মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন, তাঁদের কাজে সহায়তা করেছেন, এক সময় সফল টেস্ট টিউব বেবী লুইস এর জন্ম হয়, সেই শিশু এখনও বেঁচে আছে, পঁইয়ত্রিশ বছর বয়স হয়েছে, আজ পর্যন্ত কোন সমস্যা হয়নি।
চাকরী থেকে অবসর নিয়ে বিজ্ঞানপ্রসাদ যাদব সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে পৈতৃক জমিতেই নিজস্ব ল্যাবোরেটরী গড়েছেন, বাড়ীর গা ঘেঁষে নিজস্ব ল্যাবোরেটরী, সেখানে গিনিপিগ, খরগোশ, ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর মেলা! এই ল্যাবোরেটরী নিয়ে উনার অনেক স্বপ্ন আছে, ইন ভিট্রো পদ্ধতিতে বেশ কয়েকটি টেস্ট টিউব বেবীর জন্ম দিয়েছেন, এ সবই মানব সন্তান, উনার খুব ইচ্ছে, কোন মহীয়সী যদি রাজী হতো, তাহলে বাজ পাখীর স্পার্ম এবং মানবীর ডিম্বানু নিষিক্ত করে দেখতেন, পক্ষীমানবের জন্ম হয় কিনা! কিন্তু সমস্যা হয়েছে, কোন মানবী রাজী হবেনা। রাজী হলে এতদিনে উনি অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতেন। এখন এই বুড়ো বয়সে টেস্ট টিউব বেবীর জন্ম দেয়ায় কোন আনন্দ খুঁজে পান না। বিজ্ঞানের কাজই হলো নতুন সৃষ্টি করা, মানব কল্যান সাধিত করা!
উনার একটিমাত্র কন্যা, আদর করে নাম রেখেছিলেন গিনিপিগ। গিনিপিগ কখনও মানুষের নাম হতে পারে না, তবুও উনি কন্যাকে গিনিপিগ নামেই ডাকেন। স্ত্রীর গর্ভ থেকে যেই মুহূর্তে কন্যার জন্ম হলো, সেই মুহূর্তেই বিজ্ঞানপ্রসাদ যাদবের ল্যাবরেটরীতে প্রথম টেস্ট টিউব গিনিপিগের জন্ম হলো। ল্যাবোরেটরীর প্রথম সাফল্য, টেস্ট টিউব গিনিপিগ শিশুর সফল জন্মের আনন্দ আর উত্তেজনায় উনি নিজের কন্যার নাম রেখে ফেললেন, গিনিপিগ। ভেবেছিলেন কন্যা বড় হয়ে বাপের মতই বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকবে, বাপের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করবে। কিন্তু কন্যা বিজ্ঞানের ধার-কাছ দিয়েও ঘেঁষে না, সে তার মায়ের সাথে রান্নাঘরে থাকতে ভালোবাসে, অবশ্য সেটিও বিজ্ঞান, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, গৃহকর্মেও কত নতুন নতুন সৃষ্টি হয়, রান্নাও তো সৃষ্টি বিজ্ঞান। জীবনের সব কিছুতেই বিজ্ঞান।
একমাত্র কন্যাটির সাথে উনার সখ্যতা তৈরী হয় নি, খুব সম্ভব ‘গিনিপিগ’ নামের কারণেই কন্যা অভিমান করে বাপের কাছ ঘেঁষেনা, বন্ধুরা হয়তো ওকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। কী আর করা, নাম একবার দেয়া হয়ে গেছে, তা আর ফেরানো যাবেনা, নাম রাখাও তো সৃষ্টির অংশ। গিনিপিগের মা অবশ্য মেয়ের নাম ছোট করে ডাকেন ‘গিনি’।
গিনিপিগের বয়স যখন পনেরো বছর, জ্ঞানগম্ভীর বাস্তব নামের এক অতি মেধাবী যুবক বিজ্ঞানপ্রসাদ যাদবের ল্যাবরেটরীতে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগ দেন। জ্ঞান বাবুর মত আরও কিছু রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট এই ল্যাবে কাজ করলেও, জ্ঞানবাবুকে বিজ্ঞানপ্রসাদ যাদবের খুব মনে ধরে যায়। পঁচিশ বছর বয়সী টগবগে তরুণ, জানার অদম্য কৌতুহল, মাথার ঘিলু খুবই পরিষ্কার, ‘আ’ বলতেই আপেল, আনারস, আঙ্গুর বুঝে যায়, এমন একটি জিনিয়াস রিসার্চার পাশে থাকলে বিজ্ঞানপ্রসাদের ল্যাবরেটরী থেকে নতুন নতুন চমক আবিষ্কৃত হবে। বিজ্ঞানপ্রসাদ যাদবের খুব ইচ্ছে ছিল, ল্যাবে ‘পক্ষীমানব’শিশুর জন্ম দেয়া। অনেক ভেবেছেন, কিন্তু কোন কূলকিনারা খুঁজে পাননি। কোন নারীকেই পাওয়া যায়নি বিজ্ঞানপ্রসাদের এমন অসাধারণ রিসার্চে গিনিপিগ সাজতে।
এক সন্ধ্যায় বিজ্ঞান বাবু বারান্দায় গিনিপিগের খাঁচার পাশে বসে চা পান করছিলেন, স্ত্রী এসে বলল, “ হ্যাঁ গো, তুমি তো গিনিপিগ আর ইঁদুর নিয়েই ব্যস্ত থাকো, এদিকে আমাদের গিনি’র বয়েস তো ঊনিশ পার হতে চলল, মেয়ের বিয়ের জন্য তো পাত্তর খোঁজা দরকার। বলা তো যায় না, কখন আমি হুট করে মরে যাব, মেয়েটা পড়ে যাবে গলা জলে”।
-কেন, আমি বেঁচে থাকতে গিনিপিগ গলা জলে পড়বে কেন?
-গিনি কেন গলাজলে পড়বে তা যদি তুমি বুঝতে পারতে, তাহলে মেয়ের নাম গিনিপিগ রাখতে না। যাক গে, গিনির জন্য আমি পাত্তর খুঁজতে চাই।
স্ত্রীর কথায় বিজ্ঞানবাবু একটি নড়ে বসলেন, পরিষ্কার গলা আরও পরিষ্কার করতে অনাবশ্যক দু তিনটে খাঁকাড়ি দিলেন, বললেন,
“ গিনিপিগের মা শোন, ইয়ে, তোমায় বলা হয় নি, আমাদের গিনিপিগের জন্য খুব ভাল একটি পাত্তর আমার সন্ধানে আছে।
-তাই নাকি? তাহলে তো খুবই ভালো, তা পাত্তরের বাড়ী কোথায়? আমি কিন্তু আমার গিনি মা’কে অনেক দূরে পাঠাবো না।
-জানি তো, তুমি মেয়ে বিনে চোখে অন্ধকার দেখবে। জানি বলেই তো পাত্তর ঠিক করে ফেলেছি।
-কাকে ঠিক করছো?
-আমার ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ছেলেটা, ঐ যে সেই ছেলে গো, সারাদিন ল্যাবেই পড়ে থাকে, নামটা যেনো কি, আমার নামের কাছাকাছি নাম, মনে পড়েছে জ্ঞানগম্ভীর বাস্তব, ওকে জামাই করতে চাই।
-কী বললে? বাপের ঘরে গিনিপিগের মল মূত্র ঘেঁটে মেয়ে সোয়ামীর ঘরে গিয়েও গিনিপিগের মল মূত্র ঘাটবে?
-আহা হা! মল মূত্র ঘাটবে কেন? জ্ঞানগম্ভীর খুব ভালো ছেলে, কর্তব্যপরায়ণ ছেলে, খুবই মায়ার শরীর, দেখি তো প্রতিদিন, গিনিপিগ, ইঁদুরগুলোকে কত মায়া করে, ওদের সাথে জ্ঞানের খুব ভাব হয়ে গেছে। আমাদের গিনিপিগ মা খুব সুখী হবে এই ছেলের সংসারে।
-গিনিপিগ, ইঁদুরকে যখন এত মায়া করে, ওকে আরও দশখানা গিনিপিগ কিনে দাও, আমার গিনিকে দেবো কেনো ওর কাছে?
-শোন, আমি একটা বিশাল পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি, প্রচুর গবেষণার বিষয় জড়িত, একজন দক্ষ সহযোগী না পেলে একা এতদূর এগোতে পারবো না। ডঃ সত্যকঠিন আমার কাছ থেকে জ্ঞানগম্ভীরকে ছুটিয়ে নিতে চাইছে, বিশাল টাকার প্রলোভন দেখাচ্ছে, জ্ঞানগম্ভীর দরিদ্রের সন্তান হলেও লোভী ছেলে নয়, পরিশ্রমী ছেলে! তাছাড়া সংসারে ওর বাপ-মা, ভাই, আত্মীয়-স্বজন বলতে কেউই নেই, এইজন্যই আমি জ্ঞানগম্ভীরের সাথে গিনিপিগের বিয়ে দিয়ে ছেলেটাকে পাকাপাকি আমার কাছে রেখে দিতে চাই।
বিজ্ঞানপ্রসাদ যাদব একজন উঁচুমানের বিজ্ঞানী ও গবেষক। জীবনের অনেকটা বছর দেশী বিদেশী বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন, ঘর-সংসারের প্রতি আগাগোড়াই টান খুব কম ছিল, মা বেঁচে থাকতে মা, মায়ের মৃত্যুর পরে সংসার সামলেছেন স্ত্রী, একমাত্র কন্যা গিনি বাপের কোলে চড়ার কোন সুযোগই পায় নি। সংসারী না হলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে বিজ্ঞান বাবু মোটামুটি স্বচ্ছল, বিশাল পৈতৃক বাড়ির বিশাল উঠোন, পঞ্চাশখানা কক্ষ, পুকুর, বাগিচা, কী নেই!
গবেষণায় বিশেষ সাফল্যের কারণে দুই একটা দেশী ও বিদেশী অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন, সাফল্যের চূড়োয় পৌঁছে এক সময় উনার মনে হলো, আর কারো অধীনে কাজ করবেন না, চাকরী থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে পৈতৃক বাড়ীতেই একটি আধুনিক ল্যাবরেটরী বানিয়ে নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করেন।
দুই
গিনির কাজ অনেক বেড়ে গেছে, বাবুসোনা এখন হামাগুড়ি দিতে শিখেছে, হামাগুড়ি দিয়ে সারা ঘর ঘুরে বেড়ায়, এটা ধরে, ওটা তুলে মুখে দেয়, বাবুকে চোখে চোখে না রাখলে কখন জানি কোন বিপদ বাঁধিয়ে ফেলে! এমনিতেই বাবুসোনার জন্য গিনির দুঃশ্চিন্তার শেষ নেই, ওর পিঠের দিকে দু পাশ বেশ উঁচু দেখা যায়, এবং দিনে দিনে উঁচুটা যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে, অবশ্য জামা পরিয়ে রাখলে বাইরে থেকে কিছু বুঝা যায় না, তবুও গিনির বুক কাঁপে। উঁচু অংশটুকু দুই কাঁধের একটু নীচ থেকে শুরু হয়ে দুই দিকে বেঁকে যাচ্ছে, পাখীর ডানা যেমন হয়, অনেকটা সেই আদলে বেরোতে চাইছে যেন, ইদানিং একটু ক্র্যাকের মত সরু সরু দাগ পরছে। এইজন্যই গিনির বুক কাঁপে, ওর আশংকার কথা স্বামীকে জানিয়েছে, কিন্তু জ্ঞানবাবুর মধ্যে কোন দুঃশ্চিন্তার লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না, বরং তার চোখে মুখে খুশী যেন উছলে উঠে। এই নিয়ে গিনির সাথে হাসি ঠাট্টা করে, গত পরশুদিনই তো বলেছে,
“অত চিন্তা করো কেন গিনিপিগ, আমাদের বাবুসোনার যদি সত্যি সত্যি দুটো ডানা গজায়, ওতো রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাবে, টেলিভিশান থেকে ক্যামেরা নিয়ে লোকজনের ভিড় হবে, খবর ছড়িয়ে যাবে, গিনিপিগের গর্ভে জন্ম হয়েছে ‘পক্ষীমানবের’, দর্শকেরা আগ্রহ নিয়ে দেখবে গিনিপিগ মায়ের কোলে পক্ষীমানব শিশু।“
এমন কথা শুনে রাগে গিনির গা জ্বলে উঠেছে, মুখ ঝামটে জবাব দিয়েছে,
“খবরদার বলছি, আমাকে গিনিপিগ ডাকবেনা, আমার নাম গিনি, আর বাবুসোনার শরীরের এই ত্রুটি নিয়ে মশকরা করবে না, তুমি এর জন্য দায়ী। নিজের বাপ হওয়ার ক্ষমতা নেই বলে টেস্ট টিউব বেবীর নাম করে তুমি কার না কার বীজ আমার গর্ভে ঢুকায়ে দিছ।
-এঃ হেঃ হেঃ! কীসব কথা বলো, নারীর মুখে এমন ভাষা শুনতে খুবই বিচ্ছিরি লাগে।
-ওরে আমার পুরুষ আসছে রে, ভাত দেয়ার ক্ষমতা নাই, কিল দেয়ার গোঁসাই। সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা নাই তো চুপ করে থাকলেই পারো, কেন ঐটুকুনি শিশুর কষ্ট নিয়ে রঙ্গ তামাসা করো।
জ্ঞানবাবু চুপ করে থাকেন, গিনিপিগকে আর রাগিয়ে দিতে চান না। বাচ্চাটার দিকে তাকালে এখন জ্ঞান বাবুরও কষ্ট হয়, যদিও এই বাচ্চাটার সাথে তার বায়োলোজিক্যাল কোন সম্পর্কই নেই, তবুও উনিই বাচ্চার বাবা, গিনিপিগ জানে না তার স্বামীই তাদের পক্ষীমানবের জন্মদাতা। পক্ষীমানবই তো, এখন প্রকাশিত হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু আর কতদিন সত্য চাপা থাকবে, দুই এক বছরের মধ্যেই বাবুটার পিঠ থেকে ডানা দুটো বেরিয়ে আসবে। লক্ষ্মণ দেখে তাই মনে হচ্ছে, উঁচু জায়গাটুকু কেমন সুন্দর করে দুই পাশে বেঁকে যাচ্ছে, সেখানে বেশ কয়েকটি সরু রেখা বের হচ্ছে, ডানা বের হওয়ার পথ তৈরী হচ্ছে! পাড়াপড়শী এখনও দেখে কিছুই বুঝতে পারেনা, তারা দেখে কী সুন্দর দেবশিশুর মত চাঁদপানা মুখশ্রী, কোলে নেয়ার জন্য টানাটানি করতে থাকে, জ্ঞানবাবুর পিঠ চাপড়ে দেয় বন্ধুরা, ‘খাসা পুত্রের জন্ম দিয়েছো’ বলে! জ্ঞানবাবু ভয় পাচ্ছেন, বাবুসোনার ডানা দুটো বেরিয়ে গেলে পাড়াপড়শীরা না জানি ‘অপদেবতা’ বলে বাবুকে মেরে ফেলতে চায়!
জ্ঞান বাবু দুপুরের আহার সেরে ঘন্টাখানেকের জন্য বিছানায় গড়িয়ে নেন। আজও তিনি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ‘বিজ্ঞানবার্তা’র পাতা উল্টোচ্ছিলেন, এক পাতা করে উল্টান, মানসচক্ষে দেখতে পান, সেখানে বড় বড় হরফে লেখা ‘জ্ঞানগম্ভীর বাস্তবের অমর কীর্তি” “সর্বপ্রথম টেস্টটিউব পক্ষীমানব শিশুর জনক”,------
চটকা ভেঙ্গে গেলো গিনির ডাকাডাকিতে। গিনি খুব ভয়ার্ত কন্ঠে ডাকছিল,
“ওগো, শীগগীর এসো, শীগগীর এসো, বাবুসোনাকে দেখে যাও, ও কী করে ওখানে উঠলো?
“ও কী করে ওখানে উঠলো” শুনে জ্ঞানবাবু এমনই চমকে উঠেছেন যে খাট থেকে নামবার সময় লুঙ্গির গিঁট বাঁধতেই ভুলে গেলেন, ভাগ্যিস ঘরে আর কেউ ছিল না, একেবারে কেলেংকারী হয়ে যেত। এক হাতে লুঙ্গির কোচা ধরেই দৌড়ে পাশের ঘরে গেলেন। যে দৃশ্য দেখলেন, উনি তা কল্পনা করতে পারেন নি। খোকা বিশাল উঁচু আলমারীর উপরে বসে আছে। ওখানে বসেই খিল খিল করে হাসছে। খোকার বয়স এই সবে দুই পূর্ণ হলো, ভাল করে দৌড়োতেই পারে না, অত উঁচুতে উঠলো কী করে! কাছে পিঠে মই নেই, যদিও ছোট একখানা টুল দেখা যাচ্ছে, সেটাও আলমারী থেকে অনেক দূরে।
জ্ঞান বাবুর হৃৎকম্পন শুরু হলো, তবে কি খোকার পিঠ থেকে ডানা দুটো বেড়িয়েছে শেষ পর্যন্ত! গিনিপিগ তো কেঁদেই চলেছে, ও ধরেই নিয়েছে খোকাকে ভুতে ধরেছে। ওর কলিজার টুকরো, ভালো করে বোল ফোটেনি মুখে, তবু মধুর স্বরে ‘মা’ আওয়াজ করে গিনিপিগকে দেখলেই, সেই মিষ্টি সোনা, যাদুসোনাকেই কি না ভুতে ধরলো।
-হাঁ করে দেখছো কী, বাবুকে ওখান থেকে নামিয়ে আনো, এখখুনি চলো গোপাল আচায্যি মশায়ের কাছে নিয়ে চলো, ভুত ঝাড়িয়ে আনি।
জ্ঞান বাবু ছোট টুলটাকে টেনে আনলেন, পা দুটো কাঁপছে, কী দেখবেন কে জানে! সবে মাত্র টুলে উঠে দাঁড়িয়েছেন, অমনি খোকা আলমারী থেকে হাত ঝাপটে উড়বার মত ভঙ্গী করে মেঝেতে নেমে এলো, এই দৃশ্যটুকু জ্ঞান বাবু সহ্য করতে পারলেন না, ব্যালেন্স হারিয়ে টুল কাত হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। গিনির তো দাঁতে দাঁত লাগার যোগাড় হয়েছে, এই বাড়ির সকলকেই ভুতে ধরেছে নিশ্চয়ই, নাহলে দেবতার কোপ পড়েছে। গিনি মাটিতে বসে পড়লো, ছোট পাখী যখন প্রথম উড়তে শেখে, তখন সে মনের আনন্দে ডানা ঝাপটে ঝাপটে এদিক থেকে সেদিক যায়, গিনির বাবুসোনাও তাই করতে লাগলো।
সারারাত স্ত্রীর পাশেই বসেছিলেন জ্ঞানবাবু, সন্ধ্যেবেলা যখন গিনি খুব ঝুলোঝুলি করছিল গোপাল আচায্যি মশায়ের কাছে যাওয়ার জন্য, তখনই জ্ঞান বাবু বুকে চেপে রাখা কথাগুলো বলে দিয়েছেন।
“গিনিপিগ, আমাদের বাবুসোনাকে ভুতে ধরে নি। ও এক্কেবারে ঠিক আছে, ওর পিঠে যে উঁচু কুঁজের মত ছিল, সেটি আসলে কোন কুঁজ ছিল না, চামড়ার ভেতরে থেকেই সেখানে ডানা গজাচ্ছিল, কিছুদিন আগে একটু ফাটলের মত দেখা যাচ্ছিল, সেই ফাটল থেকেই ওর ডানা দুটো বেরিয়ে এসেছে। ও আসলে পূর্ণাঙ্গ মানুষ নয় গিনিপিগ, ও হচ্ছে পক্ষীমানব। এটি আমার নিজের সৃষ্টি, আমি ওর জন্মদাতা পিতা নই, কিন্তু আমি ওকে সৃষ্টি করেছি। আমার সাধনা সফল হয়েছে, আমার গবেষনা সার্থক হয়েছে।
-কী বলছো তুমি? আমাদের ঘরে পক্ষীমানব?
-হ্যাঁ, মৎসকন্যা যদি থাকতে পারে, তাহলে পক্ষীমানব কেন থাকতে পারে না। ছোটবেলায় যখন ব্যাটম্যান দেখতাম, স্পাইডারম্যান দেখতাম, আমার খুব ইচ্ছে করতো, বড় হয়ে আমি বৈজ্ঞানিক হবো, যেদিন প্রথম সফল টেস্ট টিউব বেবীর জন্ম হলো, সেই একইদিনে আমার জন্ম হয়েছিল, আটাত্তর সালের পঁচিশে জুলাই তারিখে, আমার বাবা জ্যোতিষি বিদ্যা জানতেন, আমার কপালে নাকি কি সব ইকরি মিক্রি লেখা ছিল, আমার বাবা শুধু দেখেছেন, আর কেউ দেখেনি। সবাই ভেবেছে নীলচে চুলের রেখা, বাবা বুঝেছে, খুব জ্ঞানী কেউ বাবার ঘরে জন্ম নিয়েছি, বাবা নাম রেখে দিলেন জ্ঞানগম্ভীর। আমি ছোট থেকেই বিজ্ঞানের বই পড়তে ভালোবাসতাম, বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার সম্পর্কে জানতে আমার ভীষণ ভালো লাগতো। তখন থেকেই আমি ভাবতে শুরু করি, টেস্ট টিউব বেবীর জন্ম দেয়া মানেই ঈশ্বরকে চ্যালেঞ্জ করা, ঈশ্বর যদি মানুষ সৃষ্টি করেন, সেই মানুষই তো আরেকটি মানুষ সৃষ্টি করে ফেলেছে। তার মানে কি? চাইলে মানুষ সব করতে পারে, একদিন মৃত্যুকেও জয় করে ফেলবে।
-শোন, আমি তোমার বিজ্ঞান ক্লাসের ছাত্রী নই, আমি একটি অসহায় শিশুর মা, যে শিশুটি তোমার মত বৈজ্ঞানিকের ফাজলামোর কারণে অসম্পূর্ণ হয়ে জন্ম নিয়েছে। আমি তোমাকে বিশ্বাস করে ভুল করেছিলাম, আমার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মা হওয়া কঠিন ছিল বলে তুমি আমাকে অনুরোধ করেছিলে, বাবার কাছ থেকে শেখা পদ্ধতি তুমি আমার উপর প্রয়োগ করতে চাও। আমার বাবার তত্বাবধানে অনেক দম্পতীর সংসার আলো করে টেস্ট টিউব বেবীর জন্ম হয়েছে, আমি তোমার কথায় রাজী হয়েছি। তুমি নিজের স্পার্ম ব্যবহার না করে কোথাকার কোন শকুন/চিলের স্পার্ম নিয়ে আমার পেটে বসিয়ে দিয়েছো! হায় রে, মা গো, এর আগেই কেন আমার মরণ হলো না। আমি এখন এই বাচ্চা নিয়ে কী করবো, কোথায় যাবো, এই বাচ্চা তো স্কুলে যেতে পারবেনা, কথা বলতে পারবেনা, বাচ্চাদের সাথে খেলতে পারবেনা, বাচ্চা আমার গাছের ডালে বাসা বাঁধবে, বাচ্চা আমার সকলের সামনেই ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ে বেড়াবে, বাচ্চাকে এখন থেকে ছোলা খেতে দেবো----তুমি কেন এই সর্বনাশ করলে? তুমি কি একটিবার বাচ্চাটার ভবিষ্যত ভেবে দেখেছো?
-গিনিপিগ শোন
-শাট আপ, মাথা ভেঙ্গে ফেলবো, মুখ গুঁড়িয়ে দেবো যদি আমাকে আর ঐ কুৎসিত নামে ডাকো।
-সরি, গিনি শোন, আমি আমার এই সাফল্য নিয়ে তো ঘরে বসে থাকবো না।
-কি করবে? সব মেয়েদের পেটে শকুনের বাচ্চা সৃষ্টি করবে?
-ছি ছি! এভাবে বলছো কেন?
-শাট আপ, এখন নিজের বাচ্চা নিয়ে কি করবে, তা ঠিক করো। সার্কাস পার্টিতে পাঠিয়ে দিতে হবে, নাহলে কামারের কাছ থেকে লোহার খাঁচা বানায়ে আনতে হবে, মা হয়ে আমি ছেলের পেছনে পেছনে তো উড়তে পারবো না। নাহলে আরেক কাজ করা যায়, তুমি তো মহা বৈজ্ঞানিক, আমাকেও দুইটা ডানা লাগিয়ে দাও, খোকা পক্ষীমানব, আমি হবো পক্ষী মানবী। মায়ে–পুতে উড়ে বেড়াবো, সকালে গান গেয়ে তোমার ঘুম ভাঙ্গাবো, তোমার ঘুম ভাঙ্গবার পর পাড়ার সকলের ঘুম ভাঙ্গাবো, পাখীর ডাক তো শহরে শোনাই যায় না, আমরা নতুন করে পাখীর ডাকে ঘুম ভাঙ্গানোর খেলা চালু করবো, কেমন হবে বৈজ্ঞানিক বাবু।
-প্রস্তাব মন্দ দাও নি, সত্যি তো পরিবেশ দূষণের কারণে অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, এখন একমাত্র চিড়িয়াখানা ছাড়া আর কোথাও বাজপাখী দেখা যায় না, আকাশে সোনালী ডানার চিল উড়ে না, বাবুসোনাকে দেখে আমার মনে অনেক শক্তি আর সাহস সঞ্চয় হয়েছে, এই ধরণের কাজ যদি আরও বেশী বেশী করতে পারি, তখন সমাজে ওদের প্রতিষ্ঠাও হয়ে যাবে। কত মানুষ চাইবে নিজেদের সংসারে এমন বার্ডম্যান থাকুক।
-ভাগাড়ে শকুন পড়ে না, শকুনীরা সব হারিয়ে গেছে টোকাইদের যন্ত্রণায়, তুমি এখন চিল-শকুনীদের ফিরিয়ে আনবে, আনো, যা ভালো মনে হয় করো, কিন্তু তার আগে আমার বাবুসোনার বাঁচার ব্যবস্থা করে দাও।
-হবে হবে, সব হবে, তুমি কান্না থামাও, প্লীজ, কান্না থামাও, বাবুসোনাকে দেখে আমার মনে অনেক শক্তি আর সাহস সঞ্চয় হয়েছে, ওকে নিয়ে তুমি একটুও লজ্জিত হয়ো না, ও এমনই থাকবে না, আমি ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, আমাদের পক্ষীবাবাকে যদি সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারি, ওকে নিয়ে অনেক বড় কাজ করবো আমরা।
-আমরা মানে?
-আমরা মানে, আমি আর আমার গুরু, তোমার বাবা, স্যার বিজ্ঞানপ্রসাদ যাদব। উনার স্বপ্ন ছিল এমন কিছু সৃষ্টি করার, উনি চেয়েছিলেন বলেই আমি এতবড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পেরেছি। গিনি, আমার তো বাবা হওয়ার যোগ্যতা নেই, টেস্ট টিউব বেবী তো তুমিই চেয়েছিলে, চেয়েছিলে না? একটা বাচ্চা হওয়াতে গেলে পুরুষের স্পার্ম এবং নারীর ডিম্বানু দরকার হয়, যেহেতু আমি অক্ষম, তাই স্পার্ম ডোনারের শরণাপন্ন হতেই হতো। আমিই তখন প্রস্তাব দিয়েছিলাম স্যারকে, ভাবতে পারিনি প্রথম নিরীক্ষাতেই সফলকাম হবো। স্যার আজ পৃথিবীতে নেই, কিন্তু আমার হৃদয়ে আছেন, উনি আমাকে প্রতি পলে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন, এখন আমার কাজ হবে বাবুর দেহে ছোট ছোট কিছু চিপস বসিয়ে দেখা,
-কী দেখবে? রোবট বানানো যায় কিনা?
-আরে নাহ! রোবট দিয়া আমরা কী করবো? ওর ডানাগুলোকে অ্যাকটিভ করতে হবে, আরও শক্তপোক্ত করে ও দুটোকে ব্যবহারক্ষম করতে হবে।
-তোমাদের কাজটা কী হবে তাই তো বুঝতে পারছি না।
-আচ্ছা, ছোটখাটো উদাহরণ দেই, ধরো আমি বাড়ি নেই, তোমার হঠাৎ করে গাছ থেকে দুখানা নারকেল পারার দরকার হলো, তুমি তো নারকেল গাছে উঠতে পারবে না, বাবুকে ডাকবে, হাতে দা দিয়ে দিবে, বাবু উড়ে ডাব গাছের মাথায় বসে এক কোপে নারকেল কেটে তোমার কাছে নিয়ে আসবে। আবার ধরো, মা’কে সংবাদ দিতে চাইছো, কিন্তু মোবাইলে রিচার্জ করা নেই, কী হবে? বাবুকে বলা মাত্র বাবু ফুড়ুৎ করে ঊড়ে দিম্মাকে সংবাদ পৌঁছে দিয়ে আসবে। অথবা তুমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে, ডাক্তার ডাকতে হবে, আমাকে সংবাদ দিতে হবে, রাস্তার যা অবস্থা, যা ট্র্যাফিক জ্যাম, ডাক্তারের কাছে রিকসা পৌঁছতেই তো আধঘন্টার উপর চলে যাবে, ততক্ষণে তুমি শেষ, আর বাবু যদি উড়ে চলে যায় ডাক্তারের কাছে, তালে তিন মিনিটেই পৌঁছে যাবে।
-বুঝলাম, আর রাস্তার মানুষ দেখে কী বলবে? ভুত-রাক্ষস বলে মেরেই ফেলবে! সবাই হাঁ করে দেখবে, মানুষ যাচ্ছে উড়ে উড়ে।
-আমরা তো লুকোবো না কথা, সকলেই জানবে আমাদের বাবুটা একটু অন্যরকম হয়েছে, ওর দু হাতের পাশে দুখানা পাখীর ডানাও আছে। বাবুর এত কাজ কর্ম দেখে অনেক বাবা মা নাচতে নাচতে আসবে আমাদের কাছে, পক্ষীমানন বাচ্চার খোঁজে। এবার তুমি একটু মাথা ঠান্ডা করো! এরপরের বার নাহয় মানুষের বাচ্চা এনে দেবো।
-চুপ থাকো, এইমাত্র বললে, তোমার কোন ক্ষমতা নেই।
-তা নেই, কিন্তু যারা ডোনার, তাদের থেকে নিতাম।
-ছি ছি
-ছি ছি করার কি আছে? ব্লাড ডোনার থাকে, কিডনী ডোনার থাকে, কর্ণিয়া ডোনার থাকে, আর স্পার্ম ডোনারের বেলায় যত দোষ! একজনের বদান্যতায় যদি একটি মেয়ে ‘মা’ হতে পারে, সৃষ্টির মত পবিত্র জিনিস তো আর কিছু নেই। যাক, পরের কথা পরে, এখন ঘুমাও, বাবুসোনা দেখো, দিব্যি ঘুমুচ্ছে, ওর কোন মাথাব্যথাও নেই, ওকে নিয়েই আমরা এত কথা বলছি।
অনেক বছর পর পাখীর ডাক শুনে গিনির ঘুম ভাঙ্গলো, চোখ মেলতেই দেখতে পেলো, ওর বাবুসোনা শিয়রে বসে শিস দিচ্ছে, গিনির দৃষ্টি বিভ্রম হলো কিনা বুঝতে পারছিল না। বাবুটা অবিকল গিনির বাবার চেহারা পেয়েছে, পাশেই বসে আছে, মুখ নড়ছে না অথচ দিব্বি শিস দিয়ে যাচ্ছে। গতরাতের কথা মনে পড়লো, স্বামীর সাথে অনেক ঝগড়া করেছিল, কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই। পাশ ফিরে দেখে, ওর স্বামী বিছানায় নেই। গিনি শোয়া থেকে উঠলো, বাবুকে কোলে তুলে নিতে যেতেই বাবু ফুড়ুৎ করে উড়াল দিল, কিছুক্ষণ সারাঘর উড়লো, তারপরেই ওর কোলে এসে বসলো। দৃশ্যটি মায়ের জন্য কষ্টের হলেও অন্যরকম সৌন্দর্য্য লুকিয়ে আছে দৃশ্যটির মধ্যে। গিনির দুই চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এলো, বাবা তাকে আদর করে গিনিপিগ ডাকতো বলে বাবাকে ও সহ্য করতে পারতো না, বাবা অনেক ভালোবাসতো ওকে, কিন্তু ও সেই ভালোবাসার মর্ম বুঝেনি, তাই বোধ হয় বাবা তার সন্তান হয়ে তার কোলে ঠাঁই নিলো। বাবুটাকে তো আর অবহেলা করা যায় না, ওর স্বামীর সৃষ্টি, স্বামীর সুখে-দুঃখে পাশে থাকা প্রতিটি স্ত্রীর কর্তব্য, বাবা বেঁচে থাকলে তবু একরকম ছিল, বাবা ওকে গাইড করতে পারতো, আজ দুজনের কারোরই বাবা বেঁচে নেই, গিনির তবু মা আছেন, জ্ঞান বাবুর কেউ নেই, গত রাতে গিনি খুব কঠিন কথা শুনিয়েছে তার স্বামীকে, হয়তো মানুষটা সারারাত ঘুমোয়নি। গিনির বুকটা মুচড়ে উঠলো, হঠাৎ করেই মনে হলো, জ্ঞানবাবু আর একাকী নয়, এখন থেকে গিনি আর গিনির পক্ষীরাজ জ্ঞানবাবুর ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করবে।